সবটাই তুমিময় পর্ব ১৪ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৪
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

হাসপাতালের করিডর!অপেক্ষার প্রতিটা মুহুর্তই ভয়ানক!হাতের কব্জি কচলাচ্ছি আর এপাশ ওপাশে হাটছি।এরমধ্যেই ফোনটা বেজে উঠলো।নম্বরটা দেখে একটু থেমে গেলাম।তিহান ফোন করেছে।কান্নার সবরকমের লক্ষন লুকিয়ে কলটা রিসিভ করতে যাবো,পাশে থেকে অঙ্কুর ছো মেরে ফোনটা কেড়ে নিলেন।মাস্ক পরে ওখানেই পাইচারী করছিলেন উনি।ফোনটা লাউডে দিয়ে একদম স্বাভাবিক গলায় বললেন,
-কেমন বন্ধু তুমি তিহান?তোমার বান্ধবীর এখানে লাইফরিস্ক,আর তুমি?এতোক্ষনে ফোন করলে?
-মানে?কি হয়েছে আন্নুর?
-আরে না!হোয়াট ডু ইউ থিংক?আমি থাকতে অদ্রির কিছু হতে পারে?ওর গায়ে ফুলের টোকাটাও লাগতে দেবো না আমি!

-তবে হ্যাঁ,এদিকে তানহা….
-তানহা?ক্ কি হয়েছে ওর?বলুন স্যার!তানহার….
-ও এখন হসপিটালে।
-মানে?হসপিটালে কেনো ওর?ওর কি হয়েছে?আপনি কিভ্….
কিছু না বলেই অঙ্কুর ফোনটা কেটে দিলেন।ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন,
-কিপ কোয়ায়েট!এটা হসপিটাল!
চুপ রইলাম।অনেকটা সময় পর ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন,
-চিন্তার কিছু নেই।আপনারা গিয়ে দেখা করে নিন।বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন পেশেন্টকে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।রুমে ঢুকে দেখি তানহার মাথায় ব্যান্ডেজ পরেছে।কাদতে কাদতে এগোলাম ওর দিকে।ও মলিন হেসে বললো,

-কাদছিস কেনো?কিছুই হয়নি তো!
-তান্নু!
ওকে জরিয়ে ধরে কাদতে লাগলাম।ও আমাকে ছাড়িয়ে মাথা দেখিয়ে বললো,
-চাশমিশ,দেখ!অল্প একটু‌ লেগেছে!এভাবে মরাকান্না জুরিস না ইয়ার!তোর এই কান্নাতেই অসুস্থ্য হয়ে মারা পরবো আমি।
একটু কান্না কমিয়ে ওর হাত মুঠো করে ধরলাম।চোখ দিয়ে তবুও পানি পরছেই।অঙ্কুর বললেন,
-তোমার ওকে নিয়ে এভাবে বেরোনো উচিত হয়নি তানহা।তুমি তো জানতে,অদ্রির চেহারাটা চিনে গেছে প্রদীপ সরকার আর ওর লোকেরা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তানহা মাথা নিচু করে রইলো।এরমধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে তিহান ভেতরে ঢুকলো।ওর অস্থিরতা দেখে একটু অবাক হয়ে সরে দাড়ালাম আমি।তিহান এসে সোজা তানহার হাত ধরলো।ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বললো,
-তোর এতো মরার শখ কেনো বলতে পারিস?দুদিন আগেই মরতে বসেছিলি।মনে নেই?আবার কেনো তোকে এই হসপিটালের বেডে দেখতে হচ্ছে আমাকে?মাথায় এটুকো বুদ্ধি নেই,মৃত্যু কোনোকিছুর সমাধান হতে পারে না!তুই মরে গেলে তোর কাছের মানুষগুলোর কি হবে?তাদের কথা তো একটাবার ভাববি?
তানহা বাবু হয়ে বসে মাথা নিচু করে চুপচাপ শুনছিলো সবটা।শেষেরটুক শুনে তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

-মাম্মি পাপা ব্যস্ত তিহান।তাদের মেবি খুব একটা আসবে যাবে না!
তিহান আরো রেগে গেছে।ও টেনে বেড থেকে তানহাকে নিচে নামিয়ে দাড় করালো।রাগ নিয়েই বললো,
-আমরা?আমরা তোর কেউ হই না?আমরা তোর আপনজন নই?তোকে নিয়ে আমাদের চিন্তা হয় না তানহা?
-হয়?
তিহান চোখ বন্ধ করে চুল উল্টে ধরলো।একটু চুপ থেকে হঠাৎই‌ তানহার দুহাতের উপরদিকটা চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,
-বুঝিস না তুই?তোকে বলে বোঝাতে হবে?

