সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৮

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৮
রাউফুন

ডক্টর দেখে যাওয়ার পর একজন সুন্দরী নার্স এলো বিউটির কেবিনে। বিউটির অনেক গুলো টেষ্ট করাতে হবে। তাই নার্স তার ড্রেস বদলে হসপিটালের ড্রেস পড়াতে এসেছে। যেহেতু তাকে আরও এক সপ্তাহ হসপিটাল থাকতে হবে সেই হিসেবে তাকে এখান কার ড্রেস পড়তে হবে। রোগীদের ড্রেস। নার্স যখন তাকে ড্রেস পড়াতে যাবে তখন বিউটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

‘নার্স, শুনুন!’
‘ইয়েস ম্যাম!’
‘আমার এই লম্বা বিনুনি যদি না খুলি তবে কি কোনো সমস্যা হবে? আর, আর, আর এই ড্রেসটাও থাকবে হ্যাঁ?’
‘কিন্তু…!’
‘আবার কিন্তু কি? খুলবো না ড্রেসটা৷’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘এটা তো প্রাইভেট হসপিটাল ম্যাম! তাই হসপিটালের রুলস গুলো মানতে হবে।’
‘তাতে কি হয়েছে? আমাকে হসপিটালের ড্রেস না পড়ালে কি আপনার চাকরি থাকবে না?’
‘না তা নয়। তবে আপনার তো এখানে প্রায় বেশ কিছু দিন থাকতে হবে। তাই ড্রেস বদলানো আবশ্যক! একই ড্রেস তো আর প্রতিদিন পড়ে থাকতে পারবেন না।’

‘আমার একটা কথা শুনুন, আমি একজনের জন্য মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছি। এখন দেখুন, যার জন্য অপেক্ষা করছি, সে যদি আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে আমাকে দেখতে আসে তখন তো আমার সঙ্গে রাগ করবে, অভিমানে মুখ ফুলাবে। সে বলেছিলো আমাকে এই ড্রেস পড়েই দেখতে চাই।’

‘কার কথা বলছেন?’
‘আপনি শুনবেন?’ বিউটি আগ্রহ নিয়ে শুধালো। তার চোখ চকচক করছে। প্রসঙ্গ যখন সুপ্রিয় ভাই তখন তো চোখে মুখে উজ্জ্বলতা দেখা যাবেই?
‘হ্যাঁ!’ নার্সটি বললো।

‘বসুন পাশে। জানেন আমাকে কেউ-ই শুনতে চাই না। আমি নাকি খুব বেশি বকবক করি। অবশ্য আমিও মানি এটা। একটু পর আমার বকবকানিতে আপনিও বিরক্ত হয়ে যাবেন। বলবেন একজন মানুষ অসুস্থ হয়েও যদি এতো কথা বলতে পারে তবে সুস্থ হলে কত কথা বলবে? আচ্ছা আপনিই বলুন, আল্লাহ্ মুখ দিয়েছে কি বসিয়ে রাখার জন্য? যতক্ষণ শ্বাস চলবে কথাও চলবে! কি হলো ঠিক কি না বলুন!’

নার্স মেয়েটি মাথা নাড়লো। উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি কি যেনো বলতে চাইছিলেন ম্যাম!’
‘জানেন আমার ছোট্ট বেলার একজন পছন্দের মানুষ ছিলো। তাকে কল্পনা করে সর্বক্ষণ কে’টে যায়। ভালোবাসা বাসি, তাকে ছোঁয়া, তার খিলখিল হাসিকে উপলব্ধি করা, তার এলোমেলো চাহনি, তার ঝাকড়া গোছানো চুল এলোমেলো করে দেওয়া, সে হাসলে যেনো পুরো পৃথিবী থমকে যায়।

ইশ ছেলেরাও বুঝি এমন ভয়ংকর সুন্দর করে হাসে! আপনি শুনলে হাসবেন কিন্তু এটাই সত্যি। আমি আমার সুপ্রিয় ভাইকে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে, ভালোবাসা বুঝতে পারার পর থেকে শুরু করে, আমার বয়সন্ধির উঠতি বয়স থেকে শুরু করে এখনো অব্দি তাকে পছন্দ করে যাচ্ছি। আমার এক ঘেঁয়েমি, জেদ, রাগ, বকবকানি সবকিছুতে সে মিশে আছে। তাকে ভালোবেসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি এখনো পর্যন্ত।

