সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৩
রাউফুন

প্রচন্ড জ্বরের ধা’ক্কা সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে বিউটি। মারিয়াম এসেছে তাকে দেখতে। অফিসে ফোন করে বিউটির অসুস্থতার কথা জানানো হয়েছে। মিনহাজ তা শুনে একদিনের ছুটি মঞ্জুর করেছে।
‘কি-রে কল্পনা মানবী! কি অবস্থা?
‘ভালোই তোর?’

‘আমারও ভালো। আমার তো মনে হচ্ছে জ্বরের চাইতে বিয়ের চিন্তায় তোকে একেবারে বেশি কাবু করে ফেলেছে। তারপর বল, বাড়িতে কি বলে ম্যানেজ দিচ্ছিস?’
মারিয়াম সাইড ব্যাগ রাখতে রাখতে লক্ষ্য করলো বিউটি হাসছে আপণ মনে। মেয়েটা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আধ পা’গ’ল থেকে একেবারেই পা’গ’ল হয়ে গেছে। সে বিউটিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘হাসছিস কেন একা একা?’
‘তাকে কল্পনা করছি।’
‘তা কি কল্পনা করলি?’
‘দেখলাম, সে আমাকে ধুম বৃষ্টিতে সাইকেলে চাপিয়ে ঘুরছে। আমি তার মাথায় ছাতা ধরেছি। তার খুবই সন্নিকটে আমি। মাই গড, কি অদ্ভুত ফিলিংস, যা বলে বোঝানো যাবে না তোকে।’
‘কল্পনায় অদ্ভুত ফিলিংস? কল্পনায় অনূভুতি হয় নাকি?’

‘হ্যাঁ, কল্পনায় তুই যা চাইবি, তোর যেভাবে ইচ্ছে হবে অনুভব করার সেভাবেই পারবি। ভেবেই দেখ না একবার, যদি তুই কল্পনা করে সুখে থাকতে পারিস তবে কল্পনা করবি না কেন? নিজেকে সুখী রাখতে যা করতে হয় তার সবটাই করবি বুঝলি? আমাকে দেখ, আমিও তাই করছি। আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের একজন মনে করি।’
‘থাক বাপু, আমার তোর মতো কল্পমানবী হওয়ার ইচ্ছে নেই। তা তোর কল্পমানব তোকে কল্পনায় চুমু টুমু খাই?’
বিউটি লজ্জা পেলো। তা দেখে মারিয়াম ঠোঁট বাকিয়ে বললো, ‘এয়্যাহ এমন ভাবে লজ্জা পাচ্ছিস যেনো বাস্তবেই চুমু দিয়েছে তোকে তোর সুপ্রিয় ভাই!’

‘আমার কাছে তাকে নিয়ে সব কল্পনায় বাস্তব লাগে!’
‘তোর অপেক্ষা শেষ হবে তো বিউটি?’
‘শেষ না হলেও ক্ষতি কি? বেশ তো আছি। আমি তাকে নিয়ে কল্পনায় সুখী হয়েছি। বাস্তবে পেলে যদি সে সুখ মূর্ছা যায়? আমি তাকে পেয়ে সেই সুখ হাঁরাতে চাই না।’
‘একেকবার একেক কথা বলবি না বিউটি!’ নরম কেদারা ছেড়ে বিউটির পাশে বিছানায় বসলো মারিয়াম। বিউটি অস্পষ্ট স্বরে বললো,

‘শুধু জেনে রাখ, তাকে মন থেকে আমি কতটা ভালোবাসি এটা প্রকাশ করার জন্য ভালোবাসি এই শব্দটা অনেক ছোট হয়ে যাবে। তাকে যে আমি পা’গ’লে’র মতো ভালোবাসি এটা বুঝানোর জন্য আমার এক জীবন খুব ছোট হয়ে যাবে।’
‘অনেক তো খুঁজলি পেলি কোথায় সুপ্রিয় ভাইকে?’

ওঁদের কথার মাঝেই বিউটির ভাবি সন্দিপ্তা চা নাস্তা নিয়ে এলো মারিয়ামের জন্য। বিউটি উত্তর দিতে পারলো না এই প্রশ্নের। সন্দিপ্তার পরনে মেরুন রঙের সুতি শাড়ী। কোমড়ে শাড়ীর আঁচল গোঁজা। চুল গুলো হাত খোঁপা করা। কপালে, নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাকে একদম অপূর্ব লাগছে। লাল ফর্সা হাতে স্বর্নের বালা জোড়া যেনো চকচক করছে। মারিয়ামের সামনে চা দিতে দিতে সন্দিপ্তা বললো, ‘মারিয়াম তুই বিউটিকে একটু বুঝাবি? সব যখন ঠিক ঠাক তখন এই ধ্যাটা, ধাড়ি মেয়ে বিয়ে করবে না বলে, না করছে। এটা কি ঠিক বল? এতে আমাদের বাড়ির মান সম্মান কি থাকবে?’

