প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৬

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৬
নিশাত জাহান নিশি

“তোমার বোনের কোনো দোষ নাই না? কোনো দোষ নাই? ঐ কু’ত্তা’র বা’চ্চাটা আমাকে আগে বলল না কেন যে ঐ শু’য়’রে’র বাচ্চাগুলো তাকে বিরক্ত করছে? তাকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে? এখন যদি তোমার বোনের কিছু হয়ে যায় তো আমি কী করব বলো? আমাকে কী করবা তোমরা? বলো বলো তাড়াতাড়ি বলো? কীভাবে শান্ত করবা আমাকে? আমাকেও কী তার মতো মাথায় বারি দিয়ে মে’রে ফেলবা? নাকি দেউলিয়া বানায়া ফেলবা কোনটা?”

উপস্থিত সবাই হতভম্ব! বিস্ময়ের চরম শীর্ষে। এই বিধ্বস্ত নূরকে যেন কেউ চিনতে পারছেনা। এতটা রগচটা নূর কী করে হতে পারে? হিংস্রতা যেন তার আকাশ ছুঁইছে! বিশেষ করে সোহানী তার খেয়াল থেকে বের-ই হতে পারছে না। জীবনে এই প্রথমবার নূর এতটা রূঢ় আচরণ করছে তার সাথে!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

গলা উঁচু করে কথা বলছে, কোনোরকম নম্রতা ছাড়াই তার দিকে আঙুল তুলছে! চক্ষু জোড়া জল নিয়ে মাথা নুইয়ে নিলো সোহানী। বিপরীতে নূরকে কী বলবে তাই ভেবে পাচ্ছিলনা। নূরের বর্তমান ভয়াল অবস্থা দেখে সাবরিনা আববার কেঁদে কেটে নূরের কাছে এগিয়ে এলেন। ফুঁপিয়ে কেঁদে নূরকে ঝাকিয়ে বললেন,,

“শান্ত হ বাবা। প্লিজ শান্ত হ। নিজের দিকে একটু তাকিয়ে দেখেছিস? কীভাবে টপটপ করে রক্ত পড়ছে সারা শরীর বেয়ে? ট্রিটমেন্ট নিতে হবেনা তোর বল? চাঁদ যখন জ্ঞান ফিরে দেখবে তোর এই ভয়ঙ্কর অবস্থা। তখন চাঁদ কতটা কষ্ট পাবে ভেবে দেখেছিস?”

অকাতরে চোখের জল ছেড়ে দিলো নূর! আহত টগবগে রক্তিম চক্ষু জোড়ায় সাবরিনা আবরারের দিকে বিষাক্ত দৃষ্টি ফেলল। মুখমণ্ডলে ফুটিয়ে তুলল দারুন বিমূঢ়তার ছাপ। সামনের চুলগুলো টেনে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“আমার কিছু ভালো লাগছেনা মা। বিশ্বাস করো কিছু ভালো লাগছেনা। তাকে সারপ্রাইজ দিতে এসে যে তার এত বড়ো একটা ক্ষতি করে ফেলব বিশ্বাস করো মা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি তা। ভেতরটায় যে কী এক দুঃসহ যন্ত্রণা হচ্ছে কাউকে বুঝাতে পারছিনা মা। কী একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য থেকে যে চাঁদকে উদ্ধার করে আমি বেঁচে ফিরেছি তোমাদের তা বলে বুঝাতে পারবনা।”

বিভৎস রূপে নূর এক দৌঁড়ে চাঁদের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। চাঁদের বর্তমান অবস্থা সত্যিই খুব সূচনীয়! মাথায় এতটাই আঘাত পেয়েছে যে মাথার চারিপাশে বিভিন্ন জায়গায় সেলাই করতে হয়েছে! কপালেও আঘাতের নিশানা আছে। বাধ্য হয়ে মাথার বিভিন্ন জায়গার চুল ফেলে দিতে হয়েছে! অপারেশন শেষে চাঁদ এখন কেবিনে আছে।

ঘণ্টা খানিক বাদে বুঝা যাবে আসলেই তার কী কী ক্ষতি হয়েছে! মাথায় অতিরিক্ত ব্যান্ডেজ থাকার দরুন চাঁদের মুখটা সম্পূর্ণ রূপে বুঝা যাচ্ছেনা! নিস্তেজ মুখটা দূর থেকে একটুখানি ঠাওর করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন প্রাণহীন একটা দেহ পরকালের যাত্রায় বিছানায় লাশ হয়ে পড়ে আছে! অপেক্ষা যেন পরপাড়ে পাড়ি জমানোর!

