সে আমার সুকেশিনী গল্পের লিংক || রাউফুন

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১
রাউফুন

‘রোজ একই ড্রেস পরে অফিস আসো, লজ্জা করে না তোমার?’
খুবই স্বাভাবিক ভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো বিউটি! কথাটি, বলেছে তার অফিসেরই একটা মেয়ে, তার কলিগ! সে মাথা ঝাকিয়ে বলল, ‘নাহ করে না লজ্জা! তোমার কোনো সমস্যা?’

রিমি নাক ছিটকে বললো, ‘উম্ হু কেমন গন্ধ আসছে তোমার গা থেকে! এই তুমি গোসল করো তো প্রতিদিন? নাকি জামার অভাবে বিনে গোসলে থাকো? চাকরির টাকায় একটা ভালো জামা তো কিনে নিতে পারো? এমন কঞ্জুসি পনা ছাড়ো বুঝলে?’
‘তোমাকে কে বললো ওঁর জামা..!
‘আহ মারিয়াম, তুই থাম। এই আমার কাছে আসো তো। নাও আমার শরীরে থাকা দুর্গন্ধ টা আরও একটু শুকে নাও। দেখি আসো এদিকে।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিউটি এগিয়ে গিয়ে রিমিকে জাপটে ধরে ওঁর নাকের সঙ্গে ঠেসে ধরলো ওঁর জামাটা। নাক মুখ কুচকে ছিটকে সরে গেলো রিমি।
‘ইয়াক, দূরে সরো যাও! স্যার আসুক শুধু, তোমার নামে বিচার দেবো৷ তুমি আমাকে হ্যারাস করছিলে নিজের শরীরের বিশ্রি গন্ধ শুকিয়ে!’

‘হ্যাঁ, দিও বিচার! আমিও বলবো, তুমি রোজ আমাকে আমার ড্রেস-আপ নিয়ে বিদ্রুপ করো।’
রিমি চলে গেলে বিউটির বেস্টফ্রেন্ড মারিয়াম বললো, ‘তুই একই কালারের ড্রেস না পরে, আলাদা কালারের একই ডিজাইনের, জামাও তো পরতে পারিস!’

‘হ্যাঁ পারি তো, কেন পারবো না। এখন তুইও অন্যদের মতো শুরু করে দে।’
‘আমি শুরু করছি না। তোকে শুধু বলছি সবার বিদ্রুপ থেকে বাঁচতে হবে তোকে।’
‘আমি পরোয়া করি নাকি লোককে? আমাকে এই চিনিস তুই?’
‘ওতো কিছু তো জানি না। তুই আর সেইম কালারের ড্রেস পরবি না। আলাদা রঙের সেইম ডিজাইনের ড্রেস পরতে পারিস। তাহলে আর কেউ বলবে না তোর এই হলুদ, সাদা রঙ এর একটাই জামা।’

‘কিন্তু তাতে যে কাউকে দেওয়া কথার খেলাফ হবে। আর আমি কাউকে কথা দিলে জীবন দিয়ে হলেও সেই কথা রাখি আর এটা তো আমার প্রিয়কে দেওয়া কথা। এটার কিভাবে হেলা ফেলা করি? আমার যখন বয়স সারে সাত তখন কথা দিয়েছিলাম। জানিস, আমি একদিন আগের সবচেয়ে পছন্দের জামা শুধু একটা দিন ব্যবহার করার পর সেই জামাটা ভালো লাগছিলো না। এই কথাটা প্রকাশ করাই আমাকে উদ্দেশ্যে করে প্রিয় বলেছিলো,“একদিনেই এতো অনীহা জামার প্রতি?

অথচ গতকাল তুই এই জামাটা জেদ করে কিনেছিলি কারণ এটা তোর ভীষণ ভাবে পছন্দ হয়েছিলো। একদিন ব্যবহারেই এই জামার রঙ, ডিজাইনই, তোর এখন আর পছন্দ হচ্ছে না? সমানে নিজের পছন্দের জিনিস চেঞ্জ করছিস, আলাদা আলাদা চয়েসের ড্রেস কিনছিস। এই যে বলিস বড় হয়ে আমায় বিয়ে করবি, আমায় তুই ভীষণ পছন্দ করিস, এই পছন্দ টা বড় হলে থাকবে তো? একটা জামা তোর পছন্দ হচ্ছে না একদিন পরার পরই, সেখানে আমি তো মানুষ।

