স্রোতস্বিনী পর্ব ১৭

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৭
মুগ্ধতা রাহমান মেধা

সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।সময় অনেক দ্রুত চলে যায়।সবকিছু পরিবর্তন করে দিয়ে যায়।মেহরাদ-স্রোতের বিয়ে হয়েছে একমাস শেষ।সময়ের সাথে সাথে মেহরাদ-স্রোতের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।তার পেছনে মেহরাদের সম্পূর্ণ ক্রেডিট থাকলেও স্রোতের খুব কম নেই।সে তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়েছে।স্রোতের দিনগুলো আগের মতো ব্যস্ততায় কাটলেও মন আগের মতো গম্ভীর নেই।

মন এখন প্রেমে পড়েছে, এক মেজরের প্রতি কঠিন প্রেমে পড়েছে।স্রোত আবার পুরোদমে লেখাপড়ায় মনোযোগ দিয়েছে।বনলতা বেগম তাকে রান্নাঘরের আশেপাশেও যেতে দেয় না।ধমকে রুমে পাঠিয়ে দেয় পড়ার জন্য।তার একটাই কথা,বিয়ের প্রভাব যেনো পরীক্ষার উপর না পড়ে।স্রোত মাঝে মাঝে ওনাকে দেখে অবাক হয়।এতো ভালো শাশুড়ী পৃথিবীতে আছে,সেটা বনলতা বেগমকে না দেখলে জানতেই পারতো না।এখন তো বেশিরভাগ দিন উনিই স্রোতকে খাবার খাইয়ে দেন।স্রোতের মাও এমন করতেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

যখন পরীক্ষা এগিয়ে আসতো,পরীক্ষা চলতো,তখন তিনি স্রোতকে খাইয়ে দিতেন।উনারও একটাই কথা ছিলো, তুমি শুধু পড়তে থাকো,আর কিছু চাই না তোমার থেকে।স্রোতের মনের ভয় এখন নেই বললেই চলে।ভয় উঁকি দিলেও সে পাত্তা দেয় না।প্রতি রাতে মেহরাদের সাথে কথা হয়।মেহরাদ নতুন নিয়ম করেছে।সে ভিডিও কলে কথা বলবে প্রতিদিন।তার বউ পড়বে,আর সে দেখবে।সে চায় না তার বউয়ের সময় নষ্ট হোক।এসব ভাবতে ভাবতেই স্রোতের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গত একমাসে ঘটে যাওয়া সবকিছু ভাবছিলো স্রোত।তার ধ্যান ভাঙ্গে ফোনের আওয়াজে।সে জানে তার মেজর সাহেব কল দিয়েছে।প্রতিদিন এমন সময়ই কল দেয়।স্রোতের সাথে কথা বলে চুপ হয়ে যায়,স্রোত টেবিলে বসে বসে পড়ে আর সামনে ফোনে ভিডিও কলে থাকে।অনেকসময় এভাবে দেখতে দেখতেই মেহরাদ ঘুমিয়ে যায়,আবার অনেকসময় স্রোতের সাথে সারারাত জেগে ভোরে ঘুমাতে যায়।স্রোত অনেক নিষেধ করলেও সে শোনে না।

প্রথম কয়েকদিন স্রোতের একটু অস্বস্তি হলেও এখন হয় না।এখন সে পাক্কা মেহরাদের বউ।বেশ কয়েকবার রিং বাজার পরেও স্রোত কল রিসিভ করে না।স্রোতের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চেপেছে।সে জানে এখন কল রিসিভ না করলে মেহরাদ একটু রাগ দেখাবে,কিন্তু স্রোত জানে বেশিক্ষণ রাগ দেখাতে পারবে না।আরো দু’বার রিং হওয়ার পর তিনবারের মাথায় স্রোত কল রিসিভ করে,সামনে রেখে দেয় ফোন।মেহরাদ মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,

“কয়টা কল দিয়েছি তোমায়?”
“বেশি না, মাত্র নয়টা।” মেহরাদের রাগকে পাত্তা না দিয়ে ভাব নিয়ে বলে স্রোত।
“গুনেছো অথচ রিসিভ করো নি।” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে মেহরাদ।
“আমার ফোন,আমার বর ফোন দিয়েছে, আমার ইচ্ছা কখন রিসিভ করবো নাকি করবো না।”
“দিস্ ইজ নট ফেয়ার স্রোত।জানো তো আমার টেনশন হয়।” হাল ছেড়ে দিয়ে বলে মেহরাদ।সে জানে এই মেয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। সে পাত্তাই দিবে না তাকে।

“এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার।”ভাব নিয়ে বলে স্রোত।
” ওওওওওওও,দ্যাট মিনস্,ইউ এডমিট দ্যাট ইউ আর ইন লাভ উইদ মি।”বাঁকা হেঁসে বলে মেহরাদ।
স্রোত নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে যায়,এদিক ওদিক তাকানো শুরু করে।আমতা আমতা করে বলে,
“কথার কথা বলেছি।”
“আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি।”