জানালার থাই দ্বারা চাঁদের এই নিষ্ক্রিয় অবস্থা স্বচক্ষে দেখা মাত্রই যেন কান্নার স্রোত বেড়ে গেল নূরের! মাথায় হাত দিয়ে সে মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল। হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে মেঝেতে সজোরে আঘাত করতে লাগল। যন্ত্রনায় মৃদু চিৎকার করে বলল,,

“তুমি আগে কেন বললা না চাঁদ? ঐ ছেলেগুলো তোমাকে বিরক্ত করছিল? কেন বললা না তারা তোমাকে হুমকি দিচ্ছিল? তাহলে তো আজ আর এই দিনটা দেখতে হতো না। আমি আগে থেকেই কোনো একটা ব্যবস্থা করে রাখতাম। দুনিয়ার সব কথা তো আমার কাছে শেয়ার করো চাঁদ। এই কথাটা কেন শেয়ার করলা না বলো?”

নীড়, মাহিন, আয়মন এবং হাবিব আবরার এগিয়ে এসে নূরকে জোর জবরদস্তি করে পাশের কেবিনে নিয়ে গেল। ডক্টর ডেকে ক্ষত-বিক্ষত জায়গা গুলোতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। নূরের পাগলামি যেন বেগতিক বাড়ছিল। বাচ্চাদের মত সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল! মাথা চাপড়াচ্ছিল, হাত-পা কচলাচ্ছিল।

বদ্ধ উন্মাদের মত যা তা করছিল। আহাজারি যেন কমছিল না তার। ভেতরে বাহিরে সমান ভাবে তড়পাচ্ছিল সে। সবার মানসিক অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সামিয়া আহমেদ একবার জ্ঞান হারাচ্ছেন তো একবার জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন! উপস্থিত সবার অবস্থা দীর্ণ-বিদীর্ণ!

এরমধ্যেই হঠাৎ কয়েকজন পুলিশ ছুটে এলেন উপস্থিত সবার মাঝখানে! শঙ্কিত হয়ে তৎক্ষনাৎ যে যার জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। অমনি এদের মধ্যখান থেকে একজন পুলিশ অফিসার লাঠি ঘুরিয়ে নীড়ের দিকে এগিয়ে এলেন। তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“এখানে নূর কে?”
নীড় শার্টের কলার ঝাড়ল। নির্ভয় গলায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন? কী দরকার?”

“নূর আবরারের নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে! এক্ষণি আমাদের সাথে উনাকে জেলে যেতে হবে!”
উপস্থিত সবাই ঘাবড়ে গেল! মুখ হাত দিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। সাবরিনা আবরার মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলেন। ঘটনা কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে তাই যেন সবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। উদ্বিগ্ন হয়ে হাবিব আবরার পুলিশ অফিসারের দিকে তেড়ে এলেন। অমনি নীড় হাত দিয়ে হাবিব আবরারকে থামিয়ে দিলো! গলা ঝাকিয়ে শানিত গলায় অফিসারকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কিন্তু কেন স্যার? কী করেছে নূর?”
পুলিশ অফিসার দাঁতে দাঁত চাপলেন! লাঠি ঘুরিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললেন,,
“তিন তিনটি ছেলেকে বেধড়ক পিটিয়েছে! তারা এখান হসপিটালে ভর্তি। বাঁচবে কি-না কোনো শিওরিটি নেই! এই অবস্থায় আহতদের পরিবার নূর আবরারের নামে কঠোর এলিগেশন এনেছেন। তাই নূর আবরারকে এখন আমাদের সাথে হাজুতে যেতে হবে।”

