সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৩

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৩
রাউফুন

একটা বড় রেস্ট্রন্টের সামনে এসে গাড়ি থামালো সুপ্রিয়। দুপুর তিনটা বাজে এখন। বিউটি আর সুপ্রিয় খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পরলো। বিউটি রাস্তা বলে দিচ্ছে আর সুপ্রিয় সেদিকেই যাচ্ছে। এক ঘন্টার মধ্যে তারা সেখানে পৌঁছে গেলো। বিউটি ছুটে নেমে গেলো সেখানে। এই জায়গা টা তার নিজস্ব ভাবে তৈরি। তার ভাবনা, তার কল্পনায় এই জায়গা একটা স্বর্গের মতো। আকাশমণি আর ইউকিলেক্ট্রিস গাছের বাগান। এখানে এসে সে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারে। সরু একটা রাস্তা ধরে বিউটি এগিয়ে গেলো ন”গ্ন পায়ে। এই জায়গা টাই এলে সে জুতো খুলেই হাঁটে।
‘সুপ্রিয় ভাই জুতো খুলে হাতে নিন!’

‘কিহ? পারবো না!’
‘খুলে মাটিতে পা রেখে দেখুন না, কেমন লাগে!’
সুপ্রিয় বিউটির কথা রাখতে জুতো খুলে নিলো। কিছুটা জোরেই বললো,।
‘এই জায়গা টা তোর এতো পছন্দ? এখানে তো শুধুই গাছ আর গাছ। আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই কাঠবাগানে এসে কি করিস তুই?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমি তো একা আসি না। আমার সঙ্গে মারিয়াম আসে। প্রথমে মারিয়ামেরও ভালো লাগেনি জায়গা টা। কিন্তু এখন ওরও ভালো লাগে। আসুন সামনে এগিয়ে যায়!’
সুপ্রিয় হাতে জুতো নিয়ে এগিয়ে গেলো বিউটির পিছু পিছু। মাটিতে পা রেখে বেশ ভালো লাগছে। মনে পড়ছে না শেষ কবে মাটিতে খালি পায়ে হেঁটেছে।

মাটির সোদা একটা গন্ধ নাকে এসে ঠেকছে। সুপ্রিয় সতেজ, নির্মল শ্বাস নিলো। সে আজকে ছাই রঙা শার্ট পড়েছে। বিউটি এসে চওড়া একটা মাটির রাস্তার পাশে ঘাসের উপর বসলো। এই রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যে দুই একটা সাইকেল দেখা যায়। সুপ্রিয়ও বসতেই অনুভব করলো ঠান্ডা হাওয়ায় তার শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দর বাতাস। যতদুর চোখ যাচ্ছে শুধু সবুজের সমারোহ। ইশ কি সুন্দর জায়গাটা। আরামে সুপ্রিয় দুই চোখ বন্ধ করে ফেললো! সারাদিন ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে যদি এখানে দু দন্ড বসা যায় নিঃসন্দেহে সেই ব্যাক্তির সকল ক্লান্তি উবে যাবে। বিউটি সুপ্রিয়র দিকে তাকিয়ে বললো,

‘কি মশাই, এখন বলুন কেমন লাগছে? সত্যি কথা বলবেন।’
‘আমি মিথ্যা বলি না তুই তো জানিস! সত্যি কথা বলতে অনেক দিন পর আমার মনে হচ্ছে গ্রামের সেই মনোরম আর সতেজতার সঙ্গ পেলাম। মাটির গন্ধ কাছ থেকে পেলাম। কত বছর থেকে গ্রামে যাওয়া হয় না। গ্রামে যাবি আজ?’
‘আজ?’
‘হু!’

‘আজ না গেলে হয় না? কাল যায়?’
‘নাহ আজই যাবো।
‘আচ্ছা! কিন্তু বাড়িতে কি বলবো?’
‘সেসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি ম্যানেজ করে নিবো!’
বিউটি মিষ্টি করে হাসলো। সুপ্রিয় বললো,
‘এই জনমানবহীন জায়গায় আসতে ভয় পাসনি?

