প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৪

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৪
নিশাত জাহান নিশি

“এই কী হয়েছে রে? জায়মার কী শরীর খারাপ?”
তিথী নির্বোধ ভাব নিলো। চাঁদের দিকে সন্দিহান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ঠোঁট ভেঙে ভাবশূণ্য গলায় বলল,,
“বলল তো শরীর খারাপ।”

চাঁদ ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। হঠাৎ জায়মার কী এমন শরীর খারাপ হলো? কাল রাতেও তো সব ঠিক ছিল। মধ্যরাত অবধি সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছিল। জায়মাকে তো তখন হাসি খুশি-ই দেখাচ্ছিল।পুচিকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানার উপর শুইয়ে দিলো চাঁদ। চোখে-মুখে দুঃশ্চিতার ছাপ ফেলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা জায়মার মাথার কাছে বসল। বিশৃঙ্খল শ্বাস ফেলে হেঁচকা টানে জায়মার মুখের উপর থেকে কাঁথাটা সরাতেই চাঁদ ভ্রু যুগল খরতর ভাবে কুঁচকে নিলো! উদগ্রীব গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এই জায়মা তুই কাঁদছিস কেন?”
সঙ্গে সঙ্গেই জায়মা মুখ ঢেকে বিষাদে আরও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল! কান্নার মাত্রা যেন বেগতিক বাড়তে লাগল তার। বিরহে মূর্ছা যাচ্ছিল। চাঁদ এবং তিথী দুজনই এবার ধরাধরি করে জায়মাকে টেনে শোয়া অবস্থা থেকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। দুজন দুপাশে বসে জায়মার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নাক টেনে কেঁদে জায়মা মুখ ঢেকে বলল,,

“তোরা প্লিজ এখন এখান থেকে যা। আমাকে একটু একা থাকতে দে।”
চাঁদ অবাক হলো। অবাক বলতে ভীষণ অবাক হলো। এই প্রথম জায়মাকে এতটা ইনসিকিউরড মনে হলো। সবসময় খোলাখুলি মনে থাকা জায়মাকে এতটা সংকীর্ণতা মানায় না। জায়মার আচরণে চাঁদ একগুঁয়ে ভাব নিলো। একরোখা গলায় বলল,,

“কোথাও যাচ্ছি না আমরা। আগে বল তোর কী হয়েছে?”
“বললাম তো তোরা যা। প্লিজ আমাকে একা থাকতে দে।”

হেঁচকি তুলে কেঁদে জায়মা পুনরায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। চাঁদ এবং তিথী তাজ্জব দৃষ্টিতে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। দুজনই ইশারায় বলল হলোটা কী এর? শূণ্যতায় কোনো উত্তর না পেয়ে দুজনই মাথা নুইয়ে জায়মার কাছ থেকে সরে এলো। পুচিকে কোলে তুলে চাঁদ রুম থেকে বের হয়ে রুমের দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দিলো।

বিষণ্ণ মনে দুজন করিডরে পাশাপাশি দাঁড়াতেই চাঁদের আচম্বিত দৃষ্টি পড়ল নূরের রুম থেকে বেশ ফিটফাট হয়ে বের হওয়া সাদমানের দিকে! সময় ব্যয় করতে চাইলনা চাঁদ। তৎক্ষনাৎ পুচিকে সে তিথীর কোলে তুলে দিলো। তিথীকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই সে দ্রুত পা ফেলে সাদমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অনর্গল গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“আচ্ছা কাল রাতে কী আপনার জায়মার সাথে কথা হয়েছিল?”
ঘটনার আকস্মিকতায় সাদমান ভ্রু কুঁচকালো। অবুঝ ভাব নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“বলুন না? কথা হয়েছিল কী?”
“হ্যাঁ হয়েছিল। তো কী হয়েছে এখন?”
“আপনি জর্ডান চলে যাবেন জায়মা জানে?”
“হ্যাঁ। গতকালই বলেছি। হয়েছেটা কী?”
“আপনার সাথে আমার কিছু দরকারী কথা ছিল।”

সাদমান বেশ ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকালো। তাড়াহুড়ো করে সে হঠাৎ চাঁদের দিকে অপারগ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। দ্রুত গলায় বলল,,
“সরি চাঁদ। এখন আমার সময় হবেনা। পাসপোর্ট অফিসে যেতে হবে। ওখানে কিছু ফর্মালিটিস আছে। আসলে জিজু চাইছে আর্জেন্ট আমাকে নিয়ে জর্ডান ব্যাক করতে। ধরো এই দশ/পনেরো দিনের মধ্যেই! তাই একটু তাড়ায় আছি। তবে আমি ফ্রি হয়ে তোমার সাথে কথা বলছি। এখন আসছি বায়।”

