প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৭

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৭
নিশাত জাহান নিশি

সাদমান দেশে ফিরবে খবরটা পাওয়া মাত্রই জায়মা ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে! সকাল থেকেই তার উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্ত নেই। সর্বক্ষণ সে চাঁদের কাছাকাছি থাকছে। চাঁদের সেবা নেওয়ার পাশাপাশি চাঁদ এবং নূরের সাথে সাদমানের আসা নিয়ে কী কী কথাবার্তা হচ্ছে সব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে! জায়মার এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে চাঁদ মিটিমিটি হাসছে! মনটা যে জায়মার আনচান আনচান করছে বেশ বুঝতে পারছে সে।

সন্ধ্যা হতেই নূর, মাহিন এবং আয়মন গাড়ি নিয়ে রওনা হলো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। তাদের পরের গাড়িতেই রয়েছেন সাদমানের বড়ো বোন, মা এবং বাবা। সবাই একসাথে যাচ্ছেন সাদমানকে এগিয়ে আনতে। সবার মনেই অঢেল খুশির ঢেউ বইছে! কখন সবাই সরাসরি সাদমানের দেখা পাবে সেই খুশিতে যেন আত্মহারা। ড্রাইভিংয়ের মাঝখানেই নূর কিছু একটা ভেবে স্মিত হাসল। সামনের চুলগুলো টেনে মাহিন এবং আয়মনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমার কী মনে হচ্ছে জানিস? সাদমানের ফিরে আসা নিয়ে এখানে আমাদের চেয়েও জায়মা বেশি এক্সাইটেড! কী বলিস তোরা?”
মাহিন এবং আয়মন সমস্বর তুলল। যে যার জায়গা থেকে নড়েচড়ে বসল। ব্যগ্র হেসে ঠাট্টার স্বরে বলল,,
“হ্যাঁ রাইট। এবার ভালোয় ভালোয় তাদের হিল্লেটা হয়ে গেলেই হয়। সবাই বাঁচি।”

নূর মলিন হাসল। গাড়ির হ্যান্ডেলে হাত রেখে ভ্রু যুগল উঁচালো। হাসোজ্জল গলায় বলল,,
“চিল ইয়ার। চারজোড়া বিয়ে একসাথেই হবে! শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা!”
বিপরীতে আয়মন চুপ থাকলেও মাহিন সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“চারজোড়া বিয়ে বলতে মানে তোর, আমার, আয়মন এবং সাদমানের?”
ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে আয়মন মাহিনের মাথায় গাড্ডা মারল। শ্লেষাত্মক হেসে বলল,,
“হ্যাঁ। টিউবলাইট!”
মাহিন মাথায় হাত দিয়ে মুখটা ফুলিয়ে নিলো। বিপরীতে মাহিনের মুখভঙ্গি দেখে নূর এবং আয়মন হু হা শব্দে হেসে দিলো।

এক বাটি কচুর শাক হাতে নিয়ে জায়মা দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদের রুমে এসে প্রবেশ করল। চাঁদ আধ শোয়া অবস্থায় বিছানায় পা নাড়ছে। আর খুব মনযোগের সহিত ফোনে স্ক্রলিং করছে। বাড়িতে শুয়ে, বসে থাকতে থাকতে তার অবস্থাটা এখন বন্দি খাঁচার পাখিদের ন্যায় হয়ে গেছে!

তবে পূর্বের তুলনায় তার শরীরে কিছু পরিবর্তন এসেছে৷ ওজন কমপক্ষে দশ কেজি বেড়েছে! দেখতে অনেকটাই গুলুমুলু হয়ে গেছে। চেহারার জৌলুসতাও বেড়েছে। নূর তো তার কাছে এলেই কেবল আকুপাকু করে তাকে মনভরে আদর করতে! তবে বিয়ে ছাড়া তো আদো তা সম্ভব না। তাই বহু কষ্টে তার ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখে।
চাঁদের পাশে আওয়াজ করে বসল জায়মা। দ্রুত হাতে কচুর শাকের বাটিটা চাঁদের দিকে এগিয়ে দিলো। খরখরে গলায় বলল,,

“ধর তো। খেয়ে নে।”
ফোনের স্ক্রীন থেকে চোখ উঠালো চাঁদ। জায়মার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। ফোনটা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসল। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী হলো? তেজ দেখাচ্ছিস কেন?”
“কী আশ্চর্য। আমি কী এখন একটু উচ্চ স্বরে কথাও বলতে পারবনা? সবকিছুকেই তেজ মনে হবে তোদের? আমার কি কোনো স্বাধীনতা নেই?”