পাশের কেবিন থেকে নূর সব শুনছিল। নিজেকে আর স্থির করে রাখতে পারলনা সে। মাহিন এবং আয়মনকে উপেক্ষা করে শো শো বেগে ছুটে এলো পুলিশ অফিসারের দিকে। মুখমণ্ডলে তুখোড় রাগান্বিত ছাপ ফুটিয়ে শার্টের হাতাগুলো ভাঁজ করে গরম দৃষ্টিতে পুলিশ অফিসারের দিকে দৃষ্টি ফেলল। কয়েক দফা বিশৃঙ্খল শ্বাস ফেলে ঝাঁঝালো গলায় বলল,,

“হ্যাঁ থানায় চলুন। আমারও একটা এলিগেশন আছে। যাদের হয়ে আপনি আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছেন না? তারা প্রত্যেকে মিলে আমার ওয়াইফকে অ্যাটাক করেছে! তাকে এতটাই পিটিয়েছে যে সে এখন ম’রা’র মত কেবিনে পড়ে আছে। কখন সেন্স ফিরবে, আদো ফিরবে কিনা তার কোনো গ্যারান্টি নেই। চলুন থানায় চলুন। আমিও কেস করব।”

পুলিশ অফিসার ব্যগ্র চাহনিতে নূরের দিকে তাকালেন। কিয়ৎক্ষণ সূচালো দৃষ্টিতে আগা গোঁড়া নূরকে প্রত্যক্ষণ করলেন। অতঃপর টিমদের ইশারা করে বললেন ঘটনা আদো সত্যি কি-না যাচাই বাছাই করতে। নূরের বলা সব সত্যি প্রমাণ হতেই অফিসার গলা ঝাকিয়ে বললেন,,

“এখন যাই হোক। আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে। উপর মহল থেকে নির্দেশ আছে। যেনো তেনো ছেলেফেলেদের কিন্তু পিটান নি আপনি! এলাকার মাথাওয়ালা ছেলেদের পিটিয়েছেন। যাদের খুব বড়ো বড়ো মানুষদের সাথে হাত এবং চলাফেরা। সাজা তো আপনাকে ভোগ করতেই হবে! আর আমাদেরও এখন দায়িত্ব পালন করতে হবে।”
হু হা শব্দে হেসে উঠল নূর! বাঁ পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো সে৷ বুকের উপর দু’হাত গুজে হেয়ালি স্বরে বলল,,

“কী অন্যায় করেছিল আমার ওয়াইফ হ্যাঁ? শুধুমাত্র এলাকার একটা মাথাওয়ালা ছেলেকে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। তাও আবার সেই তিনবছর আগে! এতগুলো বছরে হয়তো তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে দিব্যি সংসার করছে৷ কিন্তু ঐ মাথাওয়ালা ছেলের পরিবার সেই শোক এখনো সামলাতে পারেনি।

নিজের জেদ, অহংকার, দাম্ভিকতা ধরে রেখে তাদের নিজের সন্তানের সুখকে এখনো মেনে নিতে পারেনি। যার প্রভাব এখন আমার বৌয়ের উপরে এসে পড়েছে! আমাদের ফলো করতে করতে তারা রিসোর্ট অবধি চলে এসেছে চিন্তা করুন! আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে আমার বৌকে একা পেয়ে তাকে মারধর করবে?

আমার সামনে তার মাথায় লাঠি দ্বারা আঘাত করবে? আমার সামনে আমার দুনিয়াকে মেরে ফেলবে? মৃ”ত্যু যন্ত্রণায় সে ছটফট করবে আর আমি সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখব স্যার? তাদের উপর অ্যাটাক করব না? ঝাঁপিয়ে পড়ব না আমার বৌকে বাঁচাতে? আমি আমার বৌকে বাঁচানোর জন্যই তাদের উপর হামলা করেছিলাম!

