সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২০

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২০
রাউফুন

‘আমি না হয় আমার অনুভূতি বুঝতে দেরি করে ফেলেছি কিন্তু সুপ্রিয় ভাই, আপনি এতো দিন কেন বলেননি আপনিই আমার সুপ্রিয় ভাই?’
‘বলতাম তো! আমাদের বিয়ের রাতে তোকে সারপ্রাইজ দিতাম। কিন্তু তুই যা দূর্বল। অসুখ লেগেই আছে। এখন না বললে তুই যদি সত্যি সত্যি মিনহাজকে বিয়ে করে নিতি, তখন কি হতো?’

‘মোটেও না। মিনহাজ স্যার আমাদের বাড়িতে আনাটা ছিলো সম্পুর্ন প্রি-প্লেন্ড! আমি জানতাম রাহেলা আপু একটা না একটা ভুল করবেনই। সেদিন যখন মিনহাজ স্যারর সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাদের ছাদে পাঠাচ্ছিলেন তখন আমি মিনহাজ স্যারকে উপরে যেতে বলে অর্ধেক পথেই ফিরে আসি ওয়াশরুমে যাবো এই কথা বলে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তারপর এসে আড়াল থেকে সব কথায় শুনেছি। উনি বলেছিলেন, উনি কাকন আপু। সেদিন আপনাদের বাড়িতে ডাকাত হামলা করেছিলো। আপনার বাবা মাকে ডাকাতরা মে’রে ফেলেছে। তারপর আবার বললেন মিনহাজ স্যারই নাকি সুপ্রিয় ভাই। উনার নাম কাকন বদলে রাহেলা আর সুপ্রিয় নাম বদলে নাকি মিনহাজ রেখেছেন। উনি নাকি সন্দেহ করেন যে ওঁরা ডাকাত ছিলো না কোনো গুপ্ত শত্রু ছিলো। সেজন্য নাম পরিচয় বদলে ফেলেছেন। এখানেই আমার খটকা লাগলো।’
বিউটি সেদিনের সমস্ত কথোপকথন বললো গুছিয়ে।

‘কি বললি?’
‘কি বললাম?’
‘রাহেলা নাম বদলে কাকন নাম রেখেছেন ঐ মহিলা?’
‘হুম তাই তো আমার আব্বুকে বলছিলেন।’
‘আর তোর কাছেও তোর ঐ টক্সিক বস মিনহাজ মানে আমি সেজে গেছিলো রাইট!’
‘হুম!’

‘এর একটাই মানে হয়। এবারে সবটা পরিষ্কার আমার কাছে।’
সুপ্রিয় ভেতর থেকে জ্বলে উঠলো। সে কিছু ভাবছে। সুপ্রিয় কিছু একটা বলবে তার আগেই বিউটি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
‘রাহেলা আপু আমাদের জন্য জোড়ালো তিনটা ক্লু ছেড়েছেন! উনার ভুল গুলো আমি তো ধরেছিলাম। কিন্তু বাবা ধরতে পারেন নি।’
‘কেমন ভুল? কি ক্লু ছাড়ার কথা বলছিস?’ সুপ্রিয় ভ্রু কুচকে বললো।

‘প্রথম ভুল যেটা সেটা হলো, উনি রেস্ট্রন্টে আমার বার্থ সাইন দেখলেন, তার মানে উনি জানতেন আমার জন্মদাগ আছে, জন্মদাগ দেখার পর অনেক ঘাবড়ে যান, তারপর স্বাভাবিক হতে সময় নিলেন। আমার জন্মদাগের ব্যাপারে আপনি, আমার বন্ধু মারিয়াম, আর আমার ফ্যামিলির কেউ ছাড়া জানতো না। আপনি তো আপনার বোন কাকন আপুকে আমাদের শৈশবের সব কিছুই বলতেন।

নিশ্চয়ই আমার জন্মদাগ আছে সেটাও বলেছেন।তার মানে এখানে পরিষ্কার রাহেলা আপুই আপনার বোন কাকন। আর উনিই মিনহাজ স্যারকে সুপ্রিয় ভাই সাজিয়ে পাঠিয়েছেন। আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করাতে মিনহাজ স্যারের গলায় নিখুঁত ভাবে মেক-আপের সাহায্যে কা’টা দাগও বসিয়ে দিলেন। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই মেক-আপটা উনিই করে দিয়েছেন। সবকিছুই ঠিক ছিলো কিন্তু গলার দাগটা উনি ভুলবশত ডান পাশে বসিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তো জানি, আমার সুপ্রিয় ভাইয়ের গলার দাগ টা বাম পাশে ছিলো।’

