সূর্যশিশির পর্ব ১৫

সূর্যশিশির পর্ব ১৫
ইলমা বেহরোজ

বেলা তখন দশটা। রূপা হেঁশেলে প্রবেশ করতেই বারেক রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ” তুই হেঁশেলে আসতে গেলি কেন? একটা দিন বিশ্রাম নেয়া যায় না?”
রূপা অপ্রসন্ন মুখে বলল, “রুমে ভালো লাগে না।” পরপরই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, “এখনো নাকি মুরগি আনেননি। টাকা দেন নিয়ে আসি।”

“তোকে আনতে হবে না। সুজনকে পাঠাব। ও নিয়ে আসবে। তুই বাসায় গিয়ে বিশ্রাম কর।”
“বসে থাকতে ভালো লাগে না। এখানেই থাকি।” রূপার চোখেমুখে বিরক্তি। কণ্ঠে অনুরোধ।
“টিভি দেখ গিয়ে। তোর ফোন আছে না?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েরা সারাদিন বাসায় বসে থেকে ফোনে কত কী দেখে, নাটক, ছবি, গান, ড্রেমা…” বারেক সঠিক নামটা মনে করার চেষ্টা করলেন। মনে হতেই বললেন, “ড্রামা…ড্রামা। হারুনের মেয়েটা ফোন নাকি রাখতেই চায় না৷ দিনরাত ড্রামা দেখে। এজন্য হারুনের কত আফসোস। তুই দেখতে পারিস না? তাহলেই তো সময় কেটে যায়। ”
রূপা হাসল। বর্তমান সময়ে, সন্তানরা ফোনে যেন সময় না দেয় সেজন্য বাবা-মায়েরা বকাবকি করে৷ আর তার বাবা বলছে, ফোনে ড্রামা দেখে অবসর কাটাতে।

রূপা বলল, “আচ্ছা, যাচ্ছি। কিন্তু বিকেলে চলে আসব।”
তারও ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। পায়ে মৃদু যন্ত্রণা লেগেই রয়েছে৷ দাঁড়িয়ে থাকা বা হাঁটা দুটোই এখন পীড়াদায়ক।
ফাইয়াজের বাড়ির পথ পেরোনোর সময় রূপার রাতের কথা স্মরণে এলো। ফাইয়াজ স্যারের অর্ডারটা বাকি ছিল! তাকে টাকা ফেরত দেয়া উচিত।

গেইটের দ্বার ঠেলে অভ্যন্তরে প্রবেশ করেই ফাইয়াজের বোন জেসমিন বখতিয়ারকে দেখতে পেল। তিনি সেচনী দ্বারা টব গাছে পানি ঢালছেন।
তিন মাস অতিক্রান্ত হলো বখতিয়ার পরিবার এখানে এসেছে। অথচ রূপা একবারও তাদের দেখতে আসেনি। আজই তার প্রথম আগমন।

বাড়ির সামনের উন্মুক্ত অংশজুড়ে বিভিন্ন গাছ। ফুল গাছ সংখ্যায় একটু বেশি। প্রায় বারো বছর পর রূপা এই বাড়িতে প্রবেশ করল। যদিও তাদের বাসার ছাদ থেকে বাড়িটি দেখা যেত। তবে কাছ থেকে দেখতে অন্যরকম লাগছে!
চারপাশ পরিপাটি।
রূপাকে দেখে জেসমিন অবাক হলেন। সবিস্ময়ে বললেন, “রূপা না?”
রূপা ওষ্ঠে হাসি ধরে রেখে মাথা নাড়াল।

জেসমিন সেচনী রেখে এগিয়ে এসে বললেন, “এতগুলো দিন হলো এলাম, তোমার বাড়িতেও অনেকবার গেলাম কিন্তু তোমার সাথে আর সরাসরি দেখা হয় না৷ এইটুকু মেয়ে অথচ কত ব্যস্ত থাকো তুমি!” জেসমিন এমনভাবে কথা বলছেন যেন রূপা তার জনম জনমের চেনা।
রূপা বলল, “আম্মার মুখে আপনার কথা শুনেছি। অনেকবার দেখেছিও, কখনো কথা বলার সুযোগ হয়নি।”
“এইতো কথা হলো। চলো ভেতরে চলো।”

রূপা তুরন্ত বলল, “না… ” সম্বোধন করার মতো কিছু না পেয়ে তার কথা আটকে গেল।
জেসমিনের বয়স চল্লিশের উর্ধ্বে। তিনি আবার সুমনাকে চাচি বলে ডাকেন। অথচ দুজনই প্রায় কাছাকাছি বয়সের। তাই রূপা দ্বিধায় পড়ে যায়, জেসমিনকে আপা ডাকবে নাকি আন্টি?
জেসমিন বললেন, “কীসের না? প্রথম এসেছো, একটু বসবে না? ভেতরে চলো।”
জেসমিন হাতে ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরে৷

