সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৯

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৯
রাউফুন

সুপ্রিয় আর বিউটি দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝিলের ধারে। এইদিকে আশেপাশেই সুপ্রিয় তার কয়েকজন লোক রেখেছে। সে এখন একা নয়। বিউটি আছে এখন। চতুর্দিক থেকে বিপদেরা ওত্ পেতে আছে।
বিউটির শরীরে তখন আর হসপিটালের ড্রেস নেই। একটা খয়েরী রঙের শাড়ী তার পড়নে। জীবনের প্রথম শাড়ী পড়াই বিউটির মনে হচ্ছে সে নীল আকাশে পাখির ন্যায় উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

প্রজাপতিরা রঙিন পাখনা মেলে উড়াউড়ি করছে। খয়েরী রঙের শাড়ীটা সুপ্রিয় বিউটির জন্য আগে থেকেই কিনে রেখেছিলো। এই রাতের বেলাতে তাঁকে শাড়ী পড়তে হয়েছে। সে জীবনে কখনোই শাড়ী পড়েছে? যেভাবে পেরেছে সেভাবেই পড়ে ফেলেছে। আজ অদ্ভুত এক অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হলো বিউটি। সুপ্রিয় পাশেই দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছে বিউটিকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিউটির মনে হচ্ছে সে এখন একটা স্বপ্নপুরীতে আছে। চারিদিকে ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে। সুন্দর মনোমুগ্ধকর একটি ফ্লাওয়ারস গার্ডেন, মাঝে সরু রাস্তা। একটা বিল রয়েছে, বিলে রয়েছে সুন্দর পদ্মফুল আর বিলের ঘাটে প্রকান্ড একটি গাছের সঙ্গে দোলনা বানানো আছে। চারপাশে এতো লাইট, যে দিনের আলোর মতো সবকিছু পরিষ্কার দেখাচ্ছে। সুপ্রিয় আর বিউটি বিলের ঘাটে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় গা ভেজাচ্ছে।

চাঁদের আলো এসে বিলের পরিষ্কার পানিতে পড়েছে। কি সুন্দর ভাবে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়েছে নদীর টলটলে স্বচ্ছ জলে৷ বিউটি সবকিছুতে মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছে। আজকে শুধুই তার মুগ্ধ হওয়ারদিন। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘হে প্রকৃতি দেখো, আমি আমার মনের মানুষকে পেয়ে গেছি। আমার কল্পনা মানব আমাকে ধরা দিয়েছে। ধরা দিয়েছে সে। আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাকে একটি সুন্দর মুহুর্তে উজ্জীবিত করেছে। আজ থেকে আমি, আমার সবকিছুই স্বাধীন। কোনো বাঁধা নেই, বিপত্তি নেই। শুধুই সুখ আর সুখ। হে আকাশ বাতাস জেনে নাও আমি আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে সূখী মানুষ! আমার চাইতে বেশি সুখী আর কেউ নেই। কেউ না!’

নিরবতা ভেঙে সুপ্রিয় শান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
‘বিউটি, চুপ করে আছিস যে? তোর কোনো কিছু জানার নেই? কোনো প্রশ্ন নেই? আমি এতোদিন সামনে থেকেও তোর কাছে ধরা দেইনি কেন? জিজ্ঞেস করবি না? এতো বছরই বা কোথায় ছিলাম?’

‘উঁহু!’
‘কেন?’
‘কারণ বিউটি জানে তার সুপ্রিয় ভাই কোনো কারণ ছাড়া এরকম করবে না। আপনি যদি একটা সেকেন্ডও পেতেন আমার কাছে ছুটে চলে আসতেন এটা আমার বিশ্বাস।’
‘বাচ্চা একটা মেয়ে এতো বিশ্বাস আর মনোবল কোথায় পেলি তুই?’ ঠাট্টার স্বর সুপ্রিয়র।

‘আমি বাচ্চা মেয়ে?’
‘তা নয়তো কি?’
‘আমার উনত্রিশ বছর দুইদিন এক ঘন্টা দুই সেকেন্ড বয়স চলছে। তোমার বিউটি বুড়ি হয়ে গেছে, এখনো বাচ্চা বলছো?’ বিউটি ঘন্টা, সেকেন্ড সুপ্রিয়র হাত ঘড়িতে দেখে বললো।
‘তাই তো। তুই বুড়ি হয়ে গেছিস যে! এখন উপায়?’

