হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১২

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১২
সাইয়ারা মম

নীলুকে আর মাহিনকে এক রুমে দেখে আশেপাশের লোকজন অনেক কিছু বলছে।অনেকে অনেক খারাপ মন্তব্য করতে আছে।অনেকেই বলতে লাগল যে ‘দেখো না কি যেন করতে গিয়েছে তারপর ধরা পড়বার ভয়ে নাটক করতে শুরু করেছে’
আরফান কথাগুলো শুনে নিজের হাতটা শক্ত করে মুঠ করে রাখল।রাগটা কন্ট্রোল করতে লাগল।তবে এসবকে পাত্তা দিল না।

নীলু ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে যেটা দেখে আরফান দৌড়ে গেল।মাহিন ওর হাত ধরে ওর পাশে বসে আছে।নীলুর হাতের কাচের চুরিগুলো ভেঙে হাতে ঢুকে গিয়েছে আর সেখান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে।যেটা মাহিনের ড্রেসেও লেগে গেছে।আরফান নীলুকে কোলে উঠালো,উঠিয়ে নিয়ে বাইরে আনলো।একটু আগেই ডক্টর জাভেদ হাসানকে ইনফর্ম করে রেখেছে।ও একেবারে নীলুকে নিয়ে গাড়িতে যেতে চেয়েছিল কিন্তু উপস্থিত লোকদের ফলে পারল না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-এতক্ষণ রং তামাশা করে এখন এখান থেকে চলে যেতে দিব না।একটা রুমের মধ্যে একটা ছেলে আর মেয়ে এতক্ষণ ছিল সেটা আর যাই হোক কোনো ভালো দিক হতে পারে না।
-হ্যাঁ হ্যাঁ কবির সাহেব আপনাদের বাড়ির ছেলের তো এমন হওয়ার কথা না।তারপরও যেহেতু করে ফেলেছে তাই এখন বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়া যায় না।এর একটা বিহিত করতেই হবে
-দেখুন আপনারা বিষয়টা যা ভাবছেন তা না।মাহিনকে তো আপনারা চেনেনই ও কীভাবে এরকম করতে পারে।আর এই মেয়েটাকেও দেখুন।

কবির সাহেবের কথার মাঝেই একজন বুড়ো লোক বলে উঠল-মাহিনকে তো ভালোই দেখেছি কিন্তু বলাতো যায় না। একই রক্তের কিনা ,তাই কথাগুলো বলছি
কবির সাহেব তার কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। এই কথাগুলোর উত্তর তিনি দিতে পারলেন না।মাহিন এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বলে উঠল
-আপনারা আসলে ব্যাপারটা খারাপ ভাবে দেখছেন। আসলে ব্যাপারটা এরকম না
-তা বাবা আমরা যদি ব্যপারটা খারাপভাবে বলে থাকি তাহলে তুমি ব্যাপারটা ভালোভাবে বিশ্লেষন কর আর সত্যি ব্যাপারটা বলে দাও

মাহিন তার কথার উত্তর দিতে পারল না।চুপ করে মাথা নিচু করে আছে।তা দেখে তিনি বললেন
-দেখলেন আপনারা,দেখলেন তো কিছুই বলতে পারছে না।তারমানে আমাদের আন্দাজই ঠিক হলো।তাহলে কি বলেন আপনারা সবাই?
-হ্যাঁ এদের দুজনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক।
কথাগুলো শুনে আরফানের চোখ লাল হয়ে আসছে।তবে আরফান নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে জানে।নীলুকে সোফায় বসিয়ে মাথাটা ওর কোলে নিয়ে বসে আছে। ওর অবস্থা দেখে পিয়াস নিজেই ভয় পেয়ে গেছে।নেহাল লোকটার কথা শুনে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল

-শুনুন ভদ্রভাবে কথা বলুন।সব কিছু না জেনে শুনে এভাবে ব্লেম করা উচিত না।
আরফান নেহালকে থামতে বলল।আর ওকে ডেকে বলল সবাইকে নিয়ে বাড়ি যা।যেটা শুনে নেহাল বলে উঠল
-না ভাই পিয়াস যাক। আমি থাকি তোমার সাথে
-না আজ তোর একটা বিশেষ দিন। আজকের দিনটা এভাবে নষ্ট হতে দিস না।পিহু কষ্ট পাবে
-ভাই পিহুর থেকে নীলু আগে
-তোকে যেতে বলেছি,যা(কড়া গলায় বলল )

নেহাল আরফানের রাগন্বিত রূপ দেখে চলে গেল।পিয়াস ও পিছু পিছু যেতে চেয়েছিল কিন্তু তা দেখে আরফান বলল
-তুই কোথায় যাস?
-ন্ ন্ না কোথাও না,ওদের এগিয়ে দিয়ে আসি।
নেহাল যাওয়ার আগেই ডক্টর জাভেদ এসে গেছেন।তিনি এসে আগে নীলুকে একটা ইন্জেকশান দিলেন।তারপরও হাতটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। একটু সময় পরে নীলুর হুশ ফির কিন্তু একদম জ্ঞান পায়নি।জাভেদ বললেন
-আরফান ওকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া বেটার হবে।কারণ এইসব কথাবার্তা শুনলে ওর মাথায় চাপ পড়তে পারে।নীলুর কাছে পিয়াসকে বসিয়ে ও উঠে দাড়ালো।মাথার পাগড়ী অনেক আগেই খুলে রেখেছিল।পাঞ্জাবীর পকেটে হাত রেখে মুচকি হেসে বলতে লাগল

-আপনারা কি যেন বলেছিলেন?যে এতক্ষণ আমার বোন রং তামাশা করেছে?আবার আবদার করছেন ওকে এখন মাহিনের সাথে বিয়ে দিতে হবে?
-আচ্ছা আপনারা কে এমন যে আপনাদের কথায় আমার বোনের বিয়ে দেওয়া হবে?
-আমরা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি।আর তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়।তাই আমরা তোমাদের চেয়ে ভালো বুঝি

আরফান লোকটার কথা শুনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।তার অবস্থানের পরিবর্তন করতে লাগল। এক জায়গা থেকে ছোট ছোট কদম ফেলে অন্য জায়গায় যেতে লাগল। আবার একই ব্যবস্থায় পূর্বের জায়গায় ফিরে আসল।তারপর বলল
-আসলে একটা কথা ঠিকই বলেছেন যে আপনারা আমাদের থেকে বড়।হুম কথাটা মেনে নেওয়া যায় ।কিন্তু কি বলুনতো আপনার শেষের কথাটা ঠিক না। আপনারা আমাদের থেকে ভালো বুঝেন না।কারণ যদি ভালো বুঝে থাকতেন তাহলে এটা বুঝতেন যে দরজা ভেতর থেকে না ,বাইরে থেকে আটকানো ছিল।

-এই ছেলে তোমার সাহস তো কম না।তুমি আমাকে অপমান করছো?আমিও দেখবো তুমি কেমন করে তোমার বোনের বিয়ে দাও।
-আপনাকে অপমান করছি না শুধু বুঝাচ্ছিলাম। আর রইল বিয়ের কথা।হাহ্,যেখানে কোনো ঘটনার ভীত্ত্বিই নেই সেখানে আপনাদের কথায় আমি আমার বোনকে বিয়ে দেবো?এটা সপ্নেও ভাববেন না।আর আমার বোনকে যদি বিয়ে দিতে নাও পারি না ,,,,,,,,,,,,,,,,তবেও আমার আফসোস নেই।কারণ আমি এখনো মারা যাই নি।

