ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৬

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৬
নীহারিকা নুর

বসার ঘরে থমথমে মুখে বসে আছে তায়েফ সাইয়িদ। তার পাশেই বসে আছে তুরফা। অপর পাশের সোফায় বসে আছে নুরুল ইসলাম আর তহমিনা। তহমিনার পেছন ঘেষে মায়ের গলা জড়িয়ে দাড়িয়ে আছে তরু।তায়েফ সাহেব এর ঠিক অপজিট সাইডের সোফায় মুখোমুখি বসে আছে তুরাগ।

তুরাগ এক ধ্যানে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। উদ্যেশ্য বাবা কি বলে তা শোনা। তুরাগ এর পাশেই গুটিশুটি মেরে বসে আছে তারামন বিবি। নাতি আসছে পর থেকে নাতির পাশ ঘেষে বসে আছেন তিনি। নুরনাহার চলে যাওয়ার পর থেমে থেমে কান্না করেন এই বয়স্কা নারী। তার মেয়ে যে ছেলে মেয়ে দুটো রেখে গেছে তাদের দেখার ইচ্ছে বারবার পোষণ করেও তুরাগকে পাননি তিনি। তাই আসার পর থেকে নাতিনকে পাশে বসিয়ে রেখেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই মুহুর্তে সবাই ই তায়েফ সাইয়িদ এর মুখপানে তাকিয়ে আছে। তিনি গম্ভীর থমথমে মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না দেখে নুরুল ইসলামই কথা তুলল
– ভাইজান সবাইই এসেছে এখানে। আপনি কি কিছু বলতে চান।

– শালাবাবু তুমি তোমার ভাগিনাকে জিজ্ঞেস করো সে কি আমার কথা শুনবে নাকি এখনো তার মর্জি মতো চলবে।
তায়েফ সাইয়িদ এর কথায় চোখ ছোট ছোট করে ফেলে তুরাগ। ওর বাবা এখন কথা বলার জন্য মামুকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। কেন সরাসরি কথা বলা যায় না নাকি।

– মামু তোমার দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করো সে কি বলতে চায়। সে আমার বাবা আমি অবশ্যই তার কথা শুনব।
– শালাবাবু তোমার ভাগিনাকে বলো এখন তার মা নেই এখন এই সংসার এর হাল ধরার জন্য তো কাউকে লাগবে।
– মামু তোমার দুলাভাই কি আবার বিয়ে করতে চায় নাকি।
– অসভ্য ছেলে। মুখে লাগাম দাও। আমি তোমার বাবা হই।
– তাহলে সংসার এর হাল কে ধরবে?

– তোমাকে বড় করেছি কি এই দিন দেখার জন্য। আমি আমার বন্ধুর মেয়েকে তোমার জন্য পছন্দ করে রেখেছিলাম। তোমার মামা মামি নানু সবাই থাকতেই আমি চাই তুমি তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানাবে। বেশি কথা আমার পছন্দ নয়। এখন তুমি হ্যা ও বলতে পারো বা না ও বলতে পারো আমার কোন আপত্তি নেই। তবে তুমি যদি না বলো তাহলে আজকের পর থেকে তুমি ভুলে যাবে আমি তোমার বাবা।

রাগে মাথার রগ গুলো ফুলে গেছে। হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ এর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তুরাগ। কয়েক দিন আগে এত বড় একটা দূর্ঘটনা গেল। এই মুহুর্তে বাসার মধ্যে অশান্তি করাটা কতটা বেমানান সেটা মাথায় রেখেই রা’গকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে। কিছু সময় চুপ থেকে বাবার সামনে মুখ খুলল তুরাগ

– বাবা তুমি জানো আমি মিথিলাকে ভালোবাসি। তারপরেও তুমি কিভাবে আমার বিয়ে নিয়ে ভাবতে পারো৷ বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে মিথিলাকে করব নয়ত কখনোই বিয়ে করব না আমি।
– এটাই তোমার ফাইনাল সিদ্ধান্ত?
– হুম।
– তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত তুমিই নিবে?
– আমার জীবনে কি আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই।

– অবশ্যই আছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুজনদের কথাও শুনতে হয়। এখন তুমি যদি চাও তুমি তোমার বাবার উপরে কথা বলবে সেটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার৷ তুমি যদি এরকমটাই করো তাহলে আজকের পর এই বাসার দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তোমার খামখেয়ালিপনা অনেক সহ্য করেছি। সব তোমার জন্য হয়েছে। তোমার মায়ের চলে যাওয়ার পেছনেও তুমি দায়ী।

– বাবা…..
– ডাকবে না বাবা বলে।
– এভাবে ছেলেমানুষী করছ কেন।
– আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি যদি চাও তোমার লাইফে মিথিলা ছাড়া আর কাউকে দরকার নেই দরজা খোলা আছে বেরিয়ে যাও।

তুরাগ এর মনে হচ্ছে ওর বাবা এখন বেশি বেশি করছে। রাগে মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। এখানে সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারলে হয়ত শান্তি লাগত। মন চাচ্ছে সত্যি সত্যি এখান থেকে উঠে চলে যেতে। কিন্তু এই মুহুর্তে এই স্থান ছেড়ে উঠে যাওয়া মানে বাবাকে কষ্ট দেয়া। এরকম একটা মুহুর্তে বাবাও যে ভালো নেই সেটাও বুঝতে পারছে।

কিন্তু মিথিলার এই বিপদের মুহুর্তে মিথিলার হাত ছেড়ে দেয়াটা কি মিথিলাকে ঠকানো হবে না৷ কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না তুরাগ। এখন তুরফার উপর ভীষণ রা’গ হচ্ছে তুরাগ এর। তুরফা যদি আজ না হাসপাতালে না যেত আর ওভাবে না বলত তাহলে কি তুরাগ এখন বাসায় আসত। এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছে তুরাগ।

– তুরাগ কথা তো অনেক হলো। সবই শুনলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে তুুমি তোমার বাবার কথা অবশ্যই রাখবে। এরপরে আর কোন কথা তুমি বলবে না। তোমার মা আজ বে’চে নেই। তোমার গার্ডিয়ান বলতে তোমার বাবা৷ তোমার তাকে কষ্ট দেয়া উচিত হবে না।

নুরুল ইসলাম এর কথা শুনে অসহায় চাহনিতে মামার দিকে তাকায় তুরাগ। এভাবে সবাই এখন ওর বিরুদ্ধাচরণ করছে। কেউ অন্তত বলতে পারত যে ওর যাকে ভালো লাগে তাকেই বিয়ে করুক। মনে মনে খুব করে চাইলো মামুর কথার বিরুদ্ধে কিছু বলবে। মনে সাজিয়েও নিল কিছু কথা। যখনি বলার জন্য হা করল তখনি হাত উপরে তুলে না ইঙ্গিত করল নুরুল ইসলাম। দমে গেল তুরাগ৷

– তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না তুরাগ। ছোট থেকেই তুমি তোমার ইচ্ছে মতো চলেছো। আপার সপ্ন ছিল তার ছেলে পড়ালেখা করে ভালো কিছু করুক। তুমি তা না করে বেছে নিয়েছো গিটার। মেতে উঠেছো গানের সাথে। নিজের এত সুন্দর ক্যারিয়ার গড়ার পর সেটা ছেড়ে আবার যোগ দিয়েছো রাজনীতিতে।

তখনও পরিবার এর কেউ চায় নি তুমি এটা করো। তবুও তুমি করেছো সবার বিরুদ্বে গিয়ে। আজ যখন আপা নেই কাউকে তো এই সংসার এর হাল ধরতেই হবে। সেখানে তুমি পছন্দ করছ এমন একজন মেয়েকে যার নিজের জীবনের ই কোন নিশ্চয়তা নেই। ধরে নিলাম সে সুস্থ হবে। তার দায়িত্ব নেয়ার জন্যই তো অন্য কাউকে দরকার। সে কীভাবে সংসার সামলাবে।
-……..

নুরুল ইসলাম এর কথার জবাবে জবাব দেয় না তুরাগ। এই মামা নামক জীবটাকে যতই বন্ধুর মতো ভাবতে চাক এর রুপ মাঝে মাঝে ভীত ও করে তুরাগকে। এই ভয়ের আরো একটা কারণ রয়েছে। সেটা খুব ছোট বেলাকার। ছোট বেলায় মায়ের সাথে নানুবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল তুরাগ। সেখানে আশপাশের বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে বাধিয়েছিল তুমুল ঝগড়া।

ঝগড়ার এক পর্যায়ে ঘু’ষি মে’রে নাক ফাটিয়েছিল এক ছেলের। সেই ছেলের বাবা নুরুল ইসলামকে বিচার দিয়েছিল। কেউ অন্যায়ের বিচার দিলে রা’গ মাথায় চড়ে বসত নুরুল ইসলাম এর। সেদিন ও রা’গ হয়েছিল ভাগিনার উপর। বাসায় এসে পিটিয়েছিল তুরাগকে। শুধু মে’রেই ক্ষান্ত হননি দ’ড়ি দিয়ে দু’ঘন্টা কড়া রোধের মাঝে বেধে রেখেছিলেন। নুরনাহার ছাড়াতে গেলে তাকেও কঠোর স্বরে বারণ করে দেন।

