শেষ থেকে শুরু পর্ব ২৬

শেষ থেকে শুরু পর্ব ২৬
লাবণ্য ইয়াসমিন

জ্ঞান ফিরে চোখের সামনে অনাকাঙ্খিত একজনের মুখটা দেখে হৈমন্তী অপেক্ষা করলো না মানুষটার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ফুপিয়ে উঠলো। হঠাৎ এমন ঘটনায় আবির ঘাবড়ে গিয়ে চোখ বড়বড় করে ফেলল।।দরজায় ওর সেক্রেটারি জাবেদ দাঁড়িয়ে ছিল। হৈমন্তী এমন করবে হয়তো ও বুঝতে পারেনি। তাই দ্রুত চোখ নামিয়ে সরে গেলো। এই মেয়েটাকে ও বছর খানেক আগে দেখেছিল তারপর নিখোঁজ। হঠাৎ এখানে কিভাবে আসলো বুঝতে পারছে না।

তাছাড়া বড়লোকদের মন মর্জি বোঝা খুব মুশকিল। জাবেদ কৌতূহল দমিয়ে বেরিয়ে আসলো। স‍্যার নিজে থেকে না বললে কিছুই জানা যাবে না। আবির চুপচাপ অনুভূতি শূন্য কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে। প্রথমবার মেয়েটা ওর এতোটা কাছে এসেছে। শুধু দূর থেকেই ভালোলাগা তারপর ভালোবাসা। কখনও ভাবেনি মেয়েটা ওর এতটা কাছে আসবে। বুক ধুকপুক করছে। অনাকাঙ্খিত একটা প্রাপ্তি। আবির নিজেকে সামলে নিয়ে হৈমন্তীর মাথায় হাত রাখলো। মেয়েটা এখনো কেঁদে কেটে অস্থির হচ্ছে। ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে হয়তো নিজের মধ্যে নেই। তাই এই দূরত্ব কমিয়ে আনা। নয়তো হৈমি কখনও নিজ ইচ্ছেতে আবিরের কাছে ধরা দিবে না আবির খুব ভালো করে জানে। আবিরের কাধের বেশ কিছু অংশ হৈমির চোখের পানিতে ভিজে গেলো। আবির ফিসফিস করে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

> কিছু হয়নি আমি আছি তো।
হৈমন্তী হঠাৎ ফুপানো বন্ধ করে দিয়ে হুট করে আবিরকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলো। এতক্ষণ কি করছিল ভেবে নিভে গেলো। হিতাহিত জ্ঞান ছিল না। মারিয়াম আন্টির খুনের দৃশ্যটা আজও চোখের সামনে ভাসে। আজ হঠাৎ সেদিনের মতো ভয় করছে। আবির কি বলবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটার সঙ্গে ওর খুব একটা কথাবার্তা হয়নি। কেমন গা ছাড়া ভাব ছিল। কিভাবে যে একে ভালোবেসে ফেলেছিল মাঝেমাঝে আফসোস হয়। মানুষের জীবনে প্রেম বারবার আসে কিন্তু আবিরের প্রেম কেনো হৈমন্তীকে ঘিরেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেলো এটার হিসেব মিলাতে পারেনা। হৈমন্তীর কথায় ওর ধ‍্যান ভাঙলো,

