সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২
রাউফুন

পাত্রী দেখতে আসার পর সবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলে পাত্র আর পাত্রীকে আলাদা কথা বলার জন্য পাঠানো হলো! পাত্র পাত্রীর রুমে প্রবেশ করতেই চিকন স্বরের গুন গুনিয়ে কাঁদার শব্দ শুনতে পেলো। মেয়েটির সমস্ত শরীর কাঁপছে অনবরত! তার বয়স আঠারো কি আটাশ ঠাহর করতে পারলো না সায়র।

কিন্তু মুখের দিকে তাকানো মাত্রই টের পেলো, বয়স যাই হোক, মনে হচ্ছে খেটে খেটে আর রাত জেগে জেগে মেয়েটার শরীরে আর কিছু নেই। যেনো ফুলদানিতে জল দিয়ে ভিজিয়ে রাখা বাসী ফুলের মতো। হাত দিয়ে এতটুকু স্পর্শ করলে, এতটুকু নাড়াচাড়া করলেই গেলেই ঝরে পরবে। সায়র বিউটির কান্নায় ক্ষীন বিচলিত হলো। গলা খাকাড়ি দিয়ে বললো,
‘একি কান্ড, একি কান্ড! আপনি কাঁদছেন কেন বিউটি?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আশ্চর্য! আমি আগে কখনোই কোনো ছেলের সঙ্গে এভাবে একান্তে কথা বলতে যায়নি, তাই ভয় করছে।’
‘তাই ভয় পেতে হবে? আমি তো আর বাঘ ভাল্লুক নয়! এমন ভাবে কাঁদছিলেন যেনো কি না কি করেছি আমি। উফফ!’
বিউটি কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো, ‘আমি তো বললাম এটাই আমার প্রথমবার!’

‘কি?’
‘এই যে একটা পুরুষের ছাঁয়া মারানো, মানে এভাবে এক রুমে।’
‘ওও!’
‘এমন বিশ্রি ভাবে ওও বলছেন কেন?’
‘বিশ্রি ভাবে বলেছি?’

‘হ্যাঁ, তা নয় তো কি? একটা মেয়ে কাঁদছে আর আপনি শুধু বলছেন ওওওও! মনে হচ্ছিলো আপনি আমার কথায় পাত্তা দিলেন না। আমাকে অগ্রাহ্য করলেন! আর আমাকে কেউ অগ্রাহ্য করলে আমি তাকে সহ্য করতে পারি না।’
‘শুধুমাত্র ওও বলার জন্য এতো রুডলি কথা বলছেন কেন? সামান্য ওও বলে যে কাউকে অগ্রাহ্য করা যায় জানতাম না তো!’

‘খুব বেশিই কথা বলেছি? কিন্তু এতো কথা কোথায় বলছি? ওও যে বিশ্রি ভাবে বলেছেন সেটাই বলেছি। শুনুন, আমার সামনে এভাবে বিশ্রি করে ওওওও বলবেন না। ভালো ভাবে কথা বলবেন! এমনি আপনাকে আমার কেমন ভয় ভয় করছে! বিয়েটা হয়ে গেলে, আমি যদি বিয়ের রাতে মা’রা যায় কি হবে? ভেবেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তারপর আপনার এমন প্রকান্ড শরীর! দেখলেই মনে হয় পদ্মাসেতুর লম্বাচওড়া একটা পিলার দাঁড়িয়ে আছে!’

সায়র অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রথম দিনেই একটা মেয়ে এতোটা বকবক কি করে করতে পারে? হাউ? এর প্যানপ্যানানি তো মশার চেয়েও জঘন্য! আল্লাহ্, এর মধ্যে তার দাদি কি এমন দেখলো তিনিই ভালো জানেন। তার দাদি বিউটিকে তার বান্ধবীর বাসায় দেখেছে! মেয়েটি মানে বিউটির বান্ধবীর দাদি সায়রের দাদীর সই! কি যেনো নাম মেয়েটার? ওহ হ্যাঁ মারিয়াম মনে হয়। মারিয়ামের দাদির কোনো এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ে এই বিউটি।

