ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৮

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৮
নীহারিকা নুর

তুরাগ ভাই ফ্যামিলির সবাই যখন চাচ্ছে আপনি বিয়ে করুন তখন বিয়েটাতো আপনাকে করতেই হবে। আপনি চাইলেও উপেক্ষা করতে পারবেন না। যদি উপেক্ষা করতে চান ও তবে আপনার ফ্যামিলির বিরুদ্ধে যেতে হবে। আর ফুপা এমনিতেও খুব রে’গে আছে। এই মুহুর্তে আপনি যদি তার বিরুদ্ধে যান সে আপনার উপর আরো রে’গে যাবে এবং ভীষণ কষ্ট ও পাবেন তিনি।

তাকে কষ্ট দেয়াটাও আপনার ঠিক হবে না। এখন যদি আপনি ফুপার কথা ভেবেও রাজি হন তাহলেও আপনাকে বিয়ে করতে হবে। আর মিথিপুর অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। তিনি যদি কোমা থেকে ফিরেও আসেন পুরোপুরি সুস্থ হবেন কিনা সন্দেহ আছে। এখন যদি আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করেন সে হয়ত মিথিপুকে মেনে নিবে না। মিথিপুর যত্ন করাটা সে স্বাভাবিক ভাবে নিবে না। সেই জায়গায় যদি আমাকে বউ হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে বিষয়টা অন্যরকম হবে। যেমন আমি মিথিলা আপুর যত্ন নিব। দায়িত্ব নিব তার মায়েরও।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একদমে কথাগুলো বলে থামল তরু। তুরাগ রেলিং এর উপর দুই হাতে ভর করে আকাশপানে তাকিয়ে আছে। মনযোগ সহকারে শুনল তরুর কথাগুলো। তরু কথাগুলো শেষ করে উত্তর এর আশায় তুরাগ এর মুখপানে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় তুরাগ এর থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। সে নিরব রইল কিছু সময়। ভাবল কিছু একটা। এরপর তরুর দিকে ঘুরে সোজা হয়ে দাড়ালো। হাতগুলো আড়াআড়ি ভাবে বুকের সাথে বেধে দাড়ালো। তাকালো তরুর চোখপানে। তরু তখনো এক নজরে তুরাগ এর দিকেই তাকানো ছিলো। তুরাগ তরুর দিকে তাকাতেই চোখ নামিয়ে নিল তরু। তুরাগ কিছু একটা বলবে সেটা শোনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। শান্ত কন্ঠে তুরাগ উল্টো প্রশ্ন করলো

– ভালোবাসো আমায়?
তুরাগ এর মুখ থেকে এরকম প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল তরু। তরু ভেবেছিল তুরাগ হয়ত বলবে আমি বিয়ে করব না। কিন্তু তরুর চিন্তা ভাবনা উল্টো করে দিয়ে এ কেমন প্রশ্ন করল। জিভ দিয়ে ঠোট ভেজালো। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলবে এর আগেই ফের তুরাগ এর গলার আওয়াজ

– মিথ্যা বলবে না।
যা বলতে চাচ্ছিল তা গলা অবধি এসেই আটকে গেল তরুর। মুখ থেকে আপনাআপনি বেরিয়ে গেল
– না বাসিনা।
– তবে?
– কি?
– আমাকে ভালোবাসো না তাহলে আমাকে বিয়ে করে আমার ভালোবাসার মানুষকে কেয়ার করবে আবার তার মায়ের যত্ন নিবে বিষয়টা একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

– আমি স্যাক্রিফাইস করতে চাইলে আপনার আপত্তি থাকার কারণ কি?
– আমি মিথির জায়গা কখনো কাউকে দিতে ওাটব না মিস তরুলতা। এই মুহুর্তে যা বলেছো তা ভুলে যাও।
– আমি মিথিপুর জায়গা কখনো চাইনি। আমি নিজের ভুলের জন্য গিল্টি ফিলিং থেকে রিলিজ পেতে চাচ্ছি। এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমিও কিছুটা দায়ী।

