ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৯

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৯
নীহারিকা নুর

দেখো তোমার ইচ্ছেটাই বোধহয় পূরণ হলো। সেই বউ হয়ে এলে আমাদের বাসার। তবে এই সম্পর্ক কখনো পূর্নতা পাবে না। এটা শুধু কাগজের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটা যেন বাহিরের কেউ ঘুনাক্ষরেও টের না পায়। আমার মনে এক জনের বসবাস। আর সেটা আজীবন থাকবে। তাই ভূল করেও আমার উপরে স্ত্রীর অধিকার ফলাতে আসবে না। রাত অনেক হয়েছে হাত মুখে পানি দিয়ে এসে শুয়ে পড়ো।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল তুরাগ। মাথার ওপর টেনে দেওয়া শাড়ীর আচলটা টান দিয়ে ফেলে দিলো তরু। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল দম আটকে ছিল। তাই জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিল কয়েকবার। এরপর শান্ত হয়ে গুটিশুটি দিয়ে বসল বিছানার মাঝ বরাবর। এরপর চোখ বোলালো রুমের চারদিকে। এটা নাকি বাসর ঘর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এ ঘরে না আছে কোন ফুলের ছোয়া না আছে মরিচ বাতির সাজ৷ ঘরের মাঝে টিমটিম করে একটা নীল রঙের ডিমলাইট জ্বলতেছে। সেই আলোতেই রুমটা কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করল তরু। মুখের কোনে দেখা গেল তাচ্ছিল্য মূূলক হাসি। এটা কাউকে উপহাস করে নয়। বরং এরকম একটা বাসর ঘর দেখে। প্রতিটা মেয়েরই নিজের বিয়ে নিয়ে কিছু সপ্ন থাকে। যার কোনটাই সত্যি হলো না তরুর ক্ষেত্রে।

দুইদিন আগে তুরাগকে বলা কথাগুলো মনে করে একদফা হাসল তরু। তখন তো খুব জোর দিয়ে তুরাগকে বলেছিল আমি আপনার স্ত্রী হতে নয় বরং মিথিপুর দায়িত্ব পালন করতে চাই। আর সেই কাগজের সম্পর্কটা সত্যি হয়ে যাওয়ার পরে এখন তুরাগের বলা তিক্ত কথাগুলো কেমন গায়ে কা’টার মতো লাগছে।

নিজেকে এই মুহুর্তে সব থেকে বোকা মনে হচ্ছে। নিজের স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসুক এটা কোন মেয়েই চাইবে না আর ও কিনা সেধে সেধে সেই প্রস্তাব দিয়েছিল। রুমে জ্বলতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় নিজের গায়ে জরানো শাড়ীটার দিকে তাকালো। নীল রঙের একটা শাড়ী। তবে নীল রঙের আলোর সাথে মিশে এখন আর শাড়ীর নিজস্ব রঙ বোঝা যাচ্ছে না। বিয়ের দিনেও গায়ে জড়িয়েছে ফুপির শাড়ী।

তুরাগ চাইলেই কিন্তু একটা নতুন লাল বেনারসি কিনে দিতে পারত কিন্তু তা করেনি। বরঙ মায়ের আলমারি খুজে এই শাড়ীটা বের করে দিয়ে এসেছিল। এসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আওয়াজ কানে আসতেই মাথা তুলে সেদিকে তাকালো তরু। উদোম গায়ে শুধু একটা ট্রাউজার পরে বেরিয়ে আসছে তুরাগ। গলায় একটা টাওয়াল ঝোলানো। ফর্সা শরীরে পানির বিন্দু গুলো চিকচিক করছে। তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো তরু।

– এখনো খাটের মধ্যে বসে আছো। এতক্ষণে চেঞ্জ করতে পারতে না শাড়ীটা।
তুরাগের কথার প্রতিউত্তর না করে খাট থেকে নেমে দাড়ালো তরু। এ বাসায় আসার সময় যে ব্যাগে জামাকাপড় নিয়ে এসেছিল সেই ব্যাগটা এই রুমে দিয়ে গিয়েছে সুফিয়া খালা। তরু অন্য দিকে মুখ করেই হেটে হেটে সেই ব্যাগের কাছে গেল। ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের থ্রিপিস খুজে বের করল৷ সেটা নিয়ে তৎক্ষনাৎ ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল।