“যা খুশি করুন গিয়ে।”মেকি রাগ দেখিয়ে বলে স্রোত
“সেটাই তো পারছি না বউ।”ঠোঁট উল্টিয়ে বলে মেহরাদ।
যতবার মেহরাদ ” বউ” সম্বোধন করে ততবার স্রোতের বুকটা ধ্বক করে উঠে।মনে হয় এই শব্দটায় মা দ ক মেশানো থাকে।মেহরাদের কথা বুঝতে না পেরে স্রোত প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালে মেহরাদ আবার ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“এই যে তোমাকে আদর করতে পারছি না।”

স্রোত যেনো লজ্জা পায়,চোখ ফিরিয়ে নেয়।
মেহরাদ এভাবে গাঢ় স্বরে ডেকে উঠে,
“স্রোতস্বিনী।”
এই একটা সম্বোধন-ই যথেষ্ট স্রোতকে উলটপালট করার জন্যে।সে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
“হুম?”

“আমার অনেক আদর আদর পাচ্ছে।”বাচ্চাদের মতো অনুনয় করে বলে।
“আর?” বইয়ে মুখ রেখে বলে স্রোত।
“অনেক প্রেম প্রেমও পাচ্ছে।”
“আর?”
“তোমাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে।”

“আর?”
“এইইইই,তুমি মজা নিচ্ছো?”
স্রোত ঠোঁট টিপে হেঁসে বলে,
“একদম।!
” এই তাকাও আমার দিকে।তোমার বইগুলা আমার সাথে সতীনের মতো আচরণ করে।”নাক টেনে বলে মেহরাদ।
“তাকালাম।” চোখ ফোনের স্ক্রিনে তুলে বলে স্রোত।
“তুমি আমার ইমোশন নিয়ে মজা নিতে পারলে? ”
“পারলাম।”

“নাও নাও বেশি করে মজা নাও।তুমি তো আমার কষ্টটা বুঝলে না।” নাক টেনে টেনে ভণিতা করে করুণ স্বরে বলে মেহরাদ।
“কি কষ্ট শুনি?শুনে যুক্তিযুক্ত মনে হলে আমিও নাহয় আপনার সাথে একটু কষ্টবিলাস করবো।” মুচকি হাসলো স্রোত।
“তুমি আবার মজা নিচ্ছো।যাও আর কথাই বলবো না।”
“ওকে,রেখে দিচ্ছি ফোন।” ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে স্রোত।
“এই না না। সারাদিনে একটু বউটাকে দেখতে পেয়েছি।তুমি সতীনের মতো আচরণ শুরু করছো কেনো?” ভ্রু কুঁচকে বলে মেহরাদ।

“আমি আপনার সাথে সতীনের মতো আচরণ করছি?” সেন্টি খেয়ে বলে স্রোত।
“হ্যা করছো তো,তুমি আমার কষ্টগুলো শুনতেই চাচ্ছো না।উল্টো মজা নিচ্ছো।”
“আচ্ছা বলুন তবে আপনার কষ্টগুলো।”সোজা হয়ে বসে গালে হাত দিয়ে বলে স্রোত।
” এই যে বিয়ের পরদিনই বউকে ছেড়ে চলে আসলাম।এর থেকে কষ্টের কিছু আছে বলো?এটা কি মানা যায়?” আবার ঠোঁট উল্টায় মেহরাদ।

“একদম না,কোনো ভাবেই মানা যায় না।কঠোর প্রতিবাদ করা দরকার।” মজা নিয়ে বলে স্রোত।
“আবার মজা নিচ্ছো।তোমার তো আমার মতো সুন্দর বউ নেই তাই আমার কষ্ট তুমি বুঝলে না।এবার যদি জানতাম যে বিয়ে করবো,তাহলে এতোবছরে যত ছুটি আমি নেইনি,সবগুলোর আগে লিস্ট করতাম, তারপর ঐসবগুলো দিনের ছুটির এপ্লিকেশন করতাম।”

মেহরাদের কথা শুনে স্রোত নিজের হাসি আটকে রাখতে পারে না,শব্দ করে হেঁসে ফেলে সে।মেহরাদও হাসছে।স্রোত যখন হাসে তখন সে অপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকে।তার এতো বাচ্চামো তো স্রোতের জন্যই,স্রোতের মুখে সবসময় হাসি রাখতেই।আর সে তার চেষ্টায় সফল।
স্রোত হাসি থামাতেই দেখলো মেহরাদ বালিশের উপর এক হাত রেখে তার উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। স্রোত জিজ্ঞেস করলো,