রূপা বাড়ির ভেতরে ঢুকে ড্রয়িংরুমের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ড্রয়িংরুমের তিন পাশ জুড়ে বইয়ের তাক, যা ছাদ ছুঁয়েছে; তাতে শত শত বই। মাঝে কাঠের নান্দনিক সোফা। দেয়ালে ঝুলানো কৃত্রিম লতাপাতা, পুরনো দেয়াল ঘড়ি।
রূপা অবাক নয়নে চারপাশ দেখছে৷ তা খেয়াল করে জেসমিন বললেন, “আমি আর ফাইয়াজ বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি। দুজনে মিলে সাজিয়েছি। এখানে সব আমাদের প্রিয় বই। তুমি বসো না।”
রূপা সোফায় বসল। তার প্রথমে অস্বস্তি হলেও এখন ভালো লাগছে৷ মানুষটা সত্যিই অমায়িক।
জেসমিন প্রশ্ন করলেন, “এখন বলো কী খাবে?”

“না, না আ…” রূপা পুনরায় আটকে গেল। রুমি-রিনি আপা ডাকে যেহেতু তারও আপাই ডাকা উচিত। কিন্তু স্যারের বড় বোনকে আপা ডাকতে অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হচ্ছে৷ সে ম্যাডাম ডাকার সিদ্ধান্ত নিল। বলল, “না ম্যাডাম, কিছু খাব না৷ আমার স্যারের কাছে একটু প্রয়োজন ছিল। আজ তো শুক্রবার, উনি হয়তো বাসায় আছে।”
জেসমিন অবাক হয়ে বললেন, “আমাকে ম্যাডাম বলছ কেন? আর স্যারই কাকে বলছো?”
“যখন ক্লাস টেনে ছিলাম, কোচিংয়ের ষোলতম ব্যাচে ফাইয়াজ স্যার ইংলিশ টিচার ছিলেন।”

জেসমিন হাসিতে মাখামাখি হয়ে বললেন, “কয়েক মাস ব্যাচে পড়িয়েছিল এজন্য এতবছর পর এসেও স্যার ডাকতে হবে? ভাইয়া বলবে। আর আমাকে ভুলেও আর ম্যাডাম বলবে না। আপা বলে ডাকবে। আমার একটু বয়স বেশি, তাতে কী! যেহেতু তোমার ছোট বোন আমার ভাইয়ের বউ হবে, তোমাকে তো আপাই ডাকতে হবে।”
রূপা চকিতে তাকাল। বলল, “ছোট বোন? মানে রুমি?”

রূপার প্রতিক্রিয়া দেখে জেসমিন আশ্চর্য হয়ে গেলেন। বললেন, “হ্যাঁ, তুমি জানো না?”
রূপা বাকহারা হয়ে গেল। তার বোনের বিয়ে আর সে জানে না! রূপা কোনোরকমে বলল, “না।” থামল, ঢোক গিলল। তারপর বলল, “কবে বিয়ে?”

জেসমিন অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলেন। বড় বোন নাকি একই বাড়িতে থেকে ছোট বোনের বিয়ের খবর জানে না! এ তো অভূতপূর্ব ঘটনা! তিনি বললেন, “সুমনা চাচির সাথে তো কথা হলো। বিয়ের দিন তারিখ সোমবারে দুই পরিবার একসঙ্গে বসে ঠিক করব। ওদিনই ফাইয়াজ রুমিকে আংটি পরিয়ে আসবে। তুমি জানো না ভেবে অবাক হচ্ছি। সত্যিই জানো না? চাচি বলেনি?”

রূপার মনের গগনে ঘনীভূত হয় ঘন মেঘ। এই খবরটাও তার মা তাকে দিল না! সে তো বাহিরের কেউ না, পরিবারেরই বড় মেয়ে৷ তাছাড়া রুমি এতো ছোট! স্যারের সাথে বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি। কী করে এই বিয়ে হতে পারে?
রূপা বলল, “সকালে বের হই, রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি। বলার সুযোগ পায়নি হয়তো।”
‘ও, আচ্ছা তুমি বসো। আমি আসছি।” রূপার বিব্রত কায়া দেখে জেসমিন আর কথা বাড়ালেন না৷
রূপা ঠায় বসে ছিল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে ফাইয়াজ এলো ড্রয়িংরুমে। সে রূপাকে দেখে কোনো রকম ভাব-প্রতিক্রিয়া দেখাল না। ধীর পায়ে নিজের মতো হেঁটে চলে গেল বারান্দায়৷

