সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২২

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২২
রাউফুন

বিউটি অফিস কক্ষে ঢুকতেই মিনহাজের মুখোমুখি হলো। এভাবে মিনহাজের তার সামনে আসায় সে একটু অপ্রস্তুত বনে গেলো। তবুও অপ্রসন্ন ভাবে হাসার চেষ্টা করলো সে। ঠোঁট জোড়া অল্প বিস্তর ফাঁক করে বললো, ‘ভালো আছেন?

‘এই মুহুর্ত থেকে অনেক বেশিই ভালো আছি!’
‘কেন স্যার?’
‘এই যে অবশেষে তুমি এলে!’
বিউটি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করলো। কিন্তু এখন কোনো ভাবেই অস্বস্তি ভাবটা উপরে প্রকাশ করা যাবে না। স্বাভাবিক থাকতে হবে তাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মিনহাজ বিউটিকে এতক্ষণে খেয়াল করলো। সে নতুন ড্রেস পড়েছে খেয়ালই করেনি। এজন্য বোধহয় বিউটিকে আলাদা লাগছে আজ। বিউটি অন্যান্য দিনের মতো চুল বিনুনি করেনি। সামান্য সাজগোজ করেছে বোধহয়। পিংক কালারের ড্রেসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাগছে। মিনহাজের নজর সরছে না তার থেকে! হঠাৎ এতো আয়োজন করে সেজেছে কার জন্য? তার নাকি সায়রের জন্য এই সাজ? সায়রের সঙ্গেই বা কেন এসেছে বিউটি?

মিনহাজের মনে এই প্রশ্নটি জাগলো। সে এই সব বিষয়ে বিউটির মতো শুদ্ধ মেয়েকে প্রশ্ন করে কিছুতেই ছোট করতে চাই না। মনে প্রাণে সে বিউটিকে বিশ্বাস করে৷ সে জানে বিউটি নিজের দিক থেকে কতটা স্বচ্ছ,কতটা পরিষ্কার! সে সায়রের সঙ্গে কেন এসেছে এই প্রশ্ন করলে বিউটিকে ছোট করা হবে। আর সে এটা কোনো ভাবেই চাই না।
‘স্যার সবাই আমাদের দেখছে। কি না কি ভাববে। ভেতরে যায়?’

মিনহাজের ভ্রম কা’ট’লো। আশেপাশে তাকিয়ে সরে দাঁড়িয়ে বিউটিকে যেতে দিলো। বললো, ‘তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে। একদম ভোরের ফোটা শিউলি ফুলের মতো! ভাবছি তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবো বিকেলে। হঠাৎ এতো সাজগোজ কি আমার জন্য?’ ফিসফিস করে বললো মিনহাজ
বিউটি ক্ষীন লজ্জা পেলো। সুপ্রিয় ভাই তাকে দেখেছে? এই যে সে সেজেছে আজ? ইশ! দেখলেও কিছু বললো না কেন? একটু মন খারাপ হলো তার। তার তো সুপ্রিয় ভাই নামক মানুষটা ছাড়া আর কারোর কমপ্লিমেন্ট চাই না
‘কোথায় যাবেন স্যার?’

‘রেডি থেকো, গেলেই দেখতে পাবে!’
এখন মিনহাজকে বারণও করা যাবে না। এভাবেই অভিনয় চালিয়ে যেতে হবে তাকে। তাই সে রাজি হয়ে বললো, ‘ওকে!’

কোনো রকমে মিনহাজের সামনে থেকে সরে এলো সে। ফোস করে শ্বাস ছেড়ে বিউটি নিজের ডেস্কে গিয় বসলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রিমি বিউটির ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। ক্ষীপ্র মেজাজে বললো,
‘এতো দিন তুমি আসোনি শান্তিতে ছিলাম জানো? আজ আসতে না আসতেই মিনহাজ স্যারের পুরো অ্যাটেনশান নিজের দিকে নিয়ে নিয়েছো। বাহ স্যারকে পটাতে আবার অন্য রঙের ড্রেস পড়েছো, আবার রঙচঙ মেখেছো দেখি। তুমি বুড়ি, ময়ূর সাজার যতোই চেষ্টা করো না কেন, তুমি কিছুতেই মিনহাজ স্যারকে পাবে না। অন্তত আমি থাকতে তো কোনো ভাবেই না।’