চাঁদ বেকুব বনে গেল। জায়মার অহেতুক রাগের কারণ সে বুঝতে পারলনা। তবে এটা বেশ বুঝতে পারল জায়মা কোনো কারণে ভীষণ রেগে আছে। তাই তার সাথে এখন নরম গলায় কথা বলতে হবে। ভাব জমিয়ে কী হয়েছে জানতে হবে। জায়গা থেকে খানিক নড়েচড়ে বসল চাঁদ। গলা খাঁকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“হ্যাঁ রে? তুই কি কোনো কারণে রেগে আছিস?”
“না। আমি রাগ করব কেন হ্যাঁ? আমার কী রাগ- দুঃখ, ক্ষোভ-অভিমান কিছু আছে নাকি? আমি হলাম কাঠ-পাথরের তৈরী অদ্ভুত একজন মানুষ। যার কোনো অনুভূতি নেই। যে যেভাবে পারে সেভাবে আমাকে চালনা করতে পারে।”
“আরেহ্! কী হয়েছে বলবি তো?”
“কিছু হয়নি, ছাড়। শাকটা খেয়ে নে।”

গম্ভীর মুখে জায়মা জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়াতেই চাঁদ খপ করে জায়মার ডান হাতটি টেনে ধরল। ভগ্ন গলায় বলল,,
“তুই চিন্তা করিস না জায়মা। যার সাথে তোর বিয়ের কথাবার্তা চলছে না? তার সাথে তোর বিয়েটা হবেনা! সাদমান ভাই আসছে! তোর অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে সাদমান ভাই আসছে।”

নিঃশব্দে চোখের জল ছেড়ে দিলো জায়মা! চাপা অভিমানে রপ্ত হয়ে মাথা নুইয়ে নিলো। ভরাট গলায় বলল,,
“আমি যাকে চাই সে আমাকে চায়না চাঁদ। তুই প্লিজ সাদমান ভাইয়ার প্রসঙ্গে আমাকে আর কিছু বলবিনা। এসব শুনলে আমার মনে আশা জাগে। পরে সে আশা ভেঙে গেলে কষ্ট হয়। ভীষন কষ্ট হয়। তিনবছর ধরে অনেক সহ্য করেছি। সত্যিই আর সহ্য হচ্ছেনা।”

হেঁচকা টানে চাঁদের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো জায়মা। একছুটে জায়গা পরিত্যাগ করল। চাঁদ বিষণ্ণ মনে জায়মার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কচুর শাকের বাটিটা হাতে তুলে নিলো। নাক সিঁটিয়ে পুনরায় বাটিটা পাশে রেখে দিলো! তব্ধ শ্বাস ফেলে বলল,,

“এবার আমি কিছুতেই হাল ছাড়বনা জায়মা। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক সাদমান ভাইয়ার মনে তোর জন্য জায়গা তৈরি করতে আমি বাধ্য করব। আমিও দেখব সাদমান ভাইয়া কীভাবে তোর ভালোবাসাকে অস্বীকার করে। কতটা দাপট উনার।”

মধ্যরাত। ঘড়িতে রাত প্রায় একটা চলমান। এই নিস্তব্ধতায় ঘেরা নিশুতি রাতকে সঙ্গী করে নূর, মাহিন, আয়মন এবং সাদমান মিলে সাদমানদের বাড়ির ছাদে বসে একত্রে আড্ডা দিচ্ছে। সবার মাঝেই গল্প-গুজব, হৈ-হুল্লোড় দিব্যি বহমান। জর্ডানে কাটিয়ে আসা সাদমান তার তিনবছরের অভিজ্ঞতা সবার সাথে এক এক শেয়ার করছে।

মাঝে মাঝে সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছে। বাকি সবাই বেশ মনোযোগ সহকারে সাদমানের কথা শুনছে। মাঝে মধ্যে এটা ওটা জিজ্ঞেসও করছে। এসব কথার মাঝখানেই নূর তার সিগারেটটায় জোরে এক ফুঁক দিলো। নাক-মুখ থেকে ধোঁয়া নির্গত করে কৌতূহলী গলায় সাদমানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,

