প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৫

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৫
নিশাত জাহান নিশি

“উঁহু। আজ আর ভেতরে আসছিনা! আয়মনকে দিয়ে তোমার জন্য শাড়ি, চুরি, আলতা, গাজরা, কানের দুল পাঠিয়েছি। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে এসো। আজ রোদে দাঁড়িয়ে আমি আমার প্রিয়তমার জন্য অপেক্ষা করব!”

মিষ্টি হাসল চাঁদ। সরলরৈখিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একধ্যানে তাকিয়ে রইল ক্লান্ত, শ্রান্ত এবং নিস্তেজ চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা ঘামেসিক্ত নূরের দিকে। প্রেমটা যেন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল তার! কীভাবে পারছে এই কাঠ ফাঁটা রোদের মধ্যে এতগুলো ঘণ্টা বাইকে জার্নি করে এসে সেই তেজর্শী রোদের মাঝেই এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এবার তো তাকে এভাবে আরও ঘন্টা খানিক দাঁড়িয়ে থাকতে হবে! চাঁদের রেডি হয়ে বের হতে হতে ঘণ্টা খানিক সময় তো লাগবে-ই। ভাবতেই বুকটা অস্থিরতায় কাঁপতে লাগল চাঁদের। টুপ করে মিষ্টি হাসি মিইয়ে গেল ঠোঁটের কোণ থেকে। ব্যাকুল হয়ে উঠল প্রফুল্লিত মুখ খানি। দৃষ্টি জোড়া নিঃসংকোচে সংকুচিত হয়ে এলো। উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,,

“না। আপনাকে এভাবে আর রোদে দাঁড়িয়ে থেকে কাঠ হতে হবেনা। ভেতরে আসুন। দেখছেন তো বাইরে কী রোদ পড়েছে? এমনিতেই কত কষ্ট করে বাইক চেপে সেই সুদূর ঢাকা থেকে এসেছেন। এখন আবার আরও ঘণ্টা খানিক এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাড়াতাড়ি ভেতরে আসুন বলছি।”

বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো নূর। ঘর্মাক্ত শার্টের কলারটা এক ঝটকায় পেছনের দিকে এলিয়ে দিলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে চাঁদের দিকে মগ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ঠোঁটের আলিজে মলিন হাসি ফুটিয়ে বলল,,

“এতটুকু ধকল যদি সহ্য করতে নাই পারি তবে ভালো কেন বেসে ছিলাম বলো? প্রেমে পড়লে মানুষ নিজের দিকটা কখনো চিন্তা করে দেখেনা। যার প্রেমে পড়ে শুধু তার মাঝেই ডুবে থাকে! শুধু তার কথাটাই চিন্তা করে। আমি তো সেই অনেক আগেই তোমার প্রেমে ডুবে ম’রে’ছি চাঁদপাখি। এখন এই রোদ আমার কিছু করতে পারবেনা! এত শত কথা না বলে তুমি কুইকলি রেডি হয়ে বের হয়ে এসো তো। আমি অপেক্ষায় আছি।”

মুখটা ফুলিয়ে নিলো চাঁদ। নূরের দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চাঁদের রাশভারী মুখভঙ্গি দেখে নূর স্মিত হাসল। দ্রত গলায় বলল,,
“আরে যাও যাও। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এসো তো।”

রাগে চাঁদ পা ঝাড়লো! মুখটা বাঁকা করে পিছু ঘুরতেই আয়মন হাসিমুখে দুটি শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে চাঁদের রুমে প্রবেশ করল। দ্রুত পা ফেলে চাঁদ আয়মনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। ফোনটা কেটে বিছানার উপর ছুড়ে মারল। কোমরে দু’হাত গুজে শানিত দৃষ্টিতে আয়মনের দিকে তাকালো। কর্কশ গলায় শুধালো,,

“এই তুমি নূর ভাইয়াকে এই রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে চলে এলে? ভেতরে আসতে বললে না?”
আয়মন মুখ টিপে হাসল। চাঁদের উদ্বিগ্নতা দেখে চাঁদকে একটু বেশি করেই তার রাগাতে মন চাইল। মুখভঙ্গি পাল্টে ব্যঙ্গ করে বলল,,