তানহার চোখ ছলছল করছে।আমি অবাক হয়ে দেখছি শুধু।আজ প্রথমবার!প্রথমবার কোথাও এসে ও আমার উপস্থিতিতেও আমার দিকে না তাকিয়ে এতোটা সময় ধরে কথা বলছে।সেটাও তানহার সাথে।এটুক ভেবেই খুশি হয়ে গেলাম আমি।আচমকাই পাশ থেকে অঙ্কুর কোমড় জরিয়ে তার বুকের সাথে আটকে নিলেন আমাকে।ছাড়াতে যাবো,উনি ফিসফিসিয়ে বললেন,
-হুশ!শব্দ করো না!ওদের কিউট মোমেন্টসগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
চুপ রইলাম।তিহান তানহার হাত ছেড়ে ব্যান্ডেজটা ছুইয়ে দিয়ে বললো,
-কিভাবে লাগলো?
-র্ রাস্তায় পরে গিয়েছিলাম।
-কিভাবে?
-আন্নু স্কুটি চালাচ্ছিলো,আমি ওর পেছনেই….

তিহান এতোক্ষনে তাকালো আমার দিকে।হুশে ফিরলাম আমি।তখনও আমার কোমড় জরিয়ে রেখেছেন অঙ্কুর।চোখ সরিয়ে তিহান কাটকাট গলায় বললো,
-আন্নুর গায়ে ফুলের টোকা লাগতে না দেওয়ার জন্য ওর বর আছে।ও ফুলস্পিডে স্কুটি চালাতেই পারে।তোর তো কেউ নেই তান্নু!তাই তোকে ওর স্কুটির পেছনে বসার অনুমতি দিচ্ছি না আমি।
টুপ করে পানি বেরিয়ে এলো তানহার চোখ থেকে।তিহান অন্যদিক ফিরে বললো,
-কাদিস না।

তানহা কাদছিলোই।তিহান আবারো ওরদিক তাকিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে শান্তভাবে বললো,
-বলেছিলাম আন্নুর চোখের জলের কারন হবে যে,বন্ধু হিসেবে তাকে ছেড়ে কথা বলবো না আমি।বলিনি বলে কথাটা যে তোর জন্য নয়,এমনটা নয় তান্নু।কাদিস না।
তানহা কান্নার বেগ আরো বারলো।আমি এগোতে যাবো,অঙ্কুর একহাতে আমার মুখ চেপে সামনে জরিয়ে ধরে বললেন,
-ওদের মাঝে তোমাকে থাকতে দিচ্ছি না আমি!
উনি আরো পিছিয়ে আসলেন আমাকে নিয়ে।তিহান একদমই লক্ষ্য করেনি সেটা।ও তানহাকে নিয়েই ব্যস্ত।এ নিয়েও অবাক হয়ে থেমে রইলাম চুপচাপ।এমনিতেও শব্দ করার উপায় রাখেন নি অঙ্কুর।তিহান বললো,
-কাদছিস কেনো তুই?

-তান্নু স্টপ ক্রায়িং!কাদছিস কেনো?
তানহা এখনো কাদছেই।নিশব্দে।হুট করেই তিহান বুকে জরিয়ে ধরলো ওকে।হুহু করে শব্দ করে কেদে দিলো তানহা।আমি যেনো পাথর হয়ে গেলাম।এ দৃশ্য আমার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য!খুশিতে আমিও কেদে দিয়েছি।অঙ্কুর আমার মুখ ছেড়ে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।জরিয়ে রাখলেন আমাকে।অজান্তেই তার শার্ট মুঠো করে নিলাম।তিহান তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-এখনো কাদছিস?কান্না বন্ধ কর না!
তানহা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো ওকে।হাতের পিঠে চোখ মুছে,নাক টেনে কাদতে কাদতেই বললো,
-আমার কান্না নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না!
-ভাবতে হবে।কোনোমতে ভাইভা শেষ করে দৌড় লাগিয়েছি।এতোখানি পথ কিভাবে এসেছি আমিই জানি।থামা কান্না!বন্ধ কর!

