হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ২
সাদিয়া জাহান উম্মি

স্নিগ্ধ প্রকৃতি,হিমেল হাওয়া বইছে।আকাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা।সূর্য প্রায় হেলে পরছে পশ্চিমে।লাল আভা ছড়িয়েছে চারদিকে। ছাদের আনাচে কানাচে গাছ-গাছালিতে ভরপুর।এমন একটা মনোরম পরিবেশেও মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আরাবী।আর কিইবা করবে ও?

এমনিতেই কাঁপা-কাঁপি করতে করতে ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আর একটু পর বোধহয় শ্বাস আটকে মা’রা যাবে ও এমনটাই মনে হবে ওকে দেখলে।প্রায় আধাঘন্টা যাবত এমনভাবে দাঁড়িয়ে আরাবী।ভ*য়ের পাশাপাশি বিরক্তও হচ্ছে।ছাদে এসেছে পর থেকে জায়ান নামক ব্যাক্তিটি একটা কথাও বলেনি ওর সাথে না নিজ জায়গা হতে একটু নড়চড় করেছে।সেইযে এসে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে ফোনে কি যেন দেখছে তো দেখছেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এদিকে যে তার সামনে একটা মানুষের ভ’য়ের চোটে দম ব*ন্ধ মা*রা যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই।আরাবী যে একপলক তাকিয়ে লোকটাকে দেখবে সেই সাহসও হচ্ছে না ওর।কি একটা অবস্থা।গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে বা*জেভাবে।লোকটা কি তাকে পছন্দ করে নি?তাই তো কিছুই বলছে না।না করারই কথা।ওর গায়ের রঙটা তো শ্যামলা বর্ণের।আর মানুষ হলো সুন্দরের পূজারি।

আর এতো বড়লোক বাড়ির ছেলে কি ওর মতো শ্যামলা গায়ের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হবে নাকি?যাই হোক বিয়েটা না হলেই ভালো।আরাবী এখনই বিয়ে করতে চায়না।সবে মাত্র অনার্স কমপ্লিট করেছে ও।মাস্টার্সের ভর্তি হয়েছে এইতো কিছুদিন পর থেকেই ক্লাস শুরু হবে ওর।ও মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা চাকরি করতে চায়।তারপরেই বিয়েটা করার ইচ্ছা আরাবী।মনেপ্রানে চায় ওর সামনে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি যেন বিয়েতে না করে দেয়।

তাহলেই হলো।কিন্তু এই বিয়েটা ভেঙ্গে গেলে যে ওর মা ওকে কি করবে আরাবী জানে না।এই শ্যামবর্ণের জন্যে ওর দু-তিনিটা সম্বন্ধ ফিরত চলে গিয়েছে।এই জন্যে কম কথা শুনায়নি ওকে লিপি বেগম।তবে আরাবী এটুকু ভেবে পায় না।ওর ভাই আর ওর ছোট বোনের গায়ের রঙ ফর্সা,ওর আব্বু আম্মুও ফর্সা।তাহলে ও এমন শ্যামলা গায়ের রঙ পেলো কিভাবে?

এই প্রশ্নটা প্রায় জাগে ওর মনে।কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করে না।এমন বাচ্চামো প্রশ্ন করা নেহাতই বোকামি বলে গন্য করবে সবাই।আরাবী চাপা শ্বাস ফেললো।ঠিক তখনই ছাদে এসে উপস্থিত হয় ইফতি।ইফতি সাখাওয়াত পুরো নাম। নিহান সাখাওয়াতের ভাই মিহান সাখাওয়াতের ছেলে ইশতিয়াক ইফতি সাখাওয়াত।ইফতি ছাদে এসেই চাপা স্বরে জায়ানকে ডেকে উঠলো,