‘লাস্ট যখন আমাদের দেখা হলো তুই আট বছরের ছিলি তখন! এতো কিছু মনে রেখেছিস তুই?’
‘আপনার এই কে’টে যাওয়া দাগের কথা আমি ভুলবো? কখনোই না।’
‘আচ্ছা দেখ তো এখনো দাগ আছে?’
‘আছে, আছে। আমাকে এসিড মা’র’তে আসার দিন আপনার ঘাড়ের বাম পাশে সেরকম কা’টা দাগ দেখে থমকে গেছিলাম। তারপরও আমার মন মানতে চাইনি আপনি সুপ্রিয় ভাই। কিন্তু বার্থডে এর রাতে আমি শিওর হয়েছি। আপনিই আমার সুপ্রিয় ভাই!’

‘ হ্যাঁ তোর বাকি যে কথা গুলো কাকন আপুকে ঘিরে মনে হয় সেসব বল!’
‘প্রথমটা তো বললাম, দ্বিতীয় যে ভুলটা হলো, আমার আব্বুর যখন ট্রান্সফার হয় তখন ছিলো জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাস। সেসময় বন্যা হয় না। উনি বলেছেন, ডাকাত হামলা করেছিলো। সাধারণত বন্যার সময় ছাড়া ডাকাত হামলা করেনা। কাকন আপু নিজেও বন্যার কথা বলেছেন আব্বুকে ঘটনা বলার সময়।
আর তৃতীয় যে ভুলটা উনি করেছেন সেটা হলো,

উনি আর মিনহাজ স্যার আপন ভাই বোন না এটাও পরিষ্কার ছিলো আমার কাছে। যদি তাই হতো উনি মিনহাজ স্যারকে প্রথমে আমার কাছে সুপ্রিয় সাজিয়ে পাঠাতেন না সরাসরি আমাদের বাড়িতেই পাঠাতেন আমাদের বিয়ের কথা বলতে। কারণ উনি চাইছিলেন, আমি মিনহাজ স্যারকে বিশ্বাস করে নিজে ডাকি। তাতে করে উনার উপর আমাদের সন্দেহ হবে না। এমনটা তিনি কেন চাইছিলেন সেটা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার না,তবে উনার প্রতি সন্দেহ টা এই উনার এই ভুল থেকেই গাঢ় হয়।

প্রথমে আমি আর মারিয়াম ভেবেছিলাম আপনাকে রাহেলা ওরফে কাকন আপু আটকে রেখেছে। তারপর জোরজবরদস্তি, ব্ল্যাকমেইল করে,আমাদের শৈশবের কথা শুনে মিনহাজ স্যারকে পাঠিয়েছেন। আমাদের ধারণা থেকেই আমরা প্ল্যান করি মিনহাজ স্যারকে সুপ্রিয় ভাই মেনে নিয়ে বিয়ে অব্দি বিষয়টা এগিয়ে আনবো। এবং বিয়ের দিন রাহেলা আপুকে কিডন্যাপ করে আপনাকে খুঁজে বের করবো। এমনিতে তো রাহেলা আপু বাড়ি থেকে বের হয় না। তাই বিয়ের দিনেই সিলেক্ট করি কিডন্যাপের জন্য। কিন্তু তার আগেই যখন আমি আপনাকে চিনে ফেলেছি তখন কিডন্যাপ করে কি করবো। তাই আমাদের প্ল্যানটা ক্যান্সেল করি।’

‘তোর সুপ্রিয় ভাইকে এখন কেউ সুচের আঘাতও দিতে পারবে না আটকে রাখা তো দূরের ব্যাপার। এখন আমার হয়ে তোকে যে কাজটা করতে হবে সেটা পরে তোকে জানিয়ে দিবো। আর সেই অনুযায়ী কাজ এগোবে।’
‘আশ্চর্য, এখন বলছেন না কেন কি কাজ করতে হবে?’

‘আচ্ছা বললাম তো পরে বলবো। অনেক কথা হলো, ভোরও হয়ে আসছে। এবারে চল তোকে হসপিটাল যেতে হবে!’
‘উঁহু যাবো না। আমি এখন সুস্থ। আপনি থাকলে আমাকে কোনো অসুখই ছু্ঁতে পারবে না।’
কথা শেষ করেই বিউটি দোলনায় চেপে বসলো। উৎফুল্লতার সঙ্গে বললো, ‘ভোরের মনোরম করা বাতাস, সঙ্গে প্রিয় মানুষ আমার সুপ্রিয় ভাই। দোলনায় চেপে দোল খাওয়ার অনুভূতি আপনি বুঝবেন না সুপ্রিয় ভাই। জোরে জোরে দোল দিন।’
‘পড়ে যাবি তো। আস্তে আস্তে ধা’ক্কা দিচ্ছি!’