‘উঁহু ভয় পাবো কেন? এই জায়গা টা আমার এতো আপণ লাগে, যে ভয় আমাকে ছুঁতেই পারে না। আমি আর মারিয়াম সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত এখানে থাকি। সূর্য ডোবার মুহূর্তটা এতো সুন্দর আর মনোরম আপনি যেতেই চাইবেন না।’

‘এতোক্ষন থাকা যাবে না।’
‘আশ্চর্য যাবে না কেন?’
‘গ্রামে যাবো তাই! গ্রাম থেকে আবার রাতেই ফিরে আসতে হবে!’
‘তাহলে আজকে আমাকে গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করবেন, এখানেই। তবেই শুনবো আপনার কথা!’
‘হঠাৎ প্রপোজ করবো কেন?’ ভ্রুকুটি করে সুপ্রিয়।

‘আমি করতে বলছি তাই।’
‘এখানে গোলাপ কোথায় পাবো?’
‘আশ্চর্য, আমি কি জানি? প্রপোজ করতে হবে মানে করতেই হবে! ওওও আগেই বলে দিচ্ছি, আপনার হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে!’
সুপ্রিয় কাদো কাদো গলায় বললো,

‘মাঝে মধ্যে তুই আমাকে এমন বিপদে ফেলিস, কি বলবো! বোস, দেখি কি করা যায়, সময় টা একটু বাড়ালে হতো না? এতো অল্প সময়ে কি করে..!’
বিউটি নির্বিকার চিত্তে দুই হাটুতে হাত পেঁচিয়ে বসে রইলো। সুপ্রিয় তার দিকে তাকিয়ে বুঝলো বিউটি সময় বাড়াবে না তাই নিরবতা পালন করছে। বিউটির সুন্দর ঠোঁট জোড়া থেকে হাসি যেনো সরছে না। জোড়ো হাওয়াই তার চুল গুলো উড়ছিলো। ভীষণ ভালো লাগছিলো তার। ভালো লাগাটা বোধহয় অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে অনেক অনেক বেশি! পাশে প্রিয় মানুষ আছে যে।

ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সুপ্রিয় হাঁপাতে হাঁপাতে এলো তার কাছে।
‘এই নে তোর গোলাপ! পছন্দ হয় দেখ তো?’
বিউটি তাকিয়ে দেখলো সুপ্রিয়র হাতে পাঁচ রঙের গাছের পাতায় বানানো পাঁচটা গোলাপ। এসব আকাশমণি গাছের লম্বা চিকন পাতায় বানানো। শুকিয়ে গেলে অনেক সময় দুই থেকে তিন রঙের হয়ে থাকে। সুপ্রিয় ভাই, একটা কাচা পাতা, একটা আধা পাকা, মানে হলদে রঙের, আরেকটা শুকনো যেটা ছাই রঙা, আরেকটা খয়েরী রঙের। অন্যটি সবুজ হলুদ রঙের!

‘পছন্দ হয়েছে?’
‘খুব! কিভাবে বানালেন?’
মুগ্ধ হয়ে তাকালো বিউটি। সুপ্রিয় হেসে উঠলো। কলার উচিয়ে বললো,’তোর সুপ্রিয় ভাই পারে না এমন কিছু আছে নাকি? তাছাড়া তুই ভুলে গেছিস আমি এসব পাতা দিয়ে গোলাপ বানাতে পারি? গ্রামে অনেক বানিয়েছি। তুই বলার পরেই মনে পড়েছে। না হলে এমন রিস্ক কেউ নেই নাকি!’
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে, এবারে প্রপোজ করুন!’

‘করতেই হবে?’
‘হ্যাঁ করতেই হবে!’
অগত্যা সুপ্রিয়কে প্রপোজ করতেই হলো। সে নরম ঘাসে হাটু মুড়ে বসে বিউটির হাতে গোলাপ গুলো তুলে দিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,

