প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৩

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৩
নিশাত জাহান নিশি

“সিগারেট ধরাব। মাথায় আগুন জ্বলছে আমার। মাঝরাতে ঘুমটা ভেঙে আমার পালপিটিশান বাড়িয়ে দিলো!”
হিংস্রতায় পরিপূর্ণ সাদমান। ঘাড় থেকে শুরু করে কপালের অগ্রভাগের রগগুলোও অবধি টান টান উত্তেজনা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে! দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরা টগবগ করছে।

অকাতরে ঘাম ঝরছে গাঁ থেকে। শরীরময় তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সাদমান এদিক থেকে ওদিক পায়চারী করছে। মনে হচ্ছে যেন মাথার চুলগুলো সে এক্ষুণি টেনে ছিঁড়ে ফেলবে! সাদমানের এহেন ভয়ংকর ভাবমূর্তি দেখে জায়মা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে আদোতে কী ঘটেছে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তবে যাই ঘটে থাকুক না কেন সাদমানকে এই বিভৎস রূপে দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছেনা! ভেতরে কেমন ক্ষুদ্র ধরনের ব্যথার অনুভূতি হচ্ছে! যে ব্যথার কারণ খণ্ডানো এত সহজ নয়! এখন যেকোনো উপায়েই হোক সাদমানকে তার শান্ত করতেই হবে! স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। এই ভেবে ফুসফুসে দম সঞ্চার করল জায়মা। বুকে যথেষ্ট সাহস যুগিয়ে সে পা টিপে টিপে হেঁটে সাদমানের ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। নির্ভীক গলায় অধীর হয়ে থাকা সাদমানকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আপনি চাঁদ এবং নূর ভাইয়াকে ছাদে একসাথে দেখে ফেলেছেন তাইনা?”
ঝট করে সাদমান তার গোলন্দাজ দৃষ্টিতে জায়মার চতুর দৃষ্টিতে দৃষ্টি ফেলল! পুনরায় মুখমণ্ডলে তীব্র কঠোরতা ফুটিয়ে তুলল। জায়মার এই উপযোগী প্রশ্নে সে যে শুধু তেতে উঠেছে তা কিন্তু নয় বরং খানিকটা অবাকও হয়েছে! ছাদে সে কাকে দেখে আসল না আসল তা তো জায়মার জানার কথা নয়! তবে জায়মা জানল কীভাবে এসব? গভীর ভাবনাচিন্তায় নিমজ্জিত থাকতেই জায়মা ঝেড়ে কাশল। বুকে হাত গুজে মলিন সুরে বলল,,

“শুনেছি বুদ্ধিমানরা কখনো অন্যের সুখ দেখে নিজে অকারণে কষ্ট পায়না। বরং নিজে কীভাবে সুখে থাকবে তা নিয়ে বিরাট ভাবনাচিন্তা করে। নিজে সুখে থাকার উপায় নিজেই খুঁজে বের করে। কারণ নিজে নিজেকে খুশি করতে না পারলে অন্য কেউ তাকে খুশি করতে পারবেনা। এখন আমার প্রশ্ন হলো, আপনি কি সেই বুদ্ধিমানদের দলে নন?”

চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে সাদমান জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। জায়মার নীতিবাক্য তার মোটেও পছন্দ হলোনা। বরং কাটা গাঁয়ে লবণের ছিঁটা মনে হলো! দাঁতে দাঁত চিবিয়ে সাদমান খরখরে গলায় বলল,,
“লাইটার খুঁজতে এসেছিলাম জ্ঞান নিতে নয়!”

