ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৭

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৭
নীহারিকা নুর

বয়স্ক মানুষকে সম্মান দিতে আজও শিখলা না বৌমা। বাচ্চা, নাতি পুতিদের আর কি বলব। তুমি বড় মানুষ হইয়াই সম্মান দাও না।
– এখানে অসম্মান কি করলাম আম্মা?
– আমার মুখে মুখে তর্ক করাটা কি আমাকে অপমান করা নয়।
– আমি আপনার মুখে মুখে তর্ক করতাম না। কিন্তু একজন মা হিসেবে আমি কীভাবে আমার সন্তানকে এরকম অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিব।

– তুরাগ খারাপ ছেলে না বৌমা। ও ভালোবাসার মানে জানে। তার বর্তমান অবস্থা তুমি দেখবার পারতাছো না । একজন মানুষকে কতটা ভালোবাসলে এরকম অবস্থায় ও আগলোইয়া রাহন যায় তুমিই বলো। তরুর সাথে বিয়ে হইলে তুরাগ তরুকে খারাপ রাখব না। এই আমি বইলা দিলুৃম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ও মিথিলাকে ভুলে কীভাবে তরুকে মানবে সে ধারণা আছে আপনার আম্মা। এরকম একটা ছেলের সাথে আমি কীভাবে মেয়েকে বিয়ে দিব। ও কখনোই আমার মেয়েকে ভালো রাখতে পারবে না।
– তো কি করবা তুমি। কোথায় বিয়া দিবা তোমার মাইয়ারে। গ্রামে নিয়া বিয়া দিবা। কে করব তোমার বিয়া ভাঙ্গা মাইয়ারে বিয়া। গ্রামের হক্কল( সকল) মানুষ জানে তোমার মাইয়ার যে বিয়া ভাঙছিল। ভালো পোলা পাইবা তুমি ওই জায়গায়।

– আম্মা……
– সত্য কথা গায়ে লাগব এইডাই স্বাভাবিক।
– আম্মা আপনি এখনো সেই আগের যুগেই পড়ে আছেন। একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙছে মানেই যে তার জীবনের সবটা শেষ হয়ে গেছে এরকমটা ভাবার কোন কারণ নেই। তরুর জন্য অবশ্যই ভালো ছেলে পাবো আমি।
এতক্ষণ দাদি আর মায়ের কথা কা’টা’কা’টি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছিল তরু। এখন মনে হচ্ছে এরা অতিরিক্ত করতেছে। তাই মায়ের উদ্দেশ্য বলল

– আম্মু তুমি একটু বেশি বেশি চিন্তা করছো না। আমি যদি বলি আমি দাদির কথায় রাজি তাহলে
– তরু…। মুখে লাগাম দিতে শেখো। এখানে বয়স্করা রয়েছে। তুমি কীভাবে তাদের সামনে নিজের বিয়ের কথা নিজে বলতে পারো। এখানে আর একটা কথাও বলবে না তুমি। যাও এখান থেকে।
– আমার লাইফ নিয়ে টানাটানি করছো আর আমাকেই কথা বলতে নিষেধ করছো।
এরপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল

– বিয়েটা কি তোমার কাছে ছেলে খেলা মনে হয় দাদি। তুমি যে আমাদের মতামত না নিয়েই বলে দিলে তোমার নাতিন এর সাথে আমার বিয়ে দিবে তুমি একবারও আমাদের কাছে জানতে চেয়েছো আমরা রাজি কিনা।
তরুর কথা শুনে জ্বিভে কামড় দিলেন বৃদ্ধা। তরুকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। তরু কাছে আসলে তার বাম পাশে তরুকে বসার জন্য ইশারা করলেন। তার ডান পাশে তুরাগ নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে আছে। বৃদ্ধা তার দুই হাতে দুই নাতি নাতনির হাত ধরলেন। তার হাত ধরায় মাথা উঁচু করে তাকলো তুরাগ। তরু তুরাগ এর দিকে তাকানোই ছিল। চোখাচোখি হলো দুজনের। চোখে চোখ পড়তেই মাথা নামিয়ে নিল তরু। ওই চোখে তাকিয়ে থাকার মতো সাহস এই মুহুর্তে হয়ে উঠছে না। তুরাগ এর চোখগুলো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। পারলে চোখ দিয়েই তরুকে ভস্ম করে দেয়।

