সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২১

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২১
রাউফুন

বিয়েটা দুই মাস পেছানোর পর মিনহাজের অফিসে চাকরিটা বিউটিকে করতে হচ্ছে। সুপ্রিয় ভাই চাকরিটা আগে ছেড়ে দিতে বললেও এখন চাকরিটা ছাড়তে বারণ করেছে নিজেই। নিজেদের স্বার্থেই এখন তাদের অনেক কিছুই করতে হবে। বিউটি রেডি হয়ে বের হচ্ছে। পরনে সুন্দর পিংক কালারের নিউ ড্রেস।

প্রায় অনেক গুলো নতুন থ্রি পিস তাকে সুপ্রিয় ভাই কিনে দিয়েছে। এসব ড্রেস না পড়লে নাকি বাবু রাগ করবে। অগত্যা সুপ্রিয় ভাইয়ের কথা রাখতে বিউটিকে নতুন ড্রেসই পড়তে হয়েছে। তবে এতো সবকিছুর মধ্যে সে বুঝতে পারে, তার শরীরটা অবশ হয়ে আসে, মাঝে মধ্যে ঝিম ঝিম করে মাথা। মনে হয় সর্বাঙ্গের রক্ত হিম হয়ে আসছে। তবে সেটা বাড়িতে জানানো হয় না। জানালেই আরেক বিপত্তি বাঁধবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সবাই তাকে নিয়ে চিন্তা করুক সেটা সে চাই না। মারিয়াম এখন নিজের বাড়িতেই থাকে।সিজানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনো ভাবেই। পুলিশ কোনো কিছুই ট্রেস করতে পারেনি। যেহেতু তাকে ডিস্টার্ব করার মতো কেউ নেই সেহেতু আর কোনো ভয় নেই মারিয়ামের৷ আগের মতোই এখন সে নিজের বাড়িতে থাকে বাবা মায়ের সঙ্গে৷ বিউটি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে। তাকে নতুন ড্রেসে দেখলে সবার রিয়াকশন কেমন হবে সেটা ভেবেই লজ্জায় সে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

সন্দিপ্তা কিচেনে ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। শাহানা বেগম তাকে কাজে সাহায্য করছেন। বিউটি আর তাকে কখনোই আলাদা চোখে দেখেনি শাহানা বেগম। সন্দিপ্তা আর লিপনের বিয়ের প্রায় দশ বছর হতে চললো, অথচ তাদের এখনো একটা বাচ্চা হয়নি৷ সমস্যা টা সন্দিপ্তার। লিপন মাঝে মধ্যে বাচ্চা নিয়ে অশান্তি করলেও শাহানা বেগম বা হাশেম আলী কখনোই সন্দিপ্তাকে বাচ্চা নিয়ে কিছুই বলেন নি৷

লিপন বাচ্চা নিয়ে অশান্তি করলেও তাকে এই দশ বছরেও কখনো কটু কথা তো দূর ছেড়ে যাওয়ার কথা মুখেও আনেনি৷ সে যেমন মা ডাক শোনার জন্য মরিয়া লিপনও তো তেমন বাবা ডাক শোনার জন্য আকূল হয়ে আছে। তাই মানুষটা মাঝে মধ্যে একটু অশান্তি করে থাকে। সেজন্য সন্দিপ্তা লিপনের কথা গায়ে মাখে না। তবে শাহানা বেগম আর হাশেম আলীর জন্য লিপন তেমন কিছুই বলতে পারে না।

সন্দিপ্তা মাঝে মধ্যে ভাবে এমন মায়ের মতো শাশুড়ী, বাবার মতো এমন শ্বশুর পেয়েছিলো বলেই না সে এতো সুখী, শুধু যদি একটা বাচ্চা হতো তবে বোধহয় তার জীবনে সুখের কোনো কমতি থাকতো না। এই পৃথিবীর বুকে বোধহয় কেউ-ই পরিপূর্ণ সুখী নয়৷ প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই এমনটা হয় বোধহয়। চতুর্দিকে সুখ থাকলেও একটা না একটা দিক থেকে অসুখী হয়ে থাকে। সন্দিপ্তা মনে করে তার সব সুখই কপালে রয়েছে শুধু মা হওয়ার সুখটা বোধহয় আল্লাহ্ তার কপালে লিখেন নি। শাহানা বেগম মেয়েকে বেরোতে দেখে হাঁক ছেড়ে বললেন,