আস্তে আস্তে চয়েস চেঞ্জ হবে তোর। যত বড় হবি আরও আলাদা আলাদা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবি। পছন্দ বাড়বে আর আমাকেও একদিন এই করে করে অপছন্দের তালিকায় ফেলবি। এই যে তোর এখন লম্বা চুল ভালো লাগে, বড় হলে দেখা গেলো তোর ঘাড় অব্দি ছোট ছোট চুল পছন্দ হচ্ছে।”তখন তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাকে বলেছিলাম, আমার আপনার ক্ষেত্রে চয়েস কখনোই চেঞ্জ হবে না কথা দিলাম। আপনি দেখে নিয়েন। কিন্তু দেখ আমার পছন্দ একই আছে শুধু মানুষ টা নেই।’

মারিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ডেস্কে বসলো। এই একই গল্প বিউটি তাকে হাজার বার বলেছে। সেও শুনেছে চুপচাপ। বিউটির সেদিনের কথা আবার মনে পরলো। মানুষটা বিউটির কথা শুনে শান্ত গলায় বলেছিলো,’তবে তোর ইচ্ছে, ইচ্ছেরা উন্মুক্ত, স্বাধীন। আমার কাছে সবচেয়ে বেশি স্বাধীন! তোর ইচ্ছেরা স্বাধীন,বুঝলি?’
‘আপনিই তো বলছেন ইচ্ছেরা স্বাধীন! তবে তো আমার ইচ্ছেরা এখানে স্বাধীনতা পাচ্ছে না।’

‘আমি কি তাই বলেছি যে তুই আজীবন এই একই ড্রেস পরবি? বলেছি? আমি শুধু বুঝাতে চেয়েছি একদিনেই তোর কাছে সবচেয়ে পছন্দের জামাটা অপছন্দের হয়ে গেলো, সেখানে আমি কিভাবে এতো বছর পরেও তোর পছন্দের তালিকায় রইবো! তোর সব ইচ্ছে, ইচ্ছেরা, সবকিছু আমার কাছে স্বাধীন। আমি তোর সব ইচ্ছে পূরণ করবো!’
‘আমি বড় হলে বিয়ে করবেন আমায় সুপ্রিয় ভাই?’

‘আমার আর তোর বয়সের পার্থক্য দেখেছিস বিউটি? এখন তোর সাত বছর আর আমার পনেরো, গুণে গুনে আট বছরের বড় আমি তোর!’
‘ আশ্চর্য, এটা কোনো বয়স হলো!’
‘এই যে কথায় কথায় আশ্চর্য বলিস, বড় হয়ে দেখবি এই স্বভাবটা নেই। মানুষ, নিজের স্বভাব আর পছন্দ খুবই দ্রুত চেঞ্জ করতে পারে। নিজের পছন্দ আর অভ্যাসকে অস্তিত্বে পরিণত কর দেখবি সেটা পরিবর্তন হচ্ছে না। কারণ মানুষ নিজের অস্তিত্ব ছাড়া বাঁচত পারে না!’

‘মিস বিউটিফুল, আপনি কাজ ছেড়ে আবার কোন ভাবনার অতলে গহ্বরে তলিয়ে গেছেন?’
তার ভাবনার সুতোই টান পরে। চমকে উঠে বিউটি অফিসের বস মিনহাজ আহমেদকে দেখে। সে চোখ পিটপিট করে মাথা নত করে বলে,’স্যরি৷ স্যরি স্যার!’
‘প্রতিদিন সেইম কাজ করেন, আর সেইম ভাবে স্যরি বলেন,স্যরি শব্দটাকে একেবারে স্বস্তা বানিয়ে বস্তা ভর্তি করে ফেলেছেন!’

‘স্যরি স্যার!’
‘আবার স্যরি! আপনি কখনোই আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না, কেন ভয় পান নাকি আমাকে?’
‘নো স্যার!’
‘তবে?’

‘আমি এখানে কাজ করতে আসি কাউকে দেখতে নয়!’
‘আই সী! তবে আপনি কাজ ছেড়ে যে মাঝে মধ্যে ভাবনায় ডুব দেন, সেটা কি তবে?’
‘স্যার ওটা আমার কাজেরই অংশ।’
‘মানে সিরিয়াসলি, আবোলতাবোল ভাবনা কাজের অংশ?’
‘ইয়েস স্যার!’

‘হোয়াট?’
‘স্যরি, স্যরি মানে নো স্যার!’
‘কনফিউজড করার চেষ্টা করছেন?’
‘নো স্যার, স্যরি স্যার!’