“আহা কী দরদ গো! জামাই না হতেই এত দরদ হ্যাঁ? ভাইকে ঝাড়ি দিচ্ছিস হবু জামাইয়ের জন্য?”
“এই রোদের মধ্যে যদি তাশফিয়া এভাবে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত না? তবে বুঝতা কেমন লাগে। এখন তো বুঝবা না। কারণ, এখন তো তাশফিয়ার জায়গায় অন্য কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ নিজের না হলে পরেরটা তেমন বুঝে-না।”

অগ্নিশর্মা হয়ে চাঁদ শ্লেষাত্মক হাসতে থাকা আয়মনকে ঠেলেঠুলে রুম থেকে বের করে দিলো! বিপরীতে কোনো কথা বলার সুযোগ-ই দিলো না আয়মনকে। ড্রয়িং রুম থেকে জায়মাকে টেনেটুনে চাঁদ তার রুমে নিয়ে এলো। ভেতর থেকে দরজার খিলটা আটকে অধীর দৃষ্টিতে বেলকনি দ্বারা বাড়ির মেইন গেইটে তাকালো। নূর এখনো সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে!

বাইকের সাথে হেলান দিয়ে সময় কাটানোর জন্য ফোনে স্ক্রলিং করছে। কিয়ৎক্ষণ পর পর কপালে এবং সমস্ত মুখে জমতে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম গুলোকে মুছে নিচ্ছে! তবুও যেন চেহারায় কোথাও কোনো বিরক্তির ছাপ নেই! সবকিছু তার কাছে চিরাচরিতভাবে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

শুধু মলিনতা ছড়িয়ে পড়ছে শুভ্র রঙের মুখটিতে। এসব দেখে চাঁদের মাথা আরও গরম হয়ে গেল! মনটা কেমন খারাপ করতে লাগল। ঝট করে সে গাঁ থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নিলো। ব্যস্ত স্বরে জায়মাকে বলল,,
“এই জায়মা শোন? জাস্ট আধঘণ্টার মধ্যেই আমাকে রেডি করিয়ে দিবি ওকে? বাইরে নূর ভাইয়া অপেক্ষা করছে। এই কাঠ ফাঁটা রোদের মধ্যে।”

জায়মা শপিং ব্যাগ দুটোকে অতি মনোযোগের সহিত ঘাটতে লাগল। কালো রঙের সফট সুতির কাপড়টি হাতে নিতেই জায়মা মুখটা হা করে নিলো! মুগ্ধিত স্বরে বলল,,
“আরেব্বাস! কী সুন্দর রে কাপড়টা চাঁদ। তোর গাঁয়ে রঙে একদম ফুটে থাকবে। কী যে সুন্দর লাগবে আজ তোকে। নূর ভাইয়া শুধু ড্যাব ড্যাব করে তোর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আবার নতুন করে তোর প্রেমে পড়বে।”

চাঁদ ক্রমশ উতলা হতে লাগল। নূরের চিন্তায় তার গাঁ থেকে একপ্রকার ঘাম ঝরছিল! অতো শত দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই তার। জায়মার কথা একদণ্ডের জন্য কানে তুলল না সে। আলমারি থেকে একটি কালো রঙের ব্লাউজ এবং পেটিকোট বের করল। গাঁ থেকে জামাটা ছেড়ে ব্লাউজটা গাঁয়ে পড়ে নিলো। বেগবান গলায় বলল,,

“উফফ। এত পাকাস না তো জায়মা। সুন্দর অসুন্দর এসব পরে দেখা যাবে। এখন তাড়াতাড়ি করে আমাকে রেডি করিয়ে দে তো। মানুষটা এই রোদের মধ্যে এখনো একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জন্ডিস টন্ডিস হয়ে গেলে তখন? উফফ আমার একটা কথাও শুনবে না এই লোকটা। ঘাড় ত্যাড়া হয়েছে একদম আমার মতই! নতুন করে আবার প্রেম দেখাতে আসছে। ঢঙ যতসব।”

রাগে রি রি করে চাঁদ নূরকে ইচ্ছে মতো ঝাড়তে লাগল। চাঁদকে কাপড় পড়াতে পড়াতে জায়মা মিটিমিটি হাসতে লাগল। এটা সেটা বলে চাঁদকে আরও উস্কে দিচ্ছিল! জায়মার ইন্ধন পেয়ে চাঁদ আরও বেশি করে নূরকে ঝাড়তে লাগল! এসবে জায়মা বেশ মজা নিচ্ছিল! তবে মাঝে মাঝে চাঁদ এবং নূরের ভালোবাসা দেখলে তার বড্ড হিংসে হয়!