তাদের এখানে আসার পেছনে আমারও অবধান ছিল। নিজেকে অপরাধী লাগছে। তাদের সেবা করে ভুলের মাশুল দিতে চাচ্ছি। বাকিটা আপনার ইচ্ছে। আমি জোর করতে পারি না আপনাকে।
চোখ ছোট ছোট করে তরুর দিকে তাকায় তুরাগ। এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো। কেউ নাকি নিজের লাইফ নিজে এভাবে নষ্ট করতে চায়। একটু আগেই বলল আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে এখন আবার বলছে জোর করব না। আসলে চাইছে টা কি ও।

– তুমি আসলে চাইছো টা কি শুনি?
– আমি তো জানালাম আপনাকে। নিজের ভেতরে প্রচন্ড অপরাধ বোধ কাজ করছে। কি করব না করব মাথায় কিছুই আসছে। মনে হলো তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। তাই জানালাম আপনাকে। এমনিতে আপনার প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নাই হুহ। আপনার মেয়ে ফ্যানরা আপনার গা ঘেষে থাকতেই পারে কিন্তু এরকম মানুষের প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই।

কথা বলে না তুরাগ। এই মেয়েকে তো ম্যাচিউর ভেবেছিল। এতো হাফ মেন্টাল। এর সাথে কথা বলে লাভ নেই। পকেট থেকে সিগারেট বের করে। অন্য দিকে ঘুরে মুখে নেয় সিগারেট। তুরাগ এর কথা বলার অনীহা নজর এড়ায় না তরুর। এখন নিজের মাথায়ই নিজের চাপড়াতে মন চাচ্ছে। কি দরকার ছিল এই লোকের সামনে ছেচড়ামি করার। এক পা দুপা করে ছাদের দরজার দিকে পেছাতে থাকে তরু। পিছন দিকে হেটেই ছাদের দরজা অবধি এসেছে। দরজা ক্রস করে যেই ঘুরছে সিড়িতে পা রাখার জন্য অমনি অন্ধকার থেকে এক জোড়া হাত তরুর বাম হাতে চেপে ধরে। ঘাবড়ায় তরু। এই মুহুর্তে কে আসতে পারে ছাঁদে। ভয়ে কাপা কাপা কন্ঠে জানতে চায়

– ক ক কে? কে?
– নিজের মাকেও ভুলে গেছো পাজি মেয়ে।
– ও ও আম্মু৷ তুমি এখানে কেন।
– দয়াশীল মানবী হয়ে গেছো তুমি। মায়ের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া শিখে গিয়েছো। রুমে চলো।
রুমে চলো কথাটা তরুর ভেতর অবধি নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। ছোট বেলা থেকেই জানে তহমিনা যেমন নরম মনের মানুষ তেমন প্রয়োজনে সেরকমই কঠোর। কিন্তু এই মুহুর্তে তহমিনা ছাদে কেন এসেছে এটাই মাথায় ঢুকছে না তরুর৷

তরুর হাত নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে তহমিনা। এক প্রকার টানতে টানতেই সিড়ি থেকে নামিয়েছে তরুকে। তরু কোন কথা না বলে মায়ের পিছনে পিছনে যাচ্ছে।
নিচতলায় গেস্ট রুমেই থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে তহমিনাদের। তরুকে টানতে টানতে সেখানেই নিয়ে গেল। রুমের মধ্যে নিয়ে হাত ছেড়ে দিল।

দরজাটা এক প্রকার জোড়ে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিল। সিটকিনিটা উপরে তুলে দিয়ে আবারো তরুর হাত ধরে টেনে এনে খাটের পাশে বসাল। মোবাইল স্ক্রল করে কোনো একটা নিউজ দেখায় মত্ত ছিলেন নুরুল ইসলাম। হঠাৎ করে তহমিনার এরকম রনচন্ডী রুপ দেখে হাত থেকে ফোন রেখে দিলেন তিনি। ব্যাস্ত হলেন কি হয়েছে তা জানার জন্য। কি হয়েছে জানার জন্য তহমিনাকে প্রশ্ন করতেই ফোস করে শ্বাস ছাড়লেন তহমিনা। তরুর হাত এখনো তার হাতের মুঠোয়। তরু মাথা নিচু করে বসে আছে। নুরুল ইসলাম একবার স্ত্রী তো একবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন।