‘আমার তোমার মিনহাজ স্যারকে পাওয়ার ইচ্ছেও নেই। তোমার মিনহাজ স্যারকে আমি পাত্তাও দিচ্ছি না। কারণ আমি অলরেডি এঙ্গেইজড! এই দেখো রিং। ডায়মন্ড রিং হুম! মিনিমাম ভদ্রতা যদি থাকে আমার সামনে আর আসবে না বেয়াদব মেয়ে। সব সময় আমাকে কথা শুনিয়ে যাবে, ভেবেছো আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো? চুপ থাকি বলে আমাকে দূর্বল ভেবে ভুল করো না। থা’প’ড়ে যখন গাল লাল করে দেবো বুঝবে এই বিউটি কি জিনিস!’
‘তুমি আমাকে থা’প্প’ড় দেবে?’ রিমির ক্রুদ্ধ স্বর।

‘প্রয়োজনে সবার সামনে তোমাকে শিক্ষা দিবো, যদি এখন থেকে আমার সঙ্গে ঠিকঠাক ব্যবহার না করো। তবে কুকুর আমাকে কামড়ালেই তো আমি কুকুরকে কামড়াতে পারি না তাই না? মান সম্মান, উঁচু নিচু বলে তো একটা কথা আছে। আর এবারে ছেড়ে দিলাম পরের বার কিন্তু ভেবে কথা বলতে এসো!’
‘খুব কথা বলছো যে, আমিও দেখবো এই পাউয়ার কতদিন থাকে তোমার!’

‘এখানে কি হচ্ছে?’
রিমি তাকালো সেদিকে মিনহাজের কন্ঠ শুনে। মিনহাজের চাহনি দেখেই রিমি ভয় পেলো। সে বিউটির দিকে তাকিয়ে সাপের মতো হিসহিসিয়ে চলে গেলো।
‘মিস বিউটি আমার কেবিনে আসুন, দরকার আছে!’
‘ওকে স্যার।’

বিউটি কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। সুপ্রিয় ভাই বলেছে কাজ ছাড়া দূরত্ব বজায় রাখতে মিনহাজ স্যারে থেকে। যদিও সে জানে, সুপ্রিয় ভাই তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, অবিশ্বাসের কোনো অবকাশ নেই। তবুও মিনহাজ স্যার যদি তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে তখন? যদিও তার এটাও মনে হয় মিনহাজ সেরকম লোকদের কাতারে পড়ে না। তবুও সুক্ষ্ম একটি ভয় তার মনের মধ্যে জাগছে। ভয় টা কিসের সে সেটা ধরতে পারলো না।

প্রায় তখনই হন্তদন্ত হয়ে মারিয়াম এলো অফিসে। সে আজকে লেট করে এসেছে।
‘হাই এভ্রিওয়ান! উফফ ইটস টু লেট! আল্লাহ্ জানে আজকে আমার কপালে কি আছে!’
‘তোমরা দুই বান্ধবী কবে রাইট টাইমে এসেছো অফিসে?’
‘সেটা তো তোমাকে বলবো না রিমি! এখানে এতো জন আছে কেউ-ই কি আমার দেরিতে আসা নিয়ে কিছু বলেছে? তবে তুমি কেন বলছো? শরীরে জ্বালা ধরেছে? জ্বালা মেটাচ্ছো?’
‘অসভ্যের মতো কথা বলো না মারিয়াম। সব সময় দেরিতে আসো আর ঢং করে এটা সেটা অজুহাত দাও দুই বান্ধবীতে!’

‘আহ মারিয়াম, কি শুরু করেছিস? কেউ ঘেউঘেউ করলে কি তুই ঘেউঘেউ করবি? ও কি মানুষের ভাষা বুঝবে? যার ভাষা সে তার ভাষা ছাড়া বুঝে না, জানিস না?’
অপমান টা হজম হলো না রিমির। রাগে ক্ষোভে নিজের ডেস্কের উপর পাঞ্চ করলো।
মারিয়াম বিউটিকে আপাদমস্তক দেখে বললো, ‘আহাহ্! তোকে খুব সুন্দর লাগছে জানুউ! তাই তো বলি পোঁড়া পোঁড়া গন্ধে ভরা কেন অফিস!’