‘তুমি এতো ইয়্যাং কিভাবে? তোমার ছত্রিশ বছর বোঝা যায় না কেন?’
‘বিদেশে জীম করেছি না? ওখানে থাকলে বয়স বেশি হলেও বিদেশের ছোঁয়াই আর জীবন যাত্রার জন্য বয়স বোঝা দায়!’
‘আচ্ছা বুঝলাম, আমার একটাই প্রশ্ন আছে, সায়র নামের কি কেউ-ই এক্সিস্ট করে?’

‘হ্যাঁ। আমার প্রিয় বন্ধু আবার ছোট ভাই ও বলতে পারিস সায়রকে। সায়রের সঙ্গে কাকতালীয় ভাবেই বিদেশে পরিচয় হয় আমার। ওঁর বাবার আরেকটা বিয়ে করার কথা শুনে মনের দুঃখে আর দেশে আসেনি। বিদেশেই বিয়ে করে সংসার করছে সায়র। তবে ওঁর ফেসটা আমাকে নিতে হয়েছে। বলতে পারিস একটু মিল অমিল রেখেই বিদেশ থেকে ভালো একটা সার্জারি করিয়েছি। ছবিতে বা একবার দেখায় কেউ-ই ধরতে পারবে না আমি সায়র নয় সুপ্রিয়। সায়র কখনোই দেশে আসবে না। সায়র আমার জন্য এতো কিছু করেছে যে,ওর কাছে আমি আজীবন ঋণী হয়ে থাকবো।’

‘কিন্তু আপনার চেহেরায় বদল আনার কি প্রয়োজন ছিলো? আপনি তো এমনিতেই আসতে পারতেন।’
‘প্রয়োজন ছিলো। শুধু চেহেরায় না, নাম-ধাম সবকিছুতে পরিবর্তন না আনলে শত্রু পক্ষ আমাকে চিনে ফেলতো। আমাদের কখনোই শত্রু পক্ষকে দূর্বল ভাবা উচিত নয় বুঝলি?’
‘আচ্ছা বুঝলাম। আপনি এতো গুলো বছর আড়ালে ছিলেন কেন? স্যরি সবটা জানার কৌতুহলটা আপনার জন্যই হলো। আপনি যেহেতু বলতেই চাইছেন তবে বলুন সবটা!’

‘ষোল বছর বয়সে একটা চরম বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হতে হয় আমাকে। ম’র’তে ম’র’তে বেঁচে গেছি আমি। মা বাবাকে বাঁচাতে পারিনি সেই আফসোস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে। আমি দেশ ছাড়ি আমার বাবার প্রিয় বন্ধু শেখর আংকেলের সাথে। সেদিন শেখর আংকেল না থাকলে বোধহয় আমি বেঁচে থাকতাম না। সেদিনের লোহমর্ষক ঘটনার কথা মনে হলে আজও আমার কলিজায় কাঁপন ধরে।

আমরা পরিবারের সবাই তখন রাতের খাবার খেতে বসেছি। কাকন আপু, আমি, আব্বা, আম্মা। আমরা আনন্দ করে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই মুখোশপরা দুইজন লোক আমাদের ঘরে প্রবেশ করে। আমরা চেঁচামেচি করার আগেই ওঁরা আমাদের অজ্ঞান করে ফেলেছিলো। আমার আর কিছু মনে ছিলো না। আমার যখন জ্ঞান আসে দেখি, আমার মুখের সামনে আমার খুব পরিচিত একটি মুখ। সে আমার পেটে ছু’ড়িঘা’ত করেছিলো। আমি স্তব্ধ হয়ে, থমকে গিয়ে শুধু তাকে দেখছিলাম।