কপাল কুচকে মিনহাজ আহমেদ চুপচাপ বিউটিকে অবলোকন করলো। দেখলো মন ভরে। কড়া হলদে, শুভ্র রঙা একটি গোল রাউন্ড ড্রেস পরনে। হাতে কালো ফিতের হাত ঘড়ি। গলায় গোল্ডের চেইন। কানে ছোট্ট ছোট্ট সোনার দুল। রোজকার মতোই একই ড্রেস পরেছে, অথচ এই একই ড্রেসে তার কাছে রোজ আলাদা লাগে বিউটিকে। হাটু অব্দি লম্বা বিনুনি, কতগুলো চুল কপাল, চিবুকের উপর রিং পাঁকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ মুখটির আদল গড়া হয়েছে অতিব যত্নে, নিঁপুণ ভাবে। কথা বলার সময় তার লাভ শেইপ লিপস অল্প বিস্তর ফুলে উঠে।

সাদা ঝকমকে দাঁতের হাসিতে যে কেউ-ই ঘায়েল হতে বাধ্য হবে। ওঁর চোখে কি যেনো একটা খেলা করে সর্বক্ষণ। চোখ পিটপিট করে তাকালে যেনো মনে হয় একটা গভীর সরোবর। মেয়েটির মধ্যে সে কাউকে খুঁজে পায়! টান অনুভব করে। আলাদা কিছু অনুভূতি! নাম না জানা এই অনুভূতিটা কি সেটা ধরতে পারে না মিনহাজ্। সে হাত মুঠো করে চলে আসার সময় আবারও চমৎকার নারীর রিনরিনে, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মিষ্টি কন্ঠ কানে এলো। বিউটি তাকে ডাকলো! মিনহাজ দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে পেছনে না ঘুরে সেভাবেই দাঁড়ালো তার কথা শোনার জন্য। বিউটি একটু রয়েসয়ে বললো, ‘স্যার আমাকে আজকে চারটার মধ্যে বাড়ি যেতে হবে। যদি একটু আগে ছুটি পাওয়া যেতো! তাহলে…!’

‘কাজ শেষ হলে যেতে পারবেন তা না হলে যেতে পারবেন না। হ্যোয়েদার ইয়্যু ক্যান গো অর নট ইজ অ্যানটায়ারলি আপ টু ইয়্যু! বিকজ সামটাইমস ইয়্যু ডিসএপ্যেয়ার ইয়্যুরসেল্ফ!’
বিউটি বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করলো, ‘আমি নিজেকে হারালে, বা হারিয়ে গেলে উনার কি? সবকিছু খেয়াল করতে বলি নাকি আমি? আশ্চর্য!’

‘পাত্র পক্ষ দেখতে আসছে একটু পর রেডি হয়ে নে।’
‘হ্যাঁ সেজন্যই তো বসের ঝাড়ি খেয়ে ছুটি নিয়ে এলাম। তোমরা তো আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচো।’
‘হ্যাঁ তাই তো। আঠাশ বছরের বুড়ি কে যে কেউ দেখতে আসছে এটাই তো অনেক।’
‘এখন আঠাশ বছর কোনো বয়স না আম্মু!’

‘তোমার কাছে কিছু না হলেও আমাদের কাছে অনেক কিছু! যাক গে সেসব আর বলছি না। ছেলে তো আসবে, আসার পর তুই ভুজুংভাজুং বলে ছেলেকে বিদেয় করবি। এটাই তো ভয়!’
‘ভয় পেও না ছেলেকে আসতে দাও! এবারে আলাদা কিছুই হবে।’
শাহানা বেগম একটু স্বস্তি পেলেন। মেয়ের মন তবে গললো। নরম গলায় বললেন, ‘তাহলে একটু শাড়ী পরিস মা! শাড়ী তো পরতে পারবি না, তোর ভাবিকে বলবো ডেকে?’

‘আশ্চর্য! আমার এই জামায় কি কিছু হয়েছে? ফুটো বেরিয়েছে? দেখো তো!’
‘বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এলে পাত্রীকে শাড়ী পরতে হয়। এবারে এই জামা ছাড়! পাড়ায় বেরোতে পারি না আমি লজ্জায়। সবাই বলে তুই আস্তো হাড় কিপটে, কঞ্জুস মেয়ে। আল্লাহর দোহায় লাগে, শাড়ী পর আজকে!’
‘আমি পরবো না। আশ্চর্য সবার চয়েস কি এক হয় নাকি?’

‘যা ইচ্ছে পরগে আমার কথা কেন শুনবি। মুখ টা একটু সাজিয়ে নিস, অন্ততপক্ষে ভালো তো লাগবে!’
গজগজ করতে করতে শাহানা বেগম বেরিয়ে গেলেন। পেছন থেকে বিউটি রেগে চেঁচালো। গলার স্বর চড়াও করে বললো, ‘আশ্চর্য আম্মু, তোমরা সবাই আমার জামার পেছনে পরে থাকো কেন? আমি কি এখন নিজের চয়েস চেঞ্জ করবো? আশ্চর্য কথাবার্তা! সব জায়গায় কি তোমাদের আমার জামাটাই আগে চোখে বিঁধে পরে? আশ্চর্য!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২