নুরনাহার ও আর পা বাড়ায় না। সেদিন এর পর থেকেই মামা শব্দটা জম এর মতো মনে হয় তুরাগ এর। যদিও তুরাগ বড় হওয়ার পরে যথেষ্ট ফ্রি হওয়ার চেষ্টা করেছেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু ছোট বেলা থেকে মনের মধ্যে পুষে রাখা ভয়টা তুরাগ এর রয়েই গেছে। আজকেও মামার দেখানো যুক্তির বিরুদ্ধে আর কথা বলতে পারল না। ড্যাব ড্যাব করে অসহায় নজরে তাকিয়ে রইল।

ছেলের এরকম অবস্থা দেখে মনে মনে পুলকিত হলেন তায়েফ সাইয়িদ। এই ঘারত্যাড়া ছেলেকে তিনি জব্দ করতে পারবেন না একা একা। এজন্যই নুরুল ইসলাম থাকতে থাকতে কথা তুললেন।
সবার কথার মাঝে বাধ সাধলেন তহমিনা। তিনি তার স্বামীর উদ্দেশ্য বললেন
– জি শুরু করলে তোমরা। কয়টা দিন আগে এত বড় দূর্ঘটনার পরে এখন বিয়ে শাদীর বিষয়টা বড্ড বেমানান নয় কি।
নুরুল ইসলাম কে জবাব দিতে না দিয়ে তায়েফ সাইয়িদ ই বললেন

– দেখো তহমিনা এই পৃথিবীতে কেউ চিরদিনের জন্য থাকতে আসে না। নুরিও চলে গেছে। সবার হৃদয় অবশ্যই ভারাক্রান্ত কিন্তু এই মুহুর্তে এই কথা বলার কারণ শালাবাবুর ছুটি শেষ হবে। আর কবে আসতে পারবে কে জানে। আমার ছেলেটাকে তো এভাবে ফেলে রাখতে পারি না। আমি চাই যা কথা হবার সবার সামনে হোক। বিয়েটা তো আর এখনি করতে বলছি না। আর যদি হয়ও বাহিরের কোন লোক থাকবে না৷ আমরা পরিবারের লোকরা মিলে আকদ টা করে রাখব।

বাবার এমন কথা বার্তা শুনে অবাক হয় তুরাগ। ও একবারও বলেছে যে ও অন্য কাউকে বিয়ে করবে। ওর বাবা আকদ অবধি চিন্তা ভাবনা করে রাখছেন।

এতক্ষণ চুপচাপ সবার কাজকর্ম দেখছিলেন বৃদ্ধ তারামন বিবি। এবার তিনি গলা খাকড়ি দিয়ে নিজের গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তার গলা খাকড়ির শব্দে সবার নজর গিয়ে পড়ল তার উপর। তিনি তখনো পান চিবিয়ে যাচ্ছেন। সবাইকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
– সবাই আমার দিকে কি চাও।
তরু বলল

– ওফফ দাদি তুমি যখন কিছু বলবেই না তাহলে সবার মনযোগ আকর্ষণ এর বৃথা চেষ্টা করলা কেন।
– বলবনা কে বলেছে…বলব বলব।
– এত আস্তে না বলে একটু জলদি বলো তো দাদি।
– আরে এত লাফাস কেন ছে’ড়ি। তোর বিয়ের কথা বলব বলেই তো ঝেড়ে কাশলাম।
বৃদ্বার কথা শুনে ওখানে থাকা ছোট বড় সবাই মূলত হোচট খায়। কথা হচ্ছে তুরাগকে নিয়ে এখানে তরু কোথা থেকে আসল। নুরুল ইসলাম জিজ্ঞেস করল

– মা তুমি কি বলছো এসব?
– আমি ঠিকই বলছি। আমার তুরাগ নানুভাইয়ের সাথে অন্য কোন মেয়ের বিয়ে হইবো না। আমি চাই তুরাগ তরুকেই বিয়ে করুক।
কথাটুকু কর্নকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই আঁতকে ওঠেন তহমিনা। কি বলছেন এসব তার শাশুড়ী। এরকম একটা দায়িত্ব জ্ঞানহীন ছেলের সাথে তরুর বিয়ে কীভাবে দিতে চান তিনি।

এদিকে তুরাগ ও চোখ বড়বড় করে নানুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে তুরাগ এর নিজেকে সব থেকে বেশি অসহায় লাগছে। তার চাওয়া পাওয়াটার গুরুত্ব কেউ দিচ্ছে না। বরং কলের পুতুল এর মতো সবাই ওকে নাচাচ্ছে।
তুরাগ এর ভাবনার মধ্যেই মুখ খোলেন তহমিনা

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৫

– আম্মা আপনি যা বলছেন তা কখনো সম্ভব নয়। এই বিয়ে হতে পারে না। এরকম ছেলের সাথে তো নয়ই।
তহমিনার কথায় সবাই তাকায় তার দিকে। এরকম ছেলে বলতে কি বুঝিয়েছে তহমিনা।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৭