> বাসাই ফিরবো।
আবির ভ্রু কুচকে ঘড়ি দেখিয়ে বলল,
> একটা বাজে এখন রাস্তায় বের হওয়া যাবে না। অবরোধ চলছে। কি থেকে কি হয়ে যাবে তখন ঝামেলা হবে। তাছাড়া জান্নাত আছে আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইছি না।
জান্নাতের কথা বলতেই হৈমন্তী পাশে থাকা ঘুমন্ত মেয়েকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
> ওরা আমাকে মারতে চাইছে মিস্টার আবির। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি ওদের ক্ষোভের স্বীকার হয়ে যাবো। মেয়েটাকে দেখবেন।
হৈমন্তীর এমন কথায় আবিরের মেজাজ খারাপ হলো। রাস্তাঘাটে মেয়েদের এমন সমস্যা নতুন না। একা নির্জন রাস্তায় ঘুরাঘুরি করার সখ মিটে যেতো আবির একটু দেরী করলে। ফল কিনে আসার সময় হঠাৎ রাস্তাই চিৎকার শুনে কয়েকজন এগিয়ে আসে। আবিরও ছিল তাদের মধ্যে। মেয়েটাকে উদ্ধার করার পরে আবির বুঝতে পারলো এটা হৈমি। আবির গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> রাতে একা একা ঘুরছিলে কেনো?গাড়ি কোথায়? কিসের এতো কাজকর্ম করছো শুনি যে মেয়েকে ছেড়ে সারাদিন অফিসে থাকতে হয়। রাতে রাস্তায় হাঁটতে হয়? চাকরির খুব দরকার থাকলে অনেক জায়গা আছে। আমার অফিসে কাজ করতে পারো। রাজীব ভাইয়ার ব‍্যবসাতে হাত লাগাতে পারো। এতেও না হলে আলাদা জায়গাই জবের চেষ্টা করো। জীবন বাজি রেখে এসব করে কিসের লাভ?
আবির ঝাঝালো কণ্ঠে একদমে কথাগুলো বলে থামলো। হৈমি চোখ বন্ধ করে বলল,
> মিটিং ছিল। লোকগুলোর কথা আমি শুনেছি ওরা আমাকেই খুন করতে এসেছিল। ওখানে থাকতেও হয়েছিল। কাজটা আমি ভালোবেসে করি নিজের যোগ্যতাতে।
আবির বিস্তারিত শুনতে চাইলে হৈমন্তী ওকে সবটা খুলে বলল।সব শুনে আবির ভ্রু কুচকে বলল,

> কার সঙ্গে কি শত্রুতা তৈরী করেছো আল্লাহ্ ভালো জানে? ভালো কাজ তো পারো না।
আবির কথাটা বলে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। হৈমন্তী চুপচাপ বসে আছে। লোকটা ওর উপরে রাগ করছে কি বুঝতে পারলো না। যায় হয়েছে এতে কি ওর দোষ ছিল? হৈমন্তী প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করলো কিন্তু ভয় আর আতঙ্ক ছাড়া কিছুই পেলো না। এখনো বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। কথাটা ভাবতে ভাবতে মেয়েকে কোলের মধ্য নিয়েই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো হৈমি। আবির চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। মনের মধ্যে হাজারো চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। হৈমন্তীর এই শত্রুটাকে সনাক্ত করা অতী জরুরি কিন্তু কিভাবে? আবির ভাবতে ভাবতে উঠে আসলো। হৈমন্তীর কোল থেকে জান্নাতকে নিজের কাছে নিয়ে ওর গায়ে ভালো করে চাঁদর জড়িয়ে দিয়ে সোফায় ফিরে আসলো।

মেয়েকে বুকের উপরে নিয়ে আয়েশ করে শুয়ে পড়লো। আজকের রাতটা ওর ঘুম হবে না। রুমে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। হৈমির মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখদুটো লেগে আসলো। ভোরবেলা ফোনের শব্দে আবিরের ঘুম ভাঙলো। এখনো জান্নাত ওর বুকের উপরেই আছে। আবির হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে বলা একটা কথা ওর কানের মধ্যে বেঁজে উঠলো। হাত পা কাঁপছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনাতে হৃদয় ভেঙে খানখান হচ্ছে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে এটা বুঝি স্বপ্ন। আবির তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে হৈমীর কাছে রেখে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে সেক্রেটারি জাবেদকে রেখে গেলো হৈমন্তীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। জাবেদ যেতে চেয়েছিল কিন্তু আবির বাঁধা দিলো। ও একাই সামলে নিতে পারবে। জাবেদ চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে। একবার ভাবলো হৈমন্তীকে ডেকে তুলে দিতে কিন্তু আবিরের কড়া হুকুম ওকে জাগানো জাবে না। উপায়ন্তর না দেখে জাবেদ দরজার দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওর শাস্তি চলছে।

