সবটাই তুমিময় পর্ব ১৬ || লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৬
লেখনিতে – মিথিলা মাশরেকা

আবারো পা রাখলাম অঙ্কুরের বাড়িতে।বধুবেশে।রাতের আধারে।গাড়ি থেকে নেমে অনুভুতিশুন্য রোবটের মতো দরজায় এসে দাড়ালাম।অঙ্কুর নিজে ভেতরে ঢুকে হাত বাড়ালেন আমার দিকে।শান্ত দৃষ্টি রেখে বললেন,
-ওয়েলকাম মিসেস আরিয়ান সার্ফরাজ অঙ্কুর।
সারা বাড়িতে চোখ বুলালাম।নন্দিত নরকে নিজেকে স্বাগতম জানা অদ্রি!অঙ্কুরের হাতে হাত রেখে পা বাড়ালাম ভেতরে।উনি খানিকটা এগিয়েই হাত ছেড়ে দিলেন আমার।সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।অনেকটা সময় দম ধরে দাড়িয়ে ছিলাম ড্রয়িংরুমেই।নায়েব কাকা এসে বললো,
-যাও আহানিতা মা,ঘরে যাও!

কিছু না বলে চুপচাপ লেহেঙ্গা ধরে গুটিগুটি পায়ে আমিও‌ অঙ্কুরের রুমেই ঢুকালাম।ঘরটা অন্ধকার।তবে ব্যালকনি দিয়ে ঢোকা বাগানের আলোতে ঘরের দিকে ভালো করে তাকাতেই থমকে গেলাম।চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়া যাকে বলে।গোটা ঘরটাই ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে।বিছানাও ফুলে সাজানো।বাসর!ব্যালকনিতে ধোয়া উড়তে দেখে নিশব্দে এগোলাম সেদিকে।কাছে যেতেই বুঝলাম অঙ্কুর সিগারেট খাচ্ছেন।শার্ট ছেড়ে টিশার্ট,ট্রাউজার পরেছেন উনি।পাশেই রোহান ভাইয়া দাড়িয়ে।উনি বললেন,

-থাম অঙ্কুর।অনেক হয়েছে।এ অবদি ছয়টা শেষ করেছিস।
অঙ্কুর নিরুত্তর।রোহান ভাইয়া সিগারেট কেড়ে নিয়ে বললেন,
-অঙ্কুর!ছাড় এটা!
একপলক তার দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালালেন উনি।ধোয়া উড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন,
-বাসর সাজিয়েছিস কেনো?
-বউ নিয়ে এসেছিস তুই।শপিং করে ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বললি,তাই ভাবলাম ঘরটাও….
-তোকে বলেছি তো এতো না ভাবতে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-আমি ভাববোই।আমি তোর একটা স্বাভাবিক জীবন চাই অঙ্কুর!আহানিতাকে ঘরে নিয়ে আয়!
লাইট জালিয়ে দিলাম ঘরের।ঝিলিক দিয়ে উঠলো পুরো রুম যেনো।বাইরে থেকে এ বাসা দেখলে অন্যান্য রাতগুলোর মতোই,আধারে ঢাকা।আর ভেতরটায়?ঘরটার ফুলের সাজে চোখ পলক ফেলা ভুলে যাচ্ছে যেনো।তাচ্ছিল্যে হাসলাম।আমার ক্ষেত্রে উল্টোটাই।বাইরে থেকে যতোটা ঝকমকে সাজে সেজেছি,ভেতরটা ততোটাই,তারচেয়ে বেশিই,নিকষ কালো,আধারে ঢাকা।রোহান ভাইয়া আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।ব্যালকনিতে গিয়ে অঙ্কুরের পাশে গিয়ে দাড়ালাম।রেলিং ধরে সামনে তাকিয়ে বললাম,