গ্যাসের তলা থেকে জায়মা হাতিয়ে একটা লাইটার খুঁজে পেল! দ্রুত পায়ে হেঁটে জায়মা হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকা সাদমানের পিছু নিলো। পেছন থেকে সাদমানকে মৃদু আওয়াজে ডাকতে লাগল। লাইটার খুঁজে পেয়েছে বলে চ্যাঁচাতে লাগল। তবে সাদমান রাগে-জেদে নিজের মধ্যে এতটাই বিভোর ছিল যে কর্ণকুহরে তার শোঁ শোঁ বিকট শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ-ই পৌঁছালোই না! এক পর্যায়ে সাদমানকে ডিঙিয়ে এসে জায়মা সোজাসুজি হেঁটে সাদমানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। হাঁপাতে হাঁপাতে লাইটারটি সাদমানের মুখের সামনে ধরল। শ্রান্ত গলায় বলল,,

“এই নিন আপনার লাইটার। দয়া করে মাথাটা এবার ঠাণ্ডা করুন।”
সাদমান যেন আলোর দিশা খুঁজে পেল! স্বস্তির শ্বাস ফেলল। খানিকটা বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাওয়ার মত খুশি হলো! প্যান্টের পকেট থেকে একটি সিগারেট সে হাতে তুলে নিলো৷ দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেটটি ধরে ঝট করে জায়মার হাত থেকে লাইটারটি কেড়ে নিলো!

ব্যস্ত ভঙ্গিতে লাইটার দ্বারা সিগারেটটি ধরালো। সিগারেটটিতে দীর্ঘ এক টান দিয়ে সে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে জায়মার দিকে তাকালো৷ করিডরের রেলিংয়ে ঢ্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটটি দু’ঠোঁটের মাঝখানে রেখেই সামনের চুলগুলো ঠিক করল। অসমতল গলায় জায়মাকে শুধালো,,

“কী বলছিলা ঐ সময়? আমি বুদ্ধিমান কি-না?”
জায়মা শুকনো ঢোঁক গিলল। মাথা নুইয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। সাদমান শ্লেষাত্মক হাসল! নাক মুখ থেকে ধোঁয়া নির্গত করে বলল,,

“হ্যাঁ আমি বুদ্ধিমান! আর সে কারণেই নূর এবং চাঁদের জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। বহুদূরে চলে যাচ্ছি। আর চাইলেও হয়তো অনেকগুলো বছর আমাদের আর দেখা হবেনা!”

জায়মার নিঃশ্বাসে সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করছিল৷ যদিও তার নিঃশ্বাস নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল তবুও যেন সে এই যন্ত্রণা থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার অন্তঃপ্রাণ চেষ্টা করল। কারণ, সাদমান এখন যে কথাটি বলল সে কথাটি তার প্রাণ ছেদ করে দেওয়ার মত যথেষ্ট ছিল। নিঃশ্বাসের কষ্ট সেখানে কিছুইনা! অতি তুচ্ছ। রুদ্ধশ্বাস ফেলল জায়মা। ব্যথীত দৃষ্টি ফেলে সাদমানের দিকে তাকালো। কণ্ঠে কাতরতা এনে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
সাদমান ভাবলেশহীন। সিগারেটটিতে তৃতীয়বারের মতো ফুঁক দিলো সে। স্বাভাবিক স্বরেই বলল,,
“জর্ডান।”
“আর কখনো ফিরবেন না?”
“এখনও ভেবে দেখিনি।”

লোহিত রক্তের ন্যায় লাল হয়ে থাকা জায়মার আঁখিযুগল থেকে টলটলিয়ে শ্রাবণের বারিধারা বইতে লাগল! ভেতর থেকে আসা গোঙানীর আওয়াজটা সাদমানের কান এড়ালো না! দ্রুত দৃষ্টি ফেলে সাদমান জায়মার দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গেই সে সিগারেটটি হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলল! উদ্বেগীচিত্তে অস্থির গলায় বলল,,

“সরি সরি৷ আ’ম এক্সট্রেমলি সরি জায়মা। আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম তুমি সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারো না!”
বিনা শব্দ প্রয়োগে জায়মা জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো! মুখ চেপে ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে রুমের দিকে গতিপথ নির্ধারণ করল। সাদমানকে বুঝি সে জীবনের তরে হারিয়ে ফেলল!