“তো এই তিন বছরে ওখানে কাউকে ভালো লাগেনি তোর? আই মিন নতুন করে কারো প্রেমে পড়েছিলি?”
সাদমান মাথা নুইয়ে নিলো। তব্ধ এক শ্বাস ছাড়ল। গলায় নিরাগতা এনে জোরপূর্বক হেসে বলল,,
“নতুন করে কারো প্রেমে পড়া কি এতই সহজ রে? তাছাড়া সত্যি বলতে গেলে ওখানে কাউকে তেমন ভালো লাগেনি। আমাদের দেশী মেয়েরাই ভালো!”

সাদমানের জবাবে নূর খুশি হয়ে গেল! জায়মার প্রসঙ্গটা তোলার মোক্ষম সুযোগ পেল। নূর যেই না মুখ খুলে প্রতিউত্তরে কিছু বলতে গেল অমনি মাহিন কথা টেনে নিলো। ডানপিটে গলায় সাদমানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,,
“তো মেয়ে টেয়ে দেখব নাকি তোর জন্য হুম? বিয়ে শাদি করবি না নাকি? আমাদের তো প্ল্যানিং আছে চার বন্ধু মিলে একসাথে বিয়ে করব!”

নূর হঠাৎ জায়গা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। সিগারেটটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্যান্টের পকেট থেকে তার সেলফোনটি বের করল। নাক-মুখ কুঁচকে বিরক্তিকর গলায় বলল,,
“ওহ্ শিট। চাঁদকে এখনও কল করা হয়নি।”

সঙ্গে সঙ্গেই জায়গা থেকে সরে দাঁড়ালো নূর। আড্ডা মহল থেকে প্রায় অনেকখানি দূরে এসে দাঁড়ালো। শীঘ্রই ডাটা-টা অন করে চাঁদকে ভিডিও কল করল। অমনি চাঁদের কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল! বিতৃষ্ণায় চোখ-মুখ কুঁচকে নিলো সে। হাতড়ে ফোনটা বালিশের তলা থেকে খুঁজে বের করল। ঘুমজড়ানো চোখে ফোনের স্ক্রীনে তাকালো।

নূরের নাম্বারটা দু’চোখে ভেসে উঠতেই সে কলটা রিসিভ করল। চরম আলসেমি নিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসল। পিটপিটে চোখে ফোনের ঐ প্রান্তে থাকা নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের দিকে তাকিয়ে নূর স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। ছাদের কার্ণিশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। মিষ্টি হেসে সম্মোহিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কী? ঘুম ভেঙে গেছে আমার চাঁদপাখির?”
চাঁদ মোচড়ামুচড়ি করে উঠল। বড়ো এক হামি তুলে তিক্ত গলায় বলল,,
“হুম। আপনার জন্যই তো।”

“সন্ধ্যা থেকেই তোমার খোঁজ নিতে পারছিলামনা। সাদমান আসার পর থেকেই অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে-ই এই মাঝরাতে কল করতে হলো। রাতে খেয়েছ কিনা বলো?”

“খেয়েছি। আপনি খেয়েছেন?”
“পরে খাব। মেডিসিন নিয়েছ?”
“হুম।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ তো। সত্যি।”
“কচুর শাক? খেয়েছ?”
“হুম।”
“উঁহু! বিশ্বাস হচ্ছেনা!”
“সত্যি খেয়েছি।”
“জায়মার কাছে ফোনটা দাও!”

“আরে জায়মা ঘুমুচ্ছে তো। রাতে-বিরাতে আসছে গোয়েন্দাগিরি করতে!”
“ফোনটা দিতে বলছি দাও। তুমি এতটাও বাধ্য মেয়ে নও যে বলার আগে আগে জেচে কোনো কাজ করে ফেলবে।”
হুড়মুড়িয়ে চাঁদ বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। দ্রুত পায়ে হেঁটে সোজা বেলকনিতে দাঁড়ালো। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। তৎপর গলায় বলল,,

“আচ্ছা ফোনটা একটু সাদমান ভাইয়ার কাছে দিন তো!”
নূর ভ্রু যুগল কুঁচকালো। জায়গা থেকে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল চাঁদের দিকে। সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কেন?”

