ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩০

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩০
নীহারিকা নুর

জানালার পর্দা গলিয়ে ভোরের মিষ্টি আলো চোখের পাতার উপরে পড়তেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল তুরাগের। গায়ে থাকা পাতলা কাঁথাটা টেনে চোখ অবধি ঢেকে নিল। ঘুমানোর ব্যার্থ চেষ্টা করল। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। মুখ ঢেকে ঘুমানোর অভ্যাস একদম নেই। কাঁথাটা টেনে আবার নামিয়ে ফেলল।

আর সাথে সাথেই চোখে পানির ফোটা এসে পড়ল। চোখ মেলে তাকালো তুরাগ। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো হাতের উপরেও কিছু পানি পড়ে আছে। বিন্দু বিন্দু পানিগুলো শিশিরকণার ন্যায় মনে হচ্ছে। পানির উতস খোজার জন্য চোখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালো তুরাগ। কিছু সময়ের জন্য যেন থমকে গেলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সদ্য স্নান শেষ করে আসা রমনী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তার কোমড় সমান ছড়িয়ে থাকা রেশমি কালো চুলে হাত দিয়ে ঝাড়া দিয়েছেন যাতে অতিরিক্ত পানিগুলো পড়ে যায়। নয়ত এত বড় চুল মুছতে মুছতেই টাওয়াল ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। তার এহেন কর্মকান্ডে যে কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে সেদিকে খেয়াল নেই৷ সে আপন মনে চুলগুলো মুছে যাচ্ছে।

চুলের আগা বেয়ে শিশির বিন্দুর ন্যায় পানি গুলো টুপটুপ করে নিচে পড়ছে। মাত্রই গোসল সেরে বের হওয়ায় সদ্য ফোটা কোন গোলাপের ন্যায় মনে হচ্ছে তরুকে। তার এই রুপে কিছু সময়ের জন্য থমকালো তুরাগ। পরমুহূর্তেই কিছু একটা মাথায় আসতে চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল। নিজেকে সামলে নিয়ে খ্যাক করে উঠলো তরুর উপরে।

– তোমার কি কোনো জ্ঞান বুদ্ধি নেই নাকি। এখানে যে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে সেদিকে হুশ নেই। দেখো দিয়েছো তো আমার মুখটা ভিজিয়ে।
সকাল বেলায়ই এরকম তিক্ত কন্ঠস্বর শুনে মেজাজ খারাপ হলো তরুর। তবুও দাতে দাত কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ এর চেষ্টা করল। এই লোকের সাথে কোন প্রকার ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছে না। তাই একটু রসিকতা করেই ভালো করে তুরাগ মুখ পর্যবেক্ষন করে বলল

– আমি তো আপনার ভেজা মুখ দেখতে পাচ্ছি না। তবে আমি আপনার মুখ ভেজালাম কখন। সপ্ন দেখেছেন বোধহয়।
তরুর শান্ত গলা শুনে দমে যায় তুরাগ। না এই মেয়ের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এ মেয়ে বোধহয় ঝগড়াঝাঁটি করতে পারে না। তুরাগ নির্লজ্জের ন্যায় আবারো প্রশ্ন করলো

– সকাল সকাল গোসল করার ন্যায় কিছু হয়েছে কি কাল রাতে। এই এক মিনিট এক মিনিট আমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমার ইজ্জতে হাত বাড়িয়েছো তুমি তাই না। তুমি তো আচ্ছা নির্লজ্জ মেয়েলোক।
এবার তরু আর শান্ত না থেকে নিজেও খ্যাক করে উঠলো।

– আপনি নির্লজ্জ পুরুষ। এভাবে কথা বলার কি আছে। আর আমি এমনি এমনি এসব করিনি। তুরফা আপু এসেছিল। সে বলে গেছে। আপনিও গোসল করে আসুন। এক সাথে নিচে যাবো। সবাই নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করতেছে।
– তুমি নিজে নিজে যেতে পারো না। আমার জন্য অপেক্ষা করার কি আছে। আমি কি তোমাকে কোলে নিয়ে যাবো নাকি।

– আমার নিজস্ব পা রয়েছে আর কারো কোলে উঠতে আমার বয়েই গেছে। আমি নিজেই যেতে পারব৷ হসপিটালে যাবেন বলছিলেন কাল রাতে। এরপর কালাম ভাইয়ের সাথে দেখা করবেন। অনেক কাজ। আগে হাসপাতালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি করুন।