মারিয়াম কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই বিউটি নাকি স্বরে কান্না করতে শুরু করলো। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে বললো, ‘ভাবি আমি তোমাদের কাছে এতোই বেশি হয়ে গেছি যে আমাকে তাড়ানোর জন্য উঠে পরে লেগেছো? আমি কি দজ্জাল ননদের মতো তোমার ভাগের খাবার কে’ড়ে নিয়ে খাই? তোমার পছন্দের কসমেটিকস নিয়ে নিই? তোমার সুন্দর সুন্দর জামা নিয়ে পরি? তোমাকে কাজে হেল্প করি না আমি? আমি চলে গেলে তোমায় হেল্প কে করবে বলো? আম্মুর কি এখন সে বয়েস আছে যে তোমায় হেল্প করবে? আশ্চর্য আমাকে যে এভাবে তাড়াতে চাইবে ভাবতে পারিনি আমি ভাবি।’

‘বাবা সায়রের দাদা দাদিকে কথা দিয়েছেন। তুমি বিয়েতে অমত করলে বাবার কথার খেলাফ হবে না এতে? বয়স তো আর কম হলো না তোমার। এখনো বিয়ে করবো না, বিয়ে করবো না বললে তো আর হবে না। মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে এটা ধ্রুব সত্যি। আমি আসিনি বিয়ে করে এই বাড়িতে?’

‘আশ্চর্য সে তো এসেছো আমার ভাই জোর করে বিয়ে করেছে বলে। তোমার যে এখনো রূপের ঝলক আমিই মেয়ে হয়ে চোখ ফেরাতে পারি না। তখনও তুমি যে কি সুন্দর ছিলা গো ভাবি, এখনো সেই রূপ ধরে রেখেছো! আমি এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার রূপ দেখে দেখে টাস্কি খেয়ে যায়!’

বিউটির কথায় মারিয়াম মুচকি মুচকি হাসছে। সন্দিপ্তা বিউটির মাথায় আলতো চাটি দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। হেসে বললো, ‘হয়েছে তোর ঢপ দেওয়া? এই দেখ আমি কেমন ফুলে যাচ্ছি। এমন ফ্লার্টি ট্রেইনিং কার থেকে নিয়েছিস শুনি?’
‘সত্যিই বলবো? তোমার জামাইয়ের থেকে নিয়েছি!’
‘ওওও তার মানে তোর ভাই আমার সঙ্গে এতোদিন ফ্লার্ট করেছে! তোর ভাইয়ের আজকে হচ্ছে। এই সন্দিপ্তার সঙ্গে ফ্লার্ট করার মজা বুঝবে তোর ভাই লিপন!’

সন্দিপ্তা চলে গেলে মারিয়াম হেসে ফেললো শব্দ করে। অতঃপর বিউটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘যাকে পাওয়ার জন্য এতো দূর অব্দি যাচ্ছিস, এতো কিছু করছিস, এতো অপেক্ষা, এতো লাঞ্চনা বঞ্চনা সহ্য করছিস, সে কি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও অবিবাহিত আছে? যে মানুষটার অস্তিত্ব আছে কি না তার ঠিক নেই তাকে আঁকড়ে ধরে পরে আছিস।’

‘সে আছে, সে বেঁচে আছে। অলক্ষুণে কথা বলবি না তো। আমাকে ছাড়া আর কাউকে যদি সে ঘুরেও দেখে না, তবে সে অন্ধ হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা, তুই যে তার জন্য এতো অপেক্ষা করছিস ধর সে যদি বিয়ে থা করে থাকে, তখন কি করবি? তার দেখা পেলে তার সুখের সংসার কি ভেঙে দিবি?’
‘সে যদি বেঁচে থাকে আমায় ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না আমার বিশ্বাস!’

বিউটি শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলো। মারিয়াম ওঁকে ধরে উঠে বসালো। তারপর নরম স্বরে বললো, ‘সায়র ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে, তোকে অনেক ভালো রাখবে। উনারা তিন ভাই বোন। বড় ভাইয়া বিয়ে করেছে, ছোট একটা বোন তার বিয়ে হয়ে গেছে। সায়র ভাইয়া যখন দুই বছরের, আর উনার ছোট বোন তখন নয় মাসের শিশু! আর তখন উনার মার ব্রে**স্ট ক্যান্সার হয়।

লাস্ট স্টেজে ছিলেন তাই উনার মাকে বাঁচানো যায়নি। এরপর থেকে দাদা দাদির কাছে মানুষ হয়েছে উনারা। বাবা অন্যত্র বিয়ে করে আলাদা থাকেন। উনাদের কারোর খোঁজ রাখেন না। সায়র ভাইয়া অনেক ব্রিলিয়ান্ট, ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলেন। স্কলারশিপ এ বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। এই জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন সায়র ভাইয়া। তুই এই বিয়েটা করলে অনেক সুখী হবি! এই বিয়েটা যদি ভেঙে যায় কোনো ভাবে আংকেল আন্টিকে কি জবাব দিবি? এমনিতেই আংকেলের শারিরীক অবস্থা ভালো না। তোর চিন্তায় চিন্তায় বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কি বা’জে অবস্থা হয়েছে দেখেছিস?’

