বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৭

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৭
নিশাত জাহান নিশি

“রুমকিকে বিয়ে করবি তুই?”
হতভম্ব সাহিল। নির্বিকার, নির্লিপ্ত। মুহূর্তেই ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা লাগল তার। এটা কী আদোতেই কোনো আবদার হলো? এই আবদারের কোনো মানে খুঁজে পেলোনা সাহিল। যদিও এই প্রথম তার মা তার কাছে কোনো আবদার করল তাও আবার এমন আবদার যে আবদার সে নিজের ওপর জোর করেও রাখতে পারবেনা! রীতিমতো অসম্ভব একটি আবদার। ঝট করে সাহিল বসা থেকে ওঠে গেল। তার মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস হারালো। অন্য পাশ ফিরে ক্ষীণ গলায় বলল,

“অসম্ভব মা। আমি তোমার কাছ থেকে এমন কিছু এক্সপেক্ট করিনি।”
নাজিয়া চৌধুরীও এবার বসা থেকে ওঠে গেলেন। ছেলের মুখোমুখি দাড়ালেন। সংকীর্ণ গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,
“প্রস্তাবটা কী খারাপ ছিল? আমাদের রুমকি কোন দিকে থেকে খারাপ? রূপে, গুনে তাকে কেউ টেক্কা দিতে পারবেনা। বাপ মরা অসহায় একটি মেয়ে তাকে বিয়ে করলে তোর কতোটা পূণ্য হবে তুই জানিস?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তাছাড়া মিশালের কাঁধ থেকেও একটি দায়িত্ব নামবে। ছেলেটা একটু স্বস্তি পাবে।ছেলেটার কথা ভাবতেই আমার কলিজাটা পুঁড়ে যায় জানিস? এই বয়সে কতো স্ট্রাগল করতে হচ্ছে তাকে। যা বলছি একটু ভেবে দেখ। বয়সে রুমকি তোর থেকে অনেক ছোটো হলেও আমি তাকে সব বুঝিয়ে টুঝিয়ে নিবো। তুই অসব নিয়ে কোনো চিন্তা করিসনা। কিছুদিন পর তো তার ১৮ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে। তাকে যতোটা ছোটো ভাবছিস সে ততোটাও ছোটো নয়।”

চট করে রেগে গেল সাহিল। খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বলল,
“জাস্ট স্টপ মা। রুমকিকে কখনও আমি ঐ চোখে দেখিনি। তাকে নিয়ে আমার মনে কখনও ঐ রকম ভাবনাচিন্তা আসেনি। ভালো এতেই হবে যদি তুমি এই বিষয়টি এখানেই ভুলে যাও। প্লিজ ফারদার তুমি এমন কোনো আবদার করবেনা যে আবদার আমি রাখতে পারবনা।”

তবুও দমলেননা নাজিয়া চৌধুরী! তিনিও ছেলের মতো একরোঁখা গলায় বললেন,
“কেন ক্ষতি কী? সামান্তাকে যেহেতু তুই এখন ভুলতে পেরেছিস তাহলে তার জায়গায় রুমকিকে গ্রহণ করতে সমস্যা কী? আজ হোক বা কাল হোক বিয়ে তো তোকে করতেই হবে। সেখানে আমার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করলে তাতে সমস্যা কী? আমি যেহেতু তোর মা, আমি কী চাইতে পারিনা আমার ছেলে আমার পছন্দ মতে বিয়ে করুক? না-কি এই অধিকারটুকুও আমার নেই?”

“প্রশ্নটা অধিকারের নয় মা। প্রশ্নটা হলো আমি তোমার পছন্দকে কতটুকু মেনে নিলাম তাকে ঘিরে। তোমার পছন্দ আর আমার পছন্দ ম্যাচ না ও হতে পারে। তো তা নিয়ে তো মা ছেলের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তুমি এই টপিকটা এখানেই ইন্ড করো প্লিজ। প্রয়োজনে রুমকির জন্য আমি ভালো ছেলে খুঁজে দিব। এই নিয়ে তোমার কোনো বাড়তি টেনশন করতে হবেনা।”

হনহনিয়ে সাহিল রুম থেকে প্রস্থান নিলো। মোটেও অবিচল হলেননা নাজিয়া চৌধুরী। কোমরে হাত গুঁজলেন তিনি। ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে জিদ্দি গলায় বললেন,
“আমিও দেখে নিব তুই আমার ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে না করে কোথায় যাস! বিয়ে করতে হলে রুমকিকেই তোর বিয়ে করতে হবে। দেখি তুই কীভাবে এই বিয়ে আটকাস!”