– আপনার মেয়ে তো দিল দরদি হয়ে গেছে। সে বিষয়ে কোনো খেয়াল আছে আপনার?
তহমিনারর তেড়া কথায় কিছুটা ভড়কালো নুরুল ইসলাম। আসল ঘটনা জানার জন্য মন উসখুস করছে। তাই শান্ত স্বরে আবার প্রশ্ন করলেন

– কি করেছে ও?
– মিথিলার ফ্যামিলি এখানে আসুক সেটা তরুও চাইত প্রথম দিকে। এখন এই দূর্ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করছে। তাই সে তুরাগের কাছে গিয়েছিল কথা বলার জন্য। সে তুরাগের নামে মাত্র স্ত্রী হয়ে থাকবে। আর তুরাগ এর পাগলামির সাথে সাথে ও পাগলামি করবে।

– তুমি কীভাবে জানলে?
– তুরফার পা কে’টে গেল পরে তো নিচে নিয়ে আসল ও। তুরফাকে রুমে বসিয়ে দিয়ে আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিতে বলে আপনার মেয়ে আবার তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে তাই আমিও গিয়েছিলাম ছাদে। ভাগ্যিস গিয়েছিলাম। নয়ত জানতেই পারতাম না।
নুরুল ইসলাম কোন কথা শুনে চিন্তা ভাবনা না করেই ফট করে মেজাজ গরম করার মানুষ না। এই মুহুর্তে ও সেই গুনটা বজায় রাখলেন তিনি। তহমিনার মতো রে’গে জাননি মেয়ের উপরে। বরং শান্ত কন্ঠে জানতে চাইলেন

– মামনি তুমি কি তুরাগকে পছন্দ করো?
বাবার এরকম প্রশ্নের জবাবে কি উত্তর দিবে জানা নেই তরুর। তাই জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো। নুরুল ইসলাম ধূর্ত মানুষ। তাকে সব কিছু মুখে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তিনি মেয়েকে আবারো প্রশ্ন করলেন
– তোমার কি মনে হয় তুমি হ্যাপি থাকবে তুরাগ এর সাথে?

– আমি জানি না বাবা। তবে মিথিলা আপু অনেক ভালো একটা মেয়ে। সে তো এখানে আসতে চায় নি। এখানে তার কোনো দোষ নেই। তুরাগ ভাই অপরাধী। তার সাথে আমিও সমান অপরাধী। শাস্তি সে একা কেন পাবে তাই আমি এমন কথা বলেছি। আর কিছু না বাবা।

তহমিনার ভীষণ রাগ হচ্ছে মেয়ের প্রতি। মন চাচ্ছে গাল বরাবর ঠাটিয়ে একটা চ’ড় দিতে। জীবন কি ছেলেখেলা মনে হয় নাকি এই মেয়ের। তবে নুরুল ইসলাম যখন শান্ত হয়ে বসে আছে তার সামনে মেয়ের গায়ে হাত তোলাটা সমীচীন মনে হলো না। তাই দাতে দাত চেপে বলল
– আপনি কালকেই বাসের টিকেট কা’টবেন। আমি আর এখানে থাকব না। তরুকে নিয়ে চলে যাবো। আপনি আপনার মাকে নিয়ে কবে আসবেন তা আপনি জানেন।
নুরুল ইসলাম তহমিনার কথার জবাব না দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্য বললেন

– তুমি রুমে যাও। তোমাকে এত বেশি চিন্তা করতে হবে না। তোমার বাবা মা এখনো আছে।
তরু আর কোন কথা না বলে খুব সাবধানে বেড ছেড়ে উঠে দাড়ালো। পা টিপে টিপে বেড়িয়ে গেল রুম ছেড়ে।
রুম থেকে বের হবার সময় পেছন থেকে তহমিনা ডেকে বললেন

