হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১০

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১০
সাইয়ারা মম

আমি তখন ক্লাস টুতে পড়তাম।বয়স আর কতই বা হবে ৬/৭।একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে শুনি ছোট মাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।আমাকে ছোট মা অনেক ভালোবাসত। আমিও ছোট মায়ের নেওটা ছিলাম।তখন তৃষ্ণার্ত কাকের মত বসে ছিলাম কখন ছোট মা আসবে।কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না।ছোট কাকা একটা তোয়ালে পেচিয়ে একটা শিশুকে আনেন। আমি যখন ধরতে গিয়েছিলাম তিনি আমাকে ধরতে দেননি।তার কিছুক্ষণ পরে দাদু আরেকটা শিশুকে নিয়ে আসেন।কেউ সেই শিশুটাকে নিতে চাচ্ছিল না।তখন আমি এগিয়ে গিয়ে শিশুটিকে কোলে নিলাম।বিশ্বাস কর সেই মুহূর্তটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল। ওর ছোট ছোট হাত পা আমায় মুগ্ধ করেছিল। ওর কাছে আমার হাতটা নিতেই ও সেটা খপ করে ধরে ফেলে।আমি তখন আনন্দে কান্না করে দিয়েছিলাম।দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন

-মাহিন বাবুটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
-হ্যাঁ দাদু।
-তোমার ছোটমা তো অনেক দূরে চলে গেছেন।কিন্তু বলেগেছেন যে এইশিশুকে আগলে রাখতে।পারবে তো রাখতে?
-হুম।
তখন থেকে আমি ওকে দেখে রাখতাম।যদিও আর কেউ ওকে তত ভালো নজরে দেখতো না।তুলি প্রথম প্রথম ওকে দেখতে আসত।কিন্তু পরে মায়ের বকা খেয়ে আর আসত না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সাতদিন পরে যখন অন্য শিশুটির আকিকা করা হয় তখন তার নাম দেওয়া হয় পিহু বিনতে কবির।কিন্তু এই শিশুটির কোনো নাম কেউ দেয় নাই।যেহেতু পিহুর বোন ও,তাই আমি মিল করে রাখলাম মিহু বিনতে কবির।কিন্তু দাদু কোনো কারণে বিনতে কবির নামটা পছন্দ করেনি।তিনি নাম দিলেন তাসমীম মিহু।জানো তাসমীম অর্থ কী?

তাসমীম অর্থ দৃঢ়তা।দাদু চেয়েছিলেন মিহু ওর নামের মতোই দৃঢ় হোক।কিন্তু মিহু হয়েছে উল্টো।একদম নামের বিপরীত। ধরতে গেলে দাদুর পরে আমিই ওর অভিভাবক। আমি সব সময় স্কুল থেকে এসেই ওকে কোলে নিতাম। অনেক সুখী ছিলাম সেই দিনগুলোতে।কিন্তু আমার সেই সুখের দিন গুলো কর্পূরের মতো উড়ে চলে যায়।কারণ টু থেকে থ্রীতে উঠতে গিয়ে আমি দুই বিষয়ে ফেল করি।আমার রোল তিন থেকে গিয়ে পৌছায় ৭৮ এ।

যেহেতু আমি ভালো ছাত্র ছিলাম তাই টিচার রা আমাকে থ্রীতে উঠিয়ে দেয়।কিন্তু মিহুর সাথে মেলামেশা একদম বন্ধ করে দেয় মা।দাদুর সাথে প্রায় ঝগড়া করে যে হয় বাড়ি ভাগ করা হোক না হয় মিহুকে এতিম খানায় দেওয়া হোক।ছোট কাকাও মাকে সমর্থন করলেন।দাদু তখন এক কাপড়ে মিহুকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন।মিহু সেখানেই বড় হতে লাগল।সেখানে না মিহু অনেক আদরে আদরে বড় হতে লাগল।কিন্তু বিবাদ বাজলো তখন,দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তার চিকিৎসার জন্য আমাদের এখানে আনা হয়।তিনি মিহুকে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারবেন না।তাই মিহুকেও নিয়ে আসা হয়।তখন ওর বয়স ছিল সাত বছর।দাদুর জন্য কাকা বা আম্মু কেউ কিছু ওকে বলত না।তারপর দাদু একদম মুমূর্ষু হয়ে পড়েন।সবাই ধরেই নিয়েছিলো যে তিনি মারা যাবেন।তাই মিহুকে এতিমখানায় দিয়ে আসা হয়। ওকে ভালোবাসার শুরুটা তখনই হয়।
তিনমাস হলো দাদু অসুস্থ। আর ওর এতিম খানার বয়স ও তিন মাস। আমি তখন নাইনে পড়ি।ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে ওর কাছে যেতাম। ও দৌড়ে আমার কাছে আসত। এসে বলত

-মাহিন ভাই জানো এরা না আমাকে অনেক মারে।অনেক কাজ করায়।দেখো দেখো কালকে রাতে আমি কাজ না করে ঘুমিয়েছি তাই আমার হাতে গরম রড দিয়ে মেরেছে।
আমি তখন ওর ঐ ছোট হাতদুটো ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিতাম।যে হাত দিয়ে পিহু চকলেট খায় সেই হাত দিয়ে মিহু রডের মার খাচ্ছে।তখন মনের মধ্যে ওর জন্য কিছু করার কথা মাথায় আসে।তখন আমি ওর জন্য আলাদা কিছু ফিল করি।যেটা পিহু বা তুলির জন্য ফীল করতাম না।মিহুর জন্য ঐ তিনমাস ছিল জাহান্নামের মতো।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে দাদু সুস্থ হয়ে যায় তারপর মিহুকে বাসায় নিয়ে আসে।কয়েকদিন পরে শুনি ঐ এতিমখানা টা ছিল শিশুশ্রমের কারখানা।পুলিশ ওটাকে উঠিয়ে দিয়েছে।

তারপর থেকে আমি একটা জিনিস বুঝেছি যে মিহুর জন্য যা করতে হবে তা গোপনে।কারণ আমি যদি মিহুর কাছে যাই তাহলে মা আবার দাদুর সাথে ঝগড়া করবে আর দাদু মিহুকে নিয়ে চলে যাবেন।তাই অনেক কিছু দেখেও সহ্য করি।কিছুই বলতে পারি না।তবে আমি অনেক ভালোবাসি ওকে।
বিদিশা নিজের চোখের জল মুছল।তারপর মাহিনকে জিজ্ঞেস করল

-কিন্তু মাহিন ভাই সবাই আপুর সাথে এতো খারাপ আচরণ করে আর পিহু আপুর সাথে এত ভালো ব্যবহার করে কেন?তারাতো একই মায়ের মেয়ে।
-আমিও জানি না।বড়রা সব সময় এ ব্যাপারে আমাদের থেকে গোপন রেখেছে।তবে দাদু এ ব্যাপারে সব জানে।এসব তিনিই বলতে পারবেন

-তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করনি?
-জিজ্ঞেস করলেই কি আর বলে?থাক এব্যাপারটা বাদ দে।তুই কাউকে আমার কথা বলিস না প্লিজ।
-কিন্তু তুমি তো আপুকে ভালোবাসো।তাহলে তাকে জানাও না কেন আর কেনই বা তাকে অন্য কারো হতে দিচ্ছ?
-শোন আমি মিহুকে আমার করলে ওকে এই আজাব থেকে মুক্তি দিতে পারব না।আর সবথেকে বড় কথা মিহু আমাকে একজন বড় ভাই হিসেবে দেখে।আমি চাইনা আমার কারণে মিহুর আর কোনো বিপদ হোক। আরফানের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ও খুব ভালো একজন মানুষ।তাই ওর হাতে মিহুকে তুলে দিলে আমি নিজেকে খুব ভালো মনে করব

-ভাই তুমি একজন সত্যিকারের প্রেমিক।যে ভালোবাসার পূর্ণতা না দিয়েও ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষা করল।
এই সময়ে মিহু একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল।মাহিন বিদিশাকে বলল
– লাইট অফ করে বাইরে যা।আমি গেলাম

বিদিশার মিহুকে শুয়ে দিয়ে মনে পড়ল যে লাইট অফ করেনি।তখন রুমের কাছে এসে মাহিনের কথাগুলো শুনে ফেলে।আর মাহিন বাধ্য হয়ে ভালোবাসার কথা স্বীকার করে।বিদিশা মিহুর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দেয় আর বলে
-আপু তুই সত্যিই অনেক লাকি যে মাহিন ভাইয়ের মত একজন তোকে ভালোবাসে।আর আরফান ভাইও অনেক লাকি যে তোর মতো একজনকে পাবে।আমি শুধু আল্লাহর কাছে এটাই চাইব যেন বিয়ের পর তোর জীবনে আর কোনো দুঃখ না আসে।তুই সুখে থাকবি।

এখন রাত আটটা বাজে।পিয়াস এর ডেয়ারের সময় কাল রাত বারোটা পর্যন্ত।সব ভাইবোন মিলে ওকে ধরে বেধে নিয়ে এসেছে আরফানের রুমের সামনে।নেহাল ওকে ঠেলে রুমে পাঠাচ্ছে তখনই পিয়াস বলে
-ভাই ভাই জরুরী কাজ আছে।প্রকৃতি আমায় স্মরণ করেছে।
এরকম করে পাঁচ বার বাথরুম থেকে ঘুরে এসেছে।আরেকবার এইকথা বলতেই নেহাল বলল