দ্রুত পায়ে হেঁটে সাহিল তার রুমে প্রবেশ করল। শার্টের কলারের সাথে তার ধস্তাধস্তি লেগে গেল! সামনে যা পেল তাতেই লাথ মেরে বসল। ঘাড়ের রগ টান টান করে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
“শালা ভাগ্য আমার। যাকেই পছন্দ করছি তাকেই হারাতে বসছি! মনে হয়না প্রেম ভালোবাসা আমার কপালে আছে বলে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ার আগেই আমাকে কনফার্ম করতে হবে জেনিয়া আমার প্রতি ঠিক কী ফিল করে। যদিও প্রথম থেকে আমিই তাকে চটিয়ে দিয়েছি! মনে হচ্ছেনা পজেটিভ কিছু হবে বলে!”

বিকেল চারটা নাগাদ মিশাল বাড়ি থেকে বের হলো। রুমকিকে দেখতে সামান্তাদের বাড়িতে এলো। সদর দরোজায় দাড়িয়েই মিশাল অনুভব করল বাড়িতে আরও কেউ আছে। উচ্চস্বরে কথা এবং হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কৌতূহল নিয়ে মিশাল কলিংবেল বাজাতেই বাড়ির কাজের বুয়া এসে সদর দরজাটি খুলে দিলো। ড্রইংরুমের সোফার দিকে উৎসুক দৃষ্টি ফেলতেই মিশালের ঠোঁট দুটি প্রসারিত হয়ে ওঠল। তার ফুফু হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে! হাত দ্বারা ইশারা করে তিনি মিশালকে ডেকে বললেন,

“এদিকে আয় তাড়াতাড়ি। এই মাত্রই তোকে কল করতে যাচ্ছিলাম। এরমধ্যেই তুই চলে এলি।”
এগিয়ে এলো মিশাল তার ফুফুর দিকে। আলতো হেসে তার ফুফুর পাশে বসল। ফুফুর হাতে হাতে রেখে বলল,
“একেই বলে রক্তের টান বুঝলে? তুমি ডাকার আগেই আমি ছুটে এলাম।”

আহ্লাদী হয়ে নাজিয়া চৌধুরী মিশালের মাথায় চুমু খেলেন। মিশালের মাথায় হাত বুলিয়ে অভিমানী স্বরে বললেন,
“মাঝে মাঝে তো ফুফুকে দেখতে যেতে পারিস। ইদানিং দেখছি ফুফুকে ভুলেই গিয়েছিস। মনে পরেনা ফুফুর কথা না রে?”

“বিষয়টা এমন নয় ফুফু। একচুয়েলি ইদানিং ব্যস্ততা বেড়েছে। তাছাড়া তুমি তো জানোই ফুফা আমাকে তেমন পছন্দ করেননা! তাই বিশেষ করে যাওয়া হয়না।”
“তোর ফুফা কী সারাক্ষণ বাসায় থাকে বল? ব্যবসা বানিজ্যের কাজ নিয়েই তো সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। সময় করে চলে যাস ফুফুর কাছে। ফুফুও তো মাঝেমাঝে তোদের অনেক মিস করি। বড়ো ভাইয়া বেঁচে থাকলে তো সপ্তাহে একবার হলেও আমাকে দেখতে যেতো।”

আবেগী হয়ে কান্না জুড়ে দিলেন নাজিয়া চৌধুরী। পাশ থেকে মিজানুর রহমানও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি মাথা নুইয়ে নিলেন। মিশালের চোখের কোণেও জল ছুঁইছুঁই। পৃথিবীর মানুষদের ভয়ঙ্কর আঘাতে মিশালের চোখে ভরাডুবি না নামলেও বাবার কথা মনে পরলেই তার চোখে বিষাদ নামে! ধরে রাখতে পারেনা তার আবেগ। বাবার পাগল সে।