কিন্তু নিষ্ঠুর মানব এখনো সামনে এলো না। জানেন, পরশু রাতে আমার বার্থডে ছিলো। সে সারাদিন পর রাতে আমার বারান্দা দিয়ে চুপিসাড়ে এসে আমাকে গিফট দিয়ে গেছে। কেক, এই যে গলায় লকেট এস লেখা এটাও পরিয়ে দিয়েছে, একটা সুন্দর চিঠিও দিয়েছে। অথচ আমি এতো ঘুমে বিভোর ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি। আর গতকাল আমার বিয়ে ছিলো জানেন নার্স। কিন্তু যার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ছিলো তার বোন জামাই আজকে ইন্তেকাল করেছে।

এখন ম’রার ঘোড়ে তো আর বিয়ে হতে পারে না। আর এদিকে আমার তুমুল জ্বর। আমি জানি আমার একটা ভয়াবহ অসুখ হয়েছে। তাই আমি অনেক সময় আজেবাজে কথা বলি, অকারণ বকবক করে অন্যকে বিরক্ত করে ফেলি। জ্বরের ঘোরে নানাবিধ ঐতিহাসিক ঘটনা মনে পড়ে। কি মনে হয় জানেন?

মনে হয় আমি সুপ্রিয় ভাইয়ের সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছি। সব সুপ্রিয় ভাই আমার কল্পনায় আসা যাওয়া করে। মাঝে মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হয়। এই যে হৃদ যন্ত্র এখানে তীব্র ব্যথা হয়। আর শুনুন, মেঘের মতো সাদা ফুরফুরে চোখ, সরু পাতলা লাল খয়েরি ঠোঁট, খাড়া ঘ্রান্দ্রেয়ী, মাথায় এক ঝাক ঝাকড়া চুল, লম্বাচওড়া পুরুষ, এমন কেউ যদি আমার খোঁজ করতে আসে তবে সোজা আমার কাছে পাঠাবেন।

সে আমি যেমন অবস্থাতেই থাকি না কেন৷ ঠিক আছে?’
রুম্মিন মাথা নেড়ে সাই জানালো। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে আড়ালে চোখ মুছে নিলো। বিউটি তা দেখে বললো, ‘আরে, আরে নার্স কাঁদছেন কেন? আমার মতো নগন্য কারোর জন্য আপনি কাঁদছেন? অবিশ্বাস্য।আপনার এতো মূল্যবান চোখের পানি আমার জন্য ফেলে নষ্ট করবেন না প্লিজ! আমি তো আপনার কেউ হয় না তবে এই খারাপ লাগা কিসের জন্য?’

‘এই যে কাউকে না দেখে, শুধু তাকে কল্পনা করে, কিভাবে এতোটা ভালোবাসা যায় আপনাকে না দেখলে জানতামই না। ভালোবাসা এমনও হয়? এরকম ভালোবাসা যে বিরল আপু। স্যরি আপু বলে ফেললাম।’
‘আরে আপুই তো বলবা। আমি তোমার বড় না?’
‘আচ্ছা আপু আসি। পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে আরও!’
প্রস্থানের আগে বিউটি আবার বললো, ‘অনেক কথা হলো তোমার সঙ্গে কিন্তু নাম জানা হলো না।’

‘আমি রুম্মিন।’
‘বাহ সুন্দর নাম। আর শুনো, যদি আমার বিনুনি আর আমার ড্রেস খুলে তোমাদের হসপিটালের ড্রেস পড়তে হয় বলো আমি নিজেই পড়ে নিবো। এই যে জামাটা দেখছো, এই রকম জামা আমার শয়ে শয়ে আছে বাসায়। সেই ছোট্ট থেকে এই একই কালারের জামা পড়েছি তো তাই মায়া পরে গেছে। ছাড়তে ইচ্ছে করে না!’

বিউটি বহু বছর পর সেই জামাটা ছাড়লো। বাথরুমে গিয়ে জামাটা জড়িয়ে ধরে কান্না করলো ভীষণ। এই জামাটাই সে সুপ্রিয় ভাইয়ের গন্ধ পাই।জামাটা শরীর থেকে আলাদা করার সময় তার মনে হলো সে তার থেকে তার সুপ্রিয় ভাইকে আলাদা করে দিয়েছে। তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আবারও অনুভব করলো বুকের ভেতর সে ভোতা ব্যথা!

বিউটির সম্পুর্ন শরীরের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাকে তার বেডে শিফট করা হলো। শাহানা বেগম বাড়ি থেকে মেয়ের জন্য নানান পদের রান্না করে এনেছেন। চোখের পানি ফেলছেন আর সেসব বিউটিকে খাওয়াচ্ছেন।
‘আশ্চর্য আম্মু, আমি তো তোমার কথা শুনে খাচ্ছি তাও কেন কাঁদছো?’
শাহানা জবাব দিলেন না মেয়ের কথার। বরং কান্না দাপট বাড়লো তাঁর। তিঁনি কিভাবে বুঝাবেন মেয়ের জন্য তার ভেতরটাই কি হচ্ছে এখন?