কীভাবে পারে কেউ কাউকে এতটা গভীরভাব ভালোবাসতে? এখনকার স্বার্থপর যুগে কী আদো কেউ কাউকে এতটা নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে? নূরের ভালোবাসার সত্যিই কোনো তুলনা হয়না। জায়মার চোখে নূর প্রেমিক পুরুষ হিসেবে সেরা। যার জুড়ি মেলা ভার। ভাগ্য করে চাঁদ নূরকে পেয়েছে।

সেই ভাগ্য সবার হয়না। জায়মার ভাগ্যে ও হয়তো এমন কেউ নেই। যে জায়মাকে এতটা সূক্ষ্মভাবে, একান্তভাবে ভালোবাসতে পারবে! অথচ জায়মা সেই একজনকে গোটা তিনটি বছর যাবত নিরলসভাবে ভালোবেসে যাচ্ছে! সেই মানুষটি আদোতে জানেও না কেউ তাকে দূর থেকে এতটা প্রগাঢ়ভাবে ভালোবেসে আসছে। হয়তো কখনও জানতেও পারবেনা! আর জানার তো কথাও নয়! জায়মা তো কখনো সেই মানুষটার কাছে ভালোবাসার আর্জি নিয়ে যায়নি! হয়তো কখনও যাবেও না!

নূরকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আয়মন রোদে পুড়তে নূরের কাছে গেল! দুই বন্ধু একসাথে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মন খুলে গল্পগুজব, আড্ডা সাড্ডা দিতে লাগল। ক্লান্তি দূর করার জন্য নূর প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের একটি প্যাকেট বের করল। অমনি আয়মন চক্ষুজোড়া ছানাবড়া করে ফেলল। উত্তেজিত গলায় বলল,,
“এই কী করছিস কী তুই? নিজের এলাকা ভাই। মানসম্মান খোয়াবি নাকি?”

“এটা তোর এলাকা ওকে? আমার না! এট অ্যানি কস্ট সিগারেট একটা ধরাতেই হবে। অনেকক্ষণ যাবত ধৈর্য্য ধরে আছি ভাই। আর সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া তোর বোন সাথে থাকলে আরও আগে খেতে পারবনা! মাথার চুল একটাও মাথায় রাখবেনা!”

আয়মন ফিক করে হেসে দিলো। বুকে হাত গুজে বলল,,
“আচ্ছা খা। তবে সাবধানে। কেউ যেন না দেখে।”
দুই ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেটটি রেখে নূর লাইটার দ্বারা সিগারেটটি ধরালো। এদিক ওদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে তাকিয়ে কেউ আছে কিনা দেখতে লাগল। রাস্তা- ঘাট আংশিক ফাঁকা হয়ে আছে। লোকজনের সমাগম ততটা চোখে পড়ার মত নয়। স্বস্তির শ্বাস ফেলল নূর। ব্যস্ত গলায় আয়মনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“বল তোর আর কী খবর? ভাবি কেমন আছে?”
“ভালোই আছে। আজ রাতে তো ওর এই বাড়িতে আসার কথা। চাঁদের বার্থডে পার্টি আছে।”
“তো বিয়ে শাদি কবে করবি? আঙ্কেল-আন্টি কিছু জানে এই ব্যাপারে?”

“না। এখনও ঐরকম ভাবে কিছু জানাইনি। তবে আশা আছে কয়েকদিনের মধ্যেই জানাব। বিয়ের বয়স তো আর কম হলোনা। ঐদিকে তাশফিয়ার বাড়ি থেকেও বিয়ের চাপ আসছে। দেখি কী হয়।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ জানা। কয়েকদিনের মধ্যেই জানা। এভাবে ঝুলে থেকে কী লাভ বল? এখন তো তোর নিজেরও একটা বিজনেস আছে। ওয়েল স্যাটেল্টড। তো আর সমস্যা কী?”