আর কখনো বুঝি তাদের দেখা হবেনা, কথা হবেনা, ভালোবাসা বাসি ও হয়তো হবেনা! তার একতরফা অনুভূতিগুলো এভাবেই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, অব্যক্ত রয়ে যাবে। সাদমান কখনো জানতেও পারবেনা জায়মা সত্যি সত্যিই মন থেকে তাকে ভীষণ রকম ভালোবেসে ছিল! যে ভালোবাসার কোনে পরিধি ছিলনা! কোনো সীমা-পরিসীমা ছিলনা।

অরুণ রাঙা ভোর। প্রভাতের সমস্ত আমেজ কাটিয়ে সূর্য যেন আজ তার লাল আবির মেখে দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর প্রতিটি আনাচে কানাচে। প্রতিদিনের ন্যায় সূর্য আজও তার নির্দিষ্ট রূঢ়তায় সীমাবদ্ধ। মেজাজ যেন বেশ খরতর! সূর্যের পাশাপাশি আজ সকাল সকাল নীড়ের মেজাজটা ও বেশ খরতর হয়ে উঠল!

কারণ ঘুম ভেঙে ওঠে সে সোহানীকে তার পাশে পায়নি। বিয়ের দ্বিতীয় দিনও সোহানী প্রতিদিনকার ন্যায় কিচেনে গেছে খুন্তি নাড়তে। নীড়কে আলাদা সময় না দিয়ে। তাই জেদ দেখিয়ে নীড় ঘাপটি মেরে বিছানাতেই শুয়ে আছে। শাওয়ার নেওয়াও এখনো অবধি হয়নি তার। প্রয়োজনও মনে করছেনা। যতক্ষণ অবধি না সোহানী এই রুমে আসবে ততক্ষণ অবধি তার শাওয়ার নেওয়া হবেনা বলে কঠিন এক পণ করে রেখেছে।

সকাল নয়টা গড়ালো ঘড়িতে। চাঁদ, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া মরার মতো বিছানায় ঘুমিয়ে রইল।তারা প্রত্যেকেই এখানে মাঝরাতে ঘুমিয়েছে। তবে তিনজন ঘুমিয়েছে প্রেম করে করে আর একজন ঘুমিয়েছে বিরহে কাঁদতে কাঁদতে! নূর, মাহিন এবং সাদমানও ধুমসে পড়ে ঘুমুচ্ছে। শার্ট-প্যান্টের কোনো ঠিক নেই তাদের!

একজন আরেকজনের গাঁয়ের উপর লেদালেদি দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এরমধ্যেই হঠাৎ নূরের ফোনটি বজ্রপাতের ন্যায় বেজে উঠল! তার কানের কাছেই ভোঁ ভোঁ শব্দে বেজে উঠল ফোনটি। ঘোর তিক্ততায় নাক-মুখ সিটকালো নূর। ভ্রু যুগল খরতরভাবে কুঁচকে আড়মোড়া জড়ানো গলায় বলল,,

“শিট। এই সাত সকালে আবার কে কল করল?”
চক্ষুজোড়া দুর্ণিবার ঘুম নিয়ে নূর ফোনটি হাতে তুলে নিলো। কোনোমতে এক চোখ মেলে সে ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকালো। তবুও যেন ঘুম আচ্ছাদিত দৃষ্টিতে কিছুই ঠাওড় করতে পারলনা সে। আদো স্ক্রীনে কার নাম্বারটি ভাসছে তাও না! মেজাজ খারাপ করে নূর ঝট করে ফোনটি তুলে নিলো। অমনি ঐ পাশ থেকে মিষ্টি মধুর স্বরে মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। মিস নায়লা মৃদু হেসে বলল,,

“গুড মর্ণিং নূর।”
নূর হকচকিয়ে উঠল। ফটাফট সে শোয়া থেকে ওঠে বসল৷ মাথা ঝাকিয়ে কপাল ঘঁষল। থতমত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কে? নায়লা আপু?”
“হুম। কে ভেবেছিলে?”
চোখ-মুখ মুছল নূর। ঝিমিয়ে আসা গলায় বলল,,