-স্মোক করছেন?
-হ্যাঁ।
-কেনো?
-ড্রিংক করা এলাউড না।
-আপনি আগেও স্মোক করেছেন?
-হ্যাঁ।আজ দ্বিতীয়বার।
-কষ্ট হচ্ছে খুব?
উনি অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে।একটু হেসে সামনে তাকিয়ে বললাম,
-আমার বিদায়ের সময় আফরা খানমের চিৎকার করে কাদা উচিত ছিলো,আমারও চিৎকার করে কাদা উচিত ছিলো,তাইনা?এমনটাই তো চেয়েছিলেন আপনি।
এটুক বলে তাকালাম তারদিক।অঙ্কুরের চোখ লাল হয়ে গেছে,হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিলেন উনি।আমার দিক ফিরে দাড়িয়ে হাত মুঠো করে কড়া‌ গলায় বললেন,
-কতোটুকো জানো তুমি অদ্রি?
-আপনার কি মনে হয়?কতোটুকো জানা উচিত আমার?
-যদি বলি কিছুই না!
-তবে নিশ্চিত থাকুন।আফরা খানম আপনার এই কিছুই না কেও সম্মান দেখিয়েছেন।

সত্যিই তাই।সম্মান দেখেয়েছে তো মনিমা!ভালোবাসা!ভালোবাসাও দেখিয়েছে।অঙ্কুরের প্রতি তার ব্যবহার আমাকে অবাক করে দিচ্ছিলো ঠিকই,কিন্তু কথাগুলো শুনে আরো অবাক হয়েছিলাম।কথাগুলোতে তো মেয়েকে বিদায়ের সময় বলা শিক্ষা ছিলো না,বরং আকুতি ছিলো,অঙ্কুরকে ভালো রাখার আকুতি।আর সে আকুতি দেখে মনের মধ্যে প্রশ্নগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।এতোটা আকুতি?অঙ্কুরের জন্য?এতোটা ভালোবাসা?অঙ্কুরের জন্য?কেনো?বললাম,
-অঙ্কুর কে হয় তোমার মনিমা?

থমকে গেলো মনিমা।চোখের বাধভাঙা পানি বয়েই চলেছে তার।আমি তারদিক আরো এগিয়ে গিয়ে বললাম,
-আজ যে মানুষটার হাত ধরে এ বাসা থেকে চলে যাচ্ছি,তার প্রতি তোমার এতো ভালোবাসা,আমি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি না।কারন বিয়েটাই তো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।তবুও তার জন্য তুমি আমার সাংবাদিকতায় জরানোর মতো বিষয়টাকেও ইগ্নোর করেছো,তার জন্য তোমার ভাষ্যমতে তার ভালো থাকা ভিক্ষে চাইছো,তার জন্য চোখের জল ফেলছো তুমি,তার জন্য তোমার চোখেমুখে সে ভালোবাসাটা আজ আমি দেখতে পাচ্ছি যেটা শুধুমাত্র আপনজনের জন্য হয়।আজ আমার প্রশ্নের জবাব দাও মনিমা।অঙ্কুরের সাথে কি সম্পর্ক তোমার?

-ক্ কিছুই না!কোনো সম্পর্ক নেই!
মনিমা চেচিয়ে বলে আরো জোরে কাদতে লাগলো।ধারনা আরো জোরালো হলো আমার।বারবার মনে হচ্ছে আমার এই প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই অঙ্কুরের আমার প্রতি রাগের কারন লুকিয়ে আছে।তাই এর উত্তর লাগবে আমার!আরো জোর গলায় বললাম,
-আজ তোমাকে বলতেই হবে!আমার পরিচয় কি মনিমা?তোমার পরিচয় কি?অঙ্কুর কে?
-পারবো না!আমি বলতে পারবো না আন্নু!
-কেনো মনিমা?তুমিই তো বলতে,সম্পর্ক,ভালোবাসা,দায়িত্ব এগুলোকে উপেক্ষা করতে নেই।তবে আজ কেনো তুমিই বলছো না?

-বললাম তো,কোনো সম্পর্ক নেই আন্নু!
-আছে।আর আজ তুমি বলবে,কে তুমি?কে অঙ্কুর?আর আমিই বা কে?
-আমি তোর মা আন্নু!তুই আমার মেয়ে।আমার….
-তোমার পালিত মেয়ে আমি মনিমা।তুমি আমার নিজের মা নও!

আজ প্রথমবার এই কথাটা বললাম মনিমাকে।বুক ফেটে কান্না আসছে।চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।মনিমাও দু পা পিছিয়ে গেছে।তানহা শুধুই চুপচাপ দেখছে আর চোখের জল ফেলছে।মনিমা চোখ মুছে নিজেকে সামলে বললো,
-বেশ।আজ তোকে সবটা বলবো আমি।এতোগুলো বছর,তুই না ভাবলেও,আমি তোকে নিজের মেয়ের মতোই ভেবেছি।তাই তোর কাছে বলাটা হয়তো আমার নিজেকে অপমান করা হবে না।তোকে বলবো,তোর পরিচয়,আমার পরিচয়।তোর…তোর আসল পরিচয় হলো,তুই গত দশকের বিখ্যাত সাংবাদিক জুটি আকাশ ইলিয়াস আর অনিতা মেহরানের মেয়ে,আহানিতা!আহানিতা সিদরাতুল!