“হুম সেটাই। তো তোর কী খবর বল? তুই কবে বিয়ে করছিস?”
“ট্রেনিংটা আগে দিয়ে আসি। মাস দুয়েক সময় তো লাগবেই। ভাবছি আমরা তিনজন মিলে একসাথে বিয়ে করব। তুই, আমি, মাহিন! ব্যাপারটা কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। কী বলিস?”
আয়মন হঠাৎ উৎকণ্ঠিত গলায় বলে উঠল,,

“আর সাদমান?”
সিগারেটে ফুঁক দিতে গিয়েও নূর থেমে গেল! আয়মনের দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিয়ৎক্ষণ মৌন থেকে অতঃপর গলায় স্বাভাবিকতা এনে বলল,,
“সাদমানের বিষয়টাও আমার ভাবা আছে। শা’লা দেশে ফিরুক। ধরে বেঁধে জায়মার সাথে বিয়েটা পড়িয়ে দিব! বিয়ের পর প্রেম করবে সমস্যা কী?”

আয়মন গোলন্দাজ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ধরাশায়ী গলায় বলল,,
“কী বলছিস তুই এসব? জায়মা রাজি হবে তো?”
“হবে না কেন বল? যাকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
“তাই বলে জোর করে? জোর করা ভালোবাসা কে চায়?”

“কিছু কিছু ক্ষেত্রে জোর করেই ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়। এতে যদি পরে উভয় পক্ষেরই ভালো হয় এতে সমস্যা কী?”
আয়মন চিন্তিত হয়ে উঠল। কিয়ৎক্ষণ মনে মনে কিছু একটা ভাবল। নীরবতা ভেঙে নূরের সিদ্ধান্তকে মেনে নিলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“ভুল কিছু বলিস নি তুই। আসলেই বিষয়টা আমাদের ভেবে দেখা উচিৎ। আচ্ছা? সাদমানের পরিবারের সাথে আমরা কথা বলব? আই মিন পারিবারিকভাবে যদি বিয়েটা হয়! আমাদের জায়মা তো কোনদিক থেকেই ফেলে দেওয়ার মতো মেয়ে নয়। সাদমানের পরিবার তো এমনিতেও সাদমানের জন্য মেয়ে দেখছে। সাদমান আসার আগেই যদি পরিবারকে থেকে জায়মাকে ঠিক করে রাখা হয় তো কেমন হয় বিষয়টা?”

নূর ব্যগ্র হাসল। আয়মনের দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নাক-মুখ থেকে ধোঁয়া নির্গত করে বলল,,
“তোর কী মনে হয় হ্যাঁ? আমি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি? জায়মার বিষয়টা সাদমানের পরিবার জানে! আমিই তাদের এই বিষয়টা জানিয়েছি। তারা এখন মেয়ে দেখা বন্ধ করে রেখেছে। ছবিতে জায়মাকে দেখেছে। খুব পছন্দও করেছে। এবার শুধু সাদমান এলে এনগেজমেন্ট আর ধরে বেঁধে বিয়ে পড়ানোর পালা!”

নূরের চতুরতা দেখে আয়মন তব্দা লেগে গেল। সন্তুষ্ট হয়ে নূরের কাঁধে হাত রাখল। নূরের প্রশংসা পঞ্চমুখ হয়ে বলল,,
“তুই তো লাজবাব ভাই। ভেতরে ভেতরে সব সেটিং করে রেখেছিস? হ্যান্ডস অফ ইউ ব্রো!”
নূর উদাসীন ভাব নিলো। মুখটা উপুড় করে সিগারেট ফুঁকতে লাগল। রসালো গলায় বলল,,

“তোর বোনের থেকে এসব চালাকী শিখেছি রে ভাই! এই তিন বছরে আমাকে আরও ধূর্ত বানিয়ে ছেড়েছে। এই মেয়েটা আমার লাইফটা বদলে দিয়েছে জানিস? এত সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিয়েছে আমার জীবনটাকে! যা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো নয়। চাঁদকে পাওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত আমি কোনোকিছুতেই হারি নাই জানিস?

যে জিনিসটা ধরেছি ঠিক সেই জিনিসটাতেই সফল হয়েছি। হারতে শিখি নি। না হয় কে জানত বল? কোনো ইম্প্রুভমেন্ট ছাড়াই অনার্স মাস্টার্স কমপ্লিট করা হয়ে যাবে আমার? মাসখানেকের মধ্যে চাকরী বাকরীও পেয়ে যাব? ভাগ্য আপনাআপনি খুলে যাবে? সে আমার জন্য দো’য়া জানিস? আমার সমস্ত বেস্ট উইশেস। আমার ইন্সপিরেশন! যার প্রতিটা পদক্ষেপে আমি ইন্সপায়ারড হয়েছি। তার জন্যই আজ আমার এতকিছু।”