“আসলে আমি ঘুমুচ্ছিলাম তো। তাই আইডিয়া করতে পারিনি।”
প্রসঙ্গ পাল্টাল মিস নায়লা। বাম হাতের সাহায্যে সাদা এপ্রোণটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিল। কপালের মাঝখানে থাকা কালো টিপটিকে আরও একদফা ঠিক করে পড়ল। প্রফুল্লিত গলায় বলল,,
“আচ্ছা। এসব বাদ দাও৷ এখন বলো তুমি আজ বিকেলে ফ্রি আছো কি-না?”
“আপু। আমি আপনাকে ফ্রি হয়ে কল দিই?”

“না নূর। এখনই বলো। কারণ তোমার আনসারের উপরই ডিপেন্ড করবে আজ বিকেলে আমি চেম্বারে যাব কি-না!”
বিষয়টাকে নূর বেশ সিরিয়াসলি নিলো! কোনো ভাবে মিস নায়লার ইশারা নূর বেশ বুঝতে পারল। কোনো কিছুতেই অতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। প্রতিটা সম্পর্কের-ই নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে থাকতে হয়! যে সীমা এখন মিস নায়লা অতিক্রম করছেন। আর একটু প্রশ্রয় দিলেই তিনি হয়তো মহামারীর আকার ধারণ করবেন!

মাহিন এবং সাদমানকে গাঁয়ের উপর থেকে ঠেলেঠুলে নূর বিছানা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো পা ফেলে সে গুমোট অন্ধকার রুম থেকে বের হয়ে উদোম শরীর নিয়ে ছাদের দিকে রওনা হলো! চাঁদ সবেমাত্র ঘুম থেকে ওঠে রুম থেকে বের হলো। অমনি সে পেছন থেকে দেখতে পেল উদোম শরীরে নূর দ্রুত পা ফেলে ছাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কানে আবার ফোনও চেপে রেখেছে। বিষয়টিতে চাঁদের বেশ সন্দেহ হলো! কৌতূহলী হয়ে সে ভ্রু কুঁচকালো। রহস্য উদঘাটন করতে উদগ্রীব হয়ে উঠল। সাবধানে পা ফেলে নূরের পিছু নিলো!

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নূর সকালের কড়া রোদ উপেক্ষা করার জন্য হাত দ্বারা কপাল ঢাকল। ম্যাচম্যাচে শরীরে আলসেমি কাটানোর জন্য হাত- পা ঝাকালো। ফোনে লাইনে থাকা মিস নায়লাকে উদ্দেশ্য করে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,,
“আচ্ছা আপু? আপনি হঠাৎ আমার সাথে মিট করতে চাইছেন কেন?”

“আহা নূর। আপু কেন? আমি তো তোমার তিন বছরের-ই সিনিয়র হই তাইনা? এ আবার বড়ো কী ব্যাপার হলো বলো? তুমি বরং আমাকে নাম ধরেই ডাকতে পারো। আমি মাইন্ড করবনা। উল্টে খুশি হব!”
বিব্রতবোধ করল নূর। সামনের চুলগুলো টেনে কর্কশ গলায় বলল,,

“আপু আপনি হয়তো আমার থেকে একটু বেশিই এক্সপেক্ট করে ফেলছেন! যা সত্যিই বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে আমার কাছে।”
“মানে?”
“মানেটা খুব সহজ আপু। আমি আপনাকে জাস্ট সিনিয়র আপুর চোখে-ই দেখি। কখনো অন্য কোনো নজরে দেখিনি।”
মিস নায়লা রসালো হাসল! ঠোঁট কামড়ে ফিচেল স্বরে বলল,,
“ওকে। কোনো ব্যাপার না। এবার থেকে অন্য নজরে দেখো তাহলেই হবে!”