বিস্ময়ে তাকিয়ে আমি।আজও টিভি নিউজে এই জুটির সাহসীকতা নিয়ে লেখালেখি হয়,তাদের মৃত্যুরহস্য নিয়ে আজও ক্ষিপ্ত এদেশের সাংবাদিকজগত।তারাই আমার আসল মা বাবা?টুপ করে পানি গরিয়ে পরলো চোখ থেকে আবারো।মনিমা হেসে বললো,
-হ্যাঁ,ওই দুই অসম্ভব সাহসী সাংবাদিকই তোর মা বাবা।আর এজন্যই তোর সাংবাদিকতায় এতো ঝোক আন্নু।এটাই তোর পরিচয়!রক্তের সম্পর্কের পরিচয়!আর আমার পরিচয়?আমি হলাম অঙ্কুরের সেই অভাগী মা!যে শুধু পেটে ধরেছে অঙ্কুরকে,কিন্তু ওকে ভালোবেসে,নিজ হাতে মানুষ করে মাতৃত্বের সাধ মেটাতে পারে নি।নাইবা ওকে দিতে পেরেছে প্রকৃত অর্থে মায়ের ভালোবাসা,আদর,যত্ম!
পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো আমার।চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে সবটা ঘোলাটে হয়ে গেছে।ভেতরটাতে তুমুল ঝড় অনুভব করতে লাগলাম।মনিমা বলতে লাগলো,

-স্কুললাইফ থেকেই আমি তোর বাবার খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।শুধু বন্ধুত্বই ছিলো আমাদের মাঝে।কিন্তু আমাদের দুই পরিবারের বড়রা অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিলো,যা অবশ্য আমরা জানতাম না।পড়াশোনা শেষ করে আকাশ সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়।আর আমি আমার ইচ্ছামতো এনজিওতেই কাজ করতে শুরু করি।তারপরও আমাদের যোগাযোগটা ছিলো।আগের মতোই।চাকরিরত অবস্থায় অনিতার সাথে দেখা হয় ওর।দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করে।সবটাই জানতাম আমি।সাপোর্টিভও ছিলাম ওদের প্রতি।
কিন্তু আকাশ যখন তোর দাদুভাইকে অনিতার ব্যাপারে বললো,তখন আমরা জানতে পারি আমাদের দুজনকে নিয়েই তাদের উদ্ভট ভাবনা।তৎক্ষনাৎ মানা করে দেই দুজনেই।অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি,আমাদের সম্পর্কটা শুধুই বন্ধুত্বের।লাভ হয়নি।তাই বাধ্য হয়ে আকাশ অনিতা পালিয়ে বিয়ে করে নেয়,আর এ কারনে তোর দাদুভাই ত্যাজ্য করে দেয় তোর বাবাকে।

তোর বাবার পালিয়ে বিয়ে করার ফল আমাকেও সইতে হয়েছিলো অনেক।বাবা জেদ করে এমন একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে দেয় যার জীবনে টাকার চেয়ে বড় আর কিছুই না।আর ঠিক এজন্য তার উপার্জনের উপায়ও ছিলো অবৈধ!সংসার করতে শশুড়বাড়ি তো গিয়েছিলাম,কিন্তু আকাশের ব্যাপারটা জেনে ওরা উঠতে বসতে কথা শোনাতো আমাকে।যেনো আমার সত্যিসত্যি বন্ধুত্বের বাইরে সম্পর্ক ছিলো আকাশের সাথে।কিন্তু বিয়ের পরপরই শান্তিতে স্বামীর সংসার করবো বলে আমি নিজে থেকেই তোর বাবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম।তাতেও লাভ হয়নি।
ভেবেছিলাম যার সাথে বিয়েটা হয়েছে,সে অন্তত বুঝবে আমাকে।কিন্তু নাহ্!কোনোদিনও বোঝেনি সে আমাকে।আর না আমি মানতে পারছিলাম তার কাজকর্মগুলো।চলতে থাকে সম্পর্কের টানাপোড়ন।এরইমধ্যে আমার কোল আলো করে জন্ম নেয় অঙ্কুর।তবে ওর জন্মের পরও আমাদের মধ্যের রোজকার ঝগড়া,অশান্তি কমেনি।নিত্যদিন আকাশকে নিয়ে কথা শোনাতো অঙ্কুরের বাবা আর আমি শোনাতাম ওর অবৈধ কাজকর্ম নিয়ে।