রূপা পিছু পিছু গিয়ে নরম সুরে ডাকল, “স্যার?’
ফাইয়াজ দুই হাত এদিকওদিক নাড়িয়ে বলল, “বলো।”
রূপা মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার নোট বের করে ফাইয়াজের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনার টাকাটা।”
ফাইয়াজ নিজস্ব নৈপুণ্যতায় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। সময় নিয়ে রূপার হাতের টাকাটা দেখল। এরপর বলল, ” আমি কিছু অর্ডার করেছিলাম! অথচ তুমি তা না দিয়ে টাকা ফেরত দিচ্ছো?” কণ্ঠটা কাঠকাঠ লাগল।
রূপা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সরি স্যার। আপনি যখন অর্ডার করেছিলেন, তখন আমার রান্না শেষের দিকে ছিল। আলাদা করে আবার করার সময় পাইনি।”

ফাইয়াজ সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, “তা আমার দেখার বিষয় না। যখন অর্ডার করেছি তখনই তোমার ম্যানেজারের না করা উচিত ছিল। কিন্তু সে করেনি। যদি করত, আমি অন্যখানে অর্ডার করতাম। আমাকে সারারাত ক্ষুধা নিয়ে অপেক্ষা করতে হতো না। অপেক্ষা করেও কিন্তু যা চেয়েছি তা পাইনি। টাকা ফের‍ত দিতে এসেছো। স্ট্রেঞ্জ!”

ফাইয়াজের কথাতে রূপার অপরাধবোধ হয়৷ সে সুজনকে বলেছিল, আর কোনো অর্ডার না নিতে৷ কিন্তু সে ঠিক নিয়েছে। ফাইয়াজ স্যার এখন যা বলছেন ঠিক বলছেন। তিনি ক্ষুধার্ত ছিলেন সারারাত! রূপা অপরাধী সুরে বলল, “সরি স্যার।”
“কীসের সরি? এভাবে তুমি বিজনেস করবে? কাস্টমারদের হয়রানি করে? এরকম চললে, তোমার বিজনেস লাটে উঠবে। এবার তুমি আমার হয়রানির ক্ষতিপূরণ দাও।”
রূপা থতমত খেয়ে বলল, “ক্ষতিপূরণ?”

“হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ।”
রূপার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে আতঙ্কিত হলো। স্যার কি ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাকা চাইবে? ক্ষতিপূরণ তো টাকাই হয়! নিশ্চয়ই কানে ধরাবে না অথবা স্কেল নিয়ে এসে বলবে না, হাত পাতো দেখি!
টাকাই চাইবে! রূপা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

ফাইয়াজ সেচনী হাতে নিয়ে বলল, “ক্ষতিপূরণ না দিলে কিন্তু আমি পুলিশের কাছে যাব, তোমার নামে মামলা করব।”
“কিহ?” ঝড়ের গতিতে শব্দটি রূপার মুখ থেকে নিঃসৃত হলো।
“যা শুনেছো ঠিক শুনেছো। তুমি আমাকে সারারাত অপেক্ষা করিয়েছো। ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে যেতেও পারতাম। আল্লাহর রহমতে অনেক বড় বিপদ হতে গিয়েও হয়নি।” ফাইয়াজ গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে।
রূপা কৈফিয়ত দেয়ার সুরে বলল, “আমি গতকাল এক্সিডেন্ট করেছি। তাই পারিনি। বিপদ তো আর বলেকয়ে আসে না স্যার।”

“খবরটা রাতেই পেয়েছি। এখন তো ঠিক আছো? পায়ে নাকি বেশি ব্যথা পেয়েছো? এখন হাঁটতে পারো? একটু হেঁটে দেখাও তো।”
রূপা বাধ্যের মতো হেঁটে দেখাল। সে ফাইয়াজকে ভয় পায় না কিন্তু মান্য করে। নাকি একটু ভয়ও পায়?
ফাইয়াজ মনোযোগ দিয়ে রূপার হাঁটা দেখল। বলল, “এখনো পায়ে ভালো করে ভর দিতে পারছ না। বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। টাকাটা ফেরত দিতে হবে না। সুস্থ হয়ে আমার বিরিয়ানি পাঠিয়ে দিও।”

সূর্যশিশির পর্ব ১৪

মুহূর্তে মত পরিবর্তন! রূপা বলল, “ক্ষতিপূরণ তাহলে লাগবে না?”
ফাইয়াজ ভ্রুকুটি করে বলল, “দিতে চাও নাকি?”
রূপা দ্রুত বলল, “একদমই না।”

সূর্যশিশির পর্ব ১৬