‘আমাকে আগলানোর মানুষ এখন আছে তো। আপনি থাকতে আমি কখনোই দোলনা থেকে পড়বো না এটা আমার বিশ্বাস।’
সুপ্রিয় দোল দিলো। বিউটি খিলখিল করে হেসে উঠলো। আর সুপ্রিয় তার সুকেশিনীর সেই মাতাল করা হাসিতে মুগ্ধ হলো। আর প্রাণ ভরে শখের নারীকে দেখতে লাগলো। আহ কি সুখময় মুহুর্ত। চারপাশে সুখেরা যেনো দোল খাচ্ছে। দোলনায় চেপে বসা, খিলখিল করে হাসা বিউটিকে সদ্য আঠারো বছরে পা দেওয়া তরুণীর মতো লাগছিলো সুপ্রিয়র কাছে। বয়স যায় হোক না কেন, প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সব প্রেমিকায় বোধহয় আঠারো বছরের তরুণী হয়ে যায়?

বিউটি দোলনা থেকে নামলো। বললো, ‘চলুন এখন আমাদের যেতে হবে। আব্বু আম্মু আমাকে হসপিটালে না দেখলে অনেক চিন্তা করবেন।’
‘হ্যাঁ চল।’
বিউটি অগোছালো ভাবে দাঁড়ালে সুপ্রিয় লক্ষ্য করে বললো, ‘বিউটি তোর পে’ট দেখা যাচ্ছে।’
চমকে গিয়ে বিউটি মাথা নিচু করে দেখলো। এলোমেলো খয়েরী রঙের শাড়ী আর তার ধবধবে সাদা পে’ট। ইশ! কি লজ্জা।

‘আজকে কি আমাকে এভাবেই মা’রতে চাইছিস নাকি? ওহে কন্যা, সামলে রাখো নিজের রূপকে।আমি তোমার রূপের মোহে দায়সারা ভাবের হয়ে যাচ্ছি। অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছি।’
‘বেশি নিয়ন্ত্রণ হাঁরাচ্ছেন? আসেন একটা চু’মু দেন।’
বিউটি গাল এগিয়ে দিলো। সুপ্রিয় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বললো,’সত্যিই চাস চু’মু দিই?’
‘হুম চাই তো।’ বিউটির ঠোঁটে, চোখে মুখে দুষ্টুমি।

সুপ্রিয় গোল চোখে বিউটিকে পলকহীন ভাবে দেখলো। সুপ্রিয় দূরত্ব ঘুচিয়ে বিউটির নৈকট্যে গেলে শুকনো ঢুক গিলে বিউটি একটু পিছিয়ে গেলো। সে তো মজা করতে কথাটা বলেছে। কিন্তু সুপ্রিয় যে সত্যি সত্যিই আসবে সে কি জানতো? সে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো! চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সে তার গালে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া অনুভব করলো। সে আরও একটু ভয় পেলো। কিন্তু মিনিট পেরিয়ে গেলেও যখন দেখলো সবটা স্বাভাবিক তখন সে পিটপিট করে চোখ খুললো। তাকিয়ে দেখলো সুপ্রিয় ভাই শুধুই তাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, তার চোখে একরাশ মুগ্ধতা, চাহনিতে নেই কোনো অশুদ্ধতা, নেই কোনো অপবিত্রতা। শুধুই তার গালে হাত দিয়ে আদুরে ভাবে হাত বুলাচ্ছে। সুপ্রিয় মিষ্টি কন্ঠে বললো,

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ১৯

‘তুমি সামনে এলে তোমার গাল ছুঁবো, চুমু দিতে বললেও গাল ছু্ঁবো। কানের পাশের গালে স্পর্শ করবো। সে তুমি যতোই মানা করো না কেন! তুমি হলে আমার পবিত্র ফুল। তোমাকে অপবিত্র করার সাধ্যি কারোর নেই। আমারও না।’
বিউটি সুপ্রিয়র ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো৷ ভীষণ লজ্জায় মুষড়ে গেলো সে। সে শাড়ীর আঁচল ফেলে লজ্জা থেকে বাঁচতে দৌঁড়ে পালাতে চাইলো। সুপ্রিয়ও হাসতে হাসতেই তার পিছু পিছু ছুটলো। তাদের খিলখিল হাসির শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২১