প্রায় মিনিট দশেক পরে ফ্রেশ হয়ে বের হলো তরু। কালো রঙের কাজ করা জামা। সাথে প্লাজু। ওড়নাটা গলায় ঝুলানো। একদম সিম্পল রুপ। ওয়াশরুম এর দরজায় থাকতেই তরুর দিকে নজর গেলো তুরাগের। কিয়ৎক্ষন সেদিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ করে শুতে গেলে নাক গিয়ে লাগল সোফার সাথে।

নাক চেপে ধরে উঠে বসল তুরাগ। নিজের মাথায় নিজেই চাপড়ালো। কারণ ও যে সোফায় শোয়া ছিল তা প্রায় ভুলেই বসেছিল আর সে কারণেই তো ঘুরতে নাকে ঘষা লাগল ফোমের সাথে। তুরাগ এর এই অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিলো তরু। চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকালো তুরাগ। সেই চোখের দিকে নজর যেতেই তৎক্ষনাৎ হাসি থেমে গেলো তরুর। তুরাগ যে রেগে আছে তা ওর মাথায়ই ছিল না। কিছু না বলে পা টিপে টিপে গিয়ে সোফার সামনে দাড়ালো। তুরাগ এর উদ্দেশ্য বলল

– এটা আপনার বাসা। বেড ও আপনার৷ আপনি চাইলে বেড এ শুতে পারেন। আমি সোফায় শুতে পারব। সমস্যা হবে না।
– আ ইউ শিওর?
– হুম।

তুরাগ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নেমে গিয়ে শুয়ে পড়ল বেডে। সেদিকে পলকহীন কিছু সময় তাকিয়ে রইল তরু। মনে মনে হয়ত আশা করেছিল তুরাগ বলবে ” আমি সোফায় শুই তুমি বরং বেড এ শো”। তা না বলে তরুর এক বলাতেই নিজে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়ল। এখন তরু কি করবে। নিজের বোকামির জন্য আবারো মাথা চাপড়াতে মন চাচ্ছে। এই বেটাতো একটা নিরামিষ, এক নারীতে আসক্ত পুরুষ মানুষ।

সে কেন তরুর কথা ভাববে। এটা কেন আগে মাথায় এলো না। তাহলে কখনোই তাকে বলত না বেডে শোয়ার জন্য। নিজেকেই নিজে মনে মনে গালমন্দ করে সোফায় শোয়ার প্রস্তুতি নিলো তরু। সোফার হাতলে মাথা রেখে চুলগুলো ছেড়ে দিল। চুলগুলো গড়িয়ে ফ্লোর অবধি পৌছালো। যা থেকে তখনো পানি ঝড়ছে। সেই পানিতে ফ্লোর ভিজে যাচ্ছে। সেদিকে খেয়াল নেই তরুর। সে মগ্ন হলো জীবনের হিসাব মিলানোতে। এই দুইদিন কি ঝড়ঝাপটা গেল তাদের উপর। জীবনের মোড় কীভাবে ঘুরে আজ এঔ পরিস্থিতিতে এলো তা ভাবতেই মগ্ন হলো।

” ফ্লাসব্যাক”
তারামন বিবিকে কোন ভাবেই মানানো যায় নি। তিনি তার কথায় অটল। এদের বিয়ে না দেয়া অবধি তিনি পানি অবধি ছুয়ে দেখবেন না। জেদমএট বশবর্তী হয়ে অসুস্থ হলেন তবুও হার মানবেন না। শ্বাশুড়ির এমন অবস্থা দেখে ভড়কালেন তহমিনা। এরকম করার কোন কারণ খুজে পেলনা। সেই শুরু থেকেই এই ফ্যামিলির এক এক জনের মন বুঝতে পারেন নি তহমিনা।

মায়ের অসুস্থতায় নরম হলেন নুরুল ইসলাম। তার উপরে কথা বলেও তেমন সুবিধা করতে পারে না তহমিনা। স্বামীর উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করেও লাভ হয় নি। তিনি তার মায়ের কথাই রাখবেন। এদিকে তুরাগকে মানানো ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। তবে তা সম্ভব হয়েছে মিথিলার মায়ের জন্য। গত পরশুদিন বিকেলের দিকে তায়েফ সাইয়িদ এর সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা কা’টাকা’টি হচ্ছিল সেই মুহুর্তে তুরফা আর তহমিনার কাঁধে ভর করে বাসায় প্রবেশ করেছিলেন মিথিলার আম্মা।