চাঁদকে উপেক্ষা করে সাদমান একপ্রকার দৌঁড়ে নিচে নেমে গেল। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই বাড়ির সদর দরজা অতিক্রম করে গেল। চাঁদ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। জায়মার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য তার মন কাঁদতে লাগল। পুচিকে কোলে নিয়ে তিথী দ্রুত পা ফেলে চাঁদের পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“সাদমান ভাইয়া কি সত্যিই চলে যাচ্ছে?”
চাঁদ মাথা নাড়ালো। হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,,
“জায়মা পারবে তো এই শোক সামলাতে? সাদমান ভাইয়া হয়তো কখন-ই জায়মার হবেনা। আর যাই হোক জোর করে তো আর ভালোবাসা হয়না! আর আমি এই ভালোবাসা বাসির ক্ষেত্রে কাউকে জোর ও করতে চাইনা।”

পরের দিন বৌভাতের অনুষ্ঠান খুব ধুমধামভাবে পালন করা হলো। নীড় অগাধ টাকা খরচ করেছে তার রিসিপশানে! পাড়া-প্রতিবেশী হতে শুরু করে কাছের দূরের সমস্ত আত্নীয়-স্বজন, অফিসের বস, কলিগ, ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই আমন্ত্রিত ছিল তার এই মহা আলোড়িত রিসিপশানে। দিনটা খুবই হাসি খুশিতে উদযাপন করা হয়।

বিশেষ করে চাঁদ, নূর, মাহিন, তিথী, আয়মন, তাশফিয়া তারা খুব উপভোগ করেছে এই দিনটিকে। তবে সাদমান এটেন্ড ছিলনা রিসিপশানে! পাসপোর্ট এবং ভিসা নিয়ে ছুটোছুটিতে ছিল। যার কারণে জায়মারও ভীষণ মন খারাপ ছিল! অনুষ্ঠানের শেষে এবার নতুন বৌ এবং বরকে নিয়ে কুমিল্লা ফেরার পালা!

যদিও নীড়ের সাথে নূর এবং মাহিনের যাওয়ার কথা ছিল তবে এদিকটা সামলানোর জন্য তাদের আর কুমিল্লা যাওয়া হলোনা! নূর ভীষণ মন খারাপ করলেও চাঁদ নূরের সেই মন খারাপকে একরত্তিও প্রশ্রয় দিলোনা। উল্টো নূরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঢাকাতেই থাকতে বলল। অপারগ হয়ে নূর চাঁদের কথা মেনে নিলো। কঠোর মনে চাঁদকে বিদায় দিলো! চারিদিকে সন্ধ্যা নামতেই সবাই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। হলের যাবতীয় জিনিসপত্র আয়মন অনেক আগেই গাড়ি ভাড়া করে কুমিল্লা তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার শুধু তাদের কুমিল্লা পৌঁছার পালা।

কথায় আছে, “সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা।” সেই অনুরুদ্ধ স্রোতের তালেই ভেসে গেল মাঝখানে তিনটি বছর! সব আগের মত ঠিকঠাক থাকলেও সবক’টা সম্পর্কেই বেড়েছে নতুন করে টান, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা, কাছে আসা! নীড় এবং সোহানীর ভালোবাসা দিন দিন যেন বাড়ছে।

তাদের এক বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে সন্তানও আছে! যার নাম রাখা হয়েছে “আলভীন আবরার নিহাদ।” সবাই আদর করে তাকে নিদ বলে ডাকে। বিশেষ করে নূর নিহাদকে নিদ নামে ডাকতে বেশ পছন্দ করে! নিদ হয়েছে পুরো তার মায়ের মত! যেন মায়ের কার্বন কপি। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনি মায়াবী চেহারার গড়ন! নীড় যেন এই হিংসেতেই সারাক্ষণ জ্বলে! কেন তার ছেলে তার মত হলোনা?

