ভালোবাসার বর্ষণ বোনাস পর্ব 

ভালোবাসার বর্ষণ বোনাস পর্ব 
নীহারিকা নুর

টেবিলে তৈরি করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন রকমের খাবার। টেবিলে বসে অপেক্ষা করছে সবাই। সবাই আসলেও তুরাগ এখনো অনুপস্থিত। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গটগট পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামল তুরাগ৷ সবার নজর তখন তার দিকে। সবাই ভেবেছিল তুরাগ ডায়নিং এ আসলে একসাথে খেতে বসবে।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায় তুরাগ। সবার সামনে এমন আচরনে অপমানে মুখ থমথমে হয় তায়েফ সাইয়িদ এর। তিনি পেছন থেকে একবার ডাক দেন তুরাগকে। তবে তুরাগ পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে যায়। মেজাজ খারাপ হয় তায়েফ এর। তবে এই মুহুর্তে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রন এর চেষ্টা করেন। খাবার ছেড়ে উঠে যান তহমিনা। লক্ষ্য করল সবাই। নুরুল ইসলাম কিছু বলতে গিয়ে ও কথা গলার মধ্যেই গিলে নিল। যা বলার পার্সোনালি বলবেন। সবার সামনে স্ত্রীকে কিছু বলাটা ঠিক হবে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

খাওয়া শেষ করে রুমে আসলেন নুরুল ইসলাম। তহমিনা ততক্ষণে বোরকা পরে ফেলেছেন। হিজাব বাধায় ব্যাস্ত তিনি। পা টিপে টিপে রুমে প্রবেশ করলো নুরুল ইসলাম। একদম তহমিনার পিছনে এসে দাড়ালো। আয়নায় নুরুল ইসলামকে পেছনে দেখতে পেল তহমিনা। তবে কিছু না বলে নিজের কাজে মন দিলো। শান্ত কন্ঠে নুরুল ইসলাম জানতে চাইলেন

– কি করতে চাচ্ছো?
– গ্রামে চলে যাচ্ছি।
– তরু??
– তোমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে। এখন আর আমার প্রয়োজন নেই তার। সে এখন নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারে।
– আজকেই যাবে? এটা কি ভালো দেখায়?
– এখানে থেকে অপমান হতে চাই না। নিজের বাড়িই ভালো।
– মা কে কি করব?

– সে থাকুক এখানে। তার ইচ্ছে তো পুরন হয়েছে। সেটা চোখ ভরে দেখুক তিনি। আমি আর এখানে থাকব না। এটা আগে ননদের বাসা ছিল। এখন মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে এভাবে উঠে থাকাটা ভালো দেখায় না। আমি আজই যাবো। তুমি যেতে চাইলে যাও নয়ত মেয়ের শ্বশুর বাড়ি পড়ে থাকো।
নুরুল ইসলাম জানতে চাইলেন

– কেউ কিছু বলেছে?
– কে আবার বলবে। তোমার মেয়েই তো বললো এখন সে এদিক সামলাতে পারবে।
– কখন বলল?
– একটু আগে তুরফার ঘরে বসে। তার মানে তার শ্বশুর বাড়ি থাকাটা এখন তার পছন্দ নয়।
কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোনে জ্বল জমল তহমিনার।

নুরুল ইসলাম আর কথা বাড়ালেন না৷ বলে বলে অনেক দিন আটকেছেন তহমিনাকে৷ আজ আর বাধা দিলেন না। তহমিনা কষ্ট পেয়েছেন ভীষণ। নুরুল ইসলাম এর ও খারাপ লাগল। তবে তিনি তরুর উপর রেগে নেই। বিয়েটা তো তারাই দিয়েছেন। তিনিও শার্ট প্যান্ট পরে নিলেন। তৈরি হলেন যাওয়ার জন্য। ক্ষনিক সময় বাদে বেড়িয়ে এলেন বাসা থেকে।

