হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ১২

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ১২
নন্দিনী চৌধুরী

১মাস ৪দিন পর,,,,
শিশিরদের বাড়ি এখন আর আগের মতো নেই।বাড়ির সেই হাসিখুশি প্রানবন্দতা নেই।একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে ওদের বাড়ি।বাড়ির আসল প্রানটাই যে নেই।প্রানভ্রমরা ছাড়া প্রানহীন হয়ে আছে বাড়িটা।
খাবার টেবিলে নাস্তা দিচ্ছে চাঁপা।জানে যে কেউ খাবেনা নাস্তা তবুও সে দিচ্ছে নাস্তা।চাঁপা নাস্তা সাজাতে সাজাতে দেখে মহুয়া নিচে আসছে।মহুয়া চলে যেতে নিলে চাঁপা মহুয়াকে ডেকে বলে,

চাঁপা:আফা কিছু খাইয়া যান।
মহুয়া:না রে ক্ষুদা নেই।তুই মাকে খাইয়া মেডিসিন দিস।
মহুয়া কথাটুকু বলে চলে গেলো।চাঁপা একটা ছোট শ্বাস ফেলে স্যুপ হাতে সাবিনার রুমে গেলো।সাবিনা রুমের খাটে হেলান দিয়ে বসা।চাঁপা স্যুপ এনে তাকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন দিয়ে চলে আসতে নিলে সাবিনা বলে,
সাবিনা:শুভ্রতা মহুয়া আজকেও খেয়ে যায়নি?
চাঁপা:না আম্মা খায়নাই।
সাবিনা:আর কত এভাবে চলবে।আচ্ছা যা তুই।
চাঁপা চলে যেতে সাবিনা হুহু করে কেদেঁ দেয় আর বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আল্লাহ এ কোন পাপের সাজা তুমি আমায় দিলে।প্রথমে আমার স্বামীকে নিয়ে গেলে।যখন স্বামী চলে গেলো ভাবলাম ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে বেচেঁ থাকবো। কিন্তু এ কি করলে তুমি আল্লাহ আমার শিশিরকেও নিয়ে গেলে তুমি।আল্লাহ আমি মা হয়ে কি করে মেনে নেবো এটা।আল্লাহ আমার শিশিরকে ফিরিয়ে দেন।এই মায়ের কান্না ফেলে দিয়েন না।”

শুভ্রতা আজকেও কোনোরকম ক্লাস করে বাসায় আসলো।কোনো কিছুর প্রতি তার আগ্রহ আসছেনা।সব কেমন এলোমেলো লাগছে তার।শুভ্রতা বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে গেলো।রান্না ঘরে গিয়ে দেখে চাঁপা রান্না করছে।তাই সে সাবিনার রুমে গেলো।সাবিনা হুইল চেয়ারে বসে আছেন।শুভ্রতা গিয়ে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে কোলে মাথা রাখলো।সাবিনা শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।শুভ্রতা চুপচাপ হয়ে আছে।সাবিনা শুভ্রতাকে চুপচাপ দেখে নিজে বলতে শুরু করলেন,

“জানিস আমার বিয়ের পর প্রায় ৩বছর পর আমার কোল জুরে শিশির আসে।শিশিরের জন্মের পর ওর বাবার প্রমোশন হয়।খুব ভালো যাচ্ছিলো আমাদের জীবন।শিশিরকে ওর বাবা অনেক ভালোবাসতো।শিশির ও বাবা বলতে পাগল।আবার শিশিরের ৫বছরের মাথায় মহুয়া আমার পেটে আসে।মহুয়া হবার পর আমরা একদম একটা সুখি পরিবার ছিলাম।শিশির সব সময় চাইতো ওর বাবার মতো পুলিশ অফিসার হতে।

শিশিরের বাবাও ছেলের ইচ্ছাকে প্রধান্য করতো।শিশিরের বয়স যখন ১২ আর মহুয়ার ৭ তখন ওদের বাবা একটা কেস সামলাতে গিয়ে মারা গেলো।শিশিরের বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক ভেংগে পরেছিলাম আমি।তবুও ছেলে মেয়েকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করি।শিশিরের ওর ইচ্ছা মতো পুলিশ অফিসার হলো।খুব ভয় হতো যদি ওর কিছু হয়ে যায় এউ ভয়ে।আর দেখ আজ সেই ভয় সত্যি হলো।আমার শিশির ওর বাবার মতো চলে গেলো।আমি এখন বেচেঁ আছি তোদের মুখ চেয়ে।সেই তোরা যদি এমন হয়ে থাকিস তাহলে আমি ভালো থাকি কি করে।তুই মহুয়া একদম চুপচাপ হয়েগেছিস।তোরা কি আগের মতো আবার হতে পারিস না।বলনা শুভ্রতা।