বেধরক পিটিয়েছিলাম তাদের। মাথা ঠিক ছিলনা তখন। সামনে যা পেয়েছিলাম তা দিয়েই মে’রে’ছিলাম। ছু’রি, চা”কু থাকলে হয়তো তা দিয়েও আঘাত করতাম। ভেবেছিলাম তাদের জানে মে”রে ফেলব শুধু আমার বৌয়ের অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাচ্ছিল বলেই তাদের অর্ধেক মে”রে ছেড়ে এসেছি। দয়া করেছি তাদের দয়া।”
অনর্গল কথাগুলো বলে রুদ্ধশ্বাস ফেলল নূর। ব্যথাযুক্ত মাথায় হাত রেখে একরোখা গলায় বলল,,

“আমি তখনই আপনাদের সাথে থানায় যাব যখন দেখব আমার বৌয়ের সেন্স ফিরেছে। যখন নিজ চোখে দেখে যেতে পারব আমার বৌ ভালো আছে, সুস্থ আছে, মুক্তভাবে শ্বাস নিতে পারছে!”
নূরের বয়ান শুনে তব্ধ শ্বাস ফেললেন পুলিশ অফিসার। নূরের বর্তমান অবস্থা এবং বাচনভঙ্গি দেখে কিছুই অবিশ্বাস্য মনে হলোনা উনার। চোখ বুজে নূরকে বিশ্বাস করে নিলেন তিনি। তবে এই পরিস্থিতিতে তিনি নিরুপায়! কাজের বাইরে কাউকে একরত্তিও ছাড় দেওয়ার জোঁ নেই উনার। সরল দৃষ্টিতে তিনি নূরের দিকে তাকালেন। নরম স্বরে বললেন,,

“আপনাকে এখন আমাদের সাথে যেতেই হবে নূর। এখন আমি ডিউটিতে আছি। যতক্ষণ অবধি আমি ডিউটিতে আছি ততক্ষণ অবধি উপর মহলের আদেশের বাইরে কিছু করতে পারবনা আমি!”

না চাইতেও নূরকে টেনে হেঁছড়ে জীপে উঠিয়ে নেওয়া হলো! কেঁদে কেটেও কেউ নূরকে আটকে রাখতে পারলনা। এই মুহূর্তে চাঁদের পাশে থাকার সমস্ত হাল ছেড়ে দিলো নূর! শেষবারের মত আহত চাঁদকে এক ঝলক দেখে বুকে আকাশ সমান চাপা আর্তনাদ নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। যেতে যেতে সে মনকে এটা বলেই শান্তনা দিলো যে ‘চাঁদ এখনো বেঁচে আছে।’ এরচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর কিছুতেই নেই।

মাঝখানে কেটে গেল গোটা তিনদিন! নূর এখনো জেল খানায় বন্দী! নাওয়াখাওয়া, বিশ্রাম এবং যথেষ্ট যত্নের অভাবে তার বর্তমান অবস্থা খুবই বেহাল। ফুলাফালা মুখটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। শুভ্র মুখের আদল ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। দৃষ্টি বুলানো যাচ্ছেনা তার দিকে। দিন-রাত সারাটাক্ষন সে শুধু চাঁদের নাম জপ করে!

পাগলের মত সারাক্ষণ কীসব যেন ভনভন করে। চুল টানে, হুটহাট হেসে দেয়, কেঁদে ফেলে, চাঁদের সুস্থতাও কামনা করে। তাকে যে দেখতে আসে তার কাছে শুধুই চাঁদের কথা জানতে চায়। ভাত-পানির বদলে কেবল সিগারেট চায়। চাঁদ একটু ভালো আছে শুনলেই যেন তার ভেতরটা শান্তি পায়।

পাগলামিটাও একটু কমে যায়। দুই পরিবারের সবাই খুব চেষ্টা করছে নূরকে এই দুই একদিনের মধ্যেই জেল থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। কেসটা থানায় ওঠে গেলে নূরকে ছাড়িয়ে আনাটা বড্ড দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে! কোট কাচারিতে প্রচণ্ড দৌঁড়োদৌঁড়ি করতে হবে।