– তোকে যেন আর তুরাগ এর আশ পাশেও না দেখি। ব্যাগ গুছিয়ে রাখবি। কালকেই ফিরব আমরা। ফাইনাল।
তরু কিছু না বলে মনে মনে আওড়ালো
– সবাই স্বার্থপর আম্মু। এতদিন আপার ছেলে মেয়েকে দেখা শোনার জন্য এখানে রয়ে গেলে। যেই নিজের স্বার্থে টান পড়ল অমনি চলে যাবে এখান থেকে।

সারারাত ঠিক ঠাক ঘুম হলো না তুরাগের। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই রাত ফুরিয়ে গেল। চোখে একটু ঘুম ঘুম আসছিল তখনি কানে ভেসে এলো আজানের মিষ্টি মধুর সুর। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল তুরাগ। উঠে ফ্রেশ হয়ে একবারে অজু শেষ করে বের হলো। ততক্ষণে আজান শেষ হয়েছে। ঠিক করল মসজিদে যাবে।

তবে অনেক দিন ভোরে মসজিদে যাওয়া হয় না। তাই মন খচখচ করতে লাগল। হুট করে একদিন গেলে সেটা কেমন লাগবে এটা ভেবে যাব কি যাব না করতে করতে জামায়াত এর সময় শুরু হয়ে গেল। অবশেষে জায়নামাজ বিছিয়ে রুমেই নামাজের প্রস্তুতি নিল। নামাজ শেষ করে দুহাত তুলল উপরওয়ালার নিকট দোয়া প্রার্থনা করতে। নিজেকে এরকম পরিস্থিতি থেকে থেকে যেন উপরওয়ালা রক্ষা করেন।

নামাজ শেষ করে হাটতে বের হলো। বেশ অনেক সময় বাহিরেই কা’টল। বাসায় ফিরে দেখতে পেল ততক্ষণে সকালের নাস্তার জন্য সবাই টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। সবাই যার যার মতো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবার দিকে একবার একবার তাকিয়ে দেখল। দুটো চেয়ার ফাঁকা পরে আছে। তরু নেই খাবার টেবিলে। আর নানুও নেই। তরু আসেনি কেন সেটা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস হয়ে উঠল না। তাই নুরুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো

– নানু কোথায় মামা?
খাবার রেখে একবার তুরাগ এর দিকে তাকালেন নুরুল ইসলাম। তারপর গম্ভীর স্বরে বললেন
– তোমার নানুর কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন তুমি নিজে গিয়ে জানো।
এরকম করে কথা বলার কোন মানে হয়। তার সাথে আর কথা না বলে তুরফাকে জিজ্ঞেস করলো
– এই তুরফা কি হয়েছে রে?

– নানু খাওয়া বন্ধ করেছে। তার কথায় তোমরা রাজি হওনি তাই। যতক্ষণ না শুনবে তার কথা সে খাবে না।
এরকম একটা সিরিয়াস মোমেন্টেও হাসি আসল তুরাগ এর। যদিও তার নানুর এরকম কাজে সে সন্তুষ্ট নয়। তবে তার নানু তার মতোই। না খেয়ে ধর্মঘট পালন শুরু করেছে এটা ভেবে হাসি আসল।
তুরাগ আর কাউকে কিছু না বলে নানুর রুমে গেল। সে খাটের উপর পা বিছিয়ে বসে খোলা জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছেন। তুরাগ বাহির থেকে অনুমতি চাইলো ভেতরে আসার। তারামন বিবি কথা না বলে অন্য দিকে মুখ ঘোরালো৷ তুরাগ তা দেখে মনে মনে বলে

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৭

” যেভাবেই হোক এই বুড়িরে আগে ঠিক করতে হবে। যদি কোন মতে না খেয়ে দেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে না সবাই আমাকেই চেপে ধরে। কাল যে কি হবে। সবাই এরকম কেন শুরু করছে”

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৯