সেই সুবাদে স্বপরিবারে মেয়েকে দেখতে আসা। কিন্তু সবার সামনে ছোট ছোট মিষ্ট ভাষায় কথা বললেও এখানে ভোল পাল্টেছে। বিদেশ ফেরত সায়র বয়স্ক দাদির কথা ফেলতে পারেনি। তাছাড়া বিয়ে তো করতেই হবে। সায়র বিউটিকে এক পলক দেখলো। হলদে জামার এক প্রান্ত চেপে ধরে নত মস্তকে পায়ে টাইলস খুড়ছে। এমন ভাবে খুড়ছে যেনো কাদা মাটিতে পা দিয়ে গর্ত করছে। অথচ এটা টাইলস এক বিন্দুও গর্ত হয়নি। মেয়েটি তার দিকে এক বার চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত৷ এতে ভীষণ অপমান বোধ করলো সায়র।

‘কি হলো আপনি দেখি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু বলছেন না কেন? আপনি জানেন, আমার বান্ধবীরা কি বলে? বলে বর নিবি শুকনা চিকনা। যাতে তার ভার বহন করতে পারিস। এখন আমি যদি আপনার মতো এমন মোটাতাজা মানুষকে বিয়ে করি তাহলে আমার মান সম্মান থাকবে? ওঁরা তো বলবে আমি ওঁদের কথা রাখিনি, মান সম্মান থাকবে আমার বলুন?’
সায়র দু-পা এগিয়ে গেলো বিউটির দিকে!

কটমট করে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বললো, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি একদম সাদাসিধা একটা মেয়ে। এখন দেখছি আপনার খুব গভীরে চিন্তা ভাবনা। আপনাকে ওতো গভীরে কে ভাবতে বলেছে? ভার বহন মানে কি বোঝাতে চাচ্ছেন? আমি মোটা অনেক? একদম নয় হ্যাঁ! আমি যথেষ্ট ফীট! সারাজীবন দেখে এলাম মেয়েরা, হ্যান্ডসাম, ডেশিং, লয়াল, সুন্দর বডি ফিটনেসওয়ালা ছেলে পছন্দ করে, আর আপনার কিনা শুকনা, চিকনা পছন্দ! ‘

‘আশ্চর্য, সবার পছন্দ কি এক নাকি? সবার সুন্দর বডি ফিটনেস ওয়ালা জামাই পছন্দ হলেও আমার চিকনা আলী ছেলে পছন্দ!’
‘তো? এখন চাইলেই তো আর আমি চিকন আলী হতে পারবো না! যেহেতু আমার আপনাকে পছন্দ হয়েছে সেহেতু বাইরে গিয়ে বলছি বিয়ের দিন তারিখ পাকা করতে।’

‘আমাকে আপনার পছন্দ হওয়ার কারণ?’ তেঁতে উঠে বিউটি!
‘আপনি আপনার নামের মতোই সুন্দর! তাছাড়া আপনার ব্যাক্তিত্বের প্রেমে পরেছি আমি। কি সুন্দর কথা বলেন তোঁতাপাখির মতো।’
‘আশ্চর্য, আমার অনর্গল কথা বলা কারোরই পছন্দ না আর আপনার আমি এতো কথা বলার পরেও পছন্দ হলো আমাকে? আপনি দুই দিন আমার সঙ্গে কথা বললে আপনারও আর ভালো লাগবে না। তাই আমি মনে করি আপনার সময় নেওয়া প্রয়োজন!’

‘কে বললো ভালো লাগবে না? আমার চয়েস পরিবর্তন হয় না কখনোই। আমার কথা বলা মেয়ে পছন্দ। সারাদিন আমার সামনে দিয়ে গুটগুট করে ঘুরবে আর তোঁতাপাখির মতো কথা বলবে। দারুণ অনুভূতির ব্যাপার কিন্তু! আমি তো এখনি সেটা অনুভব করতে পারছি!’
‘হেই জম্বুক! আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন।’
‘কি বললেন?’
‘কেন কানে কালা, শুনতে পান না?’
‘এগেইন রিপিট দিস ওয়ার্ড!’
‘র’ক্তখেকো, জম্বুক বলেছি!’
‘জম্বুক বললেন আপনি? আমাকে র’ক্ত খেকো মনে হয়?’