নূর পূর্বের তুলনায় অধিক রূঢ় হয়ে উঠল! মেজাজ গরম করে চোয়াল শক্ত করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
“আপনি বুঝতে পারছেন না আপু। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে! চাঁদ শুধু আমার কাজিন নয় আমার গার্লফ্রেন্ডও বটে! শুধু তাই নয়, অনার্স কমপ্লিটের পর আমি চাঁদকে বিয়েও করছি। ফ্যামিলিতে এই বিষয় নিয়ে কথাও হচ্ছে।”

মিস নায়লা যেন টুপ করে আকাশ থেকে পড়ল! ঘটনার আকস্মিকতায় হাতে থাকা ফোনটি তার ঢিলে হয়ে এলো। শরীরটাও কেমন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল! চোখজোড়া আতঙ্কে বড়ো হয়ে উঠল। কম্পিত স্বরে বলল,,
“কীকীকী বললে?”
“হ্যাঁ আপু। ইট’স ফ্যাক্ট। আমি সত্যিই চাঁদকে ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ বলতে ভীষণ। যার কোনো পরিমাপ হয়না।”
ঝট করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলো মিস নায়লা! চোখের জল ছেড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। কপাল চাপড়ে হাউমাউ করে কেঁদে বলল,,

“কী শুনলাম এসব আমি হ্যাঁ? নূর কি তবে সত্যিই অন্য কাউকে ভালোবাসে?”
কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নূর হাতে রাখল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সামনের পেছনের চুলগুলো টানল। বড়ো কোনো এক বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে এমন একটা ভাব নিলো। স্থবির গলায় বলল,,
“উফফ বাবা। জোর বাঁচা বাঁচা গেল! চাঁদ দেখতে পেলে আজ খবর ছিল।”

চুল টেনে নূর পিছনে ফিরতেই হঠাৎ রণরঙ্গিণী রূপে দাঁড়িয়ে থাকা চাঁদের মুখোমুখি হয়ে গেল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদ ভ্রু উঁচিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল। নূর বিষম খেল। অস্থির দৃষ্টি ফেলে চাঁদের দিকে তাকালো। মাথার পেছনে চাপড় মেরে আনমনে বলল,,

“আইলা! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়?”
নূরের ধরাশায়ী ভাবমূর্তি দেখে চাঁদ মনে মনে ভীষণ হাসল! বাঘকে বিড়াল হতে দেখলে কার-ই বা ভালো না লাগে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিলো চাঁদ। নূরকে ভয় দেখানোর জন্য পুনরায় মুখমণ্ডলে রুদ্রময়ী ছাপ ফুটিয়ে তুলল। রাশভারী গলায় শুধালো,,

“কার সাথে ইন্টু পিন্টু করছিলেন হ্যাঁ?”
নূর নির্বোধ ভাব নিলো। অবুঝ স্বরে বলল,,
“হোয়াট? ইন্টু পিন্টু আবার কী?”
“বুঝেননা না? কলা খান?”
“ছ্যাঁ! কলা আমি খাইনা!”
“ঢঙ দেখো! ফোনে মিস নায়লা ছিল না?”
নূর মাথা চুলকালো। অপরাধীর ন্যায় মাথা নুইয়ে নিলো। ভীরু গলায় বলল,,

“হুম!”
“প্রেম করছিলেন তার সাথে?”
নূর জিভ কাটল। সরল দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। হতবিহ্বল গলায় বলল,,

“আস্তাগফিরুল্লাহ্! পাশে এত চান্দের মত সুন্দরী প্রেমিকা থাকতে আমি আবার কার সাথে প্রেম করব হ্যাঁ?”
বেশ ভাব নিয়ে চাঁদ মুখ বাঁকালো। বুকে হাত গুজে নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। ব্যগ্র হেসে নূর কোনো দিকে কালক্ষেপণ না করেই চাঁদকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল! আদুরে হয়ে চাঁদের চোখে-মুখে অজস্র চুমু খেয়ে বলল,,
“ভালোবাসি আমার চাঁদপাখিটাকে।”

রান্নাঘরের টুকটাক কাজকর্ম সেরে সোহানী গরম গরম দু’কাপ কফি হাতে নিয়ে তাদের শোবার ঘরে প্রবেশ করল। নীড়কে নিয়ে একসাথে কফি খাবে বলে মনোস্থির করল। দরজা খুলে সোহানী যেই না বিছানায় পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করল অমনি দেখতে পেল নীড় উবুড় হয়ে পূর্বের ন্যায় বিছানায় শুয়ে আছে!