-ভাই নীলুর জ্ঞান ফিরেছে।এখন তাহলে চলো
পিয়াসের কথা শুনে আরফান নীলুর দিকে তাকালো।তারপর বলল- আমার বোনের এইরকম অবস্থা যে করেছে না তাকে যদি আমি খুঁজে পাই তাহলে তার অবস্থা কী হবে সেটা কেউ কল্পনা ও করতে পারবে না।
কথাগুলো বলে নীলুকে ধরে উঠালো।নীলু আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো।তারপর হেঁটে যেতে লাগল বাইরের দিকে।তুলি আরফানের ধমকি শুনে কেঁপে উঠেছে।তুলির খালাও ওর ধমকে ভয় পেয়েছে।আরফান যেতে যেতেই আবার ফিরে এলো।ফিরে এসে মাহিনকে বলল

-মাহিন একটা কাজ তুমি ঠিক করো নি।তুমি জানা শর্তেও সব কিছু লুকিয়ে গেলে।তবে এটা ভেবো না আমি আসল কালপ্রিটকে ধরতে পারব না।আরফান আদিত্য তার বোনের জন্য সব করতে পারে।কারণ তার বোন তার কাছে প্রাণ ভোমরা।
আরফান চলে যাওয়ার সাথে সাথেই লোকজন চলে গেল। এখন ঘরে শুধু নিকট আত্মীয়রা আছে।মাহিনের ফুফু ওকে জিজ্ঞেস করল
-মাহিন এখন বলতো তুই ঐখানে গেলি কীভাবে?
মাহিন কিছু বললো না।তুলির নিকটে এগিয়ে গেল।তুলি চোরা চোরা চোখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে।মাহিন শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল

-কেন করলি এটা?(তুলি কিছু বলছে না দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল)কেন করলি বল?
তুলির মা মাহিনকে বলল-কি করছিস কি? এভাবে কেউ বোনের সাথে কথা বলে?এমনিতেই অসুস্থ
-মা ওকে জিজ্ঞেস কর কেন এমনটা করেছে?
-আমি কি করেছি?আমিও তো সবার সাথে এখানেছিলাম।

তুলি কথাগুলো বলতেই ঠাস করে ওর গালে চড় পড়ে।মাহিনের এক চড়ে তুলির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে যায় ।চড়ের শব্দটা এতই ভয়াবহ ছিল যে প্রতিটা মানুষ কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।তারপর মাহিন তুলিকে বলল
-তুই যদি আমার বোন না হতি তাহলে এই চড়টা আমি সবার সামনে বসে মারতাম।তোর ভাগ্য ভালো তুই আমার বোন।তা না হলে আজকে তোর খবর ছিল।

বলে মাহিন চলে গেল।তুলি রাগে ফুলছে,ঘরের আত্মীয়রা ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর সমস্ত প্লান মাহিন জেনে গেছে।সব হয়েছে ঐ নীলু মেয়েটার জন্য। আজকে চেয়েছিল পিয়াস আর নীলুকে এক রুমে আটকে রেখে ওদের সম্পর্কে একটা নোংরা বিষয় ছড়াতে কিন্তু পিয়াসের বদলে যে মাহিন চলে যাবে তা ভাবেনি কখনো।সবার দিকে একবার কড়া নজর দিয়ে রুমে চলে গেল।

নীলুকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আরফান বিদিশাকে মিহুর কাছে বসিয়ে চলে গিয়েছে।পিহু ছিল অন্য গাড়িতে।ওরা ভেতরের বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানলো না।মিহুর যখন জ্ঞান ফিরে তখন ওদের গাড়ি চলতে শুরু করেছে।পাশে তাকিয়ে দেখে বিদিশা ওর কাধে মাথা রেখে আছে।মিহুর নড়াচড়া দেখে উঠে গেল তারপর বলল
-আসলে আপু তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে যখন,তখন তোমার নেকাব আর হিজাব খুলে দিয়েছি।আমি তোমাকেই এই প্রথম দেখলাম বিয়েতে নেকাব আর হিজাব পড়তে।