‘সুন্দরের ব্যাখ্যায় ভালোবাসা নেই! মানুষ সুন্দরের পূজারি, কিন্ত সব সুন্দর সবাই ভালোবাসে না! কিছু মানুষ সুন্দরের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভাবে ভেবে নেয়। এইযে সাদা চামড়া নয় একটা মায়াবী মুখই যথেষ্ট শ্যাম রঙের মেয়েটির প্রতি ভালোলাগা আজীবন রাখার জন্য! কেউ ব্যবহারের প্রেমে পড়ে আর কেউ ব্যাক্তির মায়ায়, ভালোবাসায় আটকে যায়। প্রেম, ভালোবাসা, মায়ার ব্যাখ্যায় যদি আসি, তবে আমি তোর প্রেম, ভালোবাসা, মায়া সব কিছুতেই আটকেছি! সেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ নেই। কোনো দিক নিশানা নেই। উইল ইয়্যু বি মাই মিসেস সুকেশিনী? উইল ইয়্যু বি মাই লাইফলং কাম্পেনিওন? উইল ইয়্যু নেভার লীভ মী? প্রমিস?’

‘ইয়্যেস আই উইল বি ইয়্যুর’স! ইয়্যু কাউন্ট অন মি মাই লাভ! আই উইল নেভার লীভ ইয়্যু!’
বিউটির দু-চোখ ভর্তি চোখের পানি উপচে পড়ছে। আনন্দে আত্মহারা বিউটি বোধবুদ্ধি হারিয়ে আকস্মিক ভাবে সুপ্রিয় বসে থাকা অবস্থায় জড়িয়ে ধরলো। সুপ্রিয় একটু অপ্রস্তুত হলো।

বিউটির মাথায় আদুরে ভাবে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ‘বিউটি, বিয়ের আগে আমাকে আর এভাবে জড়িয়ে ধরিস না। এই পৃথিবীর বুকে প্রতিটি পুরুষ মানুষ তার প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে এলে নিষিদ্ধ কাজ গুলো নিজের অজান্তেই করে বসে। তাই তোকে নিষেধ করছি এভাবে আমার এতোটা নিকটে আসিস না। আমি সত্যিই বেপরোয়া হয়ে যায়। আমি আমার সুকেশিনীকে কোনো ভাবেই অপবিত্র করতে চাই না। কোনো ভাবেই না। তুই যে আমার পবিত্র ফুল বিউটি!’

বিউটি চট করে সরে গেলো সুপ্রিয়র কাছ থেকে। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। ইশ! কথা নাই বার্তা নাই এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে? লাজ লজ্জা ভুলে সেই যে কেন বার বার জড়িয়ে ধরে তাকে।
সুপ্রিয় প্রথমে বারণ করলেও ঠিকই সূর্যাস্ত পর্যন্ত জায়গাটাই ছিলো। অবশেষে তারা গ্রামের দিকে রওনা দিলো। গ্রামের পথ ধরার আগে কিছু খাবার কিনে নিলো। এক ফ্লাক্স গরম পানি আর কড়া কফিও সঙ্গে নিলো। এই দুটো জিনিস সুপ্রিয়র লোক এসে দিয়ে গেছে। তার প্রিয় কফি, এর স্বাদ এতোটাই অতুলনীয় যে মুখে লেগে থাকার মতো!

‘এই এতো খাবার দিয়ে কি হবে?’
‘আমরা খাবো। ফিরতে ফিরতে সকাল হবে জানিস না! পথিমধ্যে খিদে পেলে খেতে হবে তো!’
‘তাই বলে এতো খাবার?’
‘হুম!’

‘আচ্ছা শুনুন, একটা কথা বলি মন খারাপ করবেন না! আপনি জানেন, কল্পনায় আপনাকে কতবার ছাই রঙা শার্ট পড়তে বারণ করেছি? আমার ছাই রঙা শার্ট পছন্দ না৷ তাই এরকম কুৎসিত শার্ট আর প্লিজ গায়ে জড়াবেন না অনুরোধ রইলো!’
‘কেন? বেশি খারাপ লাগছে?’
‘আপনাকে কেমন লাগছে বলবো?’
‘বল!’