সূক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে চাঁদ রুমের দিকে তাকালো। জায়মা কিছু টের পেল কিনা তার বুঝার চেষ্টা করল। উল্টো পাশ ফিরে ঘুমে কাত হয়ে আছে জায়মা! সবেমাত্র ঘুমিয়েছে সে। কেঁদে কেটে না খেয়ে দেয়! জায়মা এখনও কিছু টের পায়নি বুঝে স্বস্তির শ্বাস ফেলল চাঁদ। বেলকনির গ্রীল ধরে এক জায়গায় ধীরে সুস্থে দাঁড়ালো। দ্রুত গলায় বলল,,

“জায়মাকে নিয়ে কিছু কথা বলার ছিল।”
“এখন না। কাল সরাসরি বলবে।”
“না আমি এখনই বলব। জায়মা আজ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়েছে! কাল সাদমান ভাইয়া সরাসরি এসে জায়মার সাথে কথা বলবে। যতদ্রুত সম্ভব তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি করে দিতে হবে। জায়মার কষ্টটা আমি দু’চোখে দেখতে পারছিনা। আমার বোন তো, তাই আমার খুব জ্বলে। আপনি সাদমান ভাইয়া কাছে ফোনটা দিন তো। আমি এখনই উনার সাথে কথা বলব। এভাবে আর সময় গড়াতে দেওয়া চলবেনা।”

নূর ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। অকপট গলায় বলল,,
“আচ্ছা তাহলে অডিও কল দিচ্ছি।”
“কেন? ভিডিও কলে কী সমস্যা?”

“তোমার কোনো সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। আমি অ্যানি টাইম তোমাকে দেখতে পারব। যতই অগোছালো থাকো না কেন। কিন্তু অন্য কেউ কেন তোমাকে এই অগোছালো অবস্থায় দেখবে হুম? এর কোনো অধিকার আমি কাউকে দিইনি।”
ঝট করে ভিডিও কলটা কেটে দিলো নূর! এই মুহুর্তে সাদমানের সাথে চাঁদের ভিডিও কলে কথা বলাটা তার আপত্তিকর মনে হচ্ছে। নূর এখনও সাদমানকে নিয়ে বিরাট দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগে! বিয়েটা দ্রুত করতে পারলেই যেন বাঁচে। শার্টের কলারটা উঁচিয়ে নূর ফোনটা হাতে নিয়ে আড্ডামহলে গেল। সাদমানকে উদ্দেশ্য করে নিচু স্বরে বলল,,

“এই সাদমান? চাঁদ তোর সাথে কথা বলতে চায়। একটু এদিকে আয়।”
অবাক হলো সাদমান! কপালের ভাজে বিস্ময়ের ছাপ ফুটিয়ে তুলল। চাঁদ আবার হঠাৎ তার সাথে কী কথা বলতে চায়? জানার আগ্রহ যেন বেগতিক বাড়তে লাগল তার।

কৌতূহল নিয়ে সে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। মাথা চুলকে নূরের কাছে এগিয়ে গেল। চাঁদের নাম্বারে কল করল নূর৷ সাদমানের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলো। নূরের দিকে নির্বোধ দৃষ্টি ফেলে সাদমান ফোনটা কানে তুলে নিলো। অমনি ঐ পাশ থেকে চাঁদ মিঠি গলায় শুধালো,,

“হ্যালো। সাদমান ভাইয়া?”
চাঁদের সুমধুর কণ্ঠস্বরটা শোনা মাত্রই যেন সাদমানের মনে ছোটো খাটো একটা তুফান বয়ে গেল! অজানায় ডুবে গেল সে। যা এই মুহূর্তে খুবই বেমানান। পরিস্থিতি বুঝে সাদমান সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঝাঁকালো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নূরের দিকে দ্বিধার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নূর সন্দেহজনক দৃষ্টিতে সাদমানের দিকে তাকাতেই সাদমান মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। ভাবশূণ্য গলায় চাঁদকে বলল,,

“হ্যাঁ চাঁদ বলো? কেমন আছো?”
“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
“এইতো ভালোই আছি।”
“একটা খুব জরুরি কথা বলার জন্য আপনার সাথে কথা বলতে চাওয়া।”
“কী কথা চাঁদ? সিরিয়াস কিছু?”