মিহু কিছু বলল না।মিহুকে মনমরা থাকতে দেখে বলল
-কি আপু মিস করছ কাউকে?হুম?কুছ কুছ হোতা হে কেয়া?
-যা কিসব বলছিস।সেরকম কিছুই না।এসব কথা থামা অন্য মানুষ গুলো শুনলে কি মনে করবে?
-কি আর মনে করবে,,,,বুঝবে জামাইকে খুঁজছে।আর তাছাড়া ও দেখো এই গাড়িতে সব ছোটরা আর প্রায় মানুষই ঘুমের মধ্যে।
-কিন্তু নীলুকে দেখছিনা যে আর উনিও বা কোথায়?
-কি রে আপু একটু আগেই না বললি এরকম কিছুই না। আর এখনি উনি উনি শুরু করলি?
-আরে এরকম করিস না।
-জানিনা সঠিক।নেহাল ভাইয়া এসে বললেন যে নীলু নাকি অসুস্থ তাই আরফান ভাইয়ের আসতে দেরী হবে।আমাদের নাকি যেতে বলেছেন।আচ্ছা আমি এখন একটু ঘুমাই ডিস্টার্ব করিস না।

বিদিশার কথা শুনে মিহুর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এমন একটা বিশেষ দিনে ওর পাশে বিশেষ ব্যক্তিটি নেই।মন খারাপেরা ওর কোলে এসে জুড়ে বসেছে।ওর মনে হয় সারা জীবনটাই ওর সাথে এমন ঘটবে।চোখে একটু একটু পানি এসে গেল।তারপর আবার নিজেই নিজেকে বললো
তুই কেমন মিহু?তার বোন অসুস্থ, তার তো সেখানেই যাওয়া উচিত?তুই এখন কীভাবে তাকে তোর পাশে এক্সপেক্ট করো?তুই আসলেই একটা স্বার্থপর।

আরফান নীলুকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছে।এখানে এসে একজন ভালো ডক্টরের সাথে কথা বলেছে।তিনি নীলুর কয়েকটা টেস্ট করিয়েছেন।ভালোভাবে ওকে চেক আপ করেছেন।তারপর আরফান কে বললেন
-আচ্ছা মিস্টার আরফান, যা দেখলাম তাতে তো বোঝা যাচ্ছে ক্ষত টা অনেক আগের।তার সম্পর্কে একটু বলুন তো কীভাবে কি হলো

-আসলে ডক্টর আমার বোন মায়ের পেটে থাকতে একদিন মা মাটিতে পড়ে যায়।তার পেটে আঘাত লাগে।ফলে সময় হওয়ার আগেই আমার বোনকে জন্ম দিতে হয়।তখন ডক্টররা বলে দিয়েছিলেন যে ওর নাকি মাথায় কোথায় আঘাত লেগেছে।ঐ আঘাতটা নাকি একটা সময় বড় আকার ধারণ করতে পারে।কয়েকদিন আগেও জাভেদ আংকেল বলেছিলেন ও নাকি প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারত।

-হ্যাঁ তিনি ঠিকই বলেছেন।তবে একটা কথা কী জানেন, আপনার বোন যে শুধুই প্যারালাইজড হয়ে যাবে তা না।তার সাথে যা কিছু ঘটতে পারে।এই যেমন ধরেন তার কথা বলা বন্ধ হয়ে যেতে পারে কিংবা ভারসাম্য ও হারাতে পারে।তাই বলছি একটু খেয়াল রাখুন যাতে করে তার ওপর চাপ না পড়ে।
আরফান নীলুর বেডের পাশে গিয়ে বসল।তারপর ওর দিকে তাকালো।মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল

-তোকে কিচ্ছু হতে দেবো না।ভাইয়া তোকে কিচ্ছু হতে দেবেনা।শুধু তুই মন থেকে শক্ত থাক। আর তোর আজকের অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না,কিছুতেই না।

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১১

(আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত।কালকের পর্বে আমি নীলুর জায়গায় তুলি লিখেছি।আসলে আমি লেখালেখিতে নতুন তাই একটু ভূল হয়ে যায়। আর আপনাদের অনেক ধন্যবাদ ভূলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ।
রি চেক করিনি)

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৩