আমি সবসময় তার বাজে ব্যবহার লুকিয়ে যেতাম অঙ্কুরের কাছ থেকে।আর ওর বাবা সবসময় দেখাতো,আমিই খারাপ ব্যবহার করি তার সাথে।এসব দেখেই বড় হচ্ছিলো অঙ্কুর।ওকে বোঝানোর সুযোগটুকো হয়নি আমার।ওর বাবা বেশিরভাগ সময়ই আলাদা রাখতো আমাদের।অঙ্কুরকে অনেক সময় দিতো‌ সে,হাহ!শত হোক,তার সমস্ত অবৈধ টাকার উত্তরসুরী বলে কথা!আমাদের আলাদা রেখে সে সবসময় অঙ্কুরকে বুঝিয়েছে আমিই দায়ী সবটার জন্য।ওইটুকো ছেলের কাছে তার মাকেই দোষী বানিয়ে দিয়েছিলো ওর বাবা,মায়ের প্রতি ভালোবাসার বদলে ঘৃনা তৈরী করে দিয়েছিলো।বোঝাতে পারি নি।কোনোভাবেই বোঝাতে পারি নি অঙ্কুরকে!আজ অবদিও নয়!

এভাবেই কেটে যায় নয় বছর।ছাড়তে পারিনি ও বাসা।অঙ্কুরকে সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম বলে।কিন্তু একমাত্র ছেলের কাছ থেকে এতোটা উপেক্ষা সহ্য হচ্ছিলো না আমার আন্নু।খুব কষ্ট হতো।ততদিনে তোর বাবা মা তাদের কাজের জন্য সাংবাদিকতায় নিজেদের অনেক নাম ছড়িয়েছিলো।যদিও যোগাযোগ ছিলো না আমাদের।এরইমাঝে একদিন জানতে পারি অঙ্কুরের বাবার কিছু কুকীর্তির প্রমান আকাশ অনিতার হাতে চলে গেছে।অঙ্কুরের বাবাকে একদিন ফোনে বলতে শুনলাম ওদেরকে মারতে মানা করছে সে,বলছে তোর বাবা মাকে শুধু ধমকি দিতে।আর মানতে পারি নি,জানতাম অঙ্কুরের বাবাকে থামাতে পারবো না আমি।তাই আকাশকে ফোন করে বলি পুলিশকে ইনফর্ম করতে।

ওরা তাই করেছিলো।অঙ্কুরের বাবা সবটা বুঝে যায় কোনোভাবে।সেদিন…সেদিন আমার গায়ে হাত তুলেছিলো সে।কিন্তু বরাবরের মতো সেটাও অঙ্কুরের দৃষ্টিগোচর হতে দেইনি আমি।আচমকাই তোর বাবা ফোন করে বলে গাড়ি নিয়ে বেরোতে।ওদের প্রানসংকট।তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে যাই বাসা থেকে।আকাশ ফোনেই বলছিলো,ওরা এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো।কেউ ইচ্ছে করে ওদের গাড়ির ব্রেকফেইল করিয়েছে।ওর গাড়ির কাছে পৌছাতেই আমিও বুঝতে পারি ব্যাপারটা।ওই গাড়িতে মৃত্যুপথযাত্রী হয়ে ছিলো তিনজন।ড্রাইভিং সিটে আকাশ,ব্যাকসিটে অনিতা আর বছর পাঁচেকের এক ফুটফুটে মেয়ে,আহানিতা।তুই!