তরুর মুখে হাসপাতালের কথা শুনতেই মুহূর্তের মধ্যে হাসি হাসি মুখটায় বিশাদ এর ছায়া নেমে এলো। এতক্ষণ বোধহয় সেসেব ভুলেই ছিল। মিথিলার কথা মাথায় আসতেই মস্তিষ্ক বারবার জানান দিল ” তুই ভুল করেছিস তুরাগ। ঠকিয়েছিস তুই, অন্যায় করেছিস তুই, এর ফল তোকে ভোগ করতে হবে”। মস্তিষ্কের কথাগুলো যেন সামনে থেকে কেউ বলছে এমন মনে হতে লাগল তুরাগ এর।

মুহুর্তেই তরুর প্রতি রাগ চলে এলো। বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো। গটগট পায়ে এগিয়ে এলো তরুর সামনে। সামনে তুরাগকে দাড়াতে দেখে বসা অবস্থায়ই মুখ তুলে তুরাগ এর দিকে তাকালো তরু। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো তুরাগ। শক্ত করে হাতের কব্জি চেপে ধরল। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল তরু।

তবে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল না। মুহুর্তের মধ্যে রুপ বদলানোটা এক ধ্যানে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে তরু। তুরাগ ভেতরে তোলপাড় চলছে তা বুঝতে পারে তরু তবে সেই তোলপাড় এর ক্ষত কতটা গভীর তা অনুভব করতে পারে না। একজনের কষ্ট অন্য জন কখনোই উপলব্ধি করতে পারে না। মুখে যদিও বলে তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি তবে সেটা প্রকৃত সত্য কথা নয়।

বসার টুল থেকে এক টানে তুলে দাড় করালো তরুকে। তুরাগ এর হাতে টান দেয়ার তরুও উঠে দাড়ালো। হাত টানতে টানতে রুমের বাহিরে নিয়ে এলো তরুকে। তরুও বিনা বাক্য ব্যায়ে তুরাগ এর পায়ের সাথে পা মেলায়। তরুকে রুমের বাহিরে এনে মুখের উপর দরজা আটকে দেয়। তরুর দৃষ্টিতে ভেষে ওঠে সেদিন রাতের স্মৃতি। যে রাতে তুরাগ খাবেনা তারপরেও জোর করায় রুম থেকে বের করে এভাবে মুখের উপর দরজা আটকে দিয়েছিল। সেদিন অপমানে কান্না চলে এসেছিল।

তবে আজ কেন কান্না আসছে না। সবটা যেন একদম স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। নিজেকে অনুভুতি শুন্য লাগছে। মস্তিস্ক বারবার জানান দিচ্ছে “তুই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তরু। এভাবে কোন সংসার হয় না। স্বামী যদি স্বামী না থাকে সে বিয়ে করেও অন্য মেয়ের প্রেমে অন্ধ থাকে সেখানে কিসের সংসার হবে”। বন্ধ দরজার সামনেই কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে তরু। দাত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে রেখেছে।

মস্তিষ্ক যখন কোন কিছু নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থাকে তখন এই কাজটা তরু প্রায়শই করে থাকে। তরু নিজের মনকে বোঝায় তুই কি বিয়ে করার সময় সংসার এর কথা ভেবে বিয়ে করেছিলি। তবে এখন কেনো তা নিয়ে ভাবছিস। বিয়ের পরে সব কিছু কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে।

বিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া নেয়ামত। বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরে স্বামী স্ত্রীর পরষ্পরের প্রতি আকর্ষণ জন্মানোটা খারাপ কিছু নয়। তবে তরুর কেন মনে হচ্ছে – এখন যা৷ কিছু হচ্ছে সব কিছু মিথ্যা। এগুলো একটা সপ্ন। ঘুম ভাঙলে যেনো এসব মিথ্যা হয়ে যায়। জীবনটা যেন একদম স্বাভাবিক থাকে।

এসব আকাশকুসুম চিন্তা ভাবনার মধ্যেই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ লাগতেই চমকে ওঠে তরু। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে বাস্তবে। দরজার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে থাকায়। তরুর কাঁধে হাত দাড়িয়ে গম্ভীর মুখে দাড়িয়ে আছে তুরফা। তুরফাকে দেখে ঘুরে তুরফার দিকে তাকায় তরু৷