‘কোথায় যাওয়া হচ্ছে?’
বিউটি দাঁড়িয়ে পরলো মায়ের ডাকে। ভাবছিলো লুকিয়ে চলে যাবে ভেবেছিলো। আজকে সে আলাদা ড্রেস পড়েছে এটা সে কাউকেই দেখাতে চাইছিলো না। বললো, ‘অফিসে যাচ্ছি আমার জননী!’
‘খাবার টেবিলে বোস বিউটি আমি খাবার দিচ্ছি!’ বললো সন্দিপ্তা!

‘নাহ ভাবি আমি অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো। আমাকে দশটাই অফিসে উপস্থিত থাকতে হবে। ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে। এমনিতেই আমার অসুখের জন্য অনেক কাজ প্যান্ডিং রয়েছে। যাচ্ছি আমি!’
‘বিউটি তোকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম, এখনো ছাড়লি না। আল্লাহ্ দিলে তোর আব্বু তো তোকে অভাব বুঝতে দেইনি। তবে কেন তোকে চাকরি করতে হবে? আমার একটাও কথা শুনিস না কেন?’ কড়া কন্ঠে মেয়েকে শাসানোর ভঙ্গিতে বললেন শাহানা বেগম।

‘আশ্চর্য আম্মু, এর আগে তো আমার চাকরি নিয়ে তোমাদের সমস্যা হয়নি তবে এখন কেন এতো সমস্যা হচ্ছে?’
‘আগে আর এখনকার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। তোর তো অভাব রাখছি না তবে চাকরি করে কি করবি তুই? এই তো ক-দিন আগেই জ্বর থেকে উঠলি। একটা মাস রেস্ট নিলে কি হবে তোর?’
‘আমার নিজের জন্য করবো আমি চাকরি! ইদানীং আমাকে নিয়ে একটু বেশিই টেনশান করছো না আম্মু? এই এক্সট্রা টেনশানের কারণ কি আম্মু বলো তো?’

শাহানা বেগম থম মে’রে রইলেন। তিঁনি কিছু বলবেন তখনই লিপন রেডি হয়ে আসতে আসতে বললো, ‘আম্মু ওকে আটকাচ্ছো কেন? রোজগার করুক না। বাড়িতে বসে থেকে কিই-বা করবে? শুধু শুধু ব্যোর হবে। তার চেয়ে ভালো অফিসে গিয়ে সবার সঙ্গে থাকলে ভালো লাগবে। কাজের মধ্যে থাকবে৷’

‘এই কাজ টাই তো আমি করতে দিতে চাইছি না। আর ব্যোর হবে কেন বলছিস? একটাও রান্না জানে তোর বোন? দুইদিন পর তোর বোনের যে বিয়ে হবে তখন সে কি করে সংসার করবে?’
‘দরকার পরলে আমি আমার বোনের বাড়িতে চার পাঁচটা কাজের লোক ঠিক করে দেবো। ছোট থেকেই ও কখনো রান্না ঘরে গিয়েছে? তবে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে কেন রান্না করবে?’
‘লোকে তো তোমার বোনের মুখ দেখে দেখে খেতে দেবে।’

‘আহ মা এভাবে বলছেন কেন? আমাদের বিউটি কি যেমন তেমন মেয়ে নাকি? ওকে যে পাবে তার ভাগ্য কতটা ভালো বলেন তো?’ সন্দিপ্তা টেবিলে খাবার দিতে দিতে বললো।
লিপন ইশারায় সন্দিপ্তাকে কাছে ডাকলো। সন্দিপ্তা কান পেতে দিলো। লিপন ফিসফিস করে বললো, ‘আমি যা দেখছি তুমিও কি তাই দেখতে পাচ্ছো? আমার বোন নতুন ড্রেস কিনেছে, ভাবা যায়?’