এরপর তারা যখন আব্বা আম্মার লাশ লুকিয়ে ফেলার জন্য গেছিলো, তখনই আমার সামনে আসেন আব্বার বন্ধু শেখর আংকেল। আমার মনে পড়ে, আব্বা বলেছিলেন, “যদি আমরা কেউ কখনোই না থাকি তবে এই নাম্বারে যোগাযোগ করিস। তোকে সে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে।” আমি এখন বুঝতে পারি, আব্বা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, তার সঙ্গে এরকম কিছু হতে পারে। মৃ’ত্যু পথযাত্রী আমি তখন ছটফট করছিলাম। শেখর আংকেল দ্রুত আমাকে ঘর থেকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন।

আমাকে দ্রুত শহরের হসপিটালের দিকে নিয়ে চলে আসেন। উনি হইতো কোনো কারণে আমাদের গ্রামেই আসছিলেন। হইতো বাবা আশংকা করেছিলেন এমন কিছু হতে পারে। সেজন্য শেখর আংকেল এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। উনি না থাকলে আমাকে এখানে দেখতে পারতিস না। আমাকে শেখর আংকেল একদম নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করেছেন। আমাকে এখানে সুস্থ করেন। আমি প্রায় চার পাঁঁচ বছর ট্রমায় ছিলাম। জান প্রাণ দিয়ে আমাকে সুস্থ করেছেন। আমি সুস্থ হওয়া পর আমাকে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য বিদেশ পাঠান শেখর আংকেল।

উনার একটা মেয়ে আছে। মেয়ে আর আমাকে এক সঙ্গেই বিদেশ পাঠান। আমি ওখানে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে আমার নিজের একটি পরিচয় গড়তে থাকি। আর উনারই মেয়ে রুম্মিনকে বিয়ে করেন সায়র। তারপর সায়রের সঙ্গে আমার পরিচয়, ভালো বন্ধুত্ব! অবশ্য আমাকে সব কিছুতেই শেখর আংকেল সাহায্য করতেন। আজ আমার এতো ক্ষমতা, এতো দৌলত সবটাই শেখর আংকেলের জন্য!

প্রতি বার দেশে আসতাম শুধু মাত্র তোকে খুজার জন্য। কিন্তু কোনো ভাবেই খুঁজে পাইনি। এতো কিছুর মধ্যে একটা মুহুর্তও তোকে ভুলতে পারিনি আমি। তুই ছাড়াও আরও একজনকে খুঁজে বের করার চেষ্টায় মরিয়া ছিলাম আমি। সারা বাংলাদেশে আমি কিভাবে খুঁজে পেতাম তোদের? আমি যদি শুধু একবার জানতাম কোথায় ট্রান্সফার হয়েছে হাশেম আংকেলের তাহলে আরও অনেক আগে খুঁজে পেতাম।

‘এক মিনিট কি নাম বললেন সায়রের বউয়ের?’
‘রুম্মিন। রুম্মিন আজকে হসপিটালে নার্স সেজে ছিলো। ওঁকে আমাদের ছোট বেলার গল্প শুনিয়েছিস। ওর সাহায্যেই তোকে এখানে নিয়ে এসেছি!’
তার মানে সব প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিলো? আর আপনাকে আ’ঘা’ত করা পরিচিত মুখ টা কার ছিলো?’
‘এটা না হয় পরেই বলবো! তবে তোকে এবারে আমার একটি কাজ করে দিতে হবে।’
‘কি কাজ?’

‘আস্তে আস্তে সব বলবো। এখন এই মুহুর্তটা অনুভব করতে থাক।’
‘করবো তার আগে আপনার কাজে লাগতে পারে এমন একটা ইনফরমেশন দেওয়ার ছিলো।’
‘কি রকম?’
‘সেদিন রাহেলা আপু মানে মিনহাজ স্যারের বোন উনারা দুইজন আমাদের বাড়িতে এসেছিলো। এটা জানেন?’
‘হ্যাঁ জানবো না কেন? ওঁদের তুই তো আসতে বলেছিলি! তোর ঐ বসের হাতও তো ধরেছিলি রেস্ট্রন্টে!’

বিউটি হেসে ফেললো সায়রের ছেলেমানুষী দেখে। বললো,’ বাপরে এতো হিংসুটে কেন আপনি?’
‘তো হবো না? সে আমার সুকেশিনীকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাইবে আমি বসে বসে দেখবো? এবারে আসল কথায় আসা যাক। কি ইনফরমেশন?’