– কি ব্যাপার পিচ্চি পুতুল কাঁদছিলে নাকি?
– না আপু কাঁদছি না৷ এই তুমি এখনো আমাকে কিসব নামে ডাকো বলোতো৷ আমার কিন্তু এখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমি এখন তোমার বড় ভাবি হুহ।

– ওহ আচ্ছা। এখন কি বড় ভাবি বলে ডাকবো নাকি। তা আপনি এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন বড় ভাবি?
তুরফার রসিকতায় ফিক করে হেসে দিলো তরু। তরুর গোমড়ামুখ টায় হাসি ফোটাতে পেরে তুুরফার ঠোঁটের কোনেও মুচকি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তরু বলল

– কা’টা পা নিয়ে আবারো আসলে কেন আপু?
– তোমাকে নিতে এসেছি। মামিমা বসে আছে নিচে।
– হুম যাবো। তবে আমার কিছু জিনিস প্রয়োজন ছিল।
– ভাইয়া কি ভিতর থেকে লক করে দিয়েছে?
উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বোঝালো তরু। অবাক হলো না তুরফা। ভাইয়ের এরকম স্বভাবের সাথে অভ্যস্ত সে। তরু এক হাত হাতের মুঠোয় নিলো তুরফা। হাত ধরে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো৷ আসতে আসতে বলতে লাগল

– মিথি কখনো সুস্থ হবে কিনা জানি না। যদি সুস্থ হয়ও তবে কি হবে তাও জানিনা৷ এই পরিবারে আরো বড়ো সরো কোন ঝড় আবারো নামবে সেটা আমি অনুভব করতে পারছি। তবে তুমি ভয় পেও না তরু। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছে ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাই ঘাবড়াবে না কখনো। হাল ও ছেড়ে দিবে না কখনো। শক্ত হতে হবে তোমাকে।

আমার ভাইটা খারাপ মানুষ নয়। তবে মিথিলার এক্সিডেন্ট এর পরেই এমন উগ্র স্বভাবের হয়েছে। তবের আম্মার চলে যাওয়ায় এখন আবার ওর মাঝে আগের তুরাগ ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি আমি৷ আগে চাইতাম ও যেন মিথিলাকে না ঠকায়। এখন আমার মন চাচ্ছে ভাইয়া যেন তোমাকেও তোমার অধিকার থেকে বন্চিত না করে। এমন একটা মুহুর্তে আমার কি করা উচিত আমি জানি না৷ আৃি নিরুপায় বোন। তবে দোয়া করব আল্লাহর যেটা উত্তম মনে হয় তিনি যেনো সেটাই করেন৷

কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকল দুজন। হাতের তালু ছেড়ে তরুর হাতের কব্জি ধরে বিছনায় বসাতে চায় তুরফা। মনের অজান্তেই উফফ শব্দ বের হয়ে যায় তরুর মুখ থেকে৷ ভীষণ যন্ত্রণা হয় হাতে৷ তবুও অন্য হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে তরু। তুরফা তাড়াতাড়ি তরুর হাত জাগিয়ে হাতের কব্জির দিকে তাকায়। খানিকটা জায়গা নীল হয়ে রয়েছে। ফর্সা হাতে নীলচে রঙটা কেমন যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাত যে কেউ চেপে ধরেছিল তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে যায় তুরফা৷ কন্ঠে উত্তেজনা রেখেই প্রশ্ন করে

– ভাইয়া করেছে এটা?
জবাব দেয় না তরু। তবে তুরফা এতটাও অবুঝ নিশ্চয়ই নয়৷ রেগে যায় তুরফা৷ বলে
– ও তোমাকে আঘাত করার সাহস কোথায় পেল? এটা বাবা জানলে কি হবে বলোতো।
– থাক না আপু। কাউকে বলার দরকার নেই। এমনি ঠিক হয়ে যাবে এটা
” ভালোই বড় হয়ে গেছিস। ব্যাথা পেয়ে এখন আর ভ্যা ভ্যা করে কাদিস না।মায়ের থেকে আঘাত লুকাতে শিখে গেছিস”

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৯

তহমিনার কন্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে দরজার দিকে তাকায় তুরফা আর তরু। ভয়ে ঢোক গিলে তরু। তার মা কাল থেকে এমনিতেই ভীষণ রেগে আছেন৷ কথা অবধি বলেন নি। এখন আবার এসব দেখে কি করবে কে জানে।

ভালোবাসার বর্ষণ বোনাস পর্ব