এক সময় তিনি চাইতেন যার জন্য তার মেয়ের এমন অবস্থা হয়েছে সে যেন তার মেয়ের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু ওই মুহূর্তে মিথিলার আম্মার ছিল পুরো ভিন্ন রুপ। তিনি যেন তুরাগকে সহ্যই করতে পারছিলেন না। তিনি কা’টকা’ট গলায় জানিয়েছেন মিথিলা যদি সুস্থ হয়ও তিনি বেঁচে থাকতে তুরাগ এর সাথে কোন দিনও বিয়ে সম্ভব নয়। তুরাগ যদি এরকম কথা আর মুখেও তোলে তাহলে তিনি এখান থেকে চলে যাবেনই সাথে মিথিলাকেও অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।

কারণ এই ভালোবাসা নামক অভিশাপ পুরো পরিবার ধ্বংস করে দিয়েছে। এই একটা মাত্র কারণে আজ মোহনা আমাদের মাঝে নেই। তিনি এই বিষয়টা আর একটুও সামনে আগাতে দিবেন না। তুরাগ এর চোখের পানি তাকে টলাতে পারেনি। দুই মেয়ে স্বামী সব হারিয়ে তিনি তখন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছেন।

তার কঠোরতা, ফ্যামিলি প্রেশার বাবার চাওয়া, নানুর অসুস্থতা সব মিলিয়ে অবশেষে তুরাগ হার মানে। কতদিন আর যু’দ্ধ চালিয়ে যাবে সবার সাথে। অসুস্থ নানুর হাত ধরে বলে এসেছিল তরুকে দেখে রাখবে। এরপর শুধু পরিবার এর মানুষ জনের সামনেই কাজি এসে বিয়েটা সম্পন্ন করেছিল। তহমিনা বেগম পুরো নিশ্চুপ হয়ে আছেন। তিনি এসব একটা বারের জন্যও তরুর সামনে আসেন নি। না কোন আগ্রহ ছিল এই বিয়েতে। তা নিয়ে এক প্রকার মন খারাপ ছিল। তার উপর সবার অগোচরে তুরাগ যা বলার তাতো বললই।

#ফ্লাসব্যাক এন্ড
জীবনের নতুন মোড়টা হুট করেই হয়ে গেল। এখন ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে তা জানা নেই কারোই। সবাইতো আশা করে আছে যে একবার বিয়েটা যখন হয়েছে তখন সব কিছু আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই ঠিক হবে। কিন্তু আদৌ কি কিছু ঠিক হবে। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভেতর থেকে।
তরু মুখ ঘুরিয়ে তুরাগ এর দিকে ফিরলো। তুরাগ ওর দিকে মুখ করেই শোয়া ছিল। তরু তাকাতেই চোখাচোখি হলো। তরুকে জিজ্ঞেস করলো

– ঘুমাচ্ছো না কেন?
– আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন?
– ঘুম আসছে না।
– আচ্ছা আমরা কি ভুল করলাম? মিথিলা আপু যদি ফিরে আসে তবে সে যদি আমাদের ভুল বোঝে।
– কি হবে সামনে জানি না আমি।
– সে আসলে কি আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন?

জবাব দিলো না তুরাগ। কিছু সময় দুজনই নিরব রইল। চোখের কোনে পানি জমল তরুর। সব কিছু আসলে এতটা সহজ ও নয়। কোন নারীই তার স্বামীর ভাগ অন্য কাউকে দিতে পারে না। তবুও মিথিলা নিজেকে মিথ্যা সান্তনা দেয় যে “”তুই তো সব জানতি তরু। তবুও তো বিয়েতে মত দিয়েছিস। এখন কেন কষ্ট পাচ্ছিস””।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৮

– ঘুমিয়ে পড়েছো?
তুরাগ এর কন্ঠ কানে আসতেই হাতের উল্টোপিঠে চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু মুছে ফেলল।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩০