সূর্যশিশির পর্ব ১৬

সূর্যশিশির পর্ব ১৬
ইলমা বেহরোজ

“তোর পাপা বারান্দায় বসে আছে।”
অরুনিকা বাসা থেকে বের হওয়ার পায়তারা করছিল। সেলিনার কণ্ঠ শুনে চমকে ওঠে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ায়। সেলিনা বুকের কাছে দুই হাত ভাঁজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অরুনিকা দ্রুত নিজের অভিব্যক্তি সামলে বলল, “তাতে আমার কী? আমি কি কোথাও যাচ্ছি? হাঁটছিলাম একটু।”

বাক্য শেষ করেই সে নিজের রুমে চলে এলো। পিছু পিছু এলেন সেলিনা। রুক্ষ কণ্ঠে বললেন, “তোমার পাপা বাসায়, দয়া করে আমাকে আর অশান্তি দিও না।”
অরুনিকা বিছানায় বসে বলল, “কী করলাম আমি?”
“তুমি আবার বেরিয়ে যেতে চাচ্ছিলে। এমনটা করো না। গতকাল রাতে তোমাকে এতো বকলো, ফোন ভাঙল তবুও তোমার শিক্ষা হয়নি। একদিনও পার হয়নি অথচ তুমি বেরিয়ে যেতে চাচ্ছো। এটা মনে রেখ, যদি একবার বের হও তোমার পাপা আর ঢুকতে দিবে না বাসায়।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরুনিকা তির্যকভাবে তাকায়। বলল, “ভাইয়ার মতো?”
সেলিনা ক্ষনিকের জন্য থমকালেন। তারপর বললেন, “জানোই যখন, নিজেকে শুধরে নাও।”
“ভাইয়া কোনো দোষ করেনি মা আর আমিও কোনো দোষ করিনি।”

সেলিনা ফুঁসে উঠলেন, “চুপ করো। বাজারে ভালো মেয়েরা চলাফেরা করে না। আর অর্ণবকে নিয়ে তোমার কিছু বলতে হবে না, ভাবতেও হবে না। সে দোষ করেছে নাকি করেনি সেটা আমাদের বিষয়। তুমি নিজেরটা ভাবো, বুঝেশুনে চলাফেরা করো। দয়া করে বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করো না। তোমার পাপা যেন আমাকে কথা না শোনায়। আমি তার ক্রোধের মুখোমুখি হতে চাই না।”

সেলিনা গজগজ করতে করতে চলেই যাচ্ছিলেন, অরুনিকা বলল, “তুমি ইস্ট্যাবলিশ হয়েও পাপাকে এতো ভয় পাও কেন?”
সেলিনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন। নিম্ন কিন্তু ভারী সুরে বললেন, “ভয় পাই না, তোমার পাপাকে আমি ভালোবাসি। আমি চাই না এই বয়সে এসে তোমার পাপা উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ুক।”

সেলিনা প্রস্থান করলেন। অরুনিকা থ মেরে বসে রইল কিয়ৎক্ষণ। সপ্তাহখানেক পর রমযান মাস। আর ঈদের পর তার ভার্সিটি এডমিশন। এখন তাকে অষ্টপ্রহর বই নিয়ে থাকা উচিত। অথচ সে পড়তে পারছে না। পড়তে না পারার অপারগতা তাকে আরো বেশি বিষিয়ে তুলছে। রূপার খোঁজ নিতে হবে। রূপার সাথে কথা বললেই মন শান্ত হয়।
অরুনিকা ড্রয়িং ও ডাইনিং রুম খুঁজে সেলিনাকে পেল না। সে তার বড় ভাই অর্ণবের রুমে গিয়ে দেখে, সেলিনা সেখানে আনমনা হয়ে ফুলদানি পরিষ্কার করছেন। সে রুমের বাহির থেকে কোনোরকম ভূমিকা ছাড়া বলল, “তোমার ফোনটা দাও মা।”