সাবিনার চোখ ভিজে গেছে শুভ্রতার চোখ ও ভিজা।শুভ্রতা মাথা উঠিয়ে সাবিনার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
শুভ্রতা:মামনি তুমি চিন্তা করোনা।আমি একদম ঠিক আছি আর মহুয়া আপু উনি ভাইয়ের চলে যাওয়ায় এমন হয়ে গেছে।কিছুদিন আরো যাক ঠিক হয়ে যাবে দেখো।
সাবিনা:তাই যেনো হয়রে মা তাই যেনো হয়।এভাবে আর তোদের দেখতে পারছিনা আমি।
শুভ্রতা সাবিনার থেকে উঠে চলে আসে।
রাতে,,

শুভ্রতা শিশিরের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।শিশিরের খুব পছন্দের জায়গা এটা।শুভ্রতা দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।কোনোদিন সে সেই কালো রাতের কথা ভুলবেনা।সেই কালো রাত সব কেড়ে নিয়েছে তাদের।সব সুখ শান্তি হাসি খুশি সব।
সেদিন শুক্রুবার রাতে,,,,,,

সব মেয়েদের নিয়ে জাহাজে এসে পৌছে গেছে ফিরোজেরা।একে একে সব গুলো মেয়েকে জাহাজে উঠানো হচ্ছে।পরিকল্পনা মতোই সব হচ্ছে।কিছুক্ষনের মাঝেই জাহাজ ছাড়বে।সব মেয়েদের হিসাব আরেকবার দেখেনিলো ফিরোজ।জাহাজ ছেড়ে দেবে এমন সময় শুরু হয় ফায়ারিং।আচমকা হামলা হওয়ায় প্রস্তুত ছিলোনা ফিরোজেরা।প্রথম ফায়ারিং এ দুইজন আহত হয় ফিরোজের লোকেরা।শিশিররা পুরো ঘেরাও করে ফেলেছে ফিরোজদের।ফায়ারিং করেই যাচ্ছে তারা।

ফিরোজরাও এভার পালটা ফায়ারিং দিচ্ছে।কিন্তু শিশিরদের কোপ্স বেশি থাকায় ফিরোজের লোকেরা পেরে উঠছেনা।শিশির সহ ছয় জন জাহাজে উঠে লুকিয়ে গেছে আর ফায়ারিং করছে। তাদের পালটা জবাব দিচ্ছে ফিরোজ আর তার ৪জন সাথি।বাকি পুলিশ কপ্স মেয়েদের উদ্ধার করতে লেগে পরেছে।ফায়ারিং এর এক পর্যায় ফিরোজের বন্ধুক থেকে বেরিয়ে আসা গুলি লেগে যায় শিশিরের বুক বরাবর।শিশির আর ফিরোজেরা ছাদের উপর ছিলো জাহাজের।জাহাজের একদম কোণার পিলারের পিছনে ছিলো শিশির।তার সামনের দিকেই ছিলো ফিরোজ।

গুলি লাগায় নিজেকে সামলাতে না পেরে শিশির পরে যায় পানিতে।শিশিরকে পরে যেতে দেখে মেহেদি চিৎকার দিয়ে ওদিকে যায়।ততক্ষনে শিশির পানিতে পরে যায়।ফিরোজের পায়ে গুলি করে অন্য অফিসার তারপর তাকে ধরে ফেলে।সব মেয়েদের উদ্ধার করে ফিরোজসহ সবাইকে নিয়ে যায় বাকি অফিসাররা।শিশিরকে খোজার জন্য ডুবুরি নামানো হয়েছে পানিতে।সমুদ্রের পানির স্রোত প্রবল এবং অনেক গভীর।ডুবুরিসহ অন্য সার্চ লোকেরা কেউ শিশিরকে খুজে পায়নি।

২ঘন্টা পানিতে খুজেও শিশিরকে উদ্ধার করা যেতে পারেনি।ডুবুরিরা উঠে আসে।সবাই আবার কাল সকালে খোজার আশা করে।পরেরদিন সকালে ৬ডুবুরি সহ ২সার্চটিম মিলে শিশিরকে খোজে কিন্তু কোনো হদিস মেলেনা।সবাই এটাই মানছে বডি পানির স্রোতে ভেসে গেছে।শিশিরের বাসায় দুপুরে মেহেদি গিয়ে খবর দেয়।সাবিনা এটা শুনে সিড়ি থেকে মাথা ঘুরে পরে যায়।মহুয়া ধপ করে সোফায় পরে যায়।আর শুভ্রতা একদম স্তব্ধ হয়ে যায়।বিকালের দিকে চাঁপাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।

