অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১০ || Ishita Rahman Sanjida

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১০
Ishita Rahman Sanjida

বাতাস যেন ভারি হয়ে গেছে। তাই বোধহয় ইফাজের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে ইফাজ। বায়ুতে কি কার্বনডাই অক্সাইড ভরে গেছে নাকি??না গাছগুলো অক্সিজেন দিচ্ছে না। বোধহয় গাছগুলো ইফাজের ত্যাগ করা কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করছে না। তাই বিষাক্ত গ্যাস ইফাজের কাছেই ফিরে যাচ্ছে। এজন্য বোধহয় ইফাজের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কথায় আছে না রিভেঞ্জ অফ নেচার। সেটাই হচ্ছে।
বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করছে খুব। সোফার একপাশে বসে আছে ইফাজ আর ইশান দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে বসে আছে।জাফর খান আর রেহানা বেগম ও সেখানে উপস্থিত। ইফাজের মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে ইফাজ মুখ খুলল,’আমি যেদিন পিহুকে ছেড়ে চলে এসেছিলাম তার পরেরদিন পিহু আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেটা কি তোমরা জানতে??’
ইফাজের কথায় থতমত খেয়ে গেল জাফর খান। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করছে ইফাজ??আর এসব জানলো কিভাবে ইফাজ??কে বললো তাকে??বাবা মায়ের উওর না পেয়ে আবারো ইফাজ বলল,’কি হলো বলো??’

জাফর সাহেব আমতা আমতা করে বলল, ‘তোমাকে এসব কে বলেছে??’
ইফাজ আবারো শান্ত গলায় বলল,’আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উওর দাও আগে।’
‘আমি কিভাবে বলবো??আমি কি জানি নাকি??’
ইশানের এবার রাগ হলো উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত দাদুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,’এবার তো অন্তত সত্যি কথা বলো দাদু??শেষ বয়সে এসে মিথ্যা কেন বলছো?? তোমাদের বলা কিছু মিথ্যার জন্য আমাদের জীবন থেকে এতগুলো বছর চলে গেছে। একটাবার তা ভেবে দেখেছো??’
জাফর সাহেব চুপ করে গেলেন। ইফাজ তার বাবার দিকে বলল,’সেদিন যদি তোমরা পিহুর কথা আমাকে জানাতে তাহলে আমি তোমাদের হাতছাড়া হয়ে যেতাম তাই না?? আমাকে তোমরা আর পেতে না??’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এবারও তারা চুপ করে রইলো। ইফাজ আবারো বলল,’তোমাদের কাছে আমাকে রাখার জন্য কতগুলো মানুষের কাছে আমাকে খারাপ বানিয়ে দিলে তোমরা। নিজের ছেলের সুখ কেড়ে নিতে একটুও দ্বিধা বোধ করেনি তোমাদের?? তোমরা পিহুকে কেন মেনে নিতে পারছো না??ও গরিব বলে??এই পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে যারা টাকা পয়সার দিক থেকে ধনী কিন্তু মনের দিক থেকে সে গরিব। সেভাবে বলতে গেলে পিহু তোমাদের থেকে অনেক ধনী। তাহলে কেন তোমরা পিহুকে মানতে পারলে না?? তোমরা ইশানের থেকে তার মাকেও কেড়ে নিয়েছো। ছেলেটা কিভাবে বড় হয়েছে তা তো নিজের চোখেই দেখেছো। তখন ও কি তোমাদের এসব মনে হয়নি??’

ইফাজ থামলো। তার চোখে পানি চিকচিক করছে। সে একটু দম নিয়ে আবার বলল, ‘আমি এতদিন কিভাবে কাটিয়েছি তা দেখোনি তোমরা??বাবা মা তো সন্তানের সুখের জন্য স্বার্থপর হয়। তাহলে তোমরা কেন নিজেদের সুখের জন্য স্বার্থপর হলে?? আচ্ছা মা তুমি একটা কথা বলো তো, সেদিন ডিভোর্স পেপার আমাকে দিয়ে বলেছিলে যে পিহু পাঠিয়েছে। কিন্তু আদৌ কি পিহু সেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছিলো??’