কেন তার মায়ের মত হতে গেল? সাবরিনা আবরার তখন হেসে হেসে বলে, আরেহ্ বাপ এত কাঁদিস না তো। তোর যখন মেয়ে হবে ঠিক তোর মতই হবে দেখতে। এই কথায় সোহানী ভীষণ লজ্জা পেলেও নীড় মনে মনে বাঁকা হাসত! আসলেই তার এবার একটা তার মতই দেখতে ফুটফুটে মেয়ে চাই!

অনার্স এবং মাস্টার্স কমপ্লিট করে নূর এখন একটি বেসরকারি কলেজের অ্যাকাউন্টিং টিচার। সবেমাত্র চাকরীটা পেয়েছে সে। দু, তিন দফা ট্রেনিংয়ের পর চাকরীতে জয়েন করবে। এরজন্য মাস খানিক সময় তো লাগবেই। আয়মন তার বাবার বিজনেস দেখাশোনা করছে। বিজনেসের পুরো দায়ভার এখন তার উপরই রপ্ত। সবদিক সামলাতে সামলাতে আয়মন বেশ হিমশিম খেয়ে পড়ছে।

মাহিন এবং নীড় মিলে তাদের যৌথ উদ্যোগে নিজেদের একটি কনস্ট্রাকশন বিজনেস গড়ে তুলেছে। যার সমস্ত পুঁজি নীড়ের। দুই ভাই মিলে এখন দায়িত্ব নিয়ে সেই কনস্ট্রাকশন দেখাশোনা করছে। সাদমান আপাতত জর্ডান আছে। আগামী দশদিনের মধ্যেই তার দেশে ফেরার কথা। পরিবার থেকে তার জন্য মেয়ে দেখছে! দেশে ফিরলেই তার ধুমধাম করে বিয়ে দিবে বলে দিবাস্বপ্ন দেখছে তার পরিবার!

চাঁদ, জায়মা, তিথী এবং তাশফিয়া অনার্স প্রায় কমপ্লিট করার পথে। পরীক্ষা দিয়েছে একমাস আগে এবার কেবল রেজাল্ট পাওয়ার অপেক্ষায়। প্রেমের দিক থেকে সবাই ষোলআনা পরিপূর্ণ থাকলেও জায়মার প্রণয় এখনো কারো সাথে হয়নি! সাদমান ছাড়া সে কাউকে তার মনে বসতে দেয়নি! এখনো ঠিক একইভাবে সাদমানকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে যাচ্ছে সে৷ সাদমান যদি তার না ও হয় তবুও তার কোনো আক্ষেপ নেই! কুমারী হয়েই গোটা জীবন কাটিয়ে দিবে! যদিও পরিবার চাইবেনা তবে তার ইচ্ছেই যেন এটা।

তাশফিয়ার জন্য বিভিন্ন ভালো ভালো জায়গা থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে! যার আভাস আয়মনের কানে অনেক আগেই পৌঁছেছে। আয়মনও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে তাশফিয়াকে বিয়ে করার। পরিবারকে তাশফিয়ার কথা বলার। পড়াশোনা শেষে এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সে। বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে।

এবার তার আর কোনো অজুহাত নেই। থাকার কথাও না। তাই পরিবারের তরফ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর চেষ্টা করছে আয়মন। যদিও তাশফিয়ার মা মনে মনে আয়মনকে জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছে! তবুও আয়মনের পরিবার থেকে প্রস্তাব আসার অপেক্ষা করছে!

তিথীর পরিবার এইতো কিছুদিন হলো মাহিনের কথা জেনেছে। যখন তিথী তার তিন নম্বর বিয়েটা ভেঙেছে! জামাই হিসেবে মাহিনকে তাদের সবার বেশ পছন্দ হয়েছে। যদিও তাদের এক্সপেকটেশন ছিল আরও উপরে! তবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে এবং মাহিনের দিকটাও বিবেচনা করে মেয়ের আবদারকে তারা মেনে নিয়েছে। এবার মাহিন তার পরিবার নিয়ে যেদিন বিয়ের কথা বলতে আসবে সেদিনই তারা বিনা দ্বিধায় মেয়েকে মাহিনের হাতে তুলে দিবে!