আয়মন মুগ্ধ হলো নূরের প্রতিটি কথায়। ম্লান হেসে নূরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। শৃঙ্খল শ্বাস ফেলে শূণ্য গলায় বলল,,
“জানিনা আমি তোর মতো করে তাশফিয়াকে ভালোবাসতে পেরেছি কিনা। তবে মন থেকে আমি তাকে অনেক ভালোবাসি! অনেক বলতে অনেক। যার পরিমাপ হয়না। বলতে গেলে তাশফিয়াও আমার জন্য একটা ইন্সপিরেশন। ভাগ্যটা বদলানোর উপায়। খুব শীঘ্রই আমি তাকে বিয়ে চাই জানিস? তার মত এত ভালো একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।”

দুই বন্ধু মিলে নিজেদের মনের গোপন কথাগুলো নিঃসংকোচে খুলে বলতে লাগল। গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসল যেন! এভাবে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল৷ ঠিকঠাকভাবে সেজেগুজে চাঁদ আয়নার দিকে না তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। বের হওয়ার সময় শুধু সামিয়া আহমেদকে বায় বলে চলে এলো।

পেছন থেকে তিনি আর চাঁদকে ডাকলেন না। শুধু মন ভরে মেয়ের জন্য দোয়া করলেন। চাঁদকে এগিয়ে দিতে চাঁদের পিছু পিছু জায়মাও বাড়ির মেইন গেইট অবধি চলে এলো। চাঁদকে কতটা সুন্দর লাগছে তার প্রশংসা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলল! চাঁদ আছে যত রাজ্যের পেরেশানির মধ্যে। নূরের কষ্ট তার সহ্য হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে নূর নয় সে-ই এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। যার দরুন তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!

মেইন গেইট থেকে বের হয়ে চাঁদ রাস্তায় পা বাড়ালো। অমনি নূরের আচম্বিত দৃষ্টি পড়ল চাঁদের দিকে। তৎক্ষনাৎ জায়গা থেকে নড়েচড়ে দাঁড়ালো নূর। দৃষ্টি জোড়ায় অপার মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল তার! সমস্ত ক্লান্তি যেন নিমিষেই বিনাশ হয়ে গেল। চোখের সামনেই ফুটন্ত কালো গোলাপ দেখতে পেল!

যার সুমিষ্ট ঘ্রাণ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা নূরের নাক অবধি ভেসে আসছিল! বুকটা অস্বাভাবিক ভাবেই কাঁপতে লাগল তার। বুকের ছাতি যেন ফেটে যাচ্ছিল। অনুভূতিরা শতদল প্রজাপতির রূপ নিলো। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করতে লাগল। সম্মোহিত হয়ে পড়ল নূর চাঁদের মোহময়ী রূপে। নূরের বেখবর অবস্থা দেখে আয়মন পাশ থেকে নূরকে কনুই দ্বারা ধাক্কা মারল। গলা ঝেড়ে বিড়বিড় করে বলল,,

“ভাই হইছে এবার। চোখটা সরা। ফিট খেয়ে যাবি মনে হচ্ছে!”
আয়মনের কনুইয়ের ঝাঁকুনি খেয়ে বহুকষ্টে হুশ ফিরল নূরের। মাথা ঝাকিয়ে সে রাস্তা পাড় হয়ে আসা উত্তেজিত চাঁদের দিকে তাকালো। দৌঁড়ে এসে চাঁদ নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখে-মুখে প্রখর উদগ্রীবতা ফুটিয়ে তুলল। উতলা হয়ে পার্স থেকে একটি টিস্যু পেপার বের করল। সাত পাঁচ না ভেবে চাঁদ নূরের কপালে জমতে থাকা ঘামগুলো মুছতে লাগল। উদ্বেগী গলায় বলল,,

“কী দরকার ছিল হ্যাঁ? রোদের মধ্যে এখানে এসে দাঁড়ানোর? নতুন করে ভালোবাসা দেখানোর কী আছে বলুন? আমি মনে হয় জানিনা আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন?”
গলা ঝাকালো আয়মন। মুখ টিপে হেসে নিচু স্বরে বলল,,
“আচ্ছা আমি আসছি। কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থেকে লাভ নেই। সাবধানে যাস তোরা কেমন? কোনো প্রয়োজন হলে ফোন করবি ওকে? বায়।”