রেহানা বেগম এবার ঘাবড়ে গেলেন। শরীর থেকে তার ঘাম ছুটতে লাগলো। ইশান নিজের মুখ ঘুরিয়ে ফেলেছে। ছোট থেকেই সে তার দাদিকে দেখতে পারে না। বড্ড বেশি কথা বলতেন তিনি। সবসময় পিহুর নামে বাজে কথা বলতো। তখন ইশান ওর মাকে ঘৃণা করলেও ওর দাদির মুখ থেকে ওসব কথা শুনতে ভালো লাগতো না। তাই ইশান ওর মুখটা ঘুরিয়ে ফেলেছে। রেহানা বেগমের চুপ থাকা দেখে ইফাজ ধমকে উঠে বলল,’চুপ করে আছো কেন তোমরা?? সত্যিটা বলো??’
ছেলের ধমকে রেহানা বেগম চমকে উঠলো।মুখটা কাচুমাচু করে বলতে লাগলো,’হ্যা পিহু এসেছিল ওইদিন। আমরা সেদিন ওকে ভেতরে আসতে দেইনি। দারোয়ানকে দিয়ে বলিয়েছিলাম যে আমরা সবাই লন্ডন চলে এসেছি। আররর,,,’

রেহানা বেগম থামতেই ইফাজ রাগি কন্ঠে বলে উঠলো,’আর কি??’
‘পিহু তোকে ডিভোর্স পেপার পাঠায়নি। আমি আর তোর বাবা মিলে পেপার রেডি করে তোর কাছে নিয়ে যাই আর বলি যে পেপারটা পিহু পাঠিয়েছে। নাহলে তুই সাইন করতি না। তুই যাতে আমাদের ছেড়ে পিহুর কাছে না থাকিস সেজন্য আমরা,,,,,,’
ইফাজ রেগে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,’ছিঃ তোমাদের কে আমার বাবা মা ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে। এত বড় প্রতারণা করলে আমার সাথে?? তোমাদের তো মানুষ বলে গন্য করা যায় না। আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি বলো। নিজের সন্তানের শান্তি তো সব বাবা মা চায় তাহলে তোমরা কেন চাইলে না??’

উত্তেজিত হয়ে ইফাজ সামনে থাকা টি টেবিলে সজোরে লাথি মারলো। টেবিলটা সাথে সাথেই উল্টে গেল। ইশান দৌড়ে গিয়ে ইফাজকে ধরে বলল,’আব্বু রিল্যাক্স। অনেক হয়েছে আমাদের ও অনেক ভুল হয়েছে। আমাদের আম্মুর কাছে যাওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস আম্মু আমাদের ক্ষমা করবে।’
ইফাজ অশ্রুসিক্ত নয়নে ইশানের দিকে তাকিয়ে বলল,’পিহুর কাছে আমি খারাপ হয়ে গেছি ইশান। ও কোনদিন ও আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না। আমি তো নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’

ইশান কিছু বলল না। ওর নিজের ও কষ্ট হচ্ছে। নিজের মা’কে কিভাবে অবিশ্বাস করলো সে??দোষ তো ওরও আছে। ইফাজ নিজের রুমে চলে গেল। ইশান ওর দাদা আর দাদির দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। এখন ওর মীরাকে খুঁজতে হবে। এতদিন পর মীরাকে পেয়ে সে হারাতে পারবে না। তাই ইশান গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। ইশান সোজা জিনিয়ার বাড়িতে গেল। জিনিয়া দরজা খুলতেই দ্রুত ভেতরে ঢুকলো। সিঁড়ি ভেঙে উপরে গিয়ে মীরার রুমে গেল কিন্তু মীরা সেখানে নেই। ইশান জিনিয়াকে জিজ্ঞাসা করল,’হয়ার ইজ মীরা??’