-তুই এইসব কথা বলা বন্ধ কর,তাতেই হবে!দুরে যা!
তিহান সরে গিয়ে জানালার ধারে দাড়ালো।তানহা নিচদিক তাকিয়ে শুধু ফোপাচ্ছে।কাদছে না।বারবার চোখ মুছছে।যদিও পানি নেই চোখে।নাক ডলছে।গালটাও ফুলিয়ে রেখেছে।আবারো কাদতে লাগলো শব্দ করে।তিহান কোমড়ে দুহাত দিয়ে দাড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে তাকালো ওরদিক।তানহা একবার শব্দ করে কাদছে,আবার থেমে নাক টানছে,চোখ মুছছে,তো আবার শব্দ করেই কান্না করে দিচ্ছে।ওর বাচ্চাদের মতো কান্না করা দেখে অন্যদিক মুখ করে ঠোট টিপে হেসে দিলো তিহান।পরপরই হাসিটা আটকে বললো,

-বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তোর তান্নু!এখন এইসব বাচ্চামো বাদ দে!
এটুকো বলেই শার্টের হাতা টানতে টানতে বেরিয়ে যাচ্ছিলো ও।কিন্তু থেমে গেলো দরজার কাছে।অঙ্কুর আমাকে ধরেই দাড়িয়ে ছিলেন।ঠোটের হাসি হারিয়ে আবারো ভরে উঠলো তিহানের চোখ।বরাবরের মতো সে চোখের জলকে আটকাতে সফল ও।ঠোট কামড়ে ধরে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
-শার্টটা ছাড়ুন ম্যাডাম!
বাস্তবে ফিরে সরিয়ে দিলাম অঙ্কুরকে।উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শার্টটা টেনে ঠিক করলেন।তারপর আমার দিক তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন,

-ইউ নো হোয়াট অদ্রি?এই দুরে ঠেলার ছোটখাটো চেষ্টা,কষ্ট দেওয়ার বড়বড় পরিকল্পনা,শাস্তি দেওয়ার কঠোর মনোভাব ধরে রাখা,দুর্বল হওয়া থেকে নিজেকে বাচানো,সবটায় ব্যর্থ আমি।সবটায়।ঠিক এমনটাই ঘটতে চলেছে তোমার সাথেও।বি রেডি!সেদিন কিন্তু জবাব দিতে হবে তোমাকে।কেনো আমার সাথে এসব ঘটলো?কেনো আমাকে এতোটা সইতে হলো?কেনো আমার মাঝে নিজেকে পাইনা আমি?কেনো….
উনি থেমে আরেকটু এগোলেন আমার দিকে।ধীর গলায় বললেন,

-কেনো আমার *সবটাই তুমিময়*?
-সবটাই নাটক!সবটাই আপনার জেদ!সবটাই আপনার স্বার্থসিদ্ধির জন্য,বেবির জন্য!আজ তা নিজে স্বীকার করেছেন আপনি।ক্ষমা করবো না!কোনোদিনও ক্ষমা করবো না আপনাকে!
উনি মুচকি হাসলেন।গা জ্বলে যাচ্ছিলো আমার ওই হাসিতে।দাতে দাত চেপে তানহার দিকে এগোলাম।ওর কাধে হাত রাখতেই হাতের পিঠে চোখ‌ মুছলো ও।বললাম,
-তান্নু,তিহান কিন্তু আজ….

-বন্ধুত্বে ইটস্ নরমাল আন্নু।আমি যখন সুইসাইড এটেমপ্ট করেছিলাম।তখনও এমন করেছিলো ও।ইনফ্যাক্ট আস্থা বলেছিলো আরো বেশি পাগলামো করেছিলো ও।বন্ধু ভেবেই।
-না।এটা শুধু বন্ধুত্ব হতে পারে না।কিছুতো স্পেশাল!কিছুতো আলাদা।বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি।হয়তো ভ্…
-আমাকে ভাঙ্গা স্বপ্ন জোড়া লাগানো শেখাস না আন্নু।প্রতিবার ওর অপমানে সবটা আয়নার মতো ভেঙ্গেচুরে যায়,আর আমি খুব কষ্টে তা আবারো জোড়া লাগাই।কিন্তু আমি এখন তা না জুড়ে নিজেকে‌ জুড়তে শিখেছি।নিজেকে সামলাতে শিখেছি।যেটাকে তুই স্পেশাল বলছিস,অনেক আগেই তার নামকরন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।যেটাকে ভালোবাসা…ভালোবাসা বোঝাতে চাইলি তা বরাবরই দায়িত্ব,কেয়ারিং ছিলো।থাকবে।তাই এ নিয়ে আর কোনো আলোচনাই চাইনা আমার।