“কি দেখছেন এভাবে?”
“তোমাকে।”
“প্রতিদিনই দেখেন।নতুন করে দেখার কি আছে?”
“তবুও মন ভরে না।প্রতিদিন নিয়ম করে নতুনভাবে তোমার প্রেমে পড়ি স্রোত।”
স্রোত বিপরীতে স্মিত হাসলো তবে কিছু বললো না।মেহরাদ আবার বললো,

“জানো স্রোত জীবনে কখনো প্রেম করি নি।কখনো ঐ সুযোগটাই পাইনি।যখন বিয়ের সময় হলো,তখন ইচ্ছে করতো না।কোনো মেয়ের দিকেই চোখ পড়তো না।আমার মনে হতো,যে আমার অর্ধাঙ্গিনী হবে,সে যখন আমার সামনে আসবে,তখন আমি বুঝতে পারবো।সে সামনে থাকলে আমার অন্যরকম অনুভূতি হবে,অপরিচিত অনুভূতি।আর হলোও তাই!অল্প কয়েকদিনে তোমাকে নিজের কাছে পেয়ে গেলাম।”

“আমায় কেনো ভালোবাসলেন?”
“মন বলেছিলো বলে।”
“কি বলেছিলো আপনার মন?”
“মনের নাকি তোমাকে চাই,তুমি নাকি তার খুবইই প্রয়োজনীয় কেউ।”
কথাটা শুনে স্রোত চমৎকার হাসলো।মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো,মেহরাদকে একটু রাগিয়ে দেওয়া যাক,
“জানেন মেজর সাহেব আমি না একজনকে হ্যালোসিনেট করছি।”মলিন স্বরে বললো স্রোত।
“কাকে?” হতভম্ব হয়ে শোয়া থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করে মেহরাদ।
“একটা ছেলেকে।ছেলেটা আমায় প্রপোজ করেছিলো।এখন শয়নে স্বপনে চারিদিকে শুধু তাকেই দেখি,কথা বলি তার সাথে। ” করুণ কন্ঠে বলে স্রোত।

মেহরাদের রাগ লাগছে,চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে।ইচ্ছে করছে হাতের ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিতে। রাগ নিবারণ করার চেষ্টা করছে সে।শান্ত গলায় বলে,
“তুমি কি ভুলে গেছো তুমি ম্যারিড?”
“আমি তো ভুলি নি,কিন্তু সে প্রচন্ড জ্বালাচ্ছে।আই ফিল হিম এভরি হোয়ার।মেই বি আই অ্যাম ইন লাভ উইদ হিম।প্রপোজাল এস্সেপ্ট করবো ভাবছি।”

“ইউ ফিল হিম?রিয়েলি?আর ইউ আউট অব ইউর মাইন্ড?” দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে মেহরাদ।
“আমি সজ্ঞানেই বলছি আই ফিল হিম।”
“তোমায় আমি খু ন করবো বেয়াদব,সাথে ঐ ছেলেকেও।সব কিছু সহ্য করে নেই বলে বেশি বাড় বেড়েছো ।”
চোয়াল শক্ত করে বলে ফোন কেটে দেয় মেহরাদ।

কত্তবড় সাহস ওর বউকে প্রপোজ করে,তার কল্পনায় আসে।আবার তার বউ কিনা হ্যালোসিনেট করে,ফিল করে,কথা বলে, প্রপোজ এস্সেপ্ট করার কথা বলে।সাহস কতো!রাগে বিছানার পাশে অবস্থিত ট্রি টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসটা ছুড়ে মারে।গ্লাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।এরমধ্যে ফোন বেজে উঠলে দেখে স্রোত কল করেছে,কিন্তু সে রিসিভ করে নি।অনবরত কল আসায় সে ফোন অফ করে দেয় সে।তার মাথায় চলছে অন্যকিছু!

অন্যদিকে,স্রোত ভেবেছিলো একটু মজা নিবে।কিন্তু মহাশয় তো রেগে বো’ম।সে ফিল করে,হ্যালুসিনেট করে কিন্তু সেটা তো মেহরাদকেই করে,তাও বিয়ের কয়েকদিন পর থেকেই।তার অবচেতন মস্তিষ্ক মেহরাদকে নিজের আশেপাশে কল্পনা করে নেয়,যেটা কঠিন প্রেমে পড়ার লক্ষণ।সে বার বার কল করেই যাচ্ছে, অথচ অপরপাশ থেকে সুন্দর কন্ঠের অধিকারী এক রমণী বলে চলেছে,

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৬

“আপনি যেই নম্বরে কল করেছেন সেটি এখন বন্ধ আছে।অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পরে আবার চেষ্টা করুন।”
স্রোত ভাবনায় পড়ে যায়।কে জানতো অন্য কারো কথা শুনে এতো রেগে যাবে!কি হবে এখন!!

স্রোতস্বিনী পর্ব ১৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here