জিনিয়া অবাক হয়ে গেল। ইশান কেন মীরার খোঁজ করছে অদ্ভুত তো??ইশান আবারও জিজ্ঞেস করতেই জিনিয়া বলল,’সি উইন্ট টু হার ফ্রেন্ডস হোম।’
ইশান বতিব্যস্ত হয়ে বলল,’ডু ইউ নো হার ফ্রেন্ডস হোম এড্রেস??’
‘আই ডোন্ট নো বাট হোয়াট উইল ইউ ডু নোয়িং অল দিস??’
ইশান জিনিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে জিনিয়াকে বলে গেল মীরা এলে যেন ওকে ফোন করে জানায়।

মীরা আর সাবরিন একটা রেস্তোরাঁয় বসে আছে। দুজনে আজকে একসাথে লাঞ্চ করেছে আর এখন ডিনারে এসেছে। ডিনার শেষে সে বাড়িতে ফিরবে। সাবরিনকে একে একে সব ঘটনা খুলে বলেছে মীরা। সাবরিন চিন্তিত হয়ে বলল,’তার মানে ইফাজ খান হলো সেই ব্যক্তি যার খোঁজে তুমি লন্ডন এসেছো??’
‘হুম!!’
‘তুমি তো শুরুতে আমাকে কিছু বলো নি তাহলে ওদের আরো আগেই খুঁজে পেতে।’
‘আমি তোমাকে প্রেসার দিতে চাইনি। তোমার অফিস ছিল তাই। আমি কিভাবে জানবো যে তুমি ইফাজ খানের কম্পানিতে জব করো!!’
‘সেটাও ঠিক। তাহলে এখন কি করবে??’
মীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’বিডিতে ফিরে যাবো। এখানে আমার কাজ শেষ।’
‘আর কটা দিন থেকে গেলে ভালো হতো।’

‘আমি আর এখানে থাকতে চাই না। এখানে থাকলে ইশানের মুখোমুখি হতে হবে। ওকে দেখে আমার সুবিধার মনে হচ্ছে না। আবার কখন হুট করে চলে আসে কে জানে??’
মীরার কথা শুনে সাবরিন হাসলো বলল, ‘ইশানকে তোমার কেমন মনে হয়??’
মীরা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,’কেমন মনে হবে??যাকে ঘৃনা করি তার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার।’
সাবরিন হেসে বলল,’তোমার মুখ থেকে যা শুনলাম তাতে বুঝতে পারছি তোমার প্রতি ইশানের ইন্টারেস্ট আছে।’
‘তাতে আমার কিছু যায় আসেনা।’
‘হুমম,এবার দেখো কি হয়??’
‘কিছু হবে না।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইফাজ। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখ বারবার ভিজে আসছে আর সে বারবার মুছছে। সে সত্যিই পিহুর সাথে অন্যায় করেছে। মীরা ঠিকই বলেছে ওর সেদিন পিহুর পাশে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু ও তো পিহুকে ভুল বুঝে চলে এলো। নিজের বাবা মায়ের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে এখন। তারা কেন এসব করলো। নাহলে তো পিহু আর ইফাজের জীবনটা সুন্দর হতো। সুন্দর একটা সংসার হতো ওদের। সতের টা বছর কেড়ে নিলো ওর বাবা মা। ইফাজ পকেট থেকে পিহুর দেওয়া চিঠিটা বের করলো। এই চিঠিতে পিহু তার সকল রাগ অভিমান কষ্ট তুলে ধরেছে। সকাল থেকে অনেক বার এই চিঠিটা পড়েছে সে। নেহালের চিঠি পড়ে সন্দেহ হলেও পিহুর চিঠিটা পড়ে ইফাজের বুকে ব্যথা করছে খুব।সে আবারো চিঠিতে চোখ বুলায়।