‘ঠিক, মাটির চুলাই ছাই জমা ছাইয়ের মতো। কি বিশ্রি বলুন তো? তাই আপনি আর এই রঙের শার্ট পড়বেন না।’
‘আচ্ছা, খুলে ফেলি তবে এটা! আমার এক্সট্রা শার্ট আছে গাড়িতে।’
‘না না থাক। এখন চেঞ্জ করার দরকার নেই।’ বিউটি তখনো লজ্জায় মুষড়ে যাচ্ছিলো।
বিউটি চুলে হাত খোপা করছিলো তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো মারিয়ামের কল!
‘কোথায় তুই?’ কল রিসিভ হতেই প্রশ্ন করলো মারিয়াম।

‘সুপ্রিয় ভাইয়ের সঙ্গে!’
‘বাসায় যাসনি বলে আমাকে ফোন করেছিলো আন্টি!’
‘কিছু একটা বলে ম্যানেজ কর না প্লিজ!’
‘কি বলবো আমি? আমি জীবনে মিথ্যা কথা বলেছি?’
‘কোনোদিন বলিস নাই তো কি হয়েছে? আজ বলবি। না বলতে পারলে কিসের বেস্টফ্রেন্ড তুই আমার। আমার জন্য এই টুকু করতে পারবি না!’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু যাচ্ছিস কোথায় এটা তো বলবি?’
‘সুপ্রিয় ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামে যাচ্ছি! গ্রাম থেকে ফিরতে কাল সকালও হতে পারে।’
‘আজকেই যেতে হবে? সুপ্রিয় ভাইকে বারণ কর না। আমি মনে করি, সুপ্রিয় ভাই হাতের পাঁচ স্বামী হবেন!’
‘কি সব যাতা বলছিস! হাতের পাঁচ স্বামী মানে?’

‘হাতের পাঁচ স্বামী মানে, স্বামী সব সময় হাতে থাকবে। তোর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। হাত ছাড়া হবে না কখনোই! সব মিলিয়ে এই পৃথিবীতে ছয় রকমের স্বামী বিদ্যমান! মন দিয়ে শোন!হাতের শুন্য স্বামী, যে কখনোই হাতে থাকবে না! হাতের এক স্বামী হলো, হঠাৎ হঠাৎ হাতে থাকবে, বেশির ভাগ সময় থাকবে না। হাতের দুই স্বামী হলো, হাতের একের চেয়ে একটু বেশি থাকবে।

হাতের তিন স্বামী হলো, হাতের দুই এর থেকে আরেকটু বেশি থাকবে। হাতের চার স্বামী হলো, হাতের তিন এর থেকে একটু বেশি থাকবে। হাতের পাঁচ স্বামী হচ্ছে, সব সময় হাতে থাকবে। তুই হাত ঝেড়ে ফেলে দিলেও তোর কাছ ছাড়া করবে না। তাকে কোনো ভাবেই তোর পিছু ছাড়াতে পারবি না।সব সময় কড়ে আঙুল চেপে ধরে বসে থাকবে। বলতে গেলে একেবাড়ে ঝুলে থাকবে। বুঝলি?’

‘তোর কাছে কি সব সময় এসব হিল্যোরিয়াস জোকস থাকে?’
‘তো থাকবে না? এই শোন, তোর প্রেমিক মানে তোর সুপ্রিয় ভাই তো নাম্বার ওয়ান থিফ।’
‘থিফ মানে?’
‘হ্যাঁ চোর, এই যে তোর মন চুরি করলো। এখন আর আমাকে পাত্তা দিচ্ছিস না।’
কথার ফাঁকে ফাঁকে সুপ্রিয় বিউটির দিকে তাকাচ্ছিলো আর বিউটি তাকে হাতে ইশারায় চুপ থাকতে বলেছে। কিন্তু মারিয়ামের শেষ কথা শুনে

বিউটি খিলখিল করে পেট চেপে হেসে উঠলো। মারিয়াম কল কে’টে দিলে বিউটি সুপ্রিয়কে সব বললো। বলেই আবার হাসতে লাগলো। সুপ্রিয় মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েটা সব সময় খিলখিল করে হাসে। সুপ্রিয়ও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২২

সুপ্রিয় খেয়াল করলো, বিউটির হাতে এখনো সেই পাতায় বানানো গোলাপ গুলো। সে জানে বিউটি এসব ফেলে দেবে না৷ মেয়েরা তার প্রিয় মানুষের দেওয়া প্রতিটি জিনিস যত্ন করে রেখে দেয়। কারণ তারা স্মৃতি সংগ্রহ করতে ভালোবাসে। আর আপন মানুষের দেওয়া কিছু হলে তো কথায় নেই! সেটা ক্ষ’ত হোক বা ভালোবাসা।

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৪