“আমি যে কথাটা এখন আপনাকে বলব সেই কথাটা কিন্তু খুব বেশি সিরিয়াস সাদমান ভাইয়া। আশা করি আপনি খুব মনোযোগ সহকারে কথাটা শুনবেন। এবং কথাগুলো খুব সিরিয়াসলি নিবেন।”

“হ্যাঁ। বলোনা? কী কথা?”
চাঁদ আর ভনিতা করলনা। গলা ঝেড়ে কাশলো। সোজাসাপটা গলায় বলল,,
“জায়মা আপনাকে ভালোবাসে সাদমান ভাইয়া!”
সাদমান যেন টুপ করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ল! দৃষ্টি ঘুরিয়ে সে নূরের দিকে নিষ্ক্রিয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। নূর ঠোঁট উল্টালো। ভাবলেশ হয়ে দাঁড়ালো। কিছু না বুঝার ভান ধরল। নূরের হাব ভাব দেখে সাদমান ফোনে থাকা চাঁদকে শাণিত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“এসব তুমি কী বলছ চাঁদ? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“মাথা আমার ঠিকই আছে সাদমান ভাইয়া। জায়মা সত্যিই আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। সেই তিনবছর আগে থেকে! যা আপনি কখনো বুঝার চেষ্টা করেননি।”

সাদমান হিসেব মিলাতে পারলনা৷ যতই এসব ভাবছে ততই যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠছে। কখন থেকে শুরু হলো এসব হ্যাঁ? যার একরত্তি অবকাশও সে পেল না? অথচ তিনবছর আগে অনেকবারই তার জায়মার সাথে কথা হয়েছিল। বহুবার চোখে চোখ পড়েছিল। কখনো কথার আকার ইঙ্গিতেও আঁচ করতে পারেনি জায়মা তার প্রতি দুর্বল! শুকনো গলাটা ভিজিয়ে নিলো সাদমান। ক্ষীণ গলায় বলল,,

“কই আমি তো কখনও জায়মাকে দেখে বুঝতে পারিনি জায়মা আমাকে ভালোবাসে।”
“আমিও তো কখনও আপনাকে দেখে বুঝিনি আপনিও আমাকে ভালোবাসতেন! কিন্তু ভালো তো বাসতেন নাকি? সেই বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ ছিলনা!”

সাদমান থতমত খেয়ে গেল। নিশ্চুপ হয়ে মাথা নুইয়ে নিলো। মাথার চুলগুলো সে সমানে টানতে লাগল। কী বলবে না বলবে তা ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে উঠছিল। কী এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়ে গেল সে তা ভেবেই কপাল চাপড়াচ্ছিল! অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করতে লাগল তার সর্বাঙ্গ জুড়ে।

সাদমানের বর্তমান ধরাশয়ী অবস্থা দেখে নূর বুঝতে পারল ফোনে দুজনের ঠিক কী কথাবার্তা চলছে। সাদমানের কাঁধে ভরসার হাত রাখল নূর। সাদমান আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। চোখ বুজে নূর সাদমানকে অভয় দিল। ভালো কিছুর আশায় সাদমানকে আশ্বস্ত করল। ফোনের ঐ প্রান্ত থেকে চাঁদ গলা ঝাকালো। তৎপর গলায় বলল,,

“জানেন? আপনি দেশে ফিরবেন খবরটা শোনার পর থেকেই জায়মা কতটা এক্সাইটেড হয়ে আছে? নাওয়াখাওয়া, ঘুম-নিদ্রা ভুলে শুধু আপনাকে নিয়ে কল্পনা করছে। আপনার চিন্তায় বেখবর হয়ে আছে। কখন একটিবার আপনাকে চোখের দেখা দেখবে সেই আশায় যেন দম বন্ধ অবস্থাতেও বেঁচে আছে।

একবার ভেবে দেখুন আপনি ফিরবেন বলে মেয়েটা কত খুশি! ভাবছে আপনি এবার অন্তত তার মনটা বুঝবেন। সব ভুলে তার কাছে ফিরে আসবেন। তিনবছরের সমস্ত অপেক্ষা এক নিমিষে ঘুঁচিয়ে দিবেন। ভালোবেসে তাকে আপন করে নিবেন। সে আপনার প্রতি যতটা লয়্যাল আপনিও তার প্রতি ততটাই লয়াল থাকবেন। এতটুকুই কি যথেষ্ট নয় কাউকে ভালোবাসতে?”