চাঁদের জ্ঞান ফিরেছে আজ একদিন হলো। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও সে বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারেনা। সারাটাক্ষণ শুধু যন্ত্রণায় ছটফট করে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পিপাসু দৃষ্টিতে নূরকে খুঁজে! আশেপাশে নূরকে কোথাও দেখতে না পেয়ে অকাতরে চোখের জল ছেড়ে দেয়৷ মাথার যন্ত্রণায় সে মুখ খুলে কথাও বলতে পারেনা।

তার ভেতরের আকুতিটা কাউকে প্রকাশ করতে পারেনা! নূরের নাম ধরেও ডাকতে পারেনা। সবাই বিষয়টা বুঝলেও বেশ এড়িয়ে চলে। চাঁদকে শান্তনা দিয়ে বলে নূর ট্রেনিংয়ে গেছে! দু/একদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। মনে মনে অভিমানের পাহাড় গড়ে উঠল চাঁদের। নূর কীভাবে পারল তাকে এই মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে এভাবে ট্রেনিংয়ে চলে যেতে? তবে কি চাঁদের থেকে তার ট্রেনিংটা বেশি বড়ো হয়ে গেল?

সেই তিন কার্লপ্রিট এখন চোখ মেলে তাকাতে পারে! তবে অবস্থা এখনও তেমন ভালো নয়। পুরো শরীরে মারাত্নক জখমের দাগ। হাত-পা ভেঙে সবকটার গুরুতর অবস্থা। বেঁচেও যেন ম’রে থাকার মত পড়ে আছে। আদোতে বেঁচে থেকেও তাদের কোনো কাজ নেই। তাই তাদের পরিবারের লোকজন বেশ ক্ষেপে আছে। যার কারণে তারা কেসটাও তুলতে চাইছেনা! উল্টো নূরের পরিবারকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে। এভাবে নরম ভরম হয়ে আদোতে কেসটা তোলা সম্ভবও নয়। বড়ো কোনো মাধ্যম লাগবে কেসটি তুলতে হলে।

জডার্ন থেকে পুরো ঘটনাটা সাদমানের কানে পৌঁছাতেই সাদমান উতলা হয়ে উঠল নূরের জন্য। কীভাবে সে নূরকে হেল্প করতে পারবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। চাঁদের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। পুরনো অনুভূতি আবারও জেগে উঠল! যদিও সে খুব সংযমতার সাথে তার অনুভূতিগুলোকে দাবিয়ে রেখেছে।

তবুও প্রিয় মানুষটার খারাপ থাকা শুনলে বেহায়া মন তো কাঁদবেই! এরমধ্যেই তার হঠাৎ রোজের কথা মনে পড়ল! রোজের দুঃসম্পর্কের একজন মামা আছেন। যিনি আপাতত কুমিল্লা জেলায় এমপি পদে আছেন! তিনি চাইলেই হয়তো যত দ্রুত সম্ভব কেসটা তুলে নেওয়া সহজ। নূর তো ভুলেও রোজের হেল্প নিতে চাইবেনা!

উল্টো জানতে পারলে সাদমানের সাথেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিবে! বিচ্ছেদের পর থেকে নূরের সাথে রোজের কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই। কখনো হুটহাট করে রাস্তাঘাটেও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি তাদের। তাই সাদমান অতি গোপনীয়তার সহিত রোজের নতুন নাম্বারটা কালেক্ট করল। তার সাথে গোপনে যোগাযোগ করল।

যাবতীয় বৃত্তান্ত শোনার পর রোজ খুব হায় হুতাশ করল নূরের জন্য! সাদমানের মত তার মনও নূরের জন্য কেঁদে উঠল। সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলেও কিছু না কিছু অতৃপ্ত অনুভূতি তো রয়েই যায়! সাদমানকে ভরসা দিয়ে রোজ বলল সে খুব শীঘ্রই কিছু একটা করবে। ততদিন অবধি নূরকে সামলে রাখতে। এছাড়াও তাদের মধ্যে নানান কথাবার্তা হলো। রোজের দুই বছরের ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তান আছে।

স্বামী, সংসার এবং বাচ্চা নিয়ে দিব্যি সুখেই আছে সে। হেরেফেরে যদিও নূরের কথা তার মনে পড়ে যায় তার তখন আনমনেই চোখের জল ছেড়ে দেয়! সব ভুলে আবারও নতুনভাবে সব শুরু করে।
টানা পাঁচদিন পর নূরের জামিন হলো! রোজের মামা থানায় নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথেই তিন কার্লপ্রিটের পরিবার নূরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে বাধ্য হলো!