জোড়ে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন বৃদ্ধা। এরপর তরুর দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলেন
– জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এগুলা আল্লাহর হাতে থাহে। তিনি যার লগে যার জুড়ি মিলাইছে তার লগেই বিয়ে হইবো।
এহন যদি তোগো দুইজনের জুড়ি আল্লাহ মিলাইয়া রাহে তোরা শত চাইলেও তা থেকে পালাতে পারবি না। তাঁর ইচ্ছা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না বুজছলি।

– দাদি তোমারে কে বলল যে আমাদের জুড়ি আল্লাহ মিলাইয়া রাখছে।
– ওরে পা’গলি এত কথা কওনের তো কিছু নাই। আমি চাইতাছি তোগো বিয়াডা হউক। একবার পবিত্র কালেমার বন্ধনে আবদ্ধ হইলে দেখবি ভালোবাসা আপনাআপনি তৈরি হতে থাকবে।
– কিন্তু দাদি মিথিলা আপু..

– ব্যাস। ওই মাইয়া লইয়া আর একখান কথাও কবি( বলবি) না। সব শেষ হইছে ওই মাইয়ার লইগ্যা ( জন্য)। এহন বাকি আছে তুরাগ নানুভাইর জীবনডা। হেইডাও কি ওই মুখপুরীরে নষ্ট করতে দিব নাকি।
কথাগুলো বেশ গায়ে লাগল তুরাগের। এতক্ষণ এখানে বসে মাথা নিচু করে সব সহ্য করলেও মিথিলাকে বাজে কথা বলায় ভীষণ রাগ হলো। জোড় করে হাত ছাড়িয়ে নিল নানুর হাত থেকে। সেখান থেকে উঠে হনহন করে চলে গেলো উপরে। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। নুরুল ইসলাম আর তায়েফ সাইয়িদ এতক্ষণ নিরব দর্শক এর ভুমিকা পালন করছিলেন।

তুরাগ চলে যাওয়ার পর মুখ খুললেন তায়েফ। এগিয়ে বসলেন নুরুল ইসলাম এর দিকে। সোফার হাতলে রাখা নুরুল ইসলাম এর হাতের উপর হাত রাখলেন তিনি। নুরুল ইসলাম হয়ত এতক্ষণে অনুমান করে ফেলেছেন কি বলতে চাচ্ছেন তিনি। তবুও টুঁশব্দ না করে ধৈর্য ধরলেন বড় বোন জামাই এর কথা শোনার জন্য। তার কথা না শুনে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে গেলে সেটা নিতান্তই বেয়াদবি হয়ে যাবে।

– শালাবাবু তুমি তো এখানে উপস্থিত ছিলেই। সবটাই তো দেখলে। আমি তুরাগকে বন্ধুর মেয়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমার কোন বন্ধুর মেয়েকেই আমি পছন্দ করে রাখি নি। তবে আম্মা বলার পর এতক্ষণ ভাবলাম বিষয়টা। তরু মামনি তো যথেষ্ট ভালো একটা মেয়ে। আমি যদি তোমার মেয়েটাকে আমার ঘরের মেয়ে করে রাখতে চাই তোমার কি আপত্তি আছে তাতে।

সাথে সাথেই কোন জবাব দিতে পারলেন না নুরুল ইসলাম। তবে তিনি না ও বলেন না। কারণ তার মা, বড় বোন জামাই কথাগুলো তুলেছে। যারা কথাগুলো তুলেছে তাদের যথেষ্ট সম্মান করেন নুরুল ইসলাম। তাই সাথে সাথে না করে দিয়ে জানালেন