প্রিয় ইফাজ,
আমি জানি তুমি ভালো নেই। তোমার ভালো থাকার কোন প্রশ্নই আসে না। আমাকে ছাড়া তুমি ভালো থাকতেই পারো না। কিন্তু তোমার ভালো থাকার চেয়ে তুমি তোমার জেদটাকেই বড় করে দেখলে। একটা ভুলের জন্য আমাকে হারালে সাথে সতেরটা বছর। আমি কেমন আছি সেটা বলবো না। বলার প্রয়োজন বোধ ও করি না। জানি তুমি ভালো নেই তারপরও জিজ্ঞেস করছি, কেমন আছো??
সেদিন চলে যাওয়ার পর আমাকে তোমার একটুও মনে পড়েনি??আমি কি বোকা??এসব কি বলছি তোমাকে??মনে পড়লে কি আমাকে ছেড়ে যেতে?? একসাথে সারাজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করে চলে গিয়েছিলে তুমি। তাহলে কি তোমার ভালোবাসা কম ছিল নাকি আমার ভালোবাসার কোন ত্রুটি ছিলো?? একটিবার আমাকে জিজ্ঞেস করার কোন প্রয়োজন মনে করোনি তুমি।

বিয়ের পর যখন প্রথম এই বাড়িতে এলাম তার পরেরদিন মুষল ধারে বৃষ্টি পড়ছিল। তুমি সেদিন আমাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিলে। আমার এখনও সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন তুমি বলেছিলে জীবনের সবকটা বর্ষাকালে ঠিক এভাবেই ভিজবে আমার সাথে। অথচ জীবন থেকে সতেরটা বর্ষাকাল চলে গেল তোমার দেখা নাই। তাই আর বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি। জীবনের সব ফাল্গুন একসাথে পার করার ইচ্ছা ছিলো, শীতের কুয়াশামাখা ভোরে দু’জনের দূর অজানায় হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো, বসন্তের কোকিলের ডাকটা তোমার সাথে থেকে শোনার ইচ্ছা ছিলো,ছাদে দাঁড়িয়ে তোমার কাধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে জোৎস্না বিলাস করার ইচ্ছা ছিলো বহুদিন পর্যন্ত। কিন্তু আমার এই ইচ্ছাগুলো বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

হঠাৎ করে আকাশ থেকে চাঁদটা হারিয়ে গেল শুধু পড়ে রইলো তারাগুলো। আকাশে হুট করে কালো মেঘ জমে উঠলো। চারিদিকে দমকা হাওয়া বইতে লাগলো একসময় একটা ঝড় এসে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে গেল। সতের বছর ধরে ঋতু পরিবর্তন হলো ঠিকই কিন্তু আমার জীবনের কোন পরিবর্তন হলো না। আমি ভাবতাম আমিই বুঝি তোমার প্রিয়জন। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি অনেক আগেই আমি তোমার প্রিয় থেকে অপ্রিয় হয়ে উঠেছি।

জানো আমি অপেক্ষা করতাম যে একদিন তুমি আসবে কিন্তু না আমার অপেক্ষা করে কোন লাভ হলো না তুমি এলে না। তাই এখন বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করা ছেড়ে দিয়েছি। এখন শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছি। মৃত্যুই তো এখন আমার শেষ পরিণতি। কিন্তু আমার অনুরোধ আমার মৃত্যুর পর আমার ইশানকে নিয়ে একবার এসো। আমার কবরে মাটি দিতে। তাহলেই আমি খুশি হবো। আমার রাগ অভিমান তখন ধুয়ে মুছে যাবে। তোমার প্রতি যে আমি খুব দূর্বল। রাগ করে বেশিদিন থাকতেই পারি না। অথচ তুমি রাগ করে এতো গুলো বছর কাটিয়ে দিলে।

অনেক বেশি লিখে ফেলেছি তাই না। তোমার পড়তে নিশ্চয়ই বোরিং লাগছে?? আর লিখলাম না।
তবে শেষ বারের মতো একটা কথাই বলতে চাই, সাথে যখন থাকবেই না তখন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কোন দরকার ছিলো না। মানুষকে মিথ্যা বলে হাসানোর চেয়ে সত্যি বলে কাঁদানো ঢের ভালো।
ভালো থেকো আর ইশানের যত্ন নিও।
ইতি
তোমার অপ্রিয় সেই প্রিয়জন,,,,,,,,,,,,
চিঠিটা ভাঁজ করে আবার পকেটে পুরে রাখলো ইফাজ। ওর আকাশেও যে চাঁদ নেই।দূর অজানায় হারিয়ে গেছে।

