হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৩

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৩
সাইয়ারা মম

নেহালদের বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গিয়েছে।রেবেকাসহ অন্যরা ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।পিহু গাড়ির মধ্যে নেহালের হাত জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।নেহান আস্তে আস্তে ডাক দিল
-পিহু,এই পিহু ঘুম থেকে উঠো।আমরা এসে গিয়েছি তো।ওঠো ঘুম থেকে
পিহু পিট পিট করে চোখ খুলে তাকায়।তারপর বলে

-এসে গিয়েছি?
-হুম।
-চলো তাহলে
নেহাল প্রথমে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।তারপর পাঞ্জাবী টা ঠিক করে নিজের এক হাত বাড়িয়ে দেয় পিহুর নিকটে।পিহু লাজুক হেসে নেহালের হাতটা ধরে উঠলো।তারপর এগিয়ে গেল বাড়ির সম্মুখে।তাদের এইরকম কাপল দেখে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যাবে।
কিন্তু পেছনের গাড়ি থেকে সদ্য নামা মিহুর এই দৃশ্য দেখে মুখ ভার হয়ে গেল।না,ওদের দেখে খারাপ লাগছে তা নয়।যে মুহূর্তে একটা ভরসার হাত প্রয়োজন সেই মুহূর্তে তার কাছে এখন কেউ নেই।বিদিশা মিহুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-এই আপু ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?ভেতরে চল
-হুম,চল।
পিহু আর নেহাল ঘরে ঢুকতেই রেবেকা দৌড়ে আসে।এসেই পিহুকে সোফায় বসিয়ে শরবত খেতে দেয়।তারপর জিজ্ঞেস করে
-আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো পিহু?
-না,,মা।

ঠিক সেই সময়ে দরজার পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে মিহু।বিয়ের পোশাকে মাথায় হিজাব আর নেকাব দেওয়া।গাড়ি বাসার সামনে থামতেই মিহু হিজাব আর নেকাব ঠিক করেছে।মিহুকে একা দেখে সবাই একটু থমকে যায়।তারপর আশেপাশের লোকজন বলাবলি করতে থাকে
-আরফানের মনে হয় বিয়েতে মত ছিল না।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন।না হলে কি নিজের বিয়ের সময় এভাবে বৌকে ফেলে রেখে যেতে পারে।

মিহু কথাগুলো শুনে মাথা নিচু করে ফেলল।চোখে না চাইতেও পানিগুলো চলে এসেছে।রেবেকা নীলুর বিষয়ে কিছুই জানেন না।তাই তিনি নেহালের দিকে তাকালেন।নেহাল তৎক্ষনাত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিহুর পাশে গিয়ে বলল
-আসলে আপনারা কিছুই জানেন না।আসার পথে নীলু অসুস্থ হয়ে পড়ে তাই আরফান ভাই ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।
-তারপরও বিষয় টা কেমন না।

রেবেকা তখন পিয়াসের মাকে বললেন-ভাবি ওদের দুজনকেই রুমে দিয়ে আসো।ওরা অনেক ক্লান্ত।
পিয়াসের মা রেবেকার কথা শুনে ওদের দোতলায় নিয়ে গেল।প্রথমে মিহুকে আরফানের রুমে বসিয়ে তারপর পিহুকে নেহালের রুমে দিয়ে আসল।নেহালের কাজিন সিস্টারেরা পিহু আর মিহুকে সাহায্য করল ফ্রেশ হতে।তারপর ওদের খাবারটা যে যার রুমে দিয়ে গেল।

এইদিকে নেহালকে রেবেকার কাছে পুরো ঘটনা ডিটেইলসে বলতে হয়েছে।নীলুর ঘটনা শুনে রেবেকা নেহালকে বলল
-খবর নিয়েছিলি বাড়িতে আসার পরে?
-হ্যাঁ পিয়াস কে ফোন দিয়ে ছিলাম। ও বলেছে নীলুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।ওর সুস্থ হতে একটু টাইম লাগবে।মানে কয়েকদিন লাগতে পারে।

-ওহ্।আচ্ছা আমি কি একবার ফোন করে জিজ্ঞেস করব নীলু কেমন আছে?
-তার আর কোনো দরকার নেই।আমরা নিজেদের মধ্যে এতো ফরমালিটি না দেখালেও চলবে।আমি তো খবর নিয়েছি ই।
-তারপরও আমি একবার কথা না বললে মনটাকে বোঝাতে পারছি না।
-আচ্ছা তোমার যদি মন চায় তাহলে ফোন করো।