তায়েফ, তুরফা অনেক রিকোয়েস্ট করেছেন। তবে তহমিনা এখন আর থাকবেন না। নুরুল ইসলাম জানালেন আবার আসবেন। আসার সময় তরু সেখানে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ছিল। তহমিনা ভেবেছিলেন মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে আম্মু আমার ভুল হয়েছে। তবে তার আশা আর পূর্ন হলো না। বৃযাথিত হৃদয় নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে।

এই মুহুর্তে গলা ফাটিয়ে কাদতে মনম চাচ্ছে তরুর। ঠোট চেপে কান্না আটকাচ্ছে। মন চাচ্ছে ছুটে গিয়ে মায়ের পায়ে পড়ে কাঁদতে। তবে এই মুহুর্তে নিজেকে শক্ত করতে চাচ্ছে। তহমিনা এখানে থেকে তুরাগের কর্মকান্ড সহ্য করতে পারবে না।

– দেখুন তুরাগ সাহেব আপনার জন্য একটা ব্যাড নিউজ আছ।
ড. এর মুখে এমন কথা শুনে অস্থির হয়ে গেলো তুরাগ। উত্তেজিত কন্ঠে জানতে চাইলো
– কি নিউজ ডক্টর।
– রোগী কাল রেসপন্স করেছিল।
– কখন। জানাননি কেন?

– আপনি কি কাল সকালে তার সাথে কোনো কথা বলেছিলেন?
মনে করার চেষ্টা করে তুরাগ। কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম হতেই মনে পড়ে কাল মিথিলার হাত ধরে কানের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিল। এ কথাটা চেপে গেলেন তুরাগ। বললেন

– হ্যা কথা তো বলেছিলাম।
– আপনি চলে যাওয়ার পরে রেসপন্স করেছিল পেসেন্ট। তার হাতের আঙুল নড়তে দেখা গেছে। তার মানে আপনার কথাগুলো তার মস্তিষ্কে বেশ চাপ প্রয়োগ করতে পেরেছে।

– হোয়াট……
– শান্ত হন তুরাগ সাহেব।
– কীভাবে সম্ভব। ও তো কোমায়।
– জ্বি। আপনার কথা সঠিক। তবে আপনি হয়ত এ বিষয়ে অবগত নন যে কোমায় থাকার বিষয়টাও দুই রকম হয়ে থাকে। প্রথমত ব্রেইন ডেথ এবং দ্বিতিয়ত ভেজিটেটিভ স্টেট। ব্রেইন ডেথ অর্থ মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। আর ভেজিটেটিভ স্টেট হলো রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না।

এই পেসেন্ট এর ক্ষেত্রে বর্তমানে দ্বিতীয় সমস্যাটি হয়েছে। রোগীর কোমায় থাকার যথাযথ কারণ জানা থাকলে এবং দ্রুত চিকিৎসা করা গেলে পেসেন্ট এর সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি তা না হয় তবে দুই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। এক অবস্থায় আরো অবনতি ঘটে মৃত্য ঘটতে পারে। দ্বিতিয়ত ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে যেতে পারেন।

এর মানে তার শ্বাস, প্রশ্বাস, হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ সবই ঠিক থাকে তবে সে কোনোদিন আর চেতনা বা জ্ঞান ফিরে পায় না৷ এই অবস্থায় রোগী দীর্ঘদিন থেকে যেতে পারে। অথবা মা’রাও যেতে পারে। আমি অত্যান্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমাদের এই কোমায় থাকাটা ভেজিটেটিভ স্টেটে চলে গিয়েছেন।। তার মস্তিষ্ক সজাগ। তবে তিনি চেয়েও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারবেন না। আর এই পেসেন্ট কোনোদিন চেতনা ফিরে পাবেন না।