“আচ্ছা এই বিষয়ে আমি পরে কথা বলছি। এখন রাখছি। বায়।”
ফট করে ফোনটা কেটে দিলো সাদমান। কয়েক দফা রুদ্ধ শ্বাস ফেলে অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। ফোনটা নূরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে উদ্বেগী গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“চাঁদ এসব কী বলছে নূর? সব কি সত্যি?”

বুকের পাজরে হাত গুজে সাদমানের মুখোমুখি দাঁড়ালো নূর। ডান হাতে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। সাদমানের দিকে নির্ভোজাল দৃষ্টি ফেলল। মসৃণ গলায় বলল,,
“হ্যাঁ সত্যি। জায়মা তোকে সত্যিই মন থেকে ভীষণ ভালোবাসে সাদমান। এই তিনবছরে বেশ বুঝা হয়ে গেছে আমার। তাই তোরও উচিৎ হবে যে তোকে মন থেকে এতখানি ভালোবাসে তোকেও তাকে মন থেকে মেনে নেওয়া। চাঁদকে ভুলে জায়মাকে আপন করে নেওয়া!”

নূরকে উপেক্ষা করল সাদমান! হনহনিয়ে ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। উপস্থিত সবাই নির্বোধ দৃষ্টিতে সাদমানের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। তবে কেউ পিছু ডাকলনা। নূর প্রায় ধরেই নিলো সাদমানকে বুঝানোটা বোকামো! সে যা ভালো মনে করবে ঠিক তাই করবে। কারো কথার কোনো তোয়াক্কা করবেনা। হাল ছেড়ে নূর বিশৃঙ্খল শ্বাস ছাড়ল৷ অমনি সাদমান ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে একদফা পিছু ফিরে তাকালো। সরল দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূরকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে উঁচু গলায় বলল,,

“আজ রাতটা আমাকে ভাবতে দে নূর! কাল সকালে জানাচ্ছি কী করব।”
নূর হেলানরত অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সাদমানের দিকে আচম্বিত দৃষ্টি ফেলল! সাদমানের মুখের আদলে যেন কোথাও লিখা ছিল কাল কিছু ম্যাজিক হতে চলেছে! কারণ, সাদমানের ঠোঁটের কোণেই লেগেছিল কেমন যেন রহস্যময় হাসি! যার রহস্য ভেদ করা বড্ড দুষ্কর। ঘাড়টা বাঁ দিকে বাঁকিয়ে সাদমান দেঁতো হেসে প্রস্থান নিলো। নূরের নিশ্চল দৃষ্টি স্থির রইল সাদমানের যাওয়ার পথে। কিয়ৎক্ষণ পর সে মাথা ঝাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,,
“কাল কী আসলেই অন্যরকম কিছু ঘটতে চলেছে?”

বেঘোরে ঘুমের মধ্যেই চাঁদ টের পেল তার মাথায় কেউ বিরামহীনভাবে হাত বুলিয়ে চলছে! খুবই উষ্ণ, মোলায়েম এবং গভীর প্রেমমাখানো সেই হাতের ছোঁয়া। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলোনা নূর এসেছে! নূরের ছোঁয়া চিনতে তার বেশি একটা ভাবতে হয়না। ঝট করে চাঁদ চোখজোড়া খুলে নিলো।

ঘুম কাতুরে ভাব ছেড়ে পূর্ণদৃষ্টি মেলে সম্মুখে তাকালো। অমনি খোলা জানালা দ্বারা আসা সকালের মিষ্টি রোদের ঝলকানিতে নূরের হাসোজ্জল মুখখানি তার দু’চোখে স্পষ্ট হলো। হুড়মুড়িয়ে চাঁদ বসা থেকে ওঠে বসল। নূরের দিকে মিষ্টি চাহনিতে তাকালো। কোনোদিকে কালক্ষেপণ না করে নূরের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে চোখজোড়া বুজে নিলো৷ প্রশান্তির স্বরে শুধালো,,

“কখন এলেন?”
সুঠাম বাহু দ্বারা চাঁদকে আঁকড়ে ধরে নূর স্বস্তির শ্বাস ফেলল। চাঁদের মাথায় পুনরায় হাত বুলালো। স্থির গলায় বলল,,
“মাত্র এলাম। রাতে ঘুম হয়নি। তাই ভোরের দিকেই রওনা হওয়া।”
“এ আবার কী কথা? রাতে ঘুম হয়নি কেন?”
“একটু টেনশানে আছি তাই।”
“কী টেনশান?”