ততোক্ষণে জেসমিন বেগমও ট্রে-ভর্তি চা-নাশতা নিয়ে এলেন। মিশালকে দেখে তিনি আরও একদফা খুশি হয়ে গেলেন। তবে সবার মুখের বিবর্ণ অবস্থা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন না কী হয়েছে এখানে। নির্বাক হয়ে সোফায় বসলেন তিনি। মিশালের দিকে প্রশ্ন ছুড়লেন,

“রুমকিকে দেখতে এসেছ? উপরেই আছে রুমকি। যাও তাকে দেখে এসো। মন ভালো হয়ে যাবে।”
নাজিয়া চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকালো মিশাল। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো সে। তার ফুফুর গালে লেগে থাকা জলগুলো আলতো হাতে মুছে দিলো। ম্লান হেসে বলল,
“মৃত ব্যক্তির জন্য কাঁদতে নেই ফুফু। শুধু দোয়া করো আল্লাহ্ যেনো আমার বাবাকে বেহেশত নসীব করেন। তোমরা বসে কথা বলো। আমি আসছি।”

সিঁড়ি বেয়ে মিশাল ওপরে ওঠে গেল। ধীর পায়ে সামান্তার রুমের সামনে দাড়ালো। দরজা ভেজানো। হালকা ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। রুমের ভেতর থেকে বিকট হাসাহাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। মেয়েরা একসাথে হলে যা হয়। দরোজায় নক করা উচিৎ মিশালের। বেশ ভেবেচিন্তে সে দরোজায় নক করল। “মা এসেছ?” বলেই সামান্তা রুমের দরোজাটি খুলতেই আবার এক পলকের মধ্যেই দরোজাটি বন্ধ করে দিলো।

লজ্জায় তার মাথা কাটা গেল। কেবল ব্লাউজ আর পেটিকোট পরেই সে দরোজা খুলে দিয়েছিল! কে জানত দরোজার বাইরে ওটা মিশাল হবে। ঐদিকে ফ্রিজ হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে মিশাল। কী দেখল এসব সে? ঝটকা কিছুতেই কাটছেনা তার। চোখের পলকও পরছেনা।
লজ্জায় কুকিয়ে ওঠে সামান্তা হাতের নখ কামড়াতে লাগল। কিছুক্ষণ পর পর মুখ ঢাকতে লাগল। চোখ দুটো খিঁচে ধরে সে বিড়বিড় করে বলল,

“হায় আল্লাহ্। কী হলো এটা? মিশাল ভাইয়া তো আমার সব দেখে নিলো! মে তো লুট গায়ি!”
সায়মা ও রুমকি ব্যস্ত সাজুগুজু করতে। কে আগে সাজবে এই নিয়ে তাদের প্রতিযোগীতা। সামান্তার দিকে মোটেও নজর নেই তাদের। তবে সাইফার দৃষ্টি এড়ালোনা সামান্তার দিকে থেকে। শাড়ির কুঁচি সামলে সাইফা সামান্তার দিকে এগিয়ে এলো। প্রশ্ন ছুড়ল,

“কী হলো আপু? দরজার বাইরে কে ছিল?”
“মিশাল ভাইয়া!”
“এইরে! এ তো হয়ে গেল। বিয়ের আগে না আবার মিশাল ভাইয়া ফুলসজ্জা সেরে ফেলতে চায়!”
মুখ টিপে হেসে দিলো সাইফা। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠল সামান্তা। কান মলে দিলো সাইফার। বলল,
“ঠাটিয়ে চড় দিবো। প্রেম করো বলে খুব পাঁকা হয়ে গেছো?”