আকাশ অনিতাকে বলে চলন্ত গাড়ি থেকেই তোকে আমার গাড়িতে তুলে দিতে।দুটোর স্পিড সমান রেখে আমি তাই করেছিলাম।তোকে নিজের গাড়িতে তুলে নিয়েছিলাম।কিন্তু তার পরপরই তোর বাবা মায়ের গাড়িটাকে পেছন থেকে এক ট্রাক এসে ধাক্কা দেয়।গাড়িটা উল্টে একদম আমার গাড়ির সামনে পরে।কোনোমতে ব্রেক কষে নিজের গাড়িটা তো থামাতে পেরেছিলাম,কিন্তু তোর মা বাবাকে বাচাতে পারি নি।সেদিনের কারব্লাস্টে মারা যায় ওরা।চোখের সামনে তাদের গাড়িকে জ্বলতে দেখে চিৎকার করে কেদেছিলি তুই।তারপর থেকেই আগুনে ফোবিয়া তোর।যদিও সময়ের সাথে তুই সবটাই ভুলে গেছিলি।

মা বাবার মৃত্যুর কথা কানে বাজতে লাগলো আমার।কান্না থামছেই না।তানহা জাপটে জরিয়ে ধরলো আমাকে।মনিমাও কান্না করছে।একটু শ্বাস নিয়ে মনিমা আবারো বললো,
-সেদিন তোকে বাচিয়ে নিয়ে অঙ্কুরের বাবার বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি।তোর দাদুবাড়ির কেউই মানে নি তোকে।অনিতার বাবার বাড়ি সম্পর্কেও কোনো ধারনা ছিলো না আমার তখন।পরে জানতে পারি,অনিতাকেও ক্ষমা করেনি তারা।তোর পরিচয় আর তোকে আমার কাছে রাখবো এমনটা বলতেই অঙ্কুরের বাবা ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে।
অঙ্কুর স্কুলে ছিলো তখন।আমি তোর বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য তার দিকে আঙুল তুলেছিলাম।কিন্তু ওর বাবা স্পষ্টভাবে তা অস্বীকার করে।তাদের মৃত্যুর জন্য নাকি সে দায়ী নয়।আমিও শুনেছিলাম,অন্য কাউকে ফোনে বলেছিলো সে,আকাশ অনিতাকে না মারতে।তবে হ্যাঁ,অঙ্কুরের বাবা এটা বলেছিলো আকাশ নাকি তার বিরুদ্ধের সব প্রমান দিয়ে গেছিলো পুলিশের কাছে।আর তাই তার রাগটা তোর উপর দেখাতে পিছপা হবে না ও।ভয় পেয়ে যাই আমি।সবটা ছেড়ে ছুড়ে কোনোমতে পালিয়ে আসি তোকে নিয়ে।

তারপর অনেকবার লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করেছি অঙ্কুরের সাথে।ও প্রতিবারই‌ ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার থেকে।একবার শুনলাম ওর বাবা বিদেশে।তারপর গিয়ে সবটা বলেছিলাম ওকে।সবটা শুনেও আমার প্রতি রাগ কমেনি ওর আন্নু।কমতোই বা কিভাবে?মা হিসেবে কিই‌বা দিয়েছি ওকে।তবুও,তবুও বারবার ভিক্ষুকের মতো ওর কাছে গিয়েছি।আর প্রতিবার অপমান করেছে ও আমাকে।শেষবার যখন গেলাম,অঙ্কুর বললো,আমি নাকি ওর নামযশের জন্য বারবার ওর কাছে যাই।স্পষ্ট মানা করে দেয় আমাকে,আমি যেনো কোনোদিন ওর মা বলে নিজেকে দাবী না করি।তাই কোনোদিনও কাউকে বলি নি।ও আমাকে ঘৃনা করে।ঘৃনা করে এ কারনে যে,আমি নিজের সন্তানকে ছেড়ে বন্ধুর সন্তানকে আগলে রেখেছি এতোগুলো দিন।এ নিয়েই আমার উপর ওর যতো রাগ,যতো অভিমান!

সবটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।তারমানে আমার উপর অঙ্কুরের রাগের কারন আমার জন্য মাতৃহারা হয়েছিলেন উনি।আমাকে মনিমার কাছ থেকে সরিয়ে,মনিমাকে কষ্ট দিতে চান উনি।আর বেবি হওয়ার পর আমার থেকে বেবিকে আলাদা করে দিয়ে আমাকেও একই যন্ত্রনায় রাখার পরিকল্পনা তার!তার প্রতি ঘৃনাটা সর্বোচ্চ সীমাস্পর্শ করলো।মনিমা বললো,