‘তোর আমার মতো বাচালের রোগ পেলো? তোর কি আর কথা নাই? কথা বের হয় না?’
‘বের হয়ই, হবে না কেন?
‘আশ্চর্য তাইলে কস না ক্যা? কথা বের কর। তবে এসব বিয়ে নিয়ে আমাকে বুঝাইস না! আমি সুপ্রিয় ভাইকে ঠিক খুঁজে পাবো।

আমি না পেলেও সে আসবে আমার কাছে। আসবেই দেখিস! আর এসে যদি উনি দেখেন আমি বিবাহিত তখন উনার কি প্রতিক্রিয়া হবে ভেবেছিস? তাই বিয়ে করবো না। উনি যেদিন আমার কাছে ফিরবেন, আমি আর সুপ্রিয় ভাই একে অপরের মুখোমুখি হবো। তাকে সামনে পেলেই প্রথমে জড়িয়ে ধরে নিরবে মনের অব্যাক্ত কথা গুলো ব্যাক্ত করবো। আর উনি আমি কিছু বলার আগেই আমার সকল অভিযোগ বুঝে যাবেন! এতো বছরের অব্যাক্ত কথা নিমিষেই শেষ হবে তাকে দেখলেই!’

চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে মারিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো। যেতে যেতে বললো, ‘যেভাবেই হোক মিনহাজ স্যার তোকে আগামীকাল অফিসে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।’
‘আশ্চর্য, আমি সুস্থ না হলে কি এম্বুল্যান্সে যাবো অফিসে? মিনিমাম ভদ্রতা, কমন সেন্স নেই উনার?’
‘আমি জানি না সেসব! গেলাম আমি!’

মারিয়াম চলে গেলে বিউটি খাতা পেন্সিল নিয়ে তার কল্পনায় সুপ্রিয়কে সে যেমন ভাবে সেভাবে আঁকতে লাগলো। আঁকতে আঁকতে সে খেয়াল করলো সে সায়রের চোখের মতো চোখ এঁকেছে। বিউটি নিজেই অবাক হয়ে গেলো। তখনকার সায়রের চোখের শীতল চাহনীতে কিছু একটা ছিলো যা বিউটির মনে নাড়া দিয়ে উঠলো। প্রথমবার কোনো পুরুষের চোখে তার চোখ আটকেছে ভাবতেই সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।

হঠাৎই মনে হলো অংকন করা চোখ দুটো সায়রের তখনকার চাহনীর মতো এঁকে ফেলেছে সে। অথচ সে সায়রকে ভাবেইনি। অজান্তেই এতো বড় ভুল সে কি করে করলো। হাতের কাগজটা ছিড়ে মুচড়ে ডাস্টবিনে ফেললো। মাথাটা দপদপ করছে কেমন যেনো।

সে আবারও কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। সে আরো একটা ভুল করলো। আশ্চর্য এমন ভুল তো হওয়ার কথা না তাও হলো কিভাবে? এতো দিন তো এমন ভয়ানক ভুল হয়নি! নাহ সায়রের চোখের দিকে তাকানো তার উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। সুপ্রিয় ভাই জানলে নিশ্চয়ই অনেক রাগ করবে তার উপর। ছিঃ ছিঃ। বিউটির নিজেকে ভয়ংকর শাস্তি দেওয়া ইচ্ছে জাগছে এই মুহুর্তে। একটা ভয়াবহ শাস্তি তার প্রাপ্য!

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২

বিঃদ্রঃ১(অনেকেই চাচ্ছেন নায়িকার নাম চেঞ্জ করি, কিন্তু এই নামে কি হয়েছে? ইংরেজিতে বিউটি মানেই সুন্দরী এটা খারাপ কি?😑🙂 আর সুপ্রিয় আর বিউটির ছোট বেলার বয়সের কথা বলছেন সেটা বাড়িয়ে বিউটির তেরো আর সুপ্রিয়র উনিশ করে দেওয়া হলে আমার ভাবা প্লটের বিরাট পরিবর্তন হয়ে যাবে। (শুধু এটুকু বলি নায়িকার তেরো বছর দিলে সুপ্রিয়র ফেস টা মনে থাকবে আর সাত বছর বয়স দিলে মনে থাকবে না।) আরও বাদ দিতে হবে অনেক কিছু। নায়িকার নামও পরিবর্তন হচ্ছে না। প্লিজ কেউ কিছু মনে করবেন না।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ৪