নূর এবং চাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে আয়মন জায়গা পরিত্যাগ করল। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জায়মার কাঁধে হাত রেখে দুই ভাই-বোন মিলে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। চাঁদ এখনো তীব্র মনোযোগের সহিত নূরের মুখে উদয়মান ঘামগুলো মুছতে লাগল। চাঁদের পেরেশানি দেখে নূর মলিন হাসল। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আচ্ছা হইছে তো। এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? মুখটা ফুলিয়ে রাখলে এত সুন্দর সাজটা কি দেখা যাবে বলো?”
“আমি এখানে আপনাকে সাজ দেখাতে আসি নাই। আপনার সাথে থাকতে এসেছি। যার সাথে থাকব তার ভালো-মন্দের খেয়াল রাখবনা?”

চাঁদের হাত থেকে টিস্যু পেপারটি কেড়ে নিলো নূর। শার্টের কলার ঝেড়ে একগুঁয়ে গলায় বলল,,
“অনেক খেয়াল রাখা হইছে। এবার চলো।”
চাঁদকে জোর করে বাইকে বসিয়ে দিলো নূর। বাইকের হ্যান্ডেলে থাকা বেলুনগুলো এবং কাঠ গোলাপগুলো চাঁদের হাতে ধরিয়ে দিলো। ব্যস্ত স্বরে বলল,,

“আমি কিন্তু এখনো তোমাকে বার্থডে উইশ করি নাই। এই নিয়ে আবার মুখ ফুলিয়ে রেখো না প্লিজ। সময় হলে আমি নিজেই করব ওকে?”
ফুলগুলো হাতে নিয়ে চাঁদ মৃদু হাসল। নূরের দিকে প্রেমময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আবিষ্ট স্বরে বলল,,
“আপনি এসেছেন এই অনেক। আমার আর আলাদা করে বার্থডে উইশ টুইশ লাগবেনা। আপনি নিজেই তো হলেন আমার জীবনের সবচেয়ে বিগ উইশ। এরপরে আর কী উইশ চাই আমার হ্যাঁ?

“ইশশ! এটা রাস্তা না হলে এক্ষণি টুপ করে তোমার কপালে একটা চুমু খেয়ে দিতাম! এত সুইট কেন তুমি হ্যাঁ? এসব বলে বলে প্রেমটা আরও বাড়িয়ে দাও। দিন দিন মজনু হয়ে যাচ্ছি আমি তোমার প্রেমে!”
চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো। আহ্লাদি হয়ে নূরের নাক টেনে দিলো। হেয়ালী স্বরে বলল,,
“আচ্ছা হইছে অনেক। এবার বাইকটা ছাড়ুন।”

বিপরীতে আদুরে হয়ে নূরও চাঁদের গাল টেনে দিলো। শার্টের হাতজোড়া ভাঁজ করে বাইকে ওঠে বসল। প্রশান্তির ঠায় হিসবে চাঁদ পেছন থেকে নূরকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরল। চাঁদের অভয় পেয়ে নূর যেন বল পেল! প্রাণোচ্ছ্বল হেসে অতি দ্রুত বাইকটা ছেড়ে দিলো। নূরের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চাঁদ পরম শান্তিতে চোখ জোড়া বুজে নিলো। জিজ্ঞাসু গলায় বলল,,

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“রিসোর্টে।”
“রিসোর্টে কেন?”
“সারপ্রাইজ!”
“আর কত সারপ্রাইজের বাকি আছে জনাব? তিন বছর ধরে তো শুধু সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছেন।”

“গোটা জীবন ধরে সারপ্রাইজ দিয়ে যাব। যতদিন থাকবে এই দেহে প্রাণ।”
“একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?”
“কী?”
“আজ আমরা ম্যাচিং ম্যাচিং!”
“হ্যাঁ জানেমান৷ ম্যাচিংটা তো আমি নিজেই করলাম!”
“কালো রঙে আপনাকে খুব সুন্দর মানায়।”

“তোমাকেও। ব্ল্যাক রোজ মনে হচ্ছে।”
“আর আপনাকে চকলেট বয়! আজ কত মেয়ের মাথা ঘুরাবেন হ্যাঁ?”
নূর হু হা শব্দে হেসে দিলো। হেসে হেসেই বলল,,
“আর কারো মাথা ঘুরাতে চাইনা। তোমার মাথা ঘুরলেই হবে।”
“আমার মাথা তো সেই প্রথম দেখাতেই ঘুরিয়ে দিয়েছেন জনাব! এখনও তার রেশ কেটে বেরুতে পারিনি। আহা সেই নীল চোখ। এখনও কাছে থেকেও টানে আমায়।”