কার জন্য নূর ছাড়া পেল তা নূর ছাড়া বাকি সবাই জানত! পরে কখনও সময়, সুযোগ বুঝে রোজের কথা বলা যাবে। এমন গরম পরিস্থিতিতে রোজের কথাটা বলা উচিৎ হবেনা বলে সবাই বিষয়টা বেশ সূক্ষ্ণভাবে চেপে গেল। জেল থেকে ছাড়া পেতেই নূর প্রথমে চাঁদদের বাসায় উঠল! চাঁদকে আজই হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও মাথার ব্যথাটা এখনো তেমন কমেনি তার। পুরো মাথা জুড়ে সেলাইয়ের দাগ। তবে অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো।

হসপিটালের চেয়ে বাসায় ভালো সেবা-যত্ন করা যাবে বলেই তাকে আজ হসপিটাল থেকে রিলিজ করিয়ে বাড়িতে আনা। তাছাড়া হসপিটালে থাকাটা চাঁদের নিজের কাছেই দম বন্ধকর লাগছিল। হসপিটালের নিঃশ্বাসেও বিষ আছে বলে তার ধারণা হতে লাগল!

মধ্য দুপুর। বাইরে হতে থাকা বৃষ্টি বাদলকে উপেক্ষা করে নূর মরিয়া হয়ে ছুটে এলো চাঁদের কাছে। গোঁফ-দাঁড়ি বড়ো হয়ে ভবঘুরদের মত অবস্থা তার। শুভ্র রঙের মুখের আদলটা কৃষ্ণ রঙের দাঁড়িতে ঢাকা পড়ে গেছে। পর্যাপ্ত খাওয়াদাওয়া, মানসিক শান্তি এবং ঘুমের অভাবে শরীরের অবস্থা নেতিয়ে করুন এক অবনতি তার। একই জায়গায় যেন ধীরে সুস্থে দাঁড়াতে পারছেনা নূর। টালমাটাল হয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে পড়ছে।

চাঁদ সবেমাত্র বিছানা থেকে মাথা উঠিয়েছে। জায়মা এবং সোহানী তাকে অতি যত্নের সহিত বিছানার কার্নিশে বালিশ ঠেকিয়ে সেই বালিশে ভর দিয়ে তাকে সোজা করে বসিয়েছে। এরমধ্যেই হঠাৎ উশৃংখল অবস্থায় নূরের আগমন ঘটল চাঁদের রুমে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বিছানায় তব্দিত চিত্তে বসে থাকা চাঁদের দিকে অধীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নূরকে দেখামাত্রই চাঁদ চোখের জল ছেড়ে দিলো! হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

ভেতরে জমানো আকুতি বাইরে প্রকাশ করতে লাগল। রোগা শরীর নিয়ে হাত বাড়িয়ে নূরকে কাছে ডাকল। চাঁদের ডাকে নূর তার আবেগকে ধরে রাখতে পারলনা। ভেজাক্ত শরীরে চক্ষুজোড়া খুশির ঝলক নিয়ে ছুটে এলো চাঁদের কাছে। এক ঝটকায় চাঁদকে তাকে বুকে টেনে নিলো।

বুকের একদম মধ্যখানে চাঁদকে পাকাপোক্তভাবে চেপে ধরল৷ প্রশান্তিতে চোখ জোড়া বুজে নিলো। মনে হলো যেন কত শত বছর পর সে শান্তির ঠায় খুঁজে পেল। অতৃপ্ত হৃদয় ভালোবাসায় তৃপ্ত হতে লাগল। মনের আনাচে- কানাচে বাঁধ ভাঙা সুখ বইতে লাগল। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে নূর অশ্রুসিক্ত গলায় বলল,,