সেলিনা ফুলদানি পরিষ্কার করতে করতে শান্ত সুরে বললেন, “ফোন কেন?”
“দরকার আছে।”
“রুমে গিয়ে পড়তে বসো।”
অরুনিকা রুমের ভেতর প্রবেশ করে অনুনয় করে বলল, “প্লিজ মা, রূপার একটু খোঁজ নিতে দাও। তারপর আমি সারাদিন পড়ব।”

সেলিনা ফুলদানিটা রেখে অরুনিকার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বললেন, “কী হয়েছে ওর যে, একদিন খোঁজ না নিলে…”
অরুনিকা তাৎক্ষণিক কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “গতকাল রাতে আমার ফোন বন্ধ পেয়ে বাসার সামনে এসেছিল। তখন দেখলাম, কেমন করে যেন হাঁটছে। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করতে চাই, ওর কী হয়েছে।

দাও ফোনটা, প্লিজ। রিকুয়েষ্ট করছি।”
মমতাময়ী মায়ের মায়া হয় সন্তানের প্রতি। সেলিনা সচেতন হয়ে আজিজুরের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন। কখন না তার আবির্ভাব ঘটে! তিনি ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে বললেন, “সময় এক মিনিট। যা বলার আমার সামনে বলবে।”
অরুনিকা চোখমুখ কুঁচকে বলল, “এটা কোন ধরনের সন্দেহ মা! আমি কি অপরাধ করছি? আর এক মিনিটে কী কথা বলব?”

“তাহলে কথা বলতে হবে না৷ গিয়ে পড়তে বসো।” সেলিনা নিজের শর্তে দৃঢ়।
অরুনিকা ব্যথাহত, স্তিমিত চোখে চেয়ে রইল মুহূর্তখানেক। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “ঠিক আছে, দাও।”

বাড়ি ফিরে নীরবে নিজের রুমে শুয়ে আছে রূপা৷ সে যে বাড়ি ফিরেছে সুমনার নজরে পড়েনি। রূপার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে আছে। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না। রুমির বিয়ের কথাবার্তা এতো দূর এগিয়ে গেল আর বড় বোন হয়ে সে কিছুই জানে না! এই ব্যাপারটা তার কাছে দূর্বিষহ ঠেকছে। চেপে রাখা অভিমান ভয়ংকর হয়, এক সেকেন্ডের জন্যও শান্তি দেয় না৷ তাই রূপা বিছানা ত্যাগ করে নিচ তলায় নেমে আসে। সুমনার রুমে গিয়ে দেখল, সুমনা একটা ফটো হাতে নিয়ে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। রূপা অবাক হলো। সবিস্ময়ে ডাকল, “আম্মা।”

সুমনা ধড়ফড়িয়ে ওঠলেন। দ্রুত ফটোটি আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেললেন৷ রূপার অবাকের মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ হলো। সুমনা চোখের জল মুছে বললেন, “তুই কখন এলি? দোকানে না গিয়েছিলি?”
রূপা মন্হর গলায় বলল, “আব্বা জোর করে পাঠিয়ে দিলো।”
সুমনা স্বাভাবিক হওয়ার ছল করলেন। হাতের ফটোটি আলমারির ভেতর রেখে বললেন, “ভালো করেছে। আজ বিশ্রাম নে। কিছু খাবি?”

মায়ের হঠাৎ পরিবর্তন, তার কান্না, অজ্ঞাত ফটো লুকিয়ে ফেলা – ব্যাপারগুলো রূপার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। কিন্তু সেসব নিয়ে প্রশ্ন করার সময় এখন না। সে যা বলতে এসেছে তা বলার প্রস্তুতি নিয়ে বলল, “কিছু কথা ছিল।”
সুমনা পূর্বের ঝাড়া বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “কী কথা? বল।”