‘হুম আগেই দেখেছি। মেয়েটাকে লজ্জা দিতে চাইছি না। দেখলে আবার না খেয়েই দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি মাকেও বারণ করে দিয়েছি!’
‘ওকে কতটা হ্যাপি লাগছে দেখেছো? এতো বছর থেকে তো ওর এই খুশিটাই দেখতে চাইতাম। আজকে কি যে আনন্দ হচ্ছে! শোনো ওর জন্য আমি এতো দিন যাবৎ যত ড্রেস কিনে রেখে দিয়েছি তোমার কাছে সব কটা ওর আলমারিতে গুছিয়ে রেখে আসবে।’

‘আচ্ছা! এখন খাও!’
‘মা বাবা কোথায় গো?’
‘পাড়ায় নতুন লোক এসেছে। তার সঙ্গে তোমার বাবার ভাব হয়েছে দারুণ। গল্প করতে বসলে দিন দুনিয়া ভুলে যায়। কল করেছি, আসছে এখন!’

‘তা ভালোই তো। গল্প করলে বাবার মন মানসিকতা ভালো থাকবে। সুন্দর সময় কাটানোর এই তো বয়স!’
বিউটি খাবারের ঘ্রাণেই বসে পরলো টেবিলে। দেরি হলে হোক, নিজের পছন্দের রান্নার গন্ধে সে সব ভুলে যায়।
‘তোমরা কি ফিসফাস করছো। জোরে বলো আমিও শুনি।’

‘তোমায় কেন বলবো বিউটি? দেখেছেন মা, আপনার মেয়ে কষা মাংসের গন্ধে সুরসুর করে টেবিলে বসে পরেছে!’
শাহানা বেগম হেসে ফেললেন। বিউটি ঘিয়ে ভাজা পরোটা ছিড়ে মাংস কষা দিয়ে পুরো তিনটে পরোটা শেষ করলো। খাওয়া শেষ হতেই দেখলো সারে নয়টা বাজে।

বিউটি তড়িঘড়ি বাড়ি থেকে বের হলো। অফিসে রিকশা বা অটোতে যেতে পঞ্চাশ মিনিটের মতো লাগে। সে গেট থেকে বেরোতেই কেউ একজন তাকে টেনে একটা গাড়িতে বসিয়ে দিলো৷ বিউটি চিৎকার করার সুযোগও পেলো না তার আগেই তাকে তুলে নিয়ে গাড়িটি ছুটলো। গাড়িতে বসেই বিউটি চেঁচামেচি করতে লাগলো।

‘এভাবেই চেঁচাবি নাকি আমাকে একবার দেখবি?বেশি চিঁল্লালে লোকজন আমাকে কিডন্যাপার ভাববে। অফিস পৌঁছতে কতক্ষণ বাকি আছে তোর?’
‘সুপ্রিয় ভাই?’

‘তো, তোর কি মনে হয়? আমি ছাড়া কারোই ক্ষমতা আছে যে তোকে রাস্তা থেকে তুলে নিবে?’
‘আপনি জানেন, আমি কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম? এভাবে কেউ আচমকা গাড়িতে উঠায়? আশ্চর্য!’
‘এতো ভীতু হলে চলে? আমি আছি তো? এই নে পানি খা! আহারে গলাটা শুকিয়ে গেছে।’
‘আর কখনোই যদি আপনি এরকম করছেন তো দেখে নেবো আপনাকে।’

‘কি করবি? সেদিনের মতো আবার বলিস না চুমু টুমু দিতে চাস। আজকে তবে রেহাই দিবো না, সুযোগ টা কাজে লাগাবো ভাবছি।’
‘আপনার কেন মনে হচ্ছে, এমন মহান কাজ করার জন্য আপনাকে আমি চুমু দিতে চাইবো? নির্লজ্জ, ঠোঁট কা’টা লোক’

‘আমি নির্লজ্জ?’
‘তা নয় তো কি?’
‘ঠিকই আছে, অনেক ছাড় পেয়েছিস আর পাবি না। খুব শীঘ্রই দেখবি নির্লজ্জ কত প্রকার ও কি কি!’
বিউটি পাত্তা দিলো না সুপ্রিয়র কথায়! ঠোঁট বাকিয়ে অন্য দিকে ফিরে বসলো।
‘শোন, সবার সামনে আমি এখনো সায়র। ভুলেও সবার সামনে আমাকে সুপ্রিয় ভাই বলবি না। মনে থাকবে?’
‘হ্যাঁ থাকবে। আর কি কি মনে রাখতে হবে?’