সকাল সাতটায় হৈমন্তীর ঘুম ভাঙলো। জান্নাত তখনও ঘুমে বিভোর। রুমে আবির নেই দরজা বন্ধ। সাত সকালে কোথায় গেলো লোকটা? কথাটা ভেবে ও দরজা খুলে উঁকি দিতেই জাবেদকে দেখতে পেলো। হৈমন্তী থতমত খেয়ে বলল,
> আপনি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন?
> স‍্যারের হুকুম।
> উনি কোথায়?
> হাসপাতালের মর্গে।
হৈমন্তী জাবেদে এমন ছন্নছাড়া কথায় আতঙ্কে চমকে উঠলো। মর্গের কথা শুনেই বুকের মধ্যে ছ‍্যাত করে উঠেছে। সুস্থ মানুষ মর্গে কেনো থাকবে বুঝতে পারলো না। ভয়ে শরীর কাঁপছে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> কার কি হয়েছে? উনি ঠিক আছেন? কখন গিয়েছেন? আমাকে ডাকেনি কেনো?

হৈমন্তী একদমে কথাগুলো বলে থামলো। ওর নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। হয়তো শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। জাবেদে ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। আবিরের সঙ্গে এই মেয়েটার সম্পর্ক ঠিক কেমন এটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। বিয়ের এতগুলো দিন মেয়েটাকে কখনও স‍্যারের সঙ্গে দেখা হয়নি। প্রথমদিন ভেবেছিল স‍্যার মেয়েটাকে জোরজবরদস্তি করেই বিয়ে করছে কিন্তু পরে ভেবেছিল স‍্যারের মতো মানুষ কখনও এমন করবে না। হয়তো কোনো কারণ আছে। জাবেদ সেসব জানতে চাইনি। ও শুধু আবিরের ভালো চেয়েছে। ছেলেটা বাবার মতোই ভালো মানুষ কিন্তু সেই মানুষতো আজ কোথায়? কথাটা ভেবে ওর চোখ দুটো আবারও ভিজে উঠলো। জাবেদকে চুপচাপ দেখে হৈমন্তী এবার শব্দ করে বলল,
> আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমি টেনশন করছি।
জাবেদ মাথা নিচু করে বলল,

> স‍্যারের বাবা গতকাল রাতে মারা গেছেন। অনুমান করা হচ্ছে এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না মার্ডার। রুমে সিসি ক‍্যামেরা ছিল সেটা গায়েব। পুলিশ এসেছিল লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে গেছে। স‍্যার সকালবেলায় বাড়িতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে হাসপাতালে আছেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনার জন্য স‍্যার আমাকে যেতে দেয়নি। আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি স‍্যারের কাছে যাবো।
জাবেদ শেষের কথাগুলো কেমন ধারা গলাই বলল। হৈমন্তী এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। আবিরের জন্য ভালোবাসা নাকি একজন বাবা হারা সন্তানের জন্য কষ্ট হচ্ছে হৈমন্তী বুঝতে পারছেনা। ওর বুক ফেঁটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ও সত্যিই কুফা। ছেলেটার জীবনে আসা মাত্র অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। গতকাল যদি ও বাড়িতে থাকতো তাহলে এমন কিছুই হতো না। শুধু ওর জন‍্যই এসব হচ্ছে। হৈমন্তী পুরদমে দোষটা নিজের উপরে চাপিয়ে দিলো। জাবেদ হৈমন্তীর কান্না দেখে বলল,
> ম‍্যাডাম বাসাই ফিরবেন না? চলুন।
হৈমন্তী উত্তর করলো না। দ্রুত রুমে গিয়ে জান্নাতকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। জাবেদ ওর পিছনে পিছনে গাড়িতে গিয়ে বসলো। হৈমন্তী চোখের পানি মুছে বলল,

