অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৮

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৮
ইফা আমহৃদ

শার্টের কিছু অংশ জুড়ে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কাদা মাটির সংস্পর্শে এসে বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে। গাছের উঁচু ডালে বসে পা দোলাচ্ছে আরশি। গ্রীষ্মের খরতাপে গাল দুটো রক্তিম হয়ে আছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুগুলো কালো দাগ তৈরি করেছে। ডালের দুইপাশে হাত রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে আরশি।

তারুণ্য একে একে ঘরের সব কিছু লন্ড ভন্ড করে ফেলেছে। বেডে মেলে রাখা ফুলের চাদরটা খন্ডিত হয়ে নিচে পড়ে আছে। ফুল দানীটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তারুণ্য অতিশয় ক্ষোভে মাথা চেপে ধরলো। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলা জামা কাপড় গুলো বেডের মাঝ বরাবর রাখল। ফুলদানির ছোট খন্ডিত টুকরো আঙুলে আঘাত করলো। তোয়াক্কা না করে আরো একবার মেলে মেলে দেখলো। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটার দেখা মিললো না। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে স্থির করলো। ক্রমাগত সময় ফুরিয়ে আসছে। এখনো তার প্রিয় সাদা শার্টটা পাচ্ছে না।
মুঠো ফোন তুলে অরিশের ফোনে ডায়াল করলো। পরপর দুবার ফোন করায় রিসিভ হলো। অরিশের ক্লান্তিমাখা কন্ঠস্বর ভেসে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-“তারুণ্য, রাস্তায় আছি। কিছু সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবো। রাখছি!”
-” রাখিস না, আমার সাদা শার্টটা কি তুই পড়েছিস।”
-” না, দেখ ভুল করে কোথাও রেখেছিস কি-না।”
তারুণ্য ফোন কেটে টেবিলের উপর রাখল। দৃষ্টি গেল অদূরে ঝোপঝাড় গাছের ডালে। “কে, কে?” বলে কয়েকবার চেঁচালো সে। কিন্তু প্রত্যুত্তর এলো না। বাধ্য হয়ে প্রস্থান করলো। বড় বড় পা ফেলে গাছের নিচে গিয়ে ফাঁকা গলায় ডাকে,
-“আরু, তুই আবার আমার প্রিয় শার্টটা ধরেছিস। এক্ষুনি নেমে আয়। নাম বলছি।”

শেষের দু শব্দ দৃঢ় ভাবে উচ্চারণ করলো তারুণ্য। আরশি কেঁপে উঠলো ঈষৎ। ধীরে ধীরে হাতের বন্ধন হালকা হয়ে গেল। উঁচু ডাল থেকে নিয়ে পড়ে গেল। তারুণ্য কোলে তুলে নিল আরশিকে। দৃঢ় বন্ধনে চেপে ধরে বলে,
-“এক দন্ড শান্তিতে থাকতে পারিস না তুই। কোমড়টা তো এখনই যেত।”

আরশি মুড়িয়ে উঠলো। তারুণ্য আরো দৃঢ় ভাবে ধরলো। আরশির বলশক্তি হ্রাস পেল। নম্র ভাষায় বলে,
-“তুমি সব সময় আমাকে বকো। আজকে আমাকে ছেড়ে হোস্টেলে চলে যাচ্ছ, আজকেও বকছো?
কি হয়েছে, তোমার শার্টটা একটু পড়েছি। ছিঁড়ে তো যায় নি।”
সরু চোখে আরশির মুখপানে চেয়ে রইল তারুণ্য। পা দিয়ে ঠেলে স্থানটা পরিষ্কার করে নিল। পা জোড়া গতিশীল করে বাড়ির অন্তর্ভাগে প্রবেশ করলো। স্মিত হেসে বলে,

-“তবুও তো পাগলামী থামাস না। আমি তো চলে যাচ্ছি, এবার বলার মতো কেউ নেই।”
তারুণ্য আরশিকে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে থামলো। হাত মুখে, মাথায় পানি ঢেলে বেরিয়ে এলো। ভেজা চুলগুলো টাওয়ালের সাহায্যে মুছিয়ে দিল। মাথায় চিরুনি চালিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। আরশিকে কান ধরে উঠবস করতে বলে, আরশি মুখ ফুলিয়ে কান ধরে পাঁচ বার উঠবস করে। আরশির অগোচরে ফোনের বন্দী করে নেয় মুহুর্তটা। কাবার্ড থেকে একটা প্যাকেট বের করে আরশির হাতে ধরিয়ে দিল। আরশির বাহুতে হাত চেপে কুঁচকে যাওয়া ললাটের অধর ছুয়ে দিয়ে বলে,