চাঁদ এবং নূরের বিয়ে তো সেই তিনবছর আগে থেকেই ফিক্সড করা আছে। শর্তানুযায়ী নূরের চাকরী পাওয়ার পর পরই তাদের বিয়ে হওয়ার কথা৷ নূরও এখন চাকরী পেয়ে গেল। এবার শুধু ভালো দিন ক্ষণ দেখে বিয়ে দেওয়ার পালা। নূর এবং চাঁদের ভালোবাসা দিন দিন মাখোমাখো হচ্ছে। দিনরাতের বেশিরভাগ সময় জুড়ে তাদের ফোনে কথা চলে। ফোন করলে কিছুতেই ছাড়তে চায়না নূর। চাঁদকে বিরক্ত করে এরপর ছাড়ে। সারাক্ষণ ভিডিও কলে থাকে। নূরের অতিরিক্ত ভালোবাসায় চাঁদ বিরক্ত হয়ে উঠছে! সেই বিরক্তির মাঝেও একপ্রকার সুখ খুঁজে পাচ্ছে!

আজ সকাল হতেই নূর শাওয়ার নিতে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে! ভোর সাতটা থেকেই তার বড্ড তাড়াহুড়ো। এই সাত সকালে সে রুমের লাইটটাও জ্বালিয়ে রেখেছে। যার সাথে সাথে মাহিনের ঘুমেরও বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে! কোনোরকমে শাওয়ার নিয়ে নূর ভেজা চুলে রুমে প্রবেশ করল।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত দ্বারা চুল ঝাড়তে লাগল৷ ব্যস্ত ভঙ্গিতে টাওয়াল দ্বারা ভেজা গাঁ মুছতে লাগল। অমনি চুলের পানি এসে মাহিনের আপাদমস্তকে পড়ল! ঝট করে চোখ মেলে তাকালো মাহিন। রাগে গটগট করে তেজর্শী দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। চোয়াল শক্ত করে শুধালো,,

“এই কী হইছে রে তোর? সাত সকালে কী শুরু করলি? ঘুমাতে দিবি না নাকি?”
ঘুমেসিক্ত ফোলা ফোলা চোখে নূর অবিন্যস্ত দৃষ্টি ফেলল মাহিনের দিকে। টাওয়াল দ্বারা চুলগুলো মুছে বলল,,
“কুমিল্লা যাব। একটু কাজ আছে।”
মাহিন হামি তুলল। পুনরায় চোখ বুজার বন্দোবস্ত করল। আলসেমি গলায় বলল,,

“কী কাজ?”
“আজ পাগলীটার জন্মদিন!”
কথাটা বলেই নূর আনমনে হেসে দিলো! চাঁদকে অনুভব করতে লাগল। মাহিন ধড়ফড়িয়ে বসা থেকে উঠল। ঘুম যেন নিমিষেই তার চোখ থেকে উড়ে ফুড়ে গেল! পূর্ণদৃষ্টি মেলে বেগময় গলায় বলল,,
“আমি যেতে পারব?”

নূর ভ্রু কুঁচকালো। হাতে থাকা টাওয়ালটা মাহিনের মুখের উপর ছুড়ে মারল। বুকে হাত গুজে ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন? তিথীর সাথে দেখা করার এত শখ?”
স্মিত হেসে মাহিন মাথা ঝাঁকালো। পেছনের চুলগুলো টেনে বলল,,
“ঐ আর কী!”

“দেখা করার এত শখ থাকলে সিঙ্গেলে গিয়ে দেখা কর। কাবাব মে হাড্ডি নিতে পারবনা আমি!”
মাহিনকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে দিয়ে নূর হাত দ্বারা চুল ঝেড়ে আলমারিটা খুলল। কালো রঙের একটি শার্ট বের করল। পুনরায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো। মাথাটা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,

“জানি পাগলীটা খুব রাগ করে আছে। হয়তো ভাবছে আমি তার জন্মদিনের কথা ভুলেই গেছি! তাকে সারপ্রাইজ দিব বলেই তো তাকে সাময়িক কষ্ট দেওয়া। যখনি সারপ্রাইজটা পাবে তখনি সে সব কষ্ট ভুলে যাবে।”

আজ সকাল থেকেই চাঁদ বেশ তেজ ঝাল করছে! বাড়ির সবার সাথে কেমন ঝাঁজ দেখিয়ে কথা বলছে। সকালের নাশতাটাও অবধি করেনি সে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় রণরঙ্গিণী হয়ে বসে আছে। অবাধ্য দৃষ্টি ফেলে কেবল হাতের কাছে থাকা ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকাচ্ছে! গতকাল রাত থেকে নূরের কোনো খবর নেই।

না করছে ফোন না করছে মেসেজ। ফেসবুকেও তেমন এক্টিভ নেই! তার ইনবক্সে ফ্রেন্ডরা মিলে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তাকে ট্যাগ করে পোস্টও করছে। তবে নূরের কোনো খবর নেই। বাড়ির প্রত্যেকেও চাঁদকে উইশ করে গেছে। তিথী, তাশফিয়া, জায়মা সবাই চাঁদকে সারপ্রাইজ দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে। আয়মন অলরেডি জন্মদিনের কেক অর্ডারও করে ফেলেছে। রাতে মহা সেলিব্রেশন হবে বাড়িতে!