অনেক পরিমান ড্রাগ তার শরীরে যাওয়ায় শরীর দুর্বল তার।আয়নাকেও উদ্ধার করে দিয়ে আসা হয় বাড়িতে।পুলিশ অফিসারদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।মৌ চুপেচুপে কাদেঁ শিশিরের জন্য।শিশিরের বাড়িতে সাবিনা শিড়ি দিয়ে পরে যাওয়ায় পায়ে অনেক আঘাত পায়।ডাক্তার জানায় ৬মাসেও হাটতে পারবেনা না তিনি।সাবিনা প্রথমে মানতেই চায়নি শিশির নেই।কিন্তু পরে সব প্রমান পেয়ে তিনি অনেক কাঁদেন।মহুয়া নিরবে কাদেঁ।শুভ্রতা নিজেকে সামলে শক্ত রেখে সবাইকে দেখে রাখে।

মহুয়া প্রথমে অনেক কাঁদলেও পরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ থাকে কিন্তু তবুও নিজ ঘিরে বসে অনেক কাদেঁ সে।শুভ্রতা সবাইকে সামলে নিলেও এক অজানা শুন্যতা তাকে গ্রাস করেছে।শুভ্রতা রাতের আধারেঁ এসে শিশিরের রুমে বসে থাকে।কেন সে শিশিরের শুন্যতা অনুভোব করছে সে জানেনা।তবুও ভয়ংকর শুন্যতা তার ছেয়ে গেছে।

শুভ্রতা আয়নার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলো একবার।পরে আবার কি ভেবে যায়নি।শুভ্রতা মহুয়া মিকে সাবিনা চাঁপার খেয়াল রেখেছে।১মাসের মাথায় চাঁপা সুস্থ হয়ে যায়।চাঁপা সুস্থ হবার পর শুভ্রতা কলেজে যাওয়া শুরু করে।কিন্তু কোনো কিছুতেই সে ভালো থাকতে পারছেনা।

বর্তমানে,,,
শুভ্রতা চুপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
“শিশিরহীনা শরৎশুভ্রতা হয়ে গেলাম আমি”
শিশিরহীনা হয়ে গেছে সে।হারিয়েগেছে শিশির তার জীবন থেকে।
“আমি জানিনা আপনাকে আমি ভালোবাসি কিনা তবে আপনার শুন্যতা ভয়ংকর ভাবে পোড়াচ্ছে আমায়।আপনি চলে গেলেন কেন এভাবে।এই বাড়ি যে আপনাকে ছাড়া অপুর্ন।সবাই যে আপনিহীনা একা।ফিরে আসুন না ভোরশিশির।”

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ১১

পুলিশ স্টেশনে,,,,
সবাই নিজেকে সামলে কাজে মন দিয়েছে।আদালতে ফিরোজক সহ বাকি ২৫জনকে নারী শিশিপাচার করার কারনে ২০বছরের জেল দেওয়া হয়েছে।
হাতে হেডকোয়াটার এর চিঠি নিয়ে বসে আছে মেহেদি।মৌ তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে মেহেদির কাছে এগিয়ে এসে বলে,
মৌ:কি হয়েছে মেহেদি তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
মেহেদি:হেডকোয়াটার থেকে চিঠি আসছে শিশির স্যারের জায়গা আমাকে তারা দিতে চেয়েছিলো। আমি না করার নতুন একজনকে শিশির স্যার এর জায়গায় আজকে পাঠাচ্ছেন তারা।একটু পরেই নতুন আইজি স্যার আসবেন।

মৌ:এতো তাড়াতাড়ি নতুন কাউকে না আনলে হতো।স্যার আমাদের ছেড়ে গেলেন ১মাস হলো সব এর মাঝেই নিয়ে আসলেন।
মেহেদি:আমাদের কাজটা বসে থাকার নয় যে।শত আপনজন হারিয়েও আমাদের কাজ করতে হবে।এটাই যে আমাদের গায়ের এই পোশাকটার নিয়ম।আচ্ছা চলো নতুন স্যার এলো বলে।
মৌ:হ্যা চলো।

কিছুক্ষনের মাঝে সাদা বিএম ডাব্লু গাড়িতে করে একজন সুদর্শন যুবক এসে থানার সামনে নামে।সবাই তাকে স্বাগতম জানাতে বাহিরে দাঁড়ানো।নিউ আইজিকে দেখে সবাই চমকে যায়।শিশিরের মতোই বয়সের একজন আইজি অফিসার।
নতুন অফিসারকে সবাই স্বাগতম জানায়।নিউ আইজি সবাইকে উদ্দেশ্য করে নিজের পরিচয় দেয়।
“আমি আপনাদের নিউ আইজি স্যার আরিয়ান মাহমুদ।আজ থেকে আপনারা আমার আন্ডারে কাজ করবেন।আশা করি আপনাদের কাজ করতে ভালো লাগবে আমার সাথে।”

হৃদয়ের স্পন্দন পর্ব ১৩