“চাকুরীটা নিয়ে। কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে জানতে পেরেছে আমি এক সপ্তাহ জেলে ছিলাম! তাই এটা নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে খুব দ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি আবার এই নিয়ে চিন্তা করোনা!”
চাঁদ মুখটা কালো করে নিলো। নূরের এই অবস্থার জন্য নিজেকে শতভাগ দোষারোপ করতে লাগল। নাক টেনে অপরাধী গলায় বলল,,

“আমার ভুলের জন্যই আজ আপনাকে এই দিনটা দেখতে হচ্ছে নূর। আপনার এত কষ্টে অর্জিত চাকুরীটা হুমকির মুখে পড়েছে।”
“চুপ। একদম চুপ। আর কখনও ভুলেও মুখ থেকে এসব কথা উচ্চারণ করবেনা। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে৷ চাকরী একটা চলে গেলে আরও ভালো ভালো চাকরী আসবে। শুধু ভাগ্যের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।”

নূরের কথাবার্তায় কোনো ভাবান্তর হলোনা চাঁদের। সে নাক টেনে চোখের জল ছাড়তে লাগল! নূর বিষয়টা খেয়াল করল। চাঁদকে তার বুকের পাঁজর থেকে উঠালো। তেজস্ক্রিয় দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। খিটখিটে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,
“কান্না থামাবা কিনা বলো? সবসময় শুধু নাকি কান্না! এত কান্না কই থেকে আসে তোমার হ্যাঁ?”

চাঁদ মাথা নুইয়ে নির্বিকার চিত্তে বসে রইল। নূর তেজী শ্বাস ছাড়ল। চাঁদেে অহেতুক কান্নাকাটিকে উপেক্ষা করে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই চাঁদের কোলে মাথা রাখল! হাঁটু ভাজ করে চুপটি করে শুয়ে পড়ল। নিরিবিল চক্ষু জোড়া বুজে নিলো। ক্ষান্ত গলায় বলল,,
“আমি ঘুমালাম। এবার তুমি যত ইচ্ছা কাঁদো!”

দাঁত ব্রাশ করতে করতে জায়মা ছাদে উঠেছিল। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ছাদে যাওয়াটা তার আজকাল প্রায় অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো মহল্লা ঘুরে ঘুরে দেখে দাঁত ব্রাশ করতে তার ভালো লাগে। ব্রাশ করা প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতেই জায়মা ছাদের দরজার দিকে অগ্রসর হলো।

মুখভর্তি থুথু ছাদের দরজায় ফেকে মারতেই সে তাজ্জব বনে গেল! লালা মিশ্রিত সমস্ত ফেনাযুক্ত থুথু তার সামনে-ই দাঁড়িয়ে থাকা সাদমানের মুখে ছিটকে পড়ল! অমনি সাদমান রুদ্রাক্ষের ন্যায় আগ্রাসী রূপ ধারণ করল! মুখে হাত দিয়ে জায়মার দিকে তেজস্ক্রিয় দৃষ্টি ফেলল। জায়মা ভয়ে চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড়ো বড়ো করে ফেলল। উৎকণ্ঠিত হয়ে দু’কদম পিছু হটে গেল। বুকে হাত দিয়ে অস্ফুটে গলায় শুধাল,,

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৬

“আআআপনি?”
বিদঘুটে ভাবে নাক সিটকালো সাদমান! চোয়াল উঁচু করে তেড়ে গেল জায়মার অতি সন্নিকটে। তেজ ঝাল দেখিয়ে হাত-পা ছুড়ে বলল,,
“এই এটা কী করলা হ্যাঁ? কী করলা? আমার পুরো মুখটাই নষ্ট করে দিলা।”

প্রেমময়ী তুমি পর্ব ৬৮