সকাল ঠিক দশটা বাজতেই চাঁদ তার ফোনটা বন্ধ করে দিলো! ফুপিয়ে কেঁদে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল তার। নূরের থেকে এতটা অনীহা আসে করেনি সে! গত তিনবছর ধরে নূর রাত বারোটা বাজতেই সবার আগে তাকে বার্থডে উইশ করত৷ তবে এবার তার কাজের চাপ এতটাই বেড়ে গেল যে চাঁদের জন্মদিনের কথা সে দিব্যি ভুলে গেল?

এভাবে জমাট বাঁধতে থাকা মান অভিমান নিয়ে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গেল৷ বাড়ির কারো হুমকি ধামকি শুনেও চাঁদ রুমের দরজা খুলেনি! সকালের নাশতাটাও খায়নি এমনকি দুপুরের খাবারও না! এরমধ্যেই দরজার বাইরে থেকে জায়মার উত্তেজিত গলার স্বর ভেসে এলো। দরজায় সশব্দে টোকা মেরে বলল,,

“এই চাঁদ দরজাটা খোল। নূর ভাইয়া ফোন করেছে!”
ছটফটিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে এলো চাঁদ। অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে দ্রুত পা ফেলে রুমের দরজাটা খুলে দিলো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করেই সে ঝট করে জায়মার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো। উড়নচণ্ডী ভাব নিয়ে ফোনটা কানে তুলে নিলো। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“এই তুই ফোন করছস কেন হ্যাঁ? ফোন করছস কেন?”
চাঁদের রূঢ় প্রতিক্রিয়া দেখে নূর মুখ চেপে হাসল। বাইক থেকে নেমে বাইকের চাবিটা হাতে তুলে নিলো। ঘামে সিক্ত শার্টের কলারটা বাম হাত দ্বারা ঝাঁকালো। রোদের কড়া ঝাঁজে নূর অবিলম্বেই মুখটা কুঁচকে নিলো। রুক্ষ গলায় বলল,,
“ফোন দিছিলাম কেমন আছো জানতে। এর জন্য এত হাইপার হওয়া লাগে?”

চাঁদ মনে মনে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। নূর এখনো তার জন্মদিনের কথাটা মনে করতে পারলনা ভেবে তার কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আসছিল। নাক টেনে সে ভরাট গলায় বলল,,
“না। তোর ফোন দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আর কখনো কল করবিনা আমাকে। কোনো খোঁজ খবরও নিবিনা আমার।”

“ওহ্ আচ্ছা। তার মানে তুমি ব্রেকাপ করতে চাইছ? বলা নেই কওয়া নেই হুট করে ব্রেকাপ করতে চাইছ?”
ব্রেকাপের কথাটা শুনতেই চাঁদের বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল। মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে সে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। অমনি নূর নিমগ্ন গলায় চাঁদকে বলল,,
“বাড়ির মেইন গেইটে একটু তাকাও।”

অবাক হলো চাঁদ। মুখমণ্ডল খরতর ভাবে কুঁচকে দূরদৃষ্টিতে বাড়ির মেইন গেইটের দিকে তাকালো। অমনি তার মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেল! চোখে মুখে ফুটে উঠল অনাবিল খুশির ঝলক। হাতে বড়ো বড়ো চারটি বেলুন এবং এক গুচ্ছ কাঠ গোলাপ নিয়ে নূর মিষ্টি হেসে চাঁদের দিকে তাকালো। মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে ইশারায় বলল,,

“সরি।”
চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। মুখ লুকিয়ে বলল,,
“বাড়ির ভেতরে আসুন।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৩

“উঁহু। আজ আর ভেতরে আসছিনা! আয়মনকে দিয়ে তোমার জন্য শাড়ি, চুরি, আলতা, গাজরা, কানের দুল পাঠিয়েছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে এসো। আজ রোদে দাঁড়িয়ে আমি আমার প্রিয়তমার জন্য অপেক্ষা করব!”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৫