-” আমি তো চলে যাচ্ছি পাগলী, নিজের যত্ন নিস।”
ব্যাথার্থ স্থানে আঘাত পেতেই আরশি নেতিয়ে পড়লো। বাহু চেপে ঠোঁট উল্টে কেঁদে দিল। তারুন্য আরশির ব্যাথায় ব্যথিত হলো। নম্র স্বরে বলে, “কি হয়েছে?” আরশি নিরব বচ্ছিত ভঙ্গিতে জবাব দেয়।
-“স্যার আজকে আমার এখানে মেরেছে। (হাত বাহুতে চেপে বলে)

শার্টের হাতা নামিয়ে স্থানটায় দৃষ্টি মেলাতেই তারুণ্যের মুখশ্রী ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। অন্তর্ভাগে ক্ষোভ চেপে স্বাভাবিক ব্যবহার করে। ফাস্ট এইড বক্সের সাহায্যে স্থানটা ব্যান্ডেজ করিয়ে দেয়‌। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসে।
-” আমার অনুপস্থিতিতে-ও আমার আরুর দিকে দেখার সাহস না থাকে এমন ব্যবস্থা করে যাবো‌।”
-“ঝারু ভাইয়া। (তারুণ্যের দিকে চেয়ে কথা ঘুড়িয়ে বলে)
তারু ভাইয়া, তুমি কি কারেন্ট দিয়ে তৈরি? তুমি আমাকে ছুলেই মনে হয়, আমি শকড্ খাই।

নিদ্রায় আচ্ছন্ন অপূর্বের আরশির কথা শ্রবণগোচর হতেই শব্দ করে হেসে উঠলো। হাঁসতে হাঁসতে এক পর্যায়ে চোখ মেলে তাকালো। ভঙ্গ হলো নিদ্রা। ঘুমের মাঝে অপূর্ব পূর্বের দিনগুলো থেকে ঘুড়ে এসেছে। স্বপ্ন দেখেছে সেই দিনগুলো। হাই তুলে উঠে বসলো সে। হেলতে হেলতে এগিয়ে গেল বন্ধ কাবার্ডের সমুখে। সেদিনের সাদা রঙের শার্টটা বের করে চেয়ে রইল। সেখানে দুইজন মানুষের রক্ত একত্রে শুকিয়ে আছে। রক্ত গুলো কুচকুচে কালো হয়ে গেছে।

চোখ ঝাঁপসা অপূর্বের। তার কাঁধে হাত রাখলো কোনো অপরুপ সুন্দর রমনী। দৃষ্টি সরিয়ে চাইলো। আঁতকে উঠলো অপূর্ব। শ্বাস ভারী হয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। আওরাতে আওরাতে অধর নাড়িয়ে শব্দহীন উচ্চারণ করে,-” আভা।”
পরক্ষণেই বায়ু স্তরের সাথে হারিয়ে গেল। এদিক ওদিক অবলোকন করে তাকে খুঁজতে লাগলো। পশ্চাৎ থেকে মনকাড়া খিলখিল হাসি শব্দ কানে আঘাত হানলো। পরক্ষণে ফিরে চাইলো। কিন্তু অপরুপ সুন্দর রমনী আর অপরুপ নেই। গলার কাঁটা অংশ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পড়নে ওরনা বিহীন জামা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। মুখের অবস্থা বিবর্ণ।

দুহাতে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলো। এতে মেয়েটার হাসির শব্দ আরো জোড়ালো হলো।
কথায় আছে না, যত হাঁসি তত কান্না। অতিশয় হাসতে হাসতে একসময় ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠে,
-” অপূর্ব, এই অপূর্ব। আমাদের জীবনটা কেন এমন হলো। বেশি কিছু তো চাইনি, ছোট সুখের একটা সংসার চেয়েছিলাম।

তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারছো না, তাহলে চলো আমার সাথে।”
অপূর্ব মাথা নিচু করে রইল। হঠাৎ একটা চুরি এগিয়ে এলো তার দিকে। অপূর্ব পাশে সরে দিয়ে চিৎকার করে উঠল। মিনিট পাঁচেকের ভেতরে হুরমুড়িয়ে রুমে ঢুকলো গার্ডরা।
অপূর্বকে প্রায় প্রায়ই এমন করতে দেখা যায়। বিধায় তার কক্ষের প্রবেশদ্বার খোলাই থাকে।
অপূর্বের অনুমান হলো। সবাইকে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে। মেডিসিনের বক্স থেকে মেডিসিন বের করে দুটো ডরমিকাম বের করলো।‌ আধ গ্লাস পানির সাথে খেয়ে বিছানার এক পাশে সেঁটে শুয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে রাতগুলো এইভাবে ঘুমাতে হয় তাকে।

শীতের প্রতাপ হ্রাস পেয়েছে। পৌষ মাস শেষের দিকে। উত্তরের বাঁধ ভাঙা হাওয়ায় নিভু নিভু বয়ে চলেছে জানালা ভেতরে। অরিশ কিছু একটা হিসেব করে চলেছে। কিছুদিন পরে শিক্ষাসফরে বান্দরবান যাবে। অরিশ যেতে চাইনি। তরী আর আরশির জোড়াজুড়িতে যাবে। আগামী বর্ষে পড়াশোনার চাপ থাকায় আর যাওয়া হবে না। তাছাড়া কখনো যাওয়া হবে কি-না জানা নেই।

দরজায় নক পড়লো। অরিশ চশমার ফাঁক দায়ে আঢ় চোখে দেখলো। নিভ্রান এসেছে। তিল পরিমাণ না নড়ে বলে,
-“স্যার আপনি পড়ে আসুন। আমি একটু ব্যস্ত আছি!”
-” আর আসার দরকার নেই। আমি বলতে এসেছি, আপনার বোন কি জানো নাম। ও হ্যাঁ আরশি। সে কোথায় গেল না গেল আমার জানার দরকার নেই। তবে আমার উড-বি তরিন যাতে না যায়।”

অরিশের সবটা আগে থেকেই জানা ছিল। কলমটা খাতার ভেতরে রেখে একপাশে ঠেলে রাখল। হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলে, নিভ্রানকে। নিভ্রান অরিশের সামনের চেয়ারে বসে। অরিশ পেছনে পিঠ ঠেকায়‌ কপালের কোণে স্লাইড করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
-” কি বলছিলেন আপনি, মিঃ নিভ্রান। আপনার উড-বি তরিন। তরী সেটা শুনবে এবং মানবে, যেটা আমি বলবো।”
– “তরিনের ১৮ ছাড়িয়ে।”

-” সো ওয়াট, শুধু ১৮ কেন ৮০ ছাড়িয়ে গেলেও। আমি যা বলবো, তার এক চুল পরিমানও তরী অন্যথা করবে না।”
-” বলছি, ভাই ভাইয়ের মতো থাকলে হয় না।”
-” বাইরের লোক বাইরের লোকের মতো থাকলে হয় না। আমি ভেবেছিলাম, ওদের যেতে দিবো না, কিন্তু এখন আমি না চাইলেও ওদের যেতে হবে। দেখা যাক উড-বি্ কি করে। নাউ আউট..

অরিশ ঠেলে রাখা লিস্ট টা সামনে রাখল। মন স্থাপন করলো। নিভ্রান বুঝে গেছে, তার এখানে থাকা না একই। কিছু বিব্রত বোধ করলেন। অরিশের মুখপানে একবার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেগ হলেন। কিছুটা যেতেই অরিশ মাথা তুললো। ছোট ড্রয়ার থেকে কয়েকটা মার্বেল বের করে ছুঁড়ে দিলে নিচে।

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৭

মার্বেল গুলো গড়িয়ে পড়িয়ে নিভ্রানের পায়ের দিকে গেল। নিভ্রান পা রাখতেই আচম্চা মেঝেতে পড়ে গেল। মার্বেল গুলো দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না তার।
অরিশ জায়গা ছেড়ে উঠলো। গতিহীন পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে গেল। একহাটু ভাঁজ করে বলে,
-“আমার ডিঙিরানী দিকে হাত বাড়ানো তো দূরে থাক, তাকালে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে।”

অনুভুতির অন্তরালে পর্ব ১৯