সন্দিপ্তা পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুকের ভেতর যে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে তা তো আর চেপে রাখতে পারছে না সে। হাশেম আলীর বয়স হয়েছে। বার বার মেয়েকে দেখতে আসাটা তাঁর জন্য ভীষণ কষ্টের। মারিয়াম বাড়িতে হাশেম আলীর খেয়াল রাখছে ঠিক নিজের মেয়ের মতো। লিমন বোনের রিপোর্ট, ওষুধ নিয়ে আসা, নিচ তলা থেকে উপর তলা এভাবেই ছোটাছুটি করে যাচ্ছে।

বিউটি সন্দিপ্তা আর শাহানা বেগমকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। এরপর মারিয়াম এলো মাগরিবের পর। তার মুখ টা ভীষণ ভার হয়ে আছে। তা দেখে বিউটি বললো, ‘কি রে তোরা সবাই এমন প্যাঁচার মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস কেন? এমন ভাব করছিস যেনো আমি মা’রা যাবো সত্যিই।আমার ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ কিছু হয়েছে।’

‘আহ বিউটি, সব সময় আজেবাজে কথা। আল্লাহ্ না করুন এরকম কিছু যেনো না হয় তোর। আসলে আমার তোর বিষয়ে ছাড়াও আরেকটা বিষয় নিয়ে মন খারাপ!’
‘কি হয়েছে বল তো? আগেই বুঝেছি কিছু একটা হয়েছে!’

‘সিজানকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার শ্বশুর শাশুড়ী এসেছিলেন। সব জায়গায় খুঁজেও নাকি তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎই উঁধাও হলো কিভাবে?’
‘থানায় জানাতে বলেছিস?’
‘হ্যাঁ জানানো হয়েছে।’
‘আচ্ছা, আমার কি মনে হচ্ছে জানিস?’
‘কি?’

‘আজ রাতে সুপ্রিয় ভাই আসবে। আমাদের আর কোনো প্ল্যান করতে হবে। তাছাড়া আমি অসুস্থ হওয়ায় সব প্ল্যান ভেস্তে গেছে। আমরা যে লোক ঠিক করেছিলাম রাহেলা আপুকে তুলে নেওয়ার জন্য তাদের বারণ কর৷ আর তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দে। এবারে সুপ্রিয় ভাইয়ের আগমের পালা।’

‘ওকে আমি বারণ করে দিচ্ছি! তুই শিওর সুপ্রিয় ভাই আসবেন?’
‘হ্যাঁ! আমি অসুস্থ আর সে আসবে না তা কি হয়?’
‘ওও তোকে কিন্তু আজকে দেখগে অন্য রকম লাগছে জানিস?’
‘আলাদা রঙের ড্রেস আপ তাই!’

রাত বারোটার পর সত্যিই একজন বিউটির কেবিনে প্রবেশ করলো। তাকে এতো রাতে এখানে আসার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এতো সহজ ছিলো না তার জন্য এখানে আসা! বিউটি ঘুমের ভান ধরে অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎই কোনো পদধ্বনিতে তার বুকে ধুকপুক ধুকপুক শুরু হলো। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেনো বিউটির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছিলো।
হঠাৎই বিউটি অনুভব করলো সে শুন্যে ভাসছে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রইলো সে। এই পারফিউম, এই গন্ধটা তার চেনা। এখন সে চোখ খুললে ধরা পরে যাবে। হঠাৎই সে একটা ভারী এবং পরিচিত স্বর শুনতে পেলো। মানুষটা গুনগুনিয়ে বললো,

‘ওহে পদ্মফুল, রজনীগন্ধা, চলো যায় সেথা, ফাগুনেরা মিলেছে যেথা, সেথা রয়েছে অনাবিল সুখের উল্লাসে মেতে উঠা মাতাল করা হাওয়া। ওহে সুকেশিনী, সামলে রেখো তোমার কেশ। আমি উম্মাদনায় হারায় তোমাতে বেশ!
খুলে দাও বন্ধ আঁখি, দেখো এক মুক্ত আকাশ। তোমার সুন্দর, মিষ্টি অপেক্ষা এবার হোক শেষ!’
‘সায়র!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৭

‘উঁহু সায়র নয়!তোর সুপ্রিয় ভাই।আর লুকোচুরি নয়। অপেক্ষার অবসান হোক আমার সুকেশিনীর?’
‘আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’বিউটির সহজ সরল প্রশ্ন।
‘আমার সঙ্গে যেতে ভয় পাচ্ছিস?’
বিউটি তার দু-হাতে সায়র ওরফে তার সুপ্রিয় ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। বললো,’উঁহু! বিউটি আপনার সঙ্গে জাহান্নামে যেতেও রাজি সুপ্রিয় ভাই!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৯