ডক্টর এর কথা আর শোনার ধৈর্য হলো না তুরাগের। তার হৃদপিণ্ডটা জ্বলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে চিতকার করে কাঁদতে। এরকম কিছু হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। মিথিলাকে যখন তার জীবনে ফিরাবেনই না তবে এরকম অবস্থায় কেন ফেলে গেলেন। এই কষ্ট কি সহ্য করার মতো। আর কোনদিন চেতনা ফিরে পাবেনা মিথিলা। কথাগুলো কানে বাজছে বারবার৷ হঠাৎ রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উঠে দাড়িয়ে ডক্টর এর কলার চেপে ধরে। চিল্লিয়ে বলে
– আমাকে এখন কেন জানাচ্ছেন। আগে কেন জানালেন না৷

ডক্টর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন। ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এলো তুরাগকে ধরতে। সেই মুহুর্তে ধপ করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। ডক্টর এর কলার ছেড়ে দিলো তুরাগ। পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেরিনা বেগম ( মিথিলার মায়ের নাম কি ব্যাবহার করেছিলাম মনে নেই। তাই এটা ব্যাবহার করলাম) নিচে বসে পড়েছেন। তার দুই হাত এখনো তুরফা আর তরুর দখলে।

তারা দুজনও নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে আছে। মেরিনা বেগমকে তোলার চেষ্টা করছেন না। মেরিনা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। তার কান্নার শব্দ কানে আসতেই হুশ হলো তুরফা তরুর। তারা দুজনও মেরিনার পাশে বসে পড়লেন। সান্তনা দেয়ার ভাষা তাদের জানা নেই। এতদিন ও ক্ষীণ আশা ছিলো তা যেন মুহুর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে গেল। সামনে এগিয়ে এলো তুরাগ৷ তরুর মাথা নত তখনো। তুরাগ তুরফাকে উদ্দেশ্য করে বলল

– তোরা কেন এসেছিলি?
– ভাইয়া তুমি ভুলে গেলে একদিন পরপর থেরাপি দেয়া লাগে খালাম্মাকে। আজও ডেট ছিল। তাই এসেছিলাম। খালাম্মা মিথির অবস্থা জানতে এই ডক্টর এর কাছে আসতে চাচ্ছিল। তাই এসেছি। আমরা জানতাম না তুমি এখানে।
কথাগুলো বলেই মাথা নিচু করে নিলো তুরফা।

তুরফার নিজেরও কান্না পাচ্ছে। এ কিরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। অবাক হয় তুরফা। আজ সকালেও মনে মনে বলছিল আল্লাহ পথ দেখাও। এরকম দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। একটা পথ দেখাও। আল্লাহ মনে মনে আওড়ানো কথাগুলো শুনেছেন। খেয়াল হতেই নিজেই নিজের মনকে ছি ছি করে। কিসব ভাবছে সে। তুরফা ভাবে চারপাশে মানুষ জড়ো হচ্ছে।

মেরিনা বেগমকে শান্ত করতে হবে। তরু আর তুরফা দুজন মিলে টেনে তুলে মেরিনা বেগমকে। মেরিনা বেগম হুশ হারিয়েছেন ততক্ষণে। দুজন ধরে ধরে গাড়ি অবধি নিয়ে আসে তাকে। ব্যাকসিটে শোয়ায়ে দেন তাকে। বাসায় যাওয়া জরুরি আগে। তরু বসে কোলের উপর মেরিনার মাথা নিয়েছে। তুরফা ড্রাইভার এর পাশের সিটে বসল। তুরাগ যাবেনা এখন। কেবিনে যাবে একবার। কি অবস্থা দেখতে।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দৃস্টিসীমা অতিক্রম করে। তুরাগ বাকরুদ্ধ হয়ে এই কম বয়সী দুটো মেয়ের দায়িত্ববোধ দেখছে। মা না থাকায় আজ এদেরকেই কত ঝড় ঝাপটা সামলাতে হচ্ছে। ক্ষনিক সময়ের জন্য তরুর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় তুরাগ। পা বাড়ায় আবারো ভেতরের দিকে।