‘মনে হওয়ার কি আছে? আপনি তো জম্বুকই! যা দেহ বানিয়েছেন! র’ক্ত না খেলে এমন দেহ হয় নাকি?’
সায়র হঠাৎই বিউটির নৈকট্যে আসলো। হকচকিয়ে গেলো বিউটি। সায়র দূরত্ব ঘুঁচিয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ফাঁক রাখলো তাদের মধ্যে। সায়রের নিঃশ্বাসের শব্দে এদিকে বিউটির শরীরে কম্পনের মাত্রা বেড়ে গেলো। মনে মনে গলা ফাঁটিয়ে চেঁচালো। কিন্তু তার গলা ফুড়ে সেটা বাহিরে বেরোলো না। সায়র চোয়াল শক্ত করে বললো, ‘যদি আমি র’ক্ত খেকো হতাম তবে আপনি আস্তো থাকতেন না! র’ক্ত শুন্য হয়ে মা’রা যেতেন!

বিউটি পেছাতে পেছাতে খাটের উপর পরে গেলো। সায়র প্যান্টের পকেটে হাত গুজে শিষ কাটিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বিউটির পুরো ঘরে চোখ বুলালো।
‘আহাহ্ নাইস রুম! কারুকাজ গুলো ভীষণ সুন্দর। আমার ভাবতে ভালো লাগছে যে আমার হবু বউ অনেক গোছালো। পেইন্টিং গুলো আপনার করা?’

বিউটি খাট থেকে উঠে দাঁড়ালো। সায়রের কথার উত্তর না দিয়ে আচমকা বলে উঠলো,
‘আমি গে**। এরপরেও আমায় বিয়ে করলে আপনি সুখ পাবেন না।’
রাগে সায়রের সর্বাঙ্গে জ্বলন ধরলো। সে তীব্র হুংকারে বললো,
‘নির্বোধ,গর্ধব মেয়ে,নিজের বদনাম নিজেই ছড়াচ্ছেন? এতে কি আপনার সম্মান বাড়ছে?বদমাশ মেয়ে। বোকা নির্বোধ মেয়েকে কি বিয়ে করা যায়? ইয়্যু আর জাষ্ট ইম্পসিবল!’

‘ওহ করা যায় না বিয়ে? তবে দেরি কিসের? বাইরে গিয়ে বলে দিন আপনি এই বিয়ে করছেন না!’
সায়র কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো। একবার বিউটির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। এদিকে বিউটি তার প্ল্যানে সাকসেসফুল ভেবে খুশিতে মারিয়ামকে টেক্সট করলো।
‘এই মারিয়াম, এই বিয়েটাও ক্যান্সেল। যা ডোজ দিয়েছি আর এই মুখো হবে বলে মনে হয় না!’
মারিয়াম এক মিনিট পর রিপ্লাই করলো, ‘আবার কি করলি তুই?’

‘আরে কিছু না, বকবক করা তো আছেই, সেটা করে মাথা খেয়ে ফেলেছি, কেঁদে কেটে একশাঁ, বেটা বদ তাও বিয়ে করতে চাইছিলো। না পেরে শেষে বলেছি আমি গে*। আমায় বিয়ে করলে সুখি হবেন না। শেষ কেল্লাফতে!’
মারিয়াম হতাশা হয়ে বললো,’এবারে এটাই বাকি ছিলো!’
বিউটি হেসে ফেলে। ফোন রেখে খুশিতে বিছানায় উঠে লাফালাফি করতে লাগলো। আপন মনে হাহাহা হিহি করে হাসতে লাগলো। সুপ্রিয় ভাই থাকলে নিশ্চয়ই তার বুদ্ধির খুব প্রশংসা করতো। এবারে আর তার রিজেক্ট করতে হবে না পাত্রপক্ষই বিয়ে ক্যান্সেল করবে।

কিন্তু বিধিবাম! হঠাৎই তার লম্বা বিনুনিতে টান পরলো। টাল সামলাতে না পেরে ঠাস করে পরে গেলো বিউটি। চোখ বন্ধ করে কিছু বলার আগেই তার মনে হলো প্রথমবার কোনো পুরুষালী হাত তার কোমড় ছুঁয়েছে। পেটে কামড়ে ধরার মতো অনুভূতি হলো তার। সারা শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ হয়ে গেলো। একটা সুন্দর পারফিউম এর ঘ্রাণ তার ঘ্রান্দ্রেয়িওতে তাল খেলো। এই ঘ্রাণ টা যখন সায়র রুমে প্রবেশ করেছিলো তখন পেয়েছিলো।