> দ্রুত হাসপাতালে চলুন প্রশ্ন করবেন না।
জাবেদ বাধ্য হলো হৈমন্তীকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘুরাতে। মনিবের কথা মানতে ও বাধ্য। হাসপাতালে যেতে ওদের পনেরো মিনিট সময় লাগলো। হৈমন্তী হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে মর্গের দিকে ছুটলো। আবির বাইরে একটা চেয়ারে মুখ ঢেকে বসে আছে। শরীর মাঝেমাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার ভেতরে ঢুকেছে। একেতো বাবার অকাল মৃত্যু তারপর আবার ময়নাতদন্তের জন্য কাটাছেড়া। কিভাবে সহ‍্য করবে?মাথায় উপরে থাকা বাবা নামক বৃক্ষটার আজ শরীল সমাধী হলো। ভেবেছিল এবার বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবার বয়সও তেমন খুব বেশি ছিল না। আবিরের রাগ হচ্ছে নিজের উপরে। ইচ্ছা করছে নিজেই নিজেকে শেষ করে ফেলতে। কেমন ছেলে সে যে বাবাকে বাঁচাতে পারলো না। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ায় সবথেকে বড় ভূল হয়েছিল। হয়তো উনি কিছু জানতেন তাই মুখ বন্ধ করতে খুনীরা এমনটা করলো। হৈমন্তী মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে আবিরের পাশে ফ্লোরে ধুপ করে বসে পড়লো। শব্দ শুনে ও পাশে তাকিয়ে হৈমন্তীকে দেখে ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়েটা ওর জন্য কাঁদছে কিন্তু কেনো? ভালোবাসা ছাড়া করুনা খাপছাড়া সহানুভূতি দিয়ে আবির করবেটা কি? নারী মানেই নিজেকে বিসর্জন দিয়ে পরের কথা ভাবা না। আবির চোখের পানি মুছে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

> কাঁদছো কেনো? ওকে নিয়ে ফিরে যাও।
হৈমন্তী কিছুই বলছে না নিচের দিকে তাঁকিয়ে চোখের পানি ফেলছে। দৃশ্যটা আবিরের কাছে খুব তিক্ত লাগলো। ও ঝট করে উঠে চলে গেলো। এভাবেই অনেকখানি সময় পার হলো। আরাফাত এসেছে হাসপাতালে। হৈমন্তী দ্রুত নিজেকে ঠিক করে ফেলল। আরাফাত ভ্রু কুচকে বোনকে দেখছে। গতকাল অফিসের কাজে আটকে গিয়েছিল কিন্তু এখানে কি করছে বুঝতে না পেরে বলল,
> তুই এখানে?
হৈমন্তী ফুপিয়ে বলল,
> জান্নাত মিস্টার আবিরের কাছে ছিল।

আরাফাত বুঝতে পারলো হৈমন্তী জান্নাতকে নিতে এসে এই অবস্থা দেখে ভয় পেয়েছে। ও আর প্রশ্ন করলো না। লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। আরাফাত সব ব‍্যবস্থা করেছে। হৈমন্তীকে চলে যেতে বলা হলো কিন্তু ও গেলো না। আরাফাতের সঙ্গে আবিরদের বাড়িতে এসে হাজির হলো। বাসা থেকে ছোট বড় সবাই এসেছে। আমেনা বেগম পযর্ন্ত আবিরদের বাসাই হাজির। হৈমন্তীর এমন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে চয়নিকা এগিয়ে গেলো। জান্নাত আরাফাতের আছে ছিল চয়নিকা যেতেই ওর কোলে তুলে দিয়ে চলে গেলো। অরিন চিৎকার করে কাঁদছে। বাবার জন্য একটা বছর ওর হাসপাতালেই কেঁটেছে কখনও আফসোস করেনি।

শুধু ভেবেছে বাবা ঠিক হয়ে গেলে আবারও সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে কিন্তু তেমন কিছুই তো হলো না। আবির ছেলে মানুষ চিৎকার করতে পারছে না কিন্তু চোখের পানি বাধ ভাঙেছে। মা বোনের দিকে তাকালে পৃথিবীর ধবংস করে ফেলতে মন চাইছে। প্রশ্ন ঘুরছে কার জন্য এমন হচ্ছে নিজের জন্য নাকি অন‍্য কারো জন্য? আবির ভাবতে পারলো না। বাবার খাটিয়ার পাশে বসে ছিল এসব ভেবে আস্তে করে পাশে ঢোলে পড়লো। আরাফাত আর রাজীব দৌড়ে গিয়ে ওকে সরিয়ে নিলো। পরিবারিক ডাক্তার বাড়িতেই ছিল উনি গিয়ে দেখলেন। ফারজানা হক স্বামীর হাত ধরে বসে আছেন। কয়েকঘন্টা চিৎকার করে কেঁদেছেন গলা বসে গেছে। শব্দ বের হচ্ছে না। ফ‍্যাল ফ‍্যাল করে মৃত স্বামীকে দেখছেন। কত বছরের সংসার কত স্মৃতি সব এক নিমিষেই শেষ। মৃত্যুতে কি ভালোবাসা শেষ হয়? এতো আবেগ অনুভূতি কোথায় যায়? হৃদয় নামক অদৃশ্য বস্তুটির অস্তিত্ব কি শরীরের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যায়?