‘মিসেস রাহেলা যেদিন আমাকে প্রথম দেখেছিলেন, সেদিন অদ্ভুত বিহেভ করেন। প্রথমে আমার হাতের বার্থ সাইন দেখলেন, সব পরিচয় নিলেন। উনাকে অস্বাভাবিক লাগছিলো। সেদিন উনি বলেছিলেন মিনহাজ স্যারের পরিচারিকা তিনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে গিয়ে তিনি বলেন মিনহাজ স্যার উনার নিজের ভাই মানে আপনার পরিচয় দিয়ে মিনহাজ স্যারকে সুপ্রিয় বানানোর চেষ্টা করলেন। হসপিটালেও মনে হচ্ছিলো মিনহাজ স্যার কারোর শেখানো বুলি আওড়াচ্ছিলেন। সেই অনুযায়ী সুপ্রিয় হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে মিনহাজ স্যার। কিন্তু আমাকে যে কেউ-ই এসে নিজেকে সুপ্রিয় বলে দাবী করলেই কি আমি বিশ্বাস করবো? আমি মারিয়ামকে সব সময় বলতাম, সুপ্রিয় ভাই আমার সামনে এলেই আমি তাকে অনুভব করতে পারবো।’

‘তাহলে আমাকে প্রথমেই কেন চিনতে পারিস নি?’
‘চিনতে পেরেছিলাম হইতো। আপনার উপস্থিতিতে বার বার আমার মনে হতো আপনি আমার খুব কাছের। সুপ্রিয় ভাইকে ভুলে যেতাম আপনার উপস্থিতিতে। সুপ্রিয় ভাইকে আঁকতে গিয়ে আপনার চোখ এঁকে ফেলেছি বার বার। আসলে আমার আপনার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এটা মানতে পারিনি। তাই আপনি আমার সামনে এলে বিরক্তিটাই বেশি অনুভব হতো। আপনি সুপ্রিয় ভাই হতে পারেন এটা আমি মানতেই চাইনি।’

‘তাহলে এতো সহজে সায়রকে সুপ্রিয় ভাই মেনে নিলি কিভাবে?’
‘আমার বার্থডের রাতে আমি আপনাকে চিনেছি পুরোপুরি ভাবে। মানুষ কিন্তু প্রিয় মানুষের উপস্থিতিতে তার কল্পনার মানুষ কে ভুলে যায়। সেজন্য আপনি আমার সামনে এলেই সুপ্রিয় ভাইকে ভুলে যেতাম। তাছাড়া, আপনি এতটা কড়া পারফিউম ইউস করেন যে। আপনার পারফিউম এর গন্ধই আপনাকে চিনিয়ে দিয়েছে।’
‘বাহ বাহ এই তোর আমাকে নিয়ে অনুভূতি? আমি কাছাকাছি, সামনাসামনি ছিলাম আর তুই আমাকে চিনলি না! এটা খুব খারাপ!’

‘আমি আপনার চোখ ছাড়া কিছুই দেখিনি। আমি কি আপনার মুখের দিকে একবারও তাকিয়েছিলাম? বলুন?’
‘এখন তাকা!’
বিউটি পূর্ন দৃষ্টিতে তাকালো সুপ্রিয়ার দিকে। না চাইতেও আবেগে সুপ্রিয়র পুরো মুখে হাত বুলিয়ে দিলো। তার চোখে চিকচিক করছে পানি। সুপ্রিয়ও মন ভর বিউটিকে দেখছে। হঠাৎই বিউটি ঝাপিয়ে পরলো বুকে। প্রিয় শখের পুরুষের বুকে মাথা দিয়ে হইতো সুখ খুঁজে নিচ্ছে সে।
সুপ্রিয় ফিসফিস করে বললো,

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৮

‘আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি বিউটি। এক্ষুনি আমার থেকে দূরে যা না হলে আমি ভুলভাল কিছু করে বসবো। তুই কি চাস এমন কিছু হোক? ভোর রাতে কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরে?’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২০