রূপা এক হাতে গ্রীবা ম্যাসাজ করতে করতে বলল, ” রুমিকে নাকি সোমবার পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে?”
সুমনার হাত থেমে গেল। তিনি রূপার চোখে চোখ রেখে বললেন, “কে বলল?”
সুমনার প্রতিক্রিয়া দেখে রূপা দ্বিধায় পড়ে গেল, যে খবরটি শুনল সেটি আদৌ সত্য কি না তা নিয়ে অন্তঃকরণে সংশয় সৃষ্টি হলো। বলল, “ফাইয়াজ স্যারের টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, তখন উনার বোন বলল। সত্য না?”
“কীসের টাকা?” সুমনার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়।

“স্যার কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেছিলেন। সময়ের জন্য করে দিতে পারিনি তাই টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম।”
সুমনা হইহই করে উঠলেন, “সেকি! তুই ফাইয়াজের থেকে টাকা নিয়েছিস? খবরদার আর নিবি না৷ তোর বোনের জামাই হবে কয়দিন পর।”

তাহলে যা শুনেছে তা সত্য! রূপার বুকে উথলে ওঠে অভিমান। নিজের অভিমান প্রকাশ করতে গিয়েও প্রকাশ করতে পারল না। হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমাকে তো জানাওনি তাই টাকা নিয়েছি। এরপর থেকে আর নেব না।”
সুমনা গদগদ কণ্ঠে বললেন, ” তোর এখন কত কাজ, বোনের বিয়ে বলে কথা। সোমবারে ওরা আসবে৷ ওদিন কিন্তু হোটেল বন্ধ থাকবে৷ বাসায় রান্না হবে। সব কিছু তোকে করতে হবে।”

“ঠিক আছে।” রূপা অন্যবেলা হলে ঝাঁঝ নিয়ে কথা বলতো, কিন্তু এই মুহূর্তে পারছে না৷ হেতু, গতকাল রাতে সুমনার দেয়া স্নেহার্দ ও ভালোবাসা।
রূপা রুম ছেড়ে বেরোতে গিয়ে আবার ফিরে তাকাল। বলল, “রুমি কি রাজি? মানে, ওদের বয়স পার্থক্য তো অনেক। বিয়ে নিয়ে রুমি কী বলে?”

“ও কী বলবে? আমরা যা সিদ্ধান্ত নেব, তাই হবে৷”
বুকপকেটে ফোন বেজে ওঠল। রূপা পকেট থেকে ফোন নিয়ে দেখে “আন্টি” দিয়ে সেভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। নিশ্চয়ই অরুনিকা কল করেছে!
রূপা দ্রুত পায়ে ছাদে চলে আসে৷ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে অরুনিকার কণ্ঠ –
“তুই গতকাল পা টেনে টেনে হাঁটছিলি কেন?”

তার সোজাসাপটা প্রশ্ন! রূপা রাতে অনেক চেষ্টা করেছে ঠিক হয়ে হাঁটার, পারেনি। অরুনিকার নজরে পড়েই গেছে৷ সে অকপটে মিথ্যে বলল, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। এখন ঠিক আছি।”
“কখন হয়েছিল? ”
“গতকাল বিকেলে।”
“মিথ্যে বলছিস কেন?”
রূপা থতমত খেয়ে গেল। বলল, “মিথ্যে হবে কেন?”

“তুই বিকেলে ব্যথা পেলে সাইকেল নিয়ে আসতি না। হয় রিক্সা দিয়ে নয়তো হেঁটে আসতি। যেহেতু সাইকেল ছিল সাথে, তুই আমার এলাকায় আসার আগে ঠিকই ছিলি, ব্যথা পাসনি। পথে কিছু হয়েছে৷”
রূপা মাথায় হাত দিয়ে কৌতুক করে বলল, “ওরেব্বাস! এতো ট্যালেন্ট নিয়ে ঘুমাস কী করে?”
“যা বলেছি, উত্তর দে৷ তারপর বলছি, কীভাবে ঘুমাই।”

“আরে তোদের যে অন্ধকার গলি, ওখানে পড়ে গিয়েছিলাম৷ এটা নিয়ে এতো কাহিনি করার কী আছে?”
“তুই বাজার রেখে অন্ধকার গলি দিয়ে আসতে গেলি কেন?”
“ভুল হয়েছে মা, ক্ষমা করে দে।”
অরুনিকা নিভল, “এখন ঠিক আছিস?”