বাবার কবরের পাশে বসে আছে আবির। সবাই চলে গেছে ও যেতে পারেনি। হাতে হাত রেখে পথ চলা শিখিয়েছিল সেই লোকটা আজ অতীত। বাবা নেই এতিমের সীলমোহর গায়ে লেগে গেছে। আবির মুঠো শক্ত করে ভাবলো যেই এসব করে থাকুক ও কাউকে ছাড়বে না। এভাবে বসে থাকলে তো চলবে না। রুমের সিসি ক‍্যামেরা কে খুঁলেছে জানতে হবে। তাছাড়া রুমে যে ক‍্যামেরা আছে এটা ও ছাড়া কেউ জানতো না তাহলে করলোটা কে? বাড়িতে আরশী ফারজানা হক আর কাজের দু একজন মানুষ ছিল। এর বাইরে কে এসেছিল? আবির দ্রুত উঠে বাড়ির পথ ধরলো।
আমেনা বেগম ফারজানা হকের পাশে বসে নানারকম কথাবার্তা বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সবাইকে যেতে হবে কেউ আগে আর কেউ পরে। এরকম বেশ কিছু কথা বলে ফিসফিস করে বললেন,

> আপা একটা কথা বলি মন দিয়ে শুনেন। আপনি একা বাড়িতে থাকেন। সব সময় মন খারাপ হবে তার চাইতে ছেলের একটা বিয়ে দেন। বয়সতো কম হলো না। মেয়েতো দেখলাম আপনার ঘরেই আছে। কি সুন্দর অতিথিদের সেবাযত্ন করছে চোখ জুড়িয়ে গেলো। বউ শাশুড়ি মিলেমিশে থাকেন দুদিন পরে সদস্য বাড়বে সংসার ভরে উঠবে।
ফারজানা হক উত্তর করার অবস্থায় নেই তবে আমেনা বেগমের কথা ফেলে দিতে পারছেন না। এবার সত্যিই ছেলের একজন জীবন সঙ্গী দরকার। ছেলেটা বাবার জন্য ভেঙে পড়েছে ওকে সামলানোর জন্য হলেও দরকার। কথাগুলো ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আত্মীয়স্বজন সবাই চলে গেলো কিন্তু হৈমন্তীদের বাড়ির কেউ ফিরতে পারলো না। এই কঠিন সময়ে আত্মীয়দের পাশে না থাকলে আবার কেমন আত্মীয়। তাছাড়া অরিনের বেশ কাহিল অবস্থা। কেঁদেই যাচ্ছে। আরাফাত ওকে জোর করে রুমে নিয়ে গেলো। গোসল করেছে কিন্তু খাওয়া হয়নি। বাইরে হৈমন্তী আর চয়নিকা বসে আছে। হৈমন্তীর এলোমেলো চুল মুখটা মলিন হয়ে আছে মনে হচ্ছে ওর উপর দিয়ে ঝড় চলে গেছে।মনের মধ্যে কিছু একটা খেচুরি পাকিয়ে ফেলেছে।

আবির গোরস্থান থেকে ফিরে বাড়ির গেটের সামনে আসতেই দারোয়ান ওর হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ আগে পিয়ন এসে দিয়ে গেছে। চিঠি পড়ার মতো ইচ্ছে নেই ওর তবুও হাটতে হাটতে চিঠিটা খুলে চোখের সামনে তুলে ধরলো। চিঠি না কয়েক লাইনের একটা ধাঁধা নাকি কবিতা বুঝলো না। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
” ছায়া শূন্য মস্তক, আর প্রেয়সী শূন্য হৃদয়।
শুকিয়ে যাবে অনুভূতি,জাগিয়ে তুলবে সহানুভূতি। এক প্রান্তে হাহাকার অন‍্য প্রান্তে উল্লাস।”
আবির বুঝতে পারলো না এটা ওকে কে পাঠিয়েছে। খামে প্রেরকের নাম ঠিকানা কিছু দেওয়া নেই। আবির হাতের মুঠোয় চিঠিটা পুরে নিয়ে হঠাৎ থেমে গেলো। আবারও কাগজটা চোখের সামনে তুলে ধরলো। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে মুঠো শক্ত করলো। পরের আক্রমণ কার উপরে আসবে বুঝতে ওর একটুও অসুবিধা হচ্ছে না। আবির হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে চলে আসলো। ডাইনিং রুমে হৈমন্তীর সামনে গিয়ে থামলো। গম্ভীর কন্ঠে আস্তে করে বলল,