-তুই অভিমান করেছিস তান্নু!
-না।অভিমান নয়।বাস্তব চিনেছি।আর আমি এগুলো স্বাভাবিভাবেই নিচ্ছি তো!আগেই বলেছি তোকে,নিজেকে আর ছোট করতে পারবো না আমি।তুইও প্লিজ আমার মতামতকে সম্মান কর!এ নিয়ে কথা বাড়াস না!প্লিজ!
আর কিছুই বলার খুজে পেলাম না।ওর হাত মুঠো করে ধরলাম।অঙ্কুর এগিয়ে এসে বললেন,
-হাটতে পারবে তানহা?
ও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝালো।মাস্কটা পরে আমার আরেকহাত ধরলেন অঙ্কুর।তানহার হাত ছাড়ি নি আমি।একপ্রকার টানতে টানতেই উনি গাড়ি অবদি নিয়ে এলেন দুজকেই।দরজা খুলে দিয়ে বললেন,

-ওঠো!
-কোথায় যাবো?
-গেলেই দেখতে পাবে।ওঠো!
-আপনার সাথে কোথাও না!
-এটা এখন বলছো,মানলাম।কিন্তু একদিন বলবে,আমার সাথেই মৃত্যুপথও পাড়ি দিতে প্রস্তুত তুমি।
এটুকো বলেই উনি ঝারা মেরে তানহার হাত ছাড়িয়ে দিলেন।গম্ভীরভাবে চোখ দিয়ে ইশারায় ওকে ভেতরে বসতে বললেন।তানহা একটু ভয়ভয় নিয়ে বললো,
-ওকে জ্ জোর কেনো করছেন?
-এখনো করিনি তানহা!
কথা না বাড়িয়ে ও চুপচাপ ব্যাকসিটে উঠে বসলো।অঙ্কুর বললেন,
-গাড়িতে নিজে থেকে উঠবে?নাকি কোলে করে উঠাবো?
-কোনোট্….

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৩

কথা শেষ করার আগেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন উনি।ফ্রন্টসিটে বসিয়ে লক করে দিলেন দরজা।ওপাশ দিয়ে বেরোতে যাবো,উনি ঘুরে এসে ড্রাইভিং সিটে বসেছেন ততক্ষনে।কটমটে চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি।উনি নিজেই আমার সিটবেল্ট লাগিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।চেচিয়ে বললাম,
-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?গাড়ি থামান!থামান বলছি!সন্ধ্যা হয়ে গেছে।মনিমা টেনশন করছে হয়তো।বাসায় যাবো।তান্নুও ওর বাসায় যাবে!গাড়িটা থামাচ্ছেন না কেনো?আমি কিন্তু চেচাবো!
উনি ভ্রুকুচকে তাকালেন আমার দিকে।আবারো ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিয়ে বললেন,

-এই আমার কাছে থাকলে বাসায় যাবো ছাড়া অন্য কোনো কথাই আসে না তোমার তাইনা?বাসায় যাবো,বাসায় যাবো!দু এক সময় অটোগ্রাফ দিন,সেলফি প্লিজ এসবও তো বলতে পারো!আচ্ছা!মানলাম বউ হও,অটোগ্রাফ,সেলফি লাগবে না তোমার।তাহলে মাঝেমধ্যে বউয়ের মতো কথাও তো বলতে পারো!ও গো শুনছো,হ্যাঁ গো জানো!আহা!
অগ্নিদৃষ্টি তাক করে রইলাম।উনি আবারো আমার দিক তাকিয়ে ‌বললেন,
-ওয়ানা হেয়ার আ লাই?চশমার আড়ালের ওই নজরের তীরে আমার কিছুই হয়না!এনিওয়েজ,বলেছিলাম ঠিক সময়মতো বউকে নিয়ে যাবো!সে ঠিক সময়টা এখনই মনে হচ্ছে।তাই তোমাকে নিয়ে যাবো আজ!আমার বাসায়,আমার কাছে!

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৫