“বলছিলাম না ছেড়ে যাবা না? তবে তখন ঐভাবে আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলে কেন হ্যাঁ? চোখের সামনে আমি মরণ দেখছিলাম! ভাবছিলাম তুমি কথা রাখবেনা। কতটা কষ্ট হচ্ছিল আমার তুমি জানো? বার বার মনে হচ্ছিল তুমি চলে গেলে আমি বেঁচে আছি কেন? আমিও কেন তোমার সাথে ঐ পথে পাড়ি জমাচ্ছিনা? কেন বেঁচে আছি আমি কেন?”
কথা বলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল চাঁদের। মাথাটায় সাংঘাতিক যন্ত্রণাও হচ্ছিল। তবুও সেই দুঃখ- যন্ত্রণাকে তোয়াক্কা না করে চাঁদ কান্নাজড়িত গলায় অস্ফুটে স্বরে বলল,,

“বিশ্বাস করুন নূর। ওরা যখন আমাকে মারছিল না? আমার অতটা কষ্ট হয়নি। সহ্য ক্ষমতার ভেতরেই ছিল। কিন্তু যখন ওরা আপনার মাথায়ও আঘাতটা করেছিল তখন আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে আসছিল জানেন? তখন আমার মাথায় কেবল একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল এই যাত্রায় যেন আমিও বেঁচে না ফিরি! আপনি চলে গেলে আমি বেঁচে থেকে কী করব?”
“চুপ। একদম চুপ। আর কখনো এসব কথা বলবা না তুমি। আমরা দুজনই বেঁচে আছি, ঠিক আছি, একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছি এতেই শত কোটি শুকরিয়া।”

উৎকণ্ঠিত গলায় চাঁদ হেঁচকি তুলে বলল,,
“আপনি এতদিন কোথায় ছিলেন নূর? সবাই বলছিল আপনি নাকি ট্রেনিংয়ে গেছেন? যদিও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি! আপনার চাঁদকে আপনি এই অবস্থায় রেখে কখনো ট্রেনিংয়ে যেতে পারেননা নূর। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যদিও ধরি আপনি ট্রেনিংয়ে গেছেন তবে আপনার এই অবস্থা কেন নূর? পুরো শরীরটা কেমন ভেঙে গেছে। চোখ-মুখ শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। দাড়ি-গোঁফ এত গজালো কীভাবে? কোথায় ছিলেন আপনি?”

চাঁদের কাছে আর কিছু গোপন রাখতে চাইলনা নূর। বিষয়টা খোলসা করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলো। জবাবে নির্ভীক গলায় বলল,,
“আমি জেলহাজুতে ছিলাম চাঁদ! যাদের পিটিয়েছিলাম তাদের অবস্থা খুবই মর্মান্তিক ছিল। তাই আহতদের পরিবার আমার নামে থানায় মামলা করেছিল। আর সেজন্যই টানা সাত দিনের জন্য আমাকে জেলখানায় আটকে রাখা! তবে আমি ফিরে এসেছি চাঁদ। এই নিয়ে তোমাকে আর টেনশান করতে হবেনা। যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে। ভুলে যাও সব। এখন তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠে এই আমার একমাত্র দোয়া। আর কিচ্ছু চাইনা আমার কিচ্ছু না।”

চাঁদ স্তব্ধ হয়ে নূরকে জড়িয়ে ধরে রাখল কিয়ৎক্ষণ! অতঃপর ফুঁপিয়ে কেঁদে নূরকে পূর্বের তুলনায় আরও শক্তভাবে বাঁধনে আঁকড়ে ধরল। আর্ত গলায় বলল,,

“আর কত কী করবেন আমার জন্য হ্যাঁ? আর কত বদনাম হবেন? আর কত আহত হবেন? আর কত ছাড় দিবেন বলুন তো? এত নিঃস্বার্থ কেন আপনার ভালোবাসা নূর? এত সমঝোতা কেন আপনার মাঝে? প্রতিটা কাজে-ক্ষেত্রে কতটা নিঁখুতভাবে বুঝিয়ে দেন আপনি আমাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসেন।”