মীরার বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত দশটার বেশি বেজে গেল। ক্যাব থেকে নেমে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হয় জিনিয়ার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মীরা হাঁটছে আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। মীরা ভাবছে জিনিয়া নিশ্চয়ই বাড়িতে নেই। বারে গিয়ে নাচানাচি করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বোধ হয়। এসব ভেবে মীরার আবার রাগ হলো। এই মেয়েটা কি কোনদিন শোধরাবে না?? বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কেউ একজন মীরার নাম ধরে ডাকলো। মীরা ঘাবড়ে গেল এতরাতে কে তাকে ডাকবে???ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই মীরা আবার রেগে গেল। ইশান ডেকেছে মীরাকে। এতক্ষণ সে মীরার জন্য অপেক্ষা করছিল। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। মীরা অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল বিধায় ইশানকে দেখতে পায়নি। ইশান মীরার আরেকটু কাছে আসতেই মীরার চোখমুখ শক্ত হয়ে এলো।

ইশান মীরার রাগ বেশ বুঝতে পারছে। সে অত্যন্ত নরম গলায় বলল,’মীরা আমার তোর সাথে কথা বলা জরুরী। প্লিজ চলে যাস না।আই প্রমিস বেশিক্ষণ সময় নেব না।’
মীরা ঘাড় বাঁকিয়ে হাসলো বললো,’আপনার মুখে এতো নরম কথা যে মানায় না। এর আগেই ঠিক ছিলেন হঠাৎ করে কি হলো বুঝলাম না??’
ইশান চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো তারপর বললো,’মীরা আমি জানি আম্মু কোন দোষ করেনি। সব দোষ আমার আর আব্বুর কিন্তু বিশ্বাস কর আব্বু আর আমি পরিস্থিতির শিকার। আমরা জানতাম না যে আম্মু ডিভোর্স লেটার পাঠায়নি এমনকি আম্মু যেদিন ওই বাড়িতে এসেছিল তাও আমাদের জানানো হয়নি। এরপরও আমরা দোষী। প্লিজ আমাকে আম্মুর ঠিকানা বল। আই সোয়্যার আমি আম্মুর কাছে ক্ষমা চাইব। আম্মু নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করবে।’

ইশানের কথা শুনে মীরা মনে মনে বলল,’এজন্যই তো মনি’মায়ের কাছে তোমাদের যেতে দিব না। আমি চাই তোমাদের মতো ঘৃণ্য ব্যক্তিদের মনি’মা কখনোই ক্ষমা না করুক।’
কিন্তু মীরা মুখে বলল,’আপনার মোলড্রামা শেষ হলে আসতে পারেন। আমি ভিশন টায়ার্ড। আপনার বাজে বকবক শুনতে আমার ইচ্ছা করছে না।’
ইশান অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,’মীরা,,,,,’
‘বিশ্বাস করুন আমার নামটা যতবার আপনার মুখে শুনি ততবার আমার গা ঝিমঝিম করে ওঠে। একটা ঘৃন্য মানুষের মুখে আমার নাম মানায় না। তাই দয়া করে আমাকে মীরা বলে ডাকবেন না।’
‘আমি জানতাম না যে তুই আমাকে এতটা ঘৃণা করিস??’