বলে নেহাল চলে গেল।রেবেকা ফোনটা হাতে নিল।আরফানের নম্বর টা উঠিয়ে ফোন দিল ঠিক তখনই পিয়াসের মা ডাক দিল রেবেকাকে।ফোনটা রিং হওয়ার আগেই কেটে দিল।তারপর চলে গেল পিয়াসের মায়ের কাছে।
পিহুর এখন দমবন্ধ লাগছে।এত ভারী শাড়ী পড়ে থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে ।প্রথমে সে চুলগুলো খুলে ফেলল। এতক্ষণ চুলগুলো খোপা করে থাকার ফলে মাথাটা ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল। এখন ভালো লাগছে।
-আহা কি শান্তি ই না লাগছে।পার্লারের মানুষ গুলোও না,,,,,এত পেঁচিয়ে কি চুল বাঁধে।যদি বাঁধতেই হয় তাহলে এমন ভাবে বাঁধবে যাতে খুলতে আর কষ্ট না হয়।

এভাবে বলতে বলতে নিজেই নিজের মেকআপ উঠাতে লাগল।চোখের লেন্স খুলতে গিয়ে এত ভোগ পোহাতে হল যে এটা চোখ না হয়ে যদি অন্য কিছু হতো তাহলে সেটা খুচিয়ে বারোটা বাজিয়ে দিত।চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল।মেকআপগুলো আর এত কষ্ট করে উঠাতে ইচ্ছা করছে না।তাই একেবারে ফেসওয়াস দিয়ে ফেসটা ধুয়ে আসছে।এসে শাড়িটা পাল্টাবে এমন সময় নেহাল পেছন থেকে পিহুকে জড়িয়ে ধরল।

-আরেহ তুমি আসলে কখন আর কীভাবে আসলে?তোমার বোনেরা আটকায় নি?
-আসলে ওরা নীলুকে ছাড়া কিছু করতে চাইছে না।তাই আজকে রেহাই পেলাম।তবে তুমি এত আনরোমান্টিক কেন? আমি আসার আগেই সাজ নষ্ট করে ফেললে।দেখি আমার দিকে ঘোরে।
বলার সাথে সাথেই একচিৎকার দিয়ে পেছনে লাফ দিল।নেহালের চিৎকারে পিহু ভয় পেয়ে গেছে।ও কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল

-ক্ ক্ কি হয়েছে?তুমি এত ভয় পেলে কেন?
নেহাল বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে।তারপর পিহুর দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা তুমি কি কোনদিন মেকআপ করোনি?
-না কেন বলোতো?
-তাহলে তোমাকে সাজিয়ে দিত কে?
-তুলি আপু।কিন্তু কেন বলতো?

-কিছু না।চলো তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিই।তবে আগে চোখ বন্ধ করো।
-ওয়াও আমি খুব এক্সাইটেড। আচ্ছা এই নাও চোখ বন্ধ করলাম।বলে পিহু চোখ বন্ধ করল।
নেহাল পিহুকে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো।তারপর কানে কানে বলল

-রেডি তো?
-হ্যাঁ রেডি।চোখ খুলবো?
-হুম,,,,,,,চোখ খুলো।
পিহু খুব এক্সাইটেড হয়ে চোখ খুলল।কিন্তু চোখ খুলে দিল এক চিৎকার।নেহালকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল

-আমার সামনে থেকে ডায়নীটাকে সরাও।তাড়াতাড়ি সরাও।আমার খুব ভয় লাগছে।প্লিজ
নেহাল মুচকি হাসলো।তারপর ফিসফিসিয়ে বলল
-এই যে মিসেস নেহাল, ওটা কোনো ডায়নী নয়। ওটা আপনার নিজেরই চেহারা
পিহু কান্না থামিয়ে মাথা উঠালো।তারপর জিজ্ঞেস করল-তুমি কী বললে?
-বলেছি ওটা তোমার চেহারা

কথাটা শুনে পিহু ভালো করে আয়নার দিকে তাকালো।তারপর দেখলো মেকআপ গুলো আগে না উঠিয়ে একবারে ধুতে গিয়ে এই অবস্থা।চোখের কাজল আর স্যাডো গুলো মিলে চোখদুটোকে একদম ভুত বানিয়ে দিয়েছে।নিজের দোষ স্বীকার না করে বলল
-তুমি বাজে প্রোডাক্ট কিনে পাঠিয়েছো তাই এমন হয়েছে।এখানে আমার কোনো দোষ নাই।
নেহার বিরবিরিয়ে বলল-হ্যাঁ,,,, ঐ তো নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।

-তুমি কি বললে?হ্যাঁ?
-না কিছু বলি নাই তো।কিছু না
-আচ্ছা আমাকে দেখে তোমার কী একবারো ডায়েনী মনে হয়েছে?
-হ্যাঁ তোমাকে দেখে তো একদম ডায়েনীই লাগ্ গ্ গ্ গে
বলতেই পিহুর দিকে তাকাতেই দেখতে পেল পিহু বোম দিয়ে আছে।পিহু মুখটা ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।নেহাল মুচকি হাসল,তারপর পিহুর মুখটা ওরদিকে ঘুরিয়ে বলল