-‘ ভাই,তোকে ডাকছে নিচে।’
কথাটা বলেই ইফতি দ্রুত পায়ে নিচে চলে গেলো।জায়ান ফোনটা পকেটে রেখে ছাদ থেকে নামার জন্যে অগ্রসর হলো।আরাবী ইফতির ঝড়ের মতো আসা যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলো।পরক্ষনে জায়ানকে ভালো মন্দ কিছু না বলে চলে যেতে দেখে আরাবী নিজেও নিচে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হলো।কিন্তু কাঁপাকাঁপির কারনে ঠিকঠাকভাবে হাঁটতেও পারছে না মেয়েটা।

তার উপর এই শাড়িটাও তার সাথে যেন শ’ত্রুতামি শুরু করেছে। শাড়ির কুচিগুলো ঢিলে হয়ে বার বার নিচের দিক চলে যাচ্ছে। ফলে আরাবীর হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। হাঁটার মাঝে একসময় শাড়ির কুচিতে পা পেঁচিয়ে পরে যেতে নেয় আরাবী।ভ’য়ে মৃদ্যু চিৎকার করে উঠে।নিজেকে রক্ষার জন্যে যা পায় তাই স্বজোড়ে আঁকড়ে ধরে মেয়েটা।ভ’য়ে প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম ওর।আজ যেন সব ওর সাথে উল্টাপাল্টা হচ্ছে।

সাথে সাথে কোমড়ে কারো শীতল হাতের স্পর্শে সর্বাঙ্গ মৃদু ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠে।হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো হু হু করে।ব্যাপারটা ও যা ভাবছে তা যদি হয়ে থাকে।তাহলে আরাবী এখনই এই মুহুর্তে লজ্জায় কেঁদে দিবে।অলরেডি ওর চোখজোড়া ভিজে উঠেছে।ভেজা ভেজা চোখজোড়া নিয়েই আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো আরাবী।আর ওর আন্দাজ করা ব্যাপারটাই সত্যি।এইমুহূর্তে ও জায়ানের বাহুডোড়েই বন্দি।

সাথে নিজেও খামছে ধরে আছে জায়ানের গায়ে পরিহিত কোট’টা। লোকটার দিকে তাকালো আরাবী ভয়ে ভয়ে।সাথে সাথে যেন হৃদয়ের মাঝে কেমন করে উঠলো আরাবীর।নিজেও বুঝতে পারলো না কিছু।এমন সুদর্শন ছেলে না-কি ওকে বিয়ে করবে? গ্রে কালার সুট কোট পরিহিত,ফর্সা গায়ের ছেলেটা অধিক সুদর্শন। সূর্যের লাল আভায় অন্যরকম লাগছে, গালে চাপদাড়ি,পুরু ভ্রুজোড়ায় ওই চোখদুটোর সৌন্দর্য যেন দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চোখের দিকে তাকাতেই আরাবীর যেন অন্য জগতে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।দিন দুনিয়া ভুলে বেহায়ার মতো ওই চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো।চোখের পলক ফেলাও যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে ওর।হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠের চাপা ধমকে হুশ ফিরে আসে আরাবীর,

-‘ ডা’ফার একটা।শাড়ি পরে হাটতে না পারলে পরো কেন? এখন নিজেও পরতে সাথে আমাকেও ফেলতে,ইডি’য়ট একটা।’
আরাবী এমন ধমকে ভ’য়ে কেঁপে উঠলো।ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই হাশফা’শ করতে লাগলো আরাবী।জায়ানও আরাবীকে ছেড়ে দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরাবীকে একপলক দেখে তারপর হনহনিয়ে চলে গেলো নিচে।

এদিকে আরাবী ক্যাব’লাকান্তের মতো দাঁড়িয়ে। ভাবছে লোকটা একমুহূর্তে ওর সাথে কথা বললো।তাও কিভাবে?প্রথম কথাতেই ধম’কে ধাম’কে একাকার করে দিলো। আর ওইবা কি? মানছে লোকটা সুন্দর তাই বলে এইভাবে হা*বলার মতো তাকিয়ে থাকার কোন মানে হলো?

কিভাবে তাকিয়েছিলো ও? লোকটা কি ভাববে এখন আরাবীকে?নিশ্চয়ই ভাববে আরাবী ছ্যা*ছড়া মেয়ে।নিজের মনে আরো শত রকম উল্টাপাল্টা ভাবনা চিন্তা করতে করতে নিচে নেমে আসলো আরাবীও।সাথি বেগম এগিয়ে এসে আরাবীকে টেনে নিয়ে আবারও নিজের পাশে বসালেন। নিহান সাহেব জায়ানের পক্ষ থেকে জানালেন তার ছেলের এই বিয়েতে কোন আপত্তি নেই। এখন আরাবী মতামত দিলেই হলো।জিহাদ সাহেব মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-‘ আরাবী,আম্মু তোমার কোন আপত্তি আছে এই বিয়েতে?’
আরাবী কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।কিইবা বলবে ও?ছেলে মেয়েদের আলাদা কথা বলতে পাঠালো তারা।অথচ আধাঘন্টা খামোখা সং সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন।কেউ কোন কথা বলে নি।লাস্টে আসার সময় জায়ানই আগে কথা বললো কিন্তু ওটাকে কথা বলে না ওটাকে ধম’কাধম*কি বলে।

এখন আরাবী তাদের এসব কথা কিভাবে বলবে?জিহাদ সাহেব আবারও একই প্রশ্ন করতে আরাবী নড়েচড়ে বসলো অপরপাশে সোফায় বসা লিপি বেগমের দিকে আঁড়চোখে তাকাতেই তিনি চোখ রা’ঙ্গিয়ে আরাবীকে ইশারা করলো হ্যাঁ বলার জন্যে।আরাবী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আলতো করে মাথা দুলালো।সাথে সাথে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাবী।নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও বাবা মায়ের খুশির জন্যে হ্যাঁ বলে দিলো আরাবী।ভবিষ্যতে যা হবে দেখা যাবে।আরাবী জানে ওর বাবা কখনো ওর খারা’প চাইবে না।বাবার উপর সেই ভরসা আছে ওর।তাই আর দ্বিমত করলো না।।এদিকে সাথি বেগম হাসি মুখে বলে উঠেন,

-‘ ভাই সাহেব ছেলেমেয়েদের যেহেতু কোন আপত্তি নেই।আমরা চাইছিলাম বিয়েটা যেন খুব দ্রুতই হয়ে যাক।আপনার কোন আপত্তি আছে?’
জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ নাহ নাহ আমার কোন আপত্তি নেই, আলহামদুলিল্লাহ! ‘
নিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ তাহলে এই মাসের তো আর পনেরোদিন আছে।তাহলে জিহাদ সাহেব সামনের মাসের ১ তারিখেই ওদের বিয়ের ফাইনাল ডেট। কি বলেন?’
-‘ জি আচ্ছা,আপনারা যা ভালো মনে করেন।’

সবার মতামতে আগামী মাসের ১ তারিখই বিয়ের দিন নির্ধারন করা হলো। জায়ানের পরিবার আরাবীকে আংটি পরিয়ে দিলেন আর পাঁচ হাজার টাকা সালামিও দিলেন।তারপর তারা সন্ধ্যার হালকা নাস্তা করে চলে গেলেন।রাতের ভোজনের জন্যে অনেক সাধলেন জিহাদ সাহেব আর লিপি বেগম কিন্তু তারা কেউ রাজি হলো না তাতে।জায়ান’রা চলে যেতেই জিহাদ সাহেব হেসে বলেন,

-‘ শুনলে লিপি আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার আরাবী আম্মুর এতো ভালো ঘরে বিয়ে হবে।অবশ্য হবে নাই বা কেন?আমার আম্মুর মতো মেয়ে লাখে একটা হয়।আমার আম্মাটা আমার কাছে সেরা।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১

জিহাদ সাহেব মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।আরাবী চোখ বন্ধ করে বাবার বুকে মাথা ঠেকিয়ে রাখলো।তার বাবা এই বিয়েতে অনেক খুশি।আর বাবার খুশি জন্যে আরাবী সব করতে রাজি।কারন এই মানুষটাকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসে ও।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ৩