> এখনো বসে আছো? হৈমি তুমি তো এমন ছিলে না? লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমার সামনে বসে আছো। প্লিজ একটু শান্তি দাও। বাবা নেই সেই কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তারপর আবার তুমি চোখের সামনে ঘুরছো আমি সহ‍্য করতে পারছি না। আমাকে একটু দয়া করো প্লিজ। তোমার মুখ দেখতে চাইছি না।
আবির আর দাড়ালো না। হন্তদন্ত হয়ে উপরে গিয়ে ধপাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। হৈমন্তীর চোখ থেকে আপনা আপনি কয়েক ফোঁটা পানি বেয়ে পড়লো। হৈমন্তীর নিজেকে ছোট ছোট মনে হচ্ছে। সত্যিই বেহায়া হয়ে গেছে কিন্তু ওতো এমন ছিল না। এখানে থাকা যাবে না। কথাটা ভেবে মেয়েকে তুলে নিয়ে সোজা রাজীবকে বলল বাড়িতে যাবে। এখানে ভালো লাগছে না। ঘুমানোর দরকার। রাজীব কিছু বললো না। বোনকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসলো সেই সঙ্গে আমেনা বেগম ও আসলো। চয়নিকা আর রনি থাকলো। রাজীব ওদেরকে বাড়িতে রেখে আবারও আসবে।

এভাবেই দুদিন পার হলো। আবিরের খোঁজখবর নেই। না জান্নাতকে নিতে আসলো না ওর খোঁজ নিলো। আরাফাত অরিনের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছে। চয়নিকা বাড়িতে ফিরে এসেছে। মোটামুটি সব আগের মতো। তবে যার প্রিয়জন হারিয়েছে সেই বুঝবে যন্ত্রণা। হৈমন্তী কাজের ছুটি নিয়েছিল দুদিন। ছুটি শেষ মেয়েকে চয়নিকার কাছে রেখে বের হলো। সঙ্গে নিতে চেয়েছিল কিন্তু চয়নিকা দিতে চাইনি। রনির সঙ্গে জান্নাতের বেশ ভাব হয়েছে। দুটো সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। তাছাড়া মেয়েটা বেশি বিরক্ত করে না। হৈমন্তী ভাবিকে ভরসা করে। তাই শান্তিতে কাজকর্ম করছে। আবিরের উপরে চাপা অভিমানটা আরও গাঢ় হয়েছে। ছেলেটার কথা ভাববেনা বলেও ভেবে ফেলছে আজকাল। মাথা ঠিক ছিল না কি বলতে কি বলছে সেটা ধরে বসে থাকলে চলবে না। আজকে বাড়িতে ফিরে ফোন করবে ভাবলো। হঠাৎ মেহুল ডাকে ওর ধ‍্যান ভাঙলো,

শেষ থেকে শুরু পর্ব ২৫

> হৈমন্তী তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
হৈমন্তী ফাইল চেক করছিল। ওর কথা শুনে মাথা তুলে তাঁকালো। মেয়েটার মখটা মলিন হয়ে আছে। চোখের নিচে কালো হয়ে আছে। রাতে ঘুম হয়নি বুঝতে পারলো। হৈমন্তী ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> হুম আপু বলো।
> আমি আবিরকে ভালোবাসি। আবির ও আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছিল হঠাৎ কি হলো জানিনা। ও আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
মেহুলের কথা শুনে হৈমন্তীর হাত থেকে কলমটা খপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলো।

শেষ থেকে শুরু পর্ব ২৭