ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৫

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৫
নীহারিকা নুর

ওই তুরাগ এর বাচ্চা আজকেও বাসায় আসে নাই আম্মু?
তরুর মুখে এরকম কথা শুনে চোখ মুখ কুচকে মেয়ের দিকে তাকালেন তহমিনা। দেখলেন তার মেয়ে ভীষণ রেগে আছে। তরুর রেগে যাওয়ার কারণ খুজে পেল না তহমিনা। তবুও ধমকের সুরে বললেন

– এসব কি কথা তরু। তুরাগ তোমার কত বড় সে খেয়াল কি হারিয়েছো। বড়দের এভাবে বলতে হয় না জানো না তুমি।
– রাগ হচ্ছে আম্মু আমার। আচ্ছা তুরাগ ভাই কি পাগল হয়ে গেছে। সে মিথিলা আপুকে ভালোবাসে সেটা কি ঠিক আছে। কিন্তু বাসায় যে তার একটা ছোট বোন আছে সে খেয়াল কি নেই। তার কি উচিত ছিল না এই মুহুর্তে বাবা বোনের পাশে থাকার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উপর থেকে নিচে নামতে নামতে সব কথাই তায়েফ সাইয়িদ এর কর্নকুহরে প্রবেশ করল। মুখ গম্ভীর করে দাড়িয়ে আছেন তিনি। তখনি তহমিনার নজর পড়ল তার উপরে। তরুর কথা গুলো যে মোটেও ভুল নয়। তুরাগ এর এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়িটা তারও পছন্দ নয়। কিন্তু তায়েফ সাহেব তরুর মুখে এগুলো শুনুক সেটা চাইলো না তহমিনা। তরুর মুখ তখন উল্টোদিকে ঘোরানো। ও এখনো তায়েফ সাহেবকে দেখেন নি। তহমিনা আড়ালে মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। ইশারায় বোঝালেন থামার জন্য। তরু আরো উল্টো রিয়াকশন করে। বলে ওঠে

– তুমি আমাকে থামতে বলছো কেন। আমি ভুল কি বলেছি বলো। তুরফা আপুকে দেখেছো তুমি। মেয়েটা দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। ফুপাও তো কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আর তোমার ভাগিনা এখনো গার্লফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড করে। সেখানে তো নার্সরা আছেই। মাঝে মাঝে কি বাসায় আসা যায় না। আর তোমরাই বা এখন কতজনকে নিয়ে টেনশন করবা বলো তো।
তহমিনা যে এই মুহুর্তে বিবর্তকর পরিস্থিতিতে পড়েছে তা খেয়াল করল তায়েফ সাইয়িদ। তিনি তহমিনার উদ্দেশ্য বললেন

– আরে তহমিনা তুমি মেয়েটার সাথে এমন করতেছো কেন। ও তো ভুল কিছু বলে নি। যে ছেলে মা বেচে থাকতেই তার গুরুত্ব বোঝেনি এখন আর কি বুঝবে। এই মেয়েকে তো ওর মার শুরু থেকেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু ওর জেদের কাছে হেরে গিয়ে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হলো। ওকে নিষেধ করেছি পলিটিক্স এ জড়াতে। শুনল না আমার কথা। আমার বিরুদ্ধে গিয়ে রাজনীতিতে জড়ালো। কি হলো শেষ পর্যন্ত। আমাদের সংসারটা এলোমেলো হয়ে হয়ে গেল।

– থাক না ভাইজান। বাদ দেন ওর কথা। সময় গেলে ধীরে ধীরে বুঝবে সব।
– নাহ তহমিনা তুমি বুঝতেছো না। এখন আমার সংসারটা কে দেখবে বলো। নুরিতো আমাকে একা ফেলে চলে গেলো। তুরফাকেও তো যেতে হবে। আর ওই মেয়ে কবে সুস্থ হবে তার কোন গ্যারান্টি তো ডক্টরও দিতে পারছে না। যে মেয়ের জন্য আমাদের ফ্যামিলিটা ধ্বংস হলো সেই মেয়েকে তো আমি জীবনেও আমার বাড়ির পুত্রবধু করে আনব না।

– কেন আনবে না বাবা। মেয়েটার জীবনটা কি তোমার ছেলের জন্য নষ্ট হয় নাই। ওদের তো পুরো ফ্যামিলি শেষ হয়ে গেল।
সবাই পেছনে ঘুরে দেখলো সেখানে তুরফা দাড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মুহুর্তে তুরফার কথা গুলো শুনেও মেজাজ খারাপ হলো তায়েফ সাইয়িদ এর। তিনি রেগে গেলেন মেয়ের উপর। বললেন

– তুরফা আমার উপর কথা বলো না। ওই মেয়ে যদি সুস্থ ও হয় তবুও ওকে আমি ওই বাসার বউ করব না৷ ও একটা কুফা মেয়ে। ও তুরাগ এর জীবনে আসার পরেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
– তাহলে তো তোমার ছেলেও সেটাই বাবা৷ তোমার ছেলে মিথির জীবনে আসার পরেই ওর জীবন, ওদের ফ্যামিলি এলোমেলো হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে ওদের। এখন ওর দায়িত্ব ভাইয়াই নিবে।

– তোমরা দু ভাই বোন যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলছো তবে আমাকে আর কি দরকার। আমার মনে হচ্ছে আমাকে তোমাদের লাইফে এখন আর কোন দরকার নেই। বড় হয়ে গেছো তোমরা। তুমি আর তোমার ভাই যা মন চায় করো। আমাকে আর জানাতে আসবে না৷ তোমরা যদি ঠিক করেই থাকো ওই মেয়েকে বউ করবে তাহলে সেদিন আমি নুরির কাছে চলে যাবো। তোমরা আমার লা’শের উপর দিয়ে উল্লাস করে বউ এনো।

নাস্তার প্লেট ঠেলে দিয়ে দুম করে উঠে দাড়ালেন তায়েফ সাহেব। হনহন করে বেড়িয়ে গেলেন বাড়ির বাহিরে।
বাবার এরকম কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসল তুরফার। যেই বাবা কোনদিন বকা তো দূর টুশব্দও করে নি। সেই বাবা আজ এতগুলো কথা শোনালো। আবার হুমকি ও দিয়ে গেল।

যে বাবা কোনদিন বকা না দেয় সে যদি হুট করে একটু ধমক ও দেয় তখন কিন্তু ভীষণ কষ্ট লাগে। আর তুরফার বাবা তো আজ অনেক কথা শোনালো। তুরফা সেখানে মেঝেতেই বসে পড়ে। এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে সবটা অবলোকন করছিলেন তহমিনা আর তরু। এখন মেঝেতে বসে তুরফাকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে দেখে দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন

– কাদিস না মা শান্ত হ। তোর বাবা মন থেকে এসব বলেনি।
– কিন্তু এমন কেন বলল মামি
– আপা চলে যাওয়ায় তোরা কষ্ট পাচ্ছিস। ওই মানুষটা কি পাচ্ছে না বল। আটাশ বছরের পথ চলা একসাথে। আটাশ বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে এখন তার মাথা কি ঠিক আছে বল। তোর মামার কাছে শুনেছি শুরুর দিকে তোর বাবা নাকি তোর মা বলতে পা’গল ছিল। সেই মানুষকে হারিয়ে এখন তোর বাবাও দিকবিদিকশুন্য তাই না।

– কিন্তু ভাই কি করছে মামি। মিথিলাই বা কি দোষ করেছে। এখানে ও তো সবথেকে বেশি সাফার করতেছে।
– তুই এখন বসে দোষ খুজছিস পাগলি মেয়ে। শোন এটা কারো দোষ নয়। এটা হচ্ছে নিয়তি। এরকম একটা দূর্ঘটনা নিয়তিতে ছিল বলেই হয়েছে। তবে তোর বাবা এখন মনে করছে যদি মিথিলাকে নিয়ে হাসপাতালে না যেত তাহলে এমন দূর্ঘটনা হতো না। এই মুহুর্তে তার কাছে সব থেকে দোষী মিথিলাকে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি মিথিলার দোষ দিচ্ছি না৷ ওই যে বললাম নিয়তি। তবে এই মুহুর্তে তুরাগ এর উচিত ছিল না তোদের পাশে থাকা।

– এখন আমি কি করব মামি। আমার মাথা কাজ করতেছে না।
তাদের দুইজনের কথার মধ্যেই কোথা থেকে যেন তরু এসে ধপ করে সোফার মধ্যে বসে পড়ল। তুরফা তহমিনা দুজনের দৃষ্টিই তখন তরুতে নিবদ্ধ। তরু করুন চোখে তহমিনার দিকে তাকিয়ে আছে।
– আম্মু
মেয়ের এমন করুন কন্ঠ শুনে হকচকাল তহমিনা। এই মেয়ের কিছুক্ষন পর পর কি হয় কে জানে। ব্যাস্ত কন্ঠে সুধাল

– কি হয়েছে?
– আমি কি ভুল করে ফেলেছি আম্মু।
– তুই আবার কি ভুল করলি।
– সকালে যে জোরে জোরে কথা গুলো বলে ফেললাম। না হলে তো ফুপাও শুনত না আর এত কথাও হতো না।
তহমিনাকে উত্তর দিতে না দিয়ে তুরফাই বলে উঠল