-উপর ওয়ালার কি অপার মহিমা দেখ আন্নু!যে তোকে আগলে রাখবো বলে ঘর ছেড়েছিলাম আমি,যে কারনে আমাকে অঙ্কুর ঘৃনা করে,সেই তোকেও আজ ও এতোটা ভালোবাসে।আমি তো এতেই সুখি।যাকে মাতৃস্নেহে মানুষ করলাম,সে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভালো থাকবে।আর তার ভালোবাসার মানুষটা সে,যাকে একটু ভালো রাখার জন্য এতোগুলো দিন দোয়া করে এসেছি।তার ভালো থাকার কারনটাও তুই হবি।এটা তো পরোক্ষভাবে আমারই সাফল্য আন্নু!আর কি চাই আমার!আর কিছুই চাইনা!শুধু তোরা দুজনে দুজনকে ভালোবেসে খুব ভালো থাক!এটুকোই চাওয়া!এটুকোই!

মনিমা কাদতে লাগলো।আমার কান্না থেমে গেছে।পাথর হয়ে গেছি যেনো।অঙ্কুরের বাবা জানেন আমার মা বাবার মৃত্যুর জন্য কে দায়ী।হয়তো পরোক্ষভাবে উনিও জড়িত ছিলেন।অঙ্কুর সবটা জেনেও মনিমাকে কষ্ট দিয়ে এসেছেন এতোদিন।অভিমান করে এতোটা শাস্তি দিয়েছেন মনিমাকে।এখন আমাকেও অপমান করার জন্য বিয়েটা করেছেন।দুদিন পর পুরো দেশের মানুষকে ঠকিয়ে টাকার বিনিময়ে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ হারতে যাচ্ছেন উনি।
একটা মানুষ কতোটা নিকৃষ্ট হলে এসব কাজ করতে পারে?আর মনিমা ওনাকেই ভালো রাখার জন্য আকুতি করছে আমার কাছে?তোমার এ চাওয়াও পুরন করতে পারবো না আমি মনিমা!তুমি চেনো নি তোমার ছেলেকে।ভালো থাকতে সে ভালোবাসার পথ বেছে নেয়নি।সে তো বেছেছে প্রতিশোধের পথ,শাস্তির আগুন!আমি কি করে ক্ষমা করবো তাকে?কি করে?

নাহ্!কোনোভাবেই না।আমাকে ক্ষমা করো মনিমা।তোমার ছেলে ভালোবাসার যোগ্য না।তাকে তার কাজের জন্য শাস্তি পেতেই হবে।আমাকে অপমানের শাস্তি,তোমাকে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি,এতোগুলো মানুষকে ঠকাতে চাওয়ার শাস্তি।সব শাস্তি পাওনা তার!তার প্রতিশোধের এই অগ্নিপথে ভালোবাসার পুষ্পবৃষ্টি ঝড়াবো আমি।কিন্তু পরিশেষে তাতেই ভস্ম হতে হবে অঙ্কুরকে।আর তারাও শাস্তি পাবে,যারা আমার বাবা মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী।অঙ্কুরের বাবাকে টেনে হিচড়ে এদেশে ফিরিয়ে আনবো আমি।সব সত্যিটা বলতে হবে তাকে।আর যদি কোনোভাবে সেও দায়ী হন,তাকেও শাস্তি পেতে হবে।এমনটাই হবে!এমনটাই করবো আমি!

অনেকটা সময় চুপ থেকে অঙ্কুর রহস্যময় একটা হাসি দিলেন।পিছন ফিরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ভর ছেড়ে দিলেন শরীরের।মাথা উচু করে চোখ বন্ধ করে বললেন,
-আজ অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে অদ্রি।
হাত মুঠো করে নিলাম।মুখে হাসিটা আছেই।উনি সোজা হয়ে দাড়িয়ে সেই বাকা হাসিটা রেখেই বললেন,
-ভয় পাচ্ছো?
-অদ্রি ভয় পায়?আপনি কতোটুকো চেনেন ওকে?
-সবটুকো।আর তুমি যেদিন আমার সবটুকো জানবে,আমাকে চিনবে,তোমার ঠোঠের এই হাসি,এই চাওনি সবটা বদলাবে সেদিন।দেখে নিও।গুড নাইট।
এটুক বলে উনি রুমের জন্য পা বাড়াচ্ছিলেন।পথ আগলে দাড়ালাম তার।বললাম,
-আপনার বিয়ে করা বউ আমি।
-হ্যাঁ তো?