রিমি মারিয়ামের টোন করা কথায় আরও রাগে ফেটে পড়ছে। মারিয়াম আর বিউটি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজদের মতো কথা বলে কাজ করতে শুরু করলো।
দশ মিনিট পর মিনহাজ আবারও তাকে ডেকে পাঠালো। বাধ্য হয়েই বিউটি এবারে গেলো তার কেবিনে।
‘আসবো স্যার?’
‘হ্যাঁ আসো!’

বিউটি জড়োসড়ো হয়ে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনহাজ যে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। অত্যন্ত বিব্রত হয়ে সেভাবেই কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো।
‘বিউটিফুল! বিউটিফুল! বিউটিফুল!’
বিউটি মাথা তুললো না। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো, কিছু দরকার ছিলো স্যার?’
‘সবার সামনে স্যার বলছিলে তাই কিছু বলিনি, কিন্তু এখানে তো আমাকে তোমার প্রিয় নামেই ডাকতে পারো! কি পারো না?’

‘হ-হ্যাঁ পারি!’
‘তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো? আহা লজ্জা পাওয়ার মতো কি করেছি কিছু আমি? শুধু কথায় তো বলছি! তবে বিষয়টি আমাকে আনন্দ দিচ্ছে!’
‘আ-আ-আমি যায় স-স্যার!’
‘আবার স্যার বলছো?’
‘কি বলবো তবে?’

‘সুপ্রিয় ভাই!’
‘ঠিক আছে!’
‘কি ঠিক আছে?’
‘ডাকবো!’
‘কি ডাকবে?’
বিউটি অত্যন্ত বিরক্ত হলো ভেতরে ভেতরে। সে সুপ্রিয় ভাই ছাড়া অন্য কাউকেই সুপ্রিয় ভাই ডাকতে চাই না। কাউকেই না। অভিনয় করেও না।
‘আমি আসি! আর যদি কাজ থাকে সেটা দেখিয়ে দিন!’

মিনহাজ মাথা নেড়ে টেবিল থেকে ফাইল তুলে দিলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
‘এই ফাইল গুলো সাবমিট করে দিও যখন পারবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আজকে আমি ইচ্ছা করেই মিটিং ক্যান্সেল করে কাল সকালে দিয়েছি। আজ তুমি বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে একটা শাড়ি পড়ে বের হবে! আমি তোমাকে শাড়ী পড়া অবস্থায় দেখতে চাই। তুমি রেডি থাকবে আমি গিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসবো!’

বিউটি মাথা নেড়ে সাই জানালো। ফাইল গুলো হাতে তুলে নিলো। লম্বা দম ছেড়ে বেরিয়ে পরলো মিনহাজের কেবিন থেকে। মিনহাজ মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আজকে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে বিউটিকে স্পেশাল ফিল করানোর। জান লাগিয়ে দেবে। একটা মিথ্যাকে সে কিছুতেই তাদের নতুন জীবনে আসতে দেবে না। কিছুতেই না।
বিউটি মিনহাজের সঙ্গে কথা বলে বেরোলে মারিয়াম ইশারায় জিজ্ঞেস করলো ‘কিছু হয়েছে?’ বিউটিও ইশারায় বুঝালো সব ঠিক আছে।

রিমি তখনো না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সহ্য করতে।
বিউটি অফিস থেকে বের হলো দুপুরে, মারিয়ামের কাজ কমপ্লিট হয়নি তাই সে বেরোতে পারলো না। কিন্তু বিউটিকে তো মিনহাজ আরও আগে বের হতে বলেছিলো, তাই সে কিছু প্যান্ডিং কাজ শেষ করে এখন বের হলো। বেরোনোর আধ ঘন্টা আগেই সে সুপ্রিয় ভাইকে টেক্সট করে আসতে বলেছে। আজকে সে তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গায় ঘুরতে যাবে সুপ্রিয় ভাইয়ের সঙ্গে! বিউটি নিচে নেমে দেখলো সুপ্রিয় দাঁড়িয়ে আছে অফিস থেকে কিছু টা দূরে। সে হেঁটে সেখানটাই গেলো৷ আশেপাশে তাকিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো।

‘আজকে কি কি কথা বলেছে মিনহাজ?’
বিউটি ঘটনার সবকিছুই বললো। সুপ্রিয় রাগে চোয়াল শক্ত করে বললো, ‘তোকে যাওয়াচ্ছি ঘুরতে। চল, আজকে এখন থেকে পুরো সময় আমার সঙ্গেই থাকবি। শাড়ী পড়ে দেখবে তোকে তোর ঐ টক্সিক বস তাই না? দেখাচ্ছি!’
‘দেখলেই কি হবে?’ সুপ্রিয়কে রাগাতে বিউটি ঠাট্টা করে বললো। সুপ্রিয় বুঝলো না তার ঠাট্টা!
‘কি হবে মানে? তুই ঐ লোকটার সামনে শাড়ী পড়ে যাবি নাকি? আমি ছাড়া তুই আর কারোর সামনে শাড়ী পড়ে যাবি না। ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো!’