ঘুমুচ্ছে নাকি সজাগ আছে ঐপাশ থেকে কিছুই বুঝা যাচ্ছেনা। তবে যতদূর বুঝা যাচ্ছে নীড় হয়তো এখনো ঘুমুচ্ছে। কপাল কুঁচকে সোহানী কফির মগটা নিঃশব্দে ডেস্কের উপর রাখল। রাগে দাঁতে দাঁত চাপল। সকাল দশটা বাজতে চলল অথচ জনাবের এখনো ঘুম ভাঙলো না?

খোঁপায় বাঁধা ভেজা চুলগুলো সোহানী পাখার বাতাসে মেলে দিলো। অমনি চুলের ঘ্রাণে গোটা ঘর আমোদ হয়ে গেল। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা নীড়ের নাকে এই মাতাল করা চুলের সুঘ্রাণ প্রবেশ করতেই নীড় ফট করে আঁখিযুগল খুলে নিলো! সোহানীর উপস্থিতি তার আশেপাশে টের পেল।

উবুড় হওয়া অবস্থা থেকে সে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নেশাক্ত দৃষ্টিতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল সোহানী বেশ মনোযোগের সাথে চুলগুলো সামনে এনে ঝাড়ছে। পিঠের উন্মুক্ত ধবধবে সাদা অংশটা নীড়ের দু’চোখে স্পষ্ট। রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখতে পারলনা নীড়! সোহানীর রূপে কাত হয়ে গেল। বিনা সময় ব্যয়ে নীড় সোহানীর শাড়ির আঁচলে হেঁচকা টান দিলো! সোহানীকে সরাসরি তার উন্মুক্ত বুকের উপর ফেলল!

অমনি নীড়ের চোখে-মুখে সোহানীর দীর্ঘ, ঘন এবং মসৃণ চুল গুলো এসে লেপ্টে পড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নীড় চুলের মিষ্টি ঘ্রাণটা চোখ বুজে নিতে লাগল। শ্বাসে প্রশ্বাসে তার মাদকতা ছড়াতে লাগল। সোহানীকে তার শরীরের সাথে আরও প্রখরভাবে আঁকড়ে ধরল। অনুভূতিহীন হয়ে পড়ল সোহানী। নীড়ের ভালোবাসায় মাখামাখি হতে লাগল। না চাইতেও অস্ফুটে সুরে বলল,,

“উঠুন। কফি খাবেন।”
সোহানীর কানের লতিতে নীড় উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ালো। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,,
“আগে পানিশমেন্ট ভোগ করো। এরপর কফি।”
সোহানীকে প্রতিউত্তর করার সুযোগ দিলোনা নীড়। তাকে নিজের করে পেতে কেমন মরিয়া হয়ে উঠল! সোহানীও যেন বিশেষ বাঁধা দিতে পারলনা নীড়কে! হাসিমুখে তার পাগলাটে ভালোবাসায় গাঁ ভাসাতে লাগল।

তাশফিয়া এবং আয়মন পাশাপাশি একই বিছানার উপর বসে আছে! তাশফিয়া ব্যাপক লজ্জায় এবং জড়তায় ভুগছে। অন্যদিকে আয়মন তাশফিয়াকে চোখে চোখে হারাচ্ছে! এই বিপত্তিকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাশফিয়া শেষবারের মত রুদ্ধশ্বাস ফেলে জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াতেই আয়মন পেছন থেকে তাশফিয়ার ডান হাতটি টেনে ধরল! উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এই কই যাও?”
সঙ্গে সঙ্গেই তাশফিয়া কেঁপে উঠল! তপ্ত শ্বাস ফেলে কম্পিত গলায় বলল,,
“বাবাইরে।”
“বাইরে কেন?”
“চাঁদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“চাঁদ কারো জন্য অপেক্ষা করছেনা। বরং তুমিই আমাকে ইগনোর করছ!”
“কককই? না তো!”