আইসিইউ এর সামনে থমকে দাড়িয়ে থাকে তুরাগ। বুক ফেটে যাচ্ছে। এই মানুষটা আর কখনো চেতনা ফিরে পাবেনা ভাবতেই বুক চিড়ে কান্না আসছে। হৃদপিণ্ডটা জ্বলছে। মিথিলার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বেরিয়ে আসে তুরাগ। পেছন ফিরে তাকায় না। মনে মনে বলে আর আসবে না এখানে। এই অসহায় মুখটা দেখার সাহস আর তার নেই। শার্টের গোটানো হাতায় চোখের জ্বলটুকু মুছে ফেলার চেষ্টা করে তুরাগ। তবে মনটা আজ ভীষণ ছটফটে। কোনভাবেই যেন শান্ত হচ্ছে না।

রাত দুটো
বেলকনিতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তুরাগ আসার অপেক্ষা করছে তরু। তুরাগের বেলকনি থেকে গেটটা দেখা যায়। তুরাগ গেট দিয়ে ঢুকলেই এখান থেকে দেখা যাবে৷ তাই এখানেই দাড়িয়ে আছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখটা লেগে আসছে। তাও ঠায় দাড়িয়ে আছে সেখানে। মিনিট দশেক পরে দেখা মেলে তুরাগের। হাটতে পারছে না ঠিক মতো। পা টলছে। বেকিয়ে পড়ছে।

তুরাগ আজ কোথায় গিয়েছিল তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না তরুকে। দৌড়ে নিচতলায় আসে তরু। তুরাগ ততক্ষণে সদর দরজার সামনে চলে এসেছে। তরুকে সামনে পেয়ে তরুর গায়েই ঢলে পড়ে। তরু কোন মতে দরজা লাগিয়ে ধরে ধরে উপরে নিয়ে যায়। বিছানায় বসাতেই সেখানে শুয়ে পড়ে তুরাগ। তুরাগকে রেখে জোরে জোরে শ্বাস টানে। এতটুকু আসতেই হাপিয়ে গেছে।

তুরাগ এর মতো স্বাস্থ্যবান, বলবান পুরুষ মানুষকে তরুর মতো ছোট খাট একটা মেয়ে এতগুলো সিড়ি পেরিয়ে এনেছে এটা কি চাট্টিখানি কথা। তরু লক্ষ্য করল ঘামে ভিজে আছে তুরাগ এর শার্ট টা৷ তরু যায় তুরাগ এর শার্টটা খুলে দিতে৷ সবগুলো বোতাম খুলে দিয়েছে। ঠিক সেই মুহুর্তে তরুর হাতখানা চেপে ধরে তুরাগ। যেখানে হৃদপিণ্ড থাকে ঠিক সেই বরাবর তরুর হাতটা চেপে ধরে তুরাগ। কেঁপে ওঠে তরু। এরকম অনুভুতি এই প্রথম। কোনো পুরুষ মানুষকে এরকমভাবে কাছ থেকে লক্ষ্য করা হয় নি৷ তাই লজ্জাও লাগছে তরুর৷ তখন নে’শালো কন্ঠে তুরাগ ডাক দেয়

– তরু
– হু
– তরু শুনছো
– হু
– আমার ঠিক এই জায়গায় না খুব জ্বলছে। আমি কি করব বলতে পারো। তুমি কি আমার কলিজাটা ঠান্ডা করে দিতে পারবা তরু।
তুরাগ এর নেশালো কন্ঠে বারংবার কেপে ওঠে তরু। কি বলবে এখন তরু। তরু চায় হাতটা সরিয়ে নিতে। কিন্তু পারেনা৷ তুরাগ আরো জোরে ধরেছে হাতটা।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩০

( আমি অভিজ্ঞ লেখিকা নই সেটা আমি অনেক আগের একটা পর্বেই বলেছিলাম। এই মুহুর্তে এসে যাদের মনে হচ্ছে আনাড়ি লেখিকা, গল্প লিখতে পারে না তাদের উচিত ছিল আগের সেই পর্বটা লক্ষ্য করা)

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ৩১