‘ঐ মিনহাজের থেকে দূরে থাকবি। ওর কাছাকাছি যাবি না। মূলত এই কারণেই আসা আজকে। তোর টক্সিক বসকে তো আবার এখন সুপ্রিয় মানে আমাকে ভেবেই অভিনয় করতে হবে।’
‘আর?’
‘আর কাজের বাইরে মিনহাজ তোকে ডাকতে পারে এখন। কোনো খেজুরে আলাপ করবি না।’

‘আর?’
‘আর সাবধানে থাকবি!’
‘আর?’
‘ঠিক সময়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবি। বিলম্ব করলে আমিও অনাহারে থাকবো।’
‘আর?’

‘আর, ফোন দিলে সঙ্গে সঙ্গে ধরবি। কোনো অজুহাত শুনবো না।’
‘আর!’ ফিক করে হেসে দিলো বিউটি। সুপ্রিয় চড়াও হয়ে বললো,
‘কি আর আর করছিস তুই? একটা টেনে চ’ড় বসাবো। শোন, ভুল করেও যদি আমার অবাধ্য হয়েছিস চাপকে সিধে করে দিবো।’

‘আচ্ছা তারপর?’ বিউটি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসলো। বেশ লাগছে তার সুপ্রিয় ভাইকে জ্বালাতে।
‘হাসবি না, আমি সিরিয়াস কথা বলছি কিন্তু!’
‘আমিও সিরিয়াস ভাবেই হাসছি!’
‘তার মানে তুই আমার কথায় কর্ণপাত করছিস না?’

‘নাহ!’
সুপ্রিয় জোরে গাড়ি ব্রেক কষলো। সামনে দৃষ্টি স্থির করে বললো,
‘নাম গাড়ি থেকে।’
‘ওমা কেন?’
‘নামতে বলেছি তাই!’
‘আশ্চর্য রেগে যাচ্ছেন কেন?’
‘গর্ধব তাকিয়ে দেখ, তোর অফিস এসে গেছি!’

বিউটি তাকিয়ে দেখলো তার অফিসের ঠিক সামনে সুপ্রিয় গাড়িটা থামিয়েছে। বিউটি গাড়ি থেকে নামলো না। বললো, ‘আপনি রাগলে কিন্তু দারুণ লাগে। উফফ একদম আমাদের ছাদে যে বাঁদর আসে না রোজ? ওর মতো লাগে! কি মিষ্টি দেখতে লেজ দুটো!’
‘হু? সত্যি?’

‘হ্যাঁ!’ বিউটি এবারে জোরে পেট ফাঁটা হাসি হাসলো। সুপ্রিয় কিছু না বুঝে চোখ উল্টে তাকালো৷ বিউটি গাড়ি থেকে নেমে বললো,’আসি, বাঁদর থুক্কু, সুপ্রিয় ভাই!’

সুপ্রিয় অদ্ভুত ভাবে মাথা চুলকালো। বিউটি জিব দেখিয়ে বললো, ‘বাঁদরের মতো দেখতে আপনি? মেনে নিলেন যে? তা লেজ দুটো কি প্যান্টের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছেন? দেখান তো! নাকি এখনো ছোট আছে লেজ গুলো?’
সুপ্রিয়র এতক্ষণে বোধগম্য হলো, তার প্রশংসা করার নামে উলটে বিউটি তাকে বাঁদর বলেছে।
‘তবে রে, পাজি মেয়ে। এই বিউটি দাঁড়া। আজ তোর কান মুলে দিবো। বাড়িতে আয় শুধু!’
‘আচ্ছা! দেখা যাবে!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২০

বিউটি দৌড়ে চলে গেলো। সুপ্রিয় হেসে উঠলো বিউটির দুষ্টুমিতে। মিনহাজ উপর থেকে সবটাই খেয়াল করলো। তার রাগ হচ্ছে বিউটি আর সায়রক একসঙ্গে এভাবে দেখে।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২২