– মেয়ে তো আমার একার নয় ভাইজান। এখানে তহমিনার অবদান সবচেয়ে বেশি। আগে আমি তহমিনার সাথে কথা বলি।
– আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি ( তহমিনা)
– দেখ নুরু আমি তোর মা হয়ে একটা কথা বলছি এখন কি তুই কথাখানা রাখবি না।
নুরুল ইসলাম পরছেন যাতাকলে। মা, মেয়ে, বউ কার পক্ষ নিয়ে বলবেন কে কষ্ট পাবে। তাই কথা না বলে উঠে চলে গেলেন সেখান থেকে। তায়েফ সাহেব ও উঠলেন। তহমিনা আর তরুর দাদু একজন অপরজনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলেন। তুরফা তরুর হাত ধরে উঠিয়ে নিয়ে গেল সেখান থেকে। তরুকে নিয়ে হাটা ধরল ছাদের দিকে। এতক্ষণ এখানে বসে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল যেন। ছাদে গিয়ে একটু মুক্ত হাওয়া উপভোগ করাটা লক্ষ্য।

ছাদের দরজার ওপর পাশ থেকেই শুনতে পেল কিছু একটা জোড়ে পড়ে যাওয়ার শব্দ। তরুর হাত ছেড়ে দৌড় লাগাল তুরফা। ভাগ্য যখন সাথে না থাকে তখন যা হয় আরকি পায়ে থাকা স্লিপারটা যায় ছিড়ে। স্লিপার সেখানে রেখেই ছাদে যায়। ছাদের দরজা পেরিয়ে কয়েক কদম ফেলতেই কিছু একটা খুব জোড়ে পায়ে বিধে যায়। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আহহ শব্দ করে নিচেই বসে পরে তুরফা।

রাগে ছাদের রেলিং শক্ত করে মুঠোবন্দি করে দাড়িয়ে ছিল তুরাগ। তুরফার কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই দ্রুত পায়ে সেখানে আসে তুরাগ। অন্ধকারে তুরফার পা চেপে ধরে বসে থাকার অবয়ব নজরে আসে। তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্লাস অন করে। ছাদের মেঝেতে ফ্লাস পড়তেই লাল র’ক্তের ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়। তুরফার পা বেয়ে এই রক্ত নামছে।

পাশেই ভাঙা টব পড়ে আছে। এখন তুরফার পা কে’টে যাওয়াও তুরাগের ভুলের কারণেই হয়েছে। রাগের বশে নিজের হাতেই ছাদের মেঝেতে জোড়ে আঘাত করে তুরাগ। আবার আঘাত করার জন্য হাত উপরে তুলতেই মেঝে বরাবর হাত রাখে তরু। ফলে আঘাত তুরাগ এর হাতে না লেগে তরুর হাতে লাগে। মাথা তুলে তরুর দিকে তাকায় তুরাগ। তরু শান্ত কন্ঠে বলে

– রাগ কখনোই সুফল বয়ে আনে না। দেখলেন তো রাগ করলে কি হয়। এখন যদি এগুলো না ভাঙতেন তাহলে কি আপুর পা কা’টত। তুরাগ কি বলবে ভেবে পায় না। নিজের মাথা ফাকা ফাকা লাগছে।
তরু সেদিকে মন না দিয়ে ব্যাস্ত হলো তুরফার পায়ের রক্ত বন্ধ করতে। তরুর কাধে ভর করে উঠে দাড়ালো তুরফা। তুরাগ তখনো সেখানে বসে আছে। নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো তরু। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তুরাগ এর দিকে। বলল

– এখানেই থাকবেন তুরাগ ভাই। যাইয়েন না কোথাও। আমি আপুকে নিচে দিয়ে আসছি। কথা আছে আপনার সাথে।
তরু কথা আছে বলায় রাগল না তুরাগ। বরং শান্ত কন্ঠে জানতে চাইলো
– কি বিষয়?
– আমাদের বিয়ে নিয়ে।
– হোয়াট? আমাদের বিয়ে মানে? কে করবে তোমাকে বিয়ে? আমি? হাউ ফানি।
– এত বেশি কথা বলবেন না তুরাগ ভাই। বিয়ে আপনি আমাকেই করবেন দেখে৷ নিয়েন। আপনি থাকুন আসছি আমি।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৬

তরু চলে গেল তুরফাকে নিয়ে। তুরাগ তখনো সেখানে বসে ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কি বলবে তরু মাথায় সেটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৮