-এবার কিন্তু তোকে ইন্জেকশান দিব।
-না না এমন করিস কেন? আমি যাচ্ছি তো
পিয়াসের যাচ্ছি বলতে দেরি কিন্তু নেহালের ধাক্কা দিতে দেরি নাই।ধাক্কা দিয়ে ওরা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে বসল। আরফান ওর কাজ নিয়েই ব্যস্ত।পিয়াস কে দেখে জিজ্ঞেস করল
-পিয়াস বলবি কিছু?

পিয়াস অনেকভাব সাব নিয়ে আরফানের কাছে গেল গিয়ে বলল-ভাই তুমি মিহু ভাবিকে একটা ফোন দিয়ে কথা বল।তোমার তো একবার কথা বলা উচিত বিয়ের আগে বলো।
তারপর এক থাপ্পড়ে পিয়াস বাস্তবে ফিরে এল।মানে এতক্ষণ কল্পনা করছিল যে ও আরফানকে এই কথা বললে কি হতে পারে।আরফান পিয়াসকে কিছু না বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল

-বলবি কিছু?
-হুম।
-বলে ফেল। আমার সময় নেই ততটা।কালকে তো কাজ করতে পারব না তাই এখন গুছিয়ে রাখছি।
-ভাই বলছিলাম কি,মানে বলছিলাম কি
-হ্যাঁ বল
পর্দার আড়াল থেকে ওরা ইশারা করে বলার জন্য। ওদের থেকে নজর সরিয়ে আরফানের দিকে ফেলে বলে

-বলছিম মানে ইয়ে
-তুই বলবি না থাপ্পড় খাবি?
থাপ্পড়ের কথা শুনে বড়বড় করে বলে দেয়
-তুমি বলেছিলে না ক্যামেরা দিবে সেটা দাও নাই তো
নেহাল কপালে হাত দিল। আরফান ল্যাপটপে কাজ করতে করতে বলল

-তোকে সেটা অফিস থেকে নিতে বলেছি না।সেখান থেকে নিস নি কেন? আর এখন লাগবে কেন?
-কালকে বিয়েতে ছবি তুলতে হবে তো।
-সকালের মধ্যে পেয়ে যাবি এখন যা।
নেহালের দিকে তাকাতেই ওর ধারালো চোখ দেখে মনে মনে বলে-হয় এখানে মরতে হবে না হয় বাইরে মরতে হবে।
পিয়াসকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরফান জিজ্ঞেস করল-আর কিছু বলবি?

– ইয়ে মানে ভাই তোমার ফোনটা দেবে?
-কেন?
-আমার ফোনে চার্জ,টাকা,ডাটা কিছুই নাই
আরফান আড়চোখে তাকিয়ে ফোনটা দিল।
-ভাই পাসওয়ার্ড বলো
-নীলু
-নীলুকে ডাকো কেন?
-আরে গা*ধা পাসওয়ার্ড নীলু
-ও ও ও

মিহুর নম্বরে দুইবার ফোন দেওয়ার পরে ধরল না।তৃতীয়বারে ফোন দিয়ে পিয়াস পেটে ব্যথার অভিনয় করল।বলল
-ভাই ফোন ধরলে কথা বলো।আমার না একটু বাথরুমে যাওয়া লাগবে।দুইমিনিট সময় দাও পাঁচ মিনিটে আসছি।
বলে এক দৌড়ে বাহিরে চলে গেল। আরফান অবাক হয়ে আছে।ওর এতই যদি চাপ এসে থাকে তাহলে আরফানের রুমের বাথরুমে না গিয়ে আর কোথায় গেল। আসলেই একটা গা*ধা।

ফোন রিসিভ করা দেখে কানের কাছে ধরল।মিহু ফোনের রিং শুনে ঘুম থেকে উঠলো।না দেখেই ফোন রিসিভ করেছে।যেহেতু কান্না করতে করতে ঘুমিয়েছে তাই কন্ঠস্বর একটু অন্যরকম হয়ে গেছে।ফোনটা ধরেই বলল
-আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ৮+৯

মিহুর কন্ঠস্বর শুনেই আরফান ফোনটা কেটে দিল। আর সারারাত কাজ করা হলো না।যখনই কাজ করতে যায় তখনই একটা লাইন কেবল মাথার মধ্যে ঘুরছে।এমন কি ঘুমাতে গেলেও বা ঘুমের মধ্যেও। আর সেটা হলো
‘ আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?’

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১১