তার মানে সায়র এখনো যায়নি। সে পিটপিট করে চোখ খুললো। ভালো ভাবে লক্ষ্য করতেই দেখলো সায়রের কোলের উপর পরে আছে সে। সে চিৎকার করতে ভুলে গেলো৷ প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের চোখ চোখ পরলো তার। হিম হয়ে আসা রক্ত যেনো কোনো কিছুর উষ্ণতায় টগবগ করে ফুটতে লাগলো। সুপ্রিয়র কথা মাথায় আসতেই দুই হাতে শক্ত এক ধাক্কা দিলো বিউটি৷ লাফিয়ে নামার মতো কোল থেকে নেমে আচানক ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো সায়রের ডান গালে। সায়র রাগে, ক্ষোভে কাঁপতে কাঁপতে লাগলো। এমন ধরনের ত্যাদড় মেয়েকে কি করে সামলাতে হয় তা সায়র জানে। সে মাথা ঠান্ডা করে শীতল কণ্ঠে বললো,

‘আমার আর আপনার সামনের মাসে বিয়ে। এটাই জানাতে এসেছিলাম। এসেই দেখলাম কেউ আপণ মনে লাফাচ্ছে বানরের মতো। আপনার যে বকবক করার পাশাপাশি গেছো পেত্নীর এমন রূপ আছে তা জেনে উপকৃত হলাম। এবারে গেছো পেত্নীর দায়িত্ব নিয়ে তাকে পেত্নী থেকে মানুষ করতে হবে।’

বিউটি তখনও কাঁপছিলো। চোখ বেয়ে টুপটাপ করে চোখের পানি দু গাল বেয়ে পরছিলো। সায়র বেরিয়ে গেলে তার মা-বাবা,ভাই-ভাবি এসে ওঁকে আদর করে গেলো। বিয়েটা ঠিক হওয়াই সবাই অনেক খুশি। পুরো সময় বিউটি ছিলো নির্বিকার। সত্যিই কি তার বিয়ে ঠিক হলো এই লোকটার সঙ্গে? তাহলে সুপ্রিয় ভাইকে দেওয়া কথার কি হবে?

সে ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিলো। এই যে ছোট বেলা থেকেই সে এতো পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছিলো এটা তো সুপ্রিয়র থেকে পাওয়াই একটা গুণ। সুপ্রিয় কি করতো না করতো তার প্রতিটি পদক্ষেপ, তার কথা বার্তা সব কিছুই সে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতো৷ সায়রের হাতের স্পর্শ যেখানে পরেছিলো সাবান দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে লাল করে ফেললো সে। ইচ্ছে মতো ঠান্ডা পানিতে গোসল করলো অনেকটা সময়। গোসল সেরে বেরিয়ে এসে সে অনুভব করলো তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুতেই সে যেনো দেখলো সুপ্রিয় তার মাথার কাছে বসে আছে। বিউটি তার হাত চেপে ধরে বললো,’এবারে বোধহয় বিয়েটা হয়েই যাবে সুপ্রিয় ভাই! আশ্চর্য আপনি আসছেন না কেন এখনো? আপনি এলে তো আমার আর ভয় থাকে না।’

সে অনুভব করলো সুপ্রিয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে,
‘ভয় পাশ না আমি আছি তো। আমি থাকতে কার সাধ্যি তোকে আমার থেকে আলাদা করবে? আমি ছাড়া কারোর নামেই কবুল বলতে পারবি না তুই! আমিই হবো তোর অর্ধাঙ্গ!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১

‘আপনার অপেক্ষায় আছি সুপ্রিয় ভাই! আরও কবে আসবেন আপনি? দেখতে দেখতে কত গুলো বসন্ত আপনাকে ছাড়া পার করে দিলাম। সেদিনের ঘটনার পর কোথায় হাঁরালেন আপনি?’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