‘লোকে আপনাকে খোড়া বউয়ের স্বামী বলে ক্ষেপাবে। খোড়া বউ বিয়ে করেছে বলে বিদ্রুপ করবে অনেক, তখন?’
‘বললে আমাকে বলবে। আমি খোড়া বউই পালবো। তাতে অন্যের কি? আমার বউ আমার তো সমস্যা হবে না।’
বিউটি মুখে হাত দিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। তবে বেশিক্ষণ আর আটকে রাখতে না পেরে খিলখিল করে হেসে ফেললো!
‘হাসিস না এভাবে!’

বিউটি হাসতে হাসতেই শুধালো, ‘কেন? হাসলে কি হবে? দাঁত ভেঙে দেবেন? দাঁত ভেঙে দিলে কিন্তু লোকে বলবে দাঁত ভাঙা বউ আপনার।’
‘উঁহু সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
‘কিভাবে?’

‘তুই হাসলে আমি অন্য দিকে তাকাতে পারি না। আমার চোখ শুধুই তোকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন গাড়ি চালাচ্ছি, তোকে দেখতে গেলে গাড়ি এক্সিডেন্টে দুজনেই সোজা উপরে। আমি আমাকে নিয়ে চিন্তিত না। আমি তোর তোর এই হাসি দেখে হাসতে হাসতে মরতে পারবো, কিন্তু তোকে? তোকে অনেক দিন বাঁচতে হবে।’
বিউটির মুখ থেকে হাসি উবে গেলো।

বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তার। নিভু নিভু স্বরে বললো, ‘আপনি না থাকলে আপনার বিউটির কি হবে? আপনি বিহীন বিউটি যে অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে সুপ্রিয় ভাই। আমার এই নিঃশ্বাস নেওয়া বৃথা হয়ে যাবে। আমিও তখন বাঁচবো না। আমি চাই আপনার আগে আমার মৃত্যু হোক। কারণ আমি আপনার মৃত্যু সইতে পারবো না সুপ্রিয় ভাই!’
‘হোপ! সব সময় বাজে কথা। ইমোশনাল করে দিবি না একদম। তাহলে কিন্তু…?’

‘তাহলে কি করবেন?’
‘মে’রে দেবো!’
‘দিন!’
সুপ্রিয় একবার বিউটিকে দেখে চুপচাপ ড্রাইভিংয়ে মনোযোগ দিলো। বিউটি এগিয়ে গিয়ে সুপ্রিয়র এক হাত চেপে ধরলো।

‘কি করছিস টা কি? গাড়ি চালাচ্ছি তো।’
‘নড়বেন না তো! চুপচাপ থাকুন!’
‘আমি ড্রিস্ট্র‍্যাক্ট হয়ে যাচ্ছি!’
‘কেন?’

‘তুই আমার কাছে আসলেই আমি বেসামাল হয়ে যায়!’
‘গেলে যাবেন। আমার কিছু করার নেই। আমার এভাবেই শান্তি লাগছে। নড়াচড়া না করে আমাকে এভাবেই থাকতে দিন।’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২১

সুপ্রিয় নিজের দুই ঠোঁট চেপে ধরলো। যার কাছে যার শান্তি সে তো তার সান্নিধ্যে যাবেই। হাজার বারণেও সে সেই শান্তি খুঁজে নেবে। বিউটি হেসে সুপ্রিয়র কাধে মাথা রেখে দুই চোখ বন্ধ করে রইলো। এবারে তার শান্তি লাগছে খুব। সুপ্রিয় এক হাতে সন্তর্পণে বিউটির গাল ছুঁলো। খুব আদুরে, মোলায়েম ভাবে।বিউটি দুই চোখ বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৩