তৃপ্তির হাসি হাসল নূর। চাঁদকে রাগানোর ফন্দি আটল। হেয়ালী স্বরে বলল,,
“রেশ কাটানোর ইচ্ছে টিচ্ছে আছে নাকি আবার?”
পূর্বের তুলনায় নূরকে আরও জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরল চাঁদ। তব্ধ শ্বাস ফেলে মসৃণ গলায় বলল,,
“উঁহু। আমি চাই আপনাকে পাওয়ার রেশটা আমার আজন্ম বেঁচে থাকুক। আফটার অল কিছুদিন পরেই আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। আজন্মের জন্য এক হতে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা শোনো না? তুমি কি বিয়ের পরেও আমার সাথে হুটহাট রেগে যাবা? তুই তুকারি করবা? চোখ লাল করে আমার দিকে তেড়ে আসবা? গলা টিপে ধরবা? এত যে রাগ দেখাও কবে যে আমার গলা টিপে মে’রে ফেলো কী জানি! তখন কিন্তু আমাদের আর আজন্ম পাশে থাকা হবেনা। তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে চাঁদ। তখন মৃ’ত্যু নিয়েও আমার আফসোস হবে! অথচ মৃ’ত্যুর মত চিরন্তন সত্য পৃথিবীতে আর কিছু নাই।”

চাঁদ চুপ করে রইল। নীরবতায় নিজেকে ধাতস্থ করল। মনটা বড্ড উচাটন হয়ে উঠল তার। সত্যিই চাঁদ খুব রাগ দেখায় নূরের উপর৷ মাঝে মাঝে তো গলা টিপেও ধরে! যখন রাগটা সে কন্ট্রোল করতে পারে না তখনই এতটা পাষণ্ড রূপ নেয়। তখন কোনো দিকে জ্ঞান না থাকলেও পরে ঠিকই আফসোস হয় তার। ভেতরে ভেতরে খুব অনুতপ্ত বোধ করে। চাঁদের মৌনতা দেখে নূর ফিচেল হাসল। নরম সুরে বলল,,

“আরে পাগলি। আমি তো মজা করছি। কেন মজাটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছ হ্যাঁ? মুড অন করো। তুমি জানো? তোমার জন্য আরও কত কত সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে?”
মৃদু হাসল চাঁদ। মন ভালো করে নূরের সাথে হেসে হেসে নানান কথা বলতে লাগল। কথাই যেন শেষ হচ্ছেনা তাদের। পথ ফুরাক বা না ফুরাক কথার ঝুড়ি তাদের ফুরাবেনা!

সন্ধ্যারাত। মাগরিবের আযান পড়েছে অনেক আগেই। ঘড়িতে এখন সাতটা কী আটটা চলমান। আহত নূরকে কেউ ধরে বেঁধে রাখতে পারছেনা! মাথা থেকে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তার! তবুও যেন অদম্য জেদ তার ক্ষান্ত হচ্ছেনা। বদ্ধ উন্মাদের মতো কেমন যেন করছে সে। শরীরের বেঁচে থাকা শক্তিটুকু দিয়ে সে পাশে থাকা মাহিন এবং আয়মনকে ঝেড়ে ফেলে দিলো! রুখে গেল সোহানীর দিকে! আঙুল তাক করে গরম দৃষ্টিতে সোহানীর দিকে তাকালো। মাথার চুলগুলো টেনে চোয়াল শক্ত করে বলল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৪

“তোমার বোনের কোনো দোষ নাই না? কোনো দোষ নাই? ঐ কু’ত্তা’র বা’চ্চাটা আমাকে আগে বলল না যে ঐ শু’য়’রে’র বাচ্চাগুলো তাকে বিরক্ত করছে? তাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে? এখন যদি তোমার বোনের কিছু হয়ে যায় তো আমি কী করব বলো? আমাকে কী করবা তোমরা? বলো বলো তাড়াতাড়ি বলো? কীভাবে শান্ত করবা আমাকে? আমাকেও কী তার মতো মাথায় বারি দিয়ে মে’রে ফেলবা? নাকি দেউলিয়া বানায়া ফেলবা কোনটা?”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৬