“তাহলে জায়গায় বসো।”
হেঁচকা টানে তাশফিয়াকে জায়গায় বসিয়ে দিলো আয়মন। নিবিষ্ট দৃষ্টিতে মাথা নুইয়ে বসে থাকা তাশফিয়ার দিকে তাকালো। ঘোর জড়ানো গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“ভালোবাসো না আমাকে?”
তাশফিয়া নাজুক দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। বেশিক্ষণ দৃষ্টি মিলাতে পারলনা আয়মনের ঐ মোহভরা প্রেমেসিক্ত দু’চোখে! সঙ্গে সঙ্গেই দৃষ্টি নামিয়ে নিলো তাশফিয়া। মাথা নাড়িয়ে বলল,,
“বাসি।”

“তাহলে এত ছটফট করো কেন আমার কাছ থেকে দূরে যেতে?”
“আপনাকে দেখলেই আমার কেমন দম বন্ধ আসে আয়মন! আপনার ছোঁয়া আমাকে অগোছালো করে তুলে। আপনার চাহনি আমাকে ভেতর থেকে মে’রে দেয়! কী করব আমি বলুন?”

আয়মন স্মিত হাসল! তাশফিয়ার করা মিষ্টি স্বীকারোক্তিতে প্রানোচ্ছ্বল হয়ে উঠল। সন্তোষ জনক দৃষ্টিতে তাশফিয়ার দিকে তাকালো। দ্বিধা দ্বন্ধ ভুলে এক ঝটকায় তাশফিয়াকে তার বুকের পাজরে আকঁড়ে ধরল। প্রবিষ্ট গলায় বলল,,
“এই বুকে একবার ভালোভাবে মিশে দেখো। আজ থেকে আর আমার কাছ থেকে পালানোর জন্য ছটফট করবেনা! বরং বারংবার ছটফট করবে আমার এই প্রেমে উত্তাল বুকের সাথে একাকার হয়ে মিশে থাকতে!”

সারারাত অঝরে কাঁদার দরুন জায়মার আঁখি পল্লব লাল বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটো কেমন ফুলকো হয়ে আছে! সুশৃঙ্খল দৃষ্টিতে সে কোথাও তাকাতে পারছেনা। দৃষ্টি কেমন ভারী হয়ে আছে। জায়মার পাশে বসে তিথী ফোনে স্ক্রলিং করছিল। হঠাৎ-ই তার দৃষ্টি পড়ল জায়মার বিবর্ণ মুখমণ্ডলে। বিশেষ করে চোখের কোটরে। সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা হাত থেকে সাইডে রাখল তিথী। উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে পাশ ফিরে জায়মার দিকে ঝুঁকে তাকালো। তৎপর গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,,

“এই জায়মা তোর কী হয়েছে রে? মুখটা কেমন শুকনা শুকনা লাগছে। চোখদুটোও কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। কী হয়েছে বল তো?”
ঘটনার আকস্মিকতায় জায়মা মুখ লুকিয়ে নিলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল! উত্তেজিত হয়ে অধীর গলায় বলল,,
“শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে রে। তাই দেখতে এমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬২

ইতোমধ্যেই চাঁদ ওয়াশরুম থেকে পুচিকে পটি করিয়ে রুম ঢুকল। অবেলায় জায়মা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকায় চাঁদের বেশ সন্দেহ হলো। সন্দিহান হয়ে সে ভ্রু কুঁচকালো। পাশে হতভম্ব হয়ে বসে থাকা তাশফিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,
“এই কী হয়েছে রে? জায়মার কী শরীর খারাপ?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৪