নূরের মাথাটা ফট করে ঘুরে এলো! চারিদিক ঝাপসা হয়ে এলো। শরীরটা নিস্তেজ হয়ে বমি বমি ভাব হতে লাগল। ঘামে সিক্ত হয়ে উঠল দুর্বল শরীর। চাঁদের গাঁয়ের উপর শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো। গলা খাদে এনে বলল,,
“আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে চাঁদ। দিশা খুঁজে পাচ্ছিনা। তোমার বুকে মাথা রেখে একটু ঘুমাতে দিবা?”

মুহূর্তের মধ্যেই আঁখি যৃগল বুজে নিলো নূর। চাঁদ প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। শুকনো ঢোঁক গিলে নূরের বিমূর্ষ মুখমণ্ডলে তাকালো। উদ্বিগ্ন হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জায়মা এবং সোহানীকে গলা ছেড়ে ডাকল। মৃদু চিৎকার করে বলল,,
“এই তোমরা কোথায়? নূর ভাইয়া বোধ হয় সেন্স লেস হয়ে গেছে। প্লিজ ভেতরে এসো তোমরা।”

চাঁদকে ছেড়ে এবার নূরকে নিয়ে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। একের পর এক ফাঁড়া লেগেই আছে তাদের পরিবারে। যেনো তেনো প্রকারেই হোক অসুস্থ নূরকে এখন সুস্থ করে তোলাই যেন সবার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চাঁদের মোটামুটি সুস্থ হতে টানা পনেরো দিন সময় লেগে গেল! এদিকে নূরও তার চাকরীর জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় দুইবার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। আর একবার ট্রেনিংয়ের পরেই চাকরীতে জয়েন করবে সে। এই পনেরো দিনে নূর ট্রেনিং এরিয়া টু কুমিল্লা দৌঁড়োদৌঁড়ি করতে করতে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

শরীর যতই খারাপ থাকুক না কেন চাঁদকে তার অপূর্ণতা বুঝতে দেয়নি। জীর্ণ শীর্ণ মুখমণ্ডলেও চকচকে হাসি ফুটিয়ে চাঁদকে শান্তনা দিয়ে গেছে। দু’দিনে একবার হলেও সে চাঁদের সাথে দেখা করতে কুমিল্লা গেছে। কাজের ফাঁকে যখনি সুযোগ পেয়েছে চাঁদের সাথে ভিডিও কলে যথেষ্ট সময় দিয়েছে। পরিবারের সবার আদর- যত্নে, সেবায়-শ্রুশুষায় এবং নূরের থেকে পাওয়া মানসিক শান্তিতে চাঁদ পূর্বের তুলনায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। মাথার ফেলে দেওয়া চুলগুলোও গজাতে শুরু করেছে।

আজ সাদমান জর্ডান থেকে দেশে ফিরবে! বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় এয়ারপোর্ট নামবে। সন্ধ্যা থেকেই নূর, মাহিন এবং আয়মনের মধ্যে ছুটোছুটি লেগে গেছে। তারা তিনজন মিলে সাদমানকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে যাবে। সেই খুশিতে তারা তিনজনই প্রায় আত্মহারা। দীর্ঘ তিন বছর পর বেস্টফ্রেন্ডের সাথে দেখা হবে তাদের। এরচেয়ে দারুন খুশির খবর আর কী হতে পারে?

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৫

সাদমান দেশে ফিরবে খবরটা পাওয়া মাত্রই জায়মা ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে! সকাল থেকেই তার উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই। সর্বক্ষণ সে চাঁদের কাছাকাছি থাকছে। চাঁদের সেবা নেওয়ার পাশাপাশি চাঁদ নূরের সাথে সাদমানের আসা নিয়ে কী কী কথা বলছে সব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে! জায়মার এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে চাঁদ মিটিমিটি হাসছে! মনটা যে জায়মার আনচান আনচান বেশ বুঝতে পারছে সে।

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৭