“হ্যাঁ, পারফেক্ট আছি। এখন তুই আমাকে বল, তুই কেমন আছিস? আন্টি কোথায়?”
অরুনিকা আড়চোখে সেলিনার দিকে তাকাল। রূপাকে বলল, “আমি ভালো আছি৷ মা পাশে।”
“পাহারা দিচ্ছে নাকি? মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি তোর বান্ধবী না বয়ফ্রেন্ড। যেভাবে তোর বাপ-মা…”
“শোন, রাখছি। আমি ভালো আছি। আল্লাহ হাফেজ।”
রূপা কিছু বলার আগেই অরুনিকা কল কেটে দিল।

রবিবার। আজিজুর ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছেন। দুপুরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়েছে অরুনিকা। রূপা বৃহস্পতিবার রাতে এসেছিল, বারান্দা থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে – এই খবর দারোয়ান আজিজুরকে দিয়েছিল। তারপর আজিজুর অরুনিকাকে অর্ণবের রুমে স্থানান্তর করেছেন। অরুনিকার রুমে দিয়েছেন তালা। তিনি মনেমনে ফন্দি আঁটছেন অরুনিকাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার। রূপার সাথে অরুনিকার মেলামেশা আর সহ্য করতে পারছেন না।
কলিং বেল বেজে ওঠল। আজিজুর গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, “এই সেলিনা…দেখো তো কে এসেছে।”

সেলিনা দরজা খুলে দেখেন ডেলিভারি ম্যান দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় ক্যাপ, হাতে পার্সেল। মুখ ঢেকে রাখা মাস্কে। ডেলিভারি ম্যান নম্র কন্ঠে বলল, “আপনি কি অরুনিকা চৌধুরী?”
সেলিনা বললেন, “না, আমার মেয়ে অরুনিকা।”
“উনাকে একটু ডেকে দিবেন? উনার একটা পার্সেল ছিল।”
“ও তো ঘুমাচ্ছে! আপনি আমার কাছে পার্সেল দিন।”
ডেলিভারি ম্যানকে বিব্রত হতে দেখা যায়। তার দৃষ্টি অসহিষ্ণু। পরক্ষণে শান্ত হয়ে এগিয়ে দিল পার্সেল। সেলিনা জানতে চাইলেন, “পেমেন্ট বাকি?”

“না ম্যাম।”
“আচ্ছা, আসুন।”
তিনি দরজা বন্ধ করে পার্সেল নিয়ে অরুনিকার রুমে রাখলেন। ড্রয়িংরুমে আসতেই আজিজুর প্রশ্ন করলেন, “কে এসেছিল?
“ডেলিভারি ম্যান৷ অরুনিকা কিছু অর্ডার করেছিল।”
“কী অর্ডার করেছে?”
“এসব নিয়েও এখন প্রশ্ন করবে? তুমি জানো না ও সর্বক্ষণ কিছু না কিছু অর্ডার করে।”
আজিজুর আর কথা বাড়ালেন না।

সূর্যশিশির পর্ব ১৫

অপরাহ্নে অরুনিকা জাগ্রত হয়ে ড্রেসিং টেবিলে পার্সেল দেখে অবাক হলো। অলস ভঙ্গিতে হাই তুলল। পাপা কি ফোন গিফট করেছে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই সে ধড়ফড়িয়ে ওঠে পার্সেল খুলল। কিন্তু ফোনের বদলে এক জোড়া নুপুর আর একটা চিরকুট পেল। অরুনিকা ভীষণভাবে চমকাল। চিরকুট খুলে দেখল তাতে লেখা –
মনোহারিনীকে একটিবার ছাদে আসার অনুরোধ রইল।
ইতি,
হিরণ মজুমদার।

সূর্যশিশির পর্ব ১৭