-তোমাকে যেমনটা ই লাগুক না কেন তুমি আমারই থাকবে।ডায়েনী হও বা পরী তুমি একমাত্র নেহালের।
-বিশ্বাস করি না
-আচ্ছা তাহলে প্রুভ দেখাই
বলে পিহুকে কোলে তুলে নিল।পিহু নেহালের গলা জড়িয়ে ধরল।লজ্জায় তার গাল দুটো গরম হয়ে গেল।পরিপূর্ণ পেল নেহাল আর পিহুর ভালোবাসা।

মিহুকে যে খাবারটা দিয়ে গিয়েছে সেটা না খেয়ে রেখে দিল।যতই হোক স্বামী যদি না খেয়ে থাকে সেখানে সে কিভাবে খাবার খায়? অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন আরফান এলো না তখন মিহু তার বিয়ের সাজটা উঠিয়ে ফেলল। আসার পরেই বিদিশা অর্ধেক সাজ উঠিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাকি গুলো নিজে উঠালো।তারপর ওযু করে নামাজ পড়তে লাগল।শেষে মুনাজাতে বলল

-হে আল্লাহ্ ।হে আমার ভাগ্য নির্ধাতা।আমি জানি আপনি যা করেন সেটা ভালোর জন্যই করেন।তবে আমি আপনার কাছে একটা জিনিস ই চাই আমি যেন একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারি।আর আজকে আমি একজন মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছি।আমার কারণে যেন তার কোন বদনাম না হয়।পরিশেষে নীলুর সুস্থ তা কামনা করছি।আমিন।
আজকে যেন মিহুর অপেক্ষার প্রহর কাটছে না।আরফানের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সোফাতেই ঘুমিয়ে গেল। আর এইদিকে পিয়াস কে নীলুর কাছে রেখে আরফান বাইরে গেল নীলুর জন্য মেডিসিন আনতে।দোকান থেকে যখন মেডিসিন কিনে আসার জন্য রওনা দিল তখন ফুটপাতে বসা এক গাছ বিক্রেতা বলল

-স্যার একটা বেলী ফুলের চারা আছে।নিবেন?
এখন রাত বারোটার বেশী বাজে।এইসময়ে এই লোক গাছ বিক্রি করছে দেখে আরফানের একটু খটকা লাগল।তাই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল

-এত রাতে গাছ বিক্রি করছেন কেন? এখন কেউ কিনবে এগুলো?
-স্যার একপিছ রইয়া গেছে।হেই লাইগা রাইত হইলেও বেইচা যাইতে চাইছিলাম।
-আচ্ছা তাহলে ওটাকে তো সকালে বিক্রি করলেও পারতেন। এখন বাসায় গেলেই তো পারতেন।
-স্যার কি আর কমু।আইজকা আমার বিবাহ বার্ষিকী।হেইতে বিবি কইছিল একটা কেক আনতে।কিন্তু দেহেন এই এক পিছ বেচতে না পারলে কেক কিনতে পারমু না।হেই লাইগা বেচলাম
গাছ বিক্রেতার নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা দেখে অবাক হয়ে গেল।সে বলল

-আচ্ছা তাহলে গাছটা প্যাক করে দিন
গাছটা নেওয়ার পরে আরফান তাকে একটা এক হাজার টাকার নোট দিল
-স্যার ভাংতি নাই তো
-রেখে দিন,কালকে আপনার বিবিকে নিয়ে যা খুশি তাই করবেন।ঠিক আছে?
-কিন্তু

-কোনো কিন্তু নয়। আজকে আপনাদের যেমন বিবাহবার্ষিকী তেমনি আমার আজকে বিয়ে হয়েছে।মনে করবেন আমার বিয়ে উপলক্ষে আপনাদের সামান্য কিছু দিলাম
লোকটা খুশি হয়ে বলল-স্যার আপনার জন্য দোয়া রইল। এই গাছে খু সুন্দর বেলী ফুল ফোটে আর খুব ঘ্রাণ। আপনার আজকে যার লগে বিয়া হইছে সে যেন আপনার জীবনের বেলী ফুল হয়।
আরফান বেলী চারাটা নিয়ে চলে আসল। আর মনে মনে বলতে লাগল

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১২

-তার জীবনে আসলেই কী বেলী ফুল আসবে?মিহুর সাথে কী তার এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হবে?আচ্ছা এটা কি সম্ভব হবে কখনো?মিহু কি তার জীবনে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারবে?কি হবে তাদের ভবিষ্যত? কোন দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে তাদের জীবন?

হৃদমাঝারে তুমি পর্ব ১৪