– তুমি ভুল করোনি তরু। এটা কারো না কারো বলার দরকার ছিল। দেখোনা ফ্যামিলি টার কি বিশৃঙ্খল অবস্থা। এটা তো ঠিক করা জরুরি। এখন ভাই আর বাবার মধ্যে আবার মনোমালিন্য হবে। আমার মনে হয় ভাইয়ের একবার বাসায় আসা উচিত। নয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে।

– কিন্তু তুরফা আপু তোমার ঘাড়ত্যাড়া ভাই কি আসবে।
– আমি যাবো আজ হসপিটালে। মিথিলাকে আর আন্টিকেও দেখে আসব। আর ভাইয়াকে সাথে করে নিয়ে আসব।
– তাহলে আমিও যাই তোমার সাথে।
– যাবে তুমি?
– হুম।
– আচ্ছা। তাহলে একটু পরেই বের হবো আমরা। মামি তুমি যাবে আমাদের সাথে?
– আমি তো রাতেও গিয়ে আসলাম। শুনল না তো আমার কথা। দেখ তোরা গিয়ে। যদি আসে।

ভাইয়া তুমি সি’গা’রেট খাচ্ছো?
গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে আকাশপানে তাকিয়ে সি’গারেট এর ধোঁয়া ওড়াচ্ছিল তুরাগ। ছোট বোন এর কন্ঠ শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে হাত থেকে ফেলে দিল আধ খাওয়া সিগারেটা। মুখ থেকে ধোঁয়া সরানোর ব্যার্থ চেষ্টা চালালো কিয়তক্ষন। এটা দেখে মুচকি হাসলো তুরফা। তার ভাই যে আড়ালে সিগারেট খায় এটা অজানা নয় ওর। তবে ওর সামনে কখনোই না। এই যে এখনও ওকে দেখে লুকাতে ব্যাস্ত।
নিরবতা কাটিয়ে তুরাগ ই বলল

– তুই এখানে কেন এসেছিস।
– আমার বুঝি আমার ভাইকে দেখতে মন চায় না। আমার ভাইয়ের আমাদের দেখতে মন নাই চাইতে পারে। কিন্তু আমাদের তো তাকে দেখতে মন চায়।
বোনের কন্ঠে তীব্র অভিমান লক্ষ্য করল তুরাগ। এতক্ষণে বোধহয় হুশ হলো তুরাগ এর। আসলেই ওর মাথা থেকে বোনের কথা বেড়িয়ে গিয়েছিল। এই মুহুর্তে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিল তুরাগ৷

– আচ্ছা ভাইয়া আমরা যদি বলি মিথিলাকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না তাহলে কি মায়ের মতো আমাদের ও দূরে সরিয়ে দেবে তুমি?
তুরফার কথায় আতকে ওঠে তুরাগ। তুরফার এরকম কথার মানে খুজে পায় না। তুরফা তো সব সময় চাইতো মিথিলা তুরাগ এর বউ হয়ে আসুক। তাহলে এই মুহুর্তে এমন কথা বলছে কেন। কাপা কাপা কন্ঠে জানতে চাইলো

– এসব কি কথা বলছিস পিচ্চি।
– আমি মোটেও পিচ্চি না। আমি যেটা বললাম তার উত্তর দাও।
– আমি মিথিলাকে ভালোবাসি।
– আচ্ছা। তাহলে তুমি তোমার মিথিলাকে নিয়েই থাকো৷ আমি বা আমার বাবা কাউকে তুমি দেখতে আসবে না।
– পাগলামি কেন করছিস বোন আমার। ওকে তো তুইও পছন্দ করিস।
– হুম করি। সব সময়ই করব। কিন্তু সেটা তোমার বউ হিসেবে নয়।
তরু তুরফার কানে কানে বলল

– এভাবে কেন বলছো তুরফা আপু। এভাবে বললে তুরাগ ভাই কখনোই বাসায় যাবে না। ফুপার সাথে কথা বলা উচিত এখন তার।
তুরফা তরুর কথা গুলো শুনে আরো জোরে জোরে বলল – ভাইয়া যদি আজ বাসায় না যায় তাহলে সমস্যা নেই। আমিই নাহয় ভুলে যাবো আমার একটা ভাই আছে। যে ভাই খারাপ সময় আমার পাশে থাকে না সেই ভাইয়ের জন্য আমি তো আর আমার বাবাকে হারাতে পারব না। মায়ের পরে এই বাবাই আছে আমার সব থেকে আপন।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৪

তুরফার প্রত্যেকটা কথা মনে হচ্ছে কানে এসে বাড়ি খাচ্ছে। আতকে ওঠে তুরাগ। তুরফা তো এরকম কথা বলার মেয়ে নয়। কি হলো হঠাৎ ওর।

ভালোবাসার বর্ষণ পর্ব ২৬