ওনার এই হ্যাঁ তো প্রশ্ন মাথায় কয়েকবার ঘুরপাক খেলো।ওনার বেবি চাই,আজ আমি তার ঘরে।তার বউ হিসেবে।তবুও উনি….তার জোর না করার কথাটা মনে পরলো।মৃদ্যু হেসে মাথার ঘোমটা খুলে ফেললাম।উনি ভ্রুকুচকে বললেন,
-হোয়াট?
তারদিক স্থির দৃষ্টি রেখে একে একে খুলে ফেলতে লাগলাম সমস্ত গয়না।হাসিটাও রেখেছি।অঙ্কুর ইতস্তত করতে করতে বললেন,
-থামো অদ্রি।এসব…
থামি নি।সব গয়না খুলে ফেলেছি।একবার জোরে শ্বাস নিয়ে কাধে তুলে দেওয়া ওড়নায় হাত দিতেই অঙ্কুর আটকে দিলেন আমাকে।শান্তভাবে বললেন,
-স্টপ ইট অদ্রি।

হাসি আরো প্রসারিত হলো আমার।তার হাত ছাড়িয়ে ওড়না সরিয়ে দিলাম কাধ থেকেও।অঙ্কুর তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলেন।গায়ে শুধু লেহেঙ্গাটাই আছে।বললাম,
-চোখ সরিয়েছেন কেনো অঙ্কুর?আমি তো আজ সেজেছি আপনারই জন্য।আপনি জোর করেন নি।আমি নিজে থেকেই নিজেকে সমর্পন করেছি আপনার কাছে।আপনার বউ আমি।
-অদ্রি,জাস্ট গো টু স্লিপ!ভালো লাগছে না আমার!
-কি ভালো লাগছে না?

-তোমার এসব কথা,এসব কাজ,কোনোটাই ভালো লাগছে না আমার।যাও গিয়ে রুমে বিছানাতেই ঘুমিয়ে পরো।
-বললাম তো,আ’ম অল ইউরস্!তবুও আজ এতোটা ইতস্ততবোধ কেনো আপনার?
উনি পাশ কাটিয়ে চলে আসছিলেন।হাত ধরে আটকে দিলাম তাকে।বললাম,
-আপনার চাওয়া পুরন করবেন না?আমি তো আপনার বিয়ে করা বউ!আর আপনার তো বেবি চাই!
মুহুর্তেই টান পরলো হাতে।তাকে ধরে রাখা হাত ধরেই হেচকা টানে আমাকে সামনে দাড় করালেন উনি।চোখ তুলে তাকিয়েছেন উনি আমার দিকে।সে গভীর চাওনি দেখে আমি নিজেই আর তাকাতে পারিনি তারদিকে।মাথা নিচু করে নিলাম।কিন্তু অঙ্কুরের সামনে নিজেকে দুর্বল দেখাবো না ভেবে আবারো মাথা তুললাম।উনি বাকা হেসে বললেন,
-খুব শখ হয়েছে বরের আদর পাওয়ার?

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৫

রিয়্যাক্ট করার আগেই আমাকে কোলে তুলে নিলেন উনি।আচমকাই এমন হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে গলা জরিয়ে রেখেছিলাম তার।আরো শক্ত করে জরিয়ে হৃদপিন্ডটাকে বারবার বোঝাতে লাগলাম,গতি একটু কমাতে।শব্দ একটু কম করে করতে।কোনোটাই মানেনি ও।উনি রুমে এনে সোজা বিছানায় শুইয়ে দিলেন আমাকে।পরে থাকা টিশার্ট একটানে খুলে ফেলে দিলেন।চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।চোখের কোনা বেয়ে পানি গরিয়েও পরেছে।মুছে নিলাম চটজলদি।অঙ্কুর আমার উপর ঝুকে আধশোয়া হয়ে বললেন,
-আপনি ম্যাডাম বিয়ের পর বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছেন দেখছি!

-আইমিন,ইটস্ ট্রু অদ্রি!আগেরবার তো আমাকে খালি গায়ে দেখে ভুত দেখার মতো চোখ বন্ধ করে নিয়েছিলে।এবার চোখ বন্ধ না করে শুধু অন্যদিকে তাকালে?নট ব্যাড!বেশ ভালো ইমপ্রুভমেন্ট!
-এনিওয়েজ!তৈরী তুমি?আমার চাওয়া পুরনে?আমার বিয়ে করা…বউ?

সবটাই তুমিময় পর্ব ১৭