গাঁয়ে কোনো রকমে গাঢ় সবুজ রঙের সিল্কের কাপড়টি প্যাচিয়ে সামান্তা রুম থেকে বের হয়ে এলো। কোথাও নেই মিশাল! চুটকির মধ্যেই কোথায় গায়েব হয়ে গেল? বাড়ির ড্রইংরুমে তাকিয়েও মিশালকে খুঁজে পেলোনা সামান্তা। দ্বিতীয় তলা পুরোটাই চুষে ফেলল। কোথায় নেই মিশাল। ছাদের সিঁড়ির দিকে যেতেই থেমে গেল সামান্তা। ছাদ থেকে সিগারেটের বিদঘুটে গন্ধ ভেসে আসছে সিঁড়ির দিকে।

বুঝতে পারল মিশাল ছাদে আছে। শাড়ি পরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠতে যদিও তার সমস্যা হচ্ছে তবে নিজেকে সামলে সে বাধ্য ছাদে ওঠতে। ছাদের দরজার সামনে যেতেই থেমে গেল সামান্তা। মিশাল তার চোখের সামনে দাড়িয়ে। পিছনের দিকে ফিরে সিগারেট ফুকছে। সামান্তার উপস্থিতি হয়তো সে টের পায়নি। কোমরে হাত গুজল সামান্তা। কর্কশ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

“আবার সিগারেট গিলছ?”
“তুই বাধ্য করলি!”
“মানে?”
“সুন্দরী নারীদের শাড়ি পরা অনুচিৎ। পুরুষদের ম্যাক্সিমাম হার্ট অ্যাটাকের কারণ হলো নারীদের শাড়ি পরা অবস্থায় দেখা।”
“ওহ্ আচ্ছা। এই জরিপ কী তুমি নতুন করে তৈরী করেছ?”

“অনুভব থেকে বললাম। তোরা মেয়েরা চাসনা পুরুষরা একটু শান্তিতে বাঁচুক। তাদের হার্টবির্টের বারোটা বাজিয়ে হয় তাদের গা’ঞ্জা’খো’র তৈরী করিস নয় জানে মে’রে ফেলিস!”
“ফেইস টু ফেইস কথা বলো। আমিও দেখতে চাই আমাকে দেখার পর তোমার ঠিক কোন অনুভূতিটা হচ্ছে!”

মিশালকে ঘুরিয়ে সামান্তা তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় সিগারেটটি হাত থেকে পরে গেল মিশালের। দৃষ্টি হয়ে গেল তার উদাস, নিমগ্ন, চঞ্চল। সামান্তা আরও এক কদম এগিয়ে গেল বেসামাল মিশালের দিকে। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো মিশালের। বুকের ওপর হাত গুটিয়ে সে মিষ্টি হেসে মিশালের চোখে চোখ রাখল। হারিয়ে গেল মিশাল সামান্তার মাঝে। ক্রুর হেসে সামান্তা শুধালো,

“হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাচ্ছেনা তো তোমার? আমি কী একটু ছুঁয়ে দিব?”
ঠাট্টার স্বরে সামান্তা কথাটি বলল। মিশাল তার চেয়েও আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যেই সে টুপ করে সামান্তার কপালে চুমু খেয়ে দিলো! আর এক মুহূর্তও দাড়ালোনা ঐদিকে! যেতে যেতে বলল,
“তোর শাড়ি পরাটাকে আজ স্বার্থক করে দিলাম! আর কখনও আমার সামনে শাড়ি পরে আসবিনা। এর চেয়েও মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে। সো বি কেয়ারফুল ওকে?”

নির্বাক সামান্তা। নিরুত্তরও বটে। লাইফে প্রথমবার কোনো পুরুষ তাকে চুমু খেলো। তাও আবার সেই পুরুষ যে পুরুষকে কিনা সে তার মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। যাকে বলে স্বপ্নের পুরুষ। মিশালকে হার্ট অ্যাটাক করাতে এসে সে নিজেই এখন হার্ট অ্যাটাকের রোগী হয়ে গেল! কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের চুমুও যে নারীদের হার্ট অ্যাটাকের কারণ মিশাল কী তা জানে?

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৬

ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে যেতেই মিশাল হঠাৎ থেমে গেল। এইমাত্র সে যা শুনল তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা! নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা। মিজানুর রহমান ও জেসমিন বেগম হেসে হেসে নাজিয়া চৌধুরীকে বলছেন,
“প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সাহিলের সাথে রুমকিকে ভীষণ মানাবে। শুভ কাজ জলদি সেরে ফেলাই উত্তম।”

বুকে যে শ্রাবণ তার পর্ব ৩৮