‘তো এখন জেনে নিন। সতের বছর ধরে একটু একটু করে ঘৃণা জমতে জমতে এভারেস্ট ছাড়িয়ে গেছে। আর এই এভারেস্ট জয় করা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।’
মীরা গটগট করে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। যাতে ইশান বাড়িতে ঢুকতে না পারে। জিনিয়ার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে সেটা দিয়ে দরজা খুলে সে। মীরা চলে গেলেও ইশান সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। আস্তে করে বলে উঠলো,’এভারেস্ট জয় করা কোন কঠিন কাজ নয় মীরা। কিন্তু তোর মনে যে অভিমানের পাহাড় গড়েছে সেটা জয় করতে আমার অনেক সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস আমি জিতবোই। পুরষ্কার স্বরুপ ট্রফিও নেব। মিলিয়ে নিস তুই।’

ইশান গাড়িতে করে চলে গেল। মীরা নিজের রুমে থেকে দেখছিল সব। পর্দার আড়ালে ছিল বলে ইশান ওকে দেখতে পায়নি। ইশান চলে যেতেই মীরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
ইশান বাড়ি ফিরতেই আগে ইফাজের রুমে ঢুকলো। রুমে দেখতে না পেয়ে ইশান বারান্দায় উঁকি দিলো। ইফাজ এখনও বারান্দায় দাঁড়ানো। ইশান গিয়ে ইফাজের পেছনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বলল,’তুমি এখনও ঘুমাও নি আব্বু??’
ইশানের দিকে না তাকিয়েই ইফাজ বলল,’ঘুম আসার কথা ছিল কি??’

ইফাজের কথাটা তীরের মতো বিধলো ইশানের বুকে। সে জানে কতরাত তার বাবা নির্ঘুম কাটিয়েছে। প্রথম প্রথম যখন লন্ডনে এসেছিল তখন ইফাজ প্রায়ই কাদতো। পিহুকে ভোলা যে তার পক্ষে অসম্ভব। ইশান নিজেও কত মায়ের জন্য কেঁদেছে। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে ইশানও শক্ত হয়ে গেছে। মায়ের প্রতি তার দূর্বলতা থাকলেও ঘৃণা বেশি ছিলো। কিন্তু আজ সেই ঘৃণা পানিতে পরিণত হয়েছে। ইশানের এখন ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মায়ের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে। ইশানের ভাবনার মাঝেই ইফাজ বলল,’ঘুমাতে যাও রাত হয়েছে। আর না ঘুম আসলে বারে যেতে পারো। আমি কিছু বলব না।’

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ৯

ইশানের খুব কষ্ট হচ্ছে তার বাবাকে দেখে। সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আবার ফিরে আসলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইফাজকে। চোখ থেকে তার পানি গাড়িয়ে পড়লো। বড় হওয়ার এই প্রথম ইশানকে কাঁদতে দেখলো ইফাজ। এর আগে তো হাসি কান্না কি তা বোধহয় ইশান জানতোই না। ইশান ধরা গলায় বলল,’আমি তোমাকে আবার আম্মুর কাছে ফিরিয়ে দেব আব্বু। আই প্রমিস। দরকার পড়লে আম্মুর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো। সবকিছু করবো তোমাকে আর আম্মুকে এক করার জন্য।’
ছেলের কথা শুনে ইফাজের চোখদুটো ভিজতে উঠলো। ইফাজ ইশানকে কিছু বলে দূর্বল করতে চাইলো না। ইশানকে তার রুমে পাঠিয়ে দিলো।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গেছে মীরার। ফ্রেশ হয়ে নিচে এলো। জিনিয়ার রুম নিচেই। মীরা জিনিয়ার রুমে উঁকি দিলো। টু কোয়াটার প্যান্ট আর ঢোলা শার্ট পড়ে উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে জিনিয়া। ওকে দেখেই মীরা নাক কুচকায়। সারারাত মদ খেয়ে এখন মরার মতো ঘুমাচ্ছে। দুনিয়া উল্টে গেলেও জিনিয়ার বারে যাওয়া কেউ ফেরাতে পারবে না। মীরা কিচেনে গিয়ে কফি বানালো। তারপর আস্তে আস্তে নিজের রুমে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে কফির মগে চুমুক দিলো। দ্বিতীয় চুমুক দিতে দিতে মীরা রাস্তার দিকে তাকালো। সাথে সাথেই মীরার চোখ আপনাআপনি বড় হয়ে গেলো। ইশান দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। এবং হাত নাড়িয়ে সে মীরাকে হাই বলছে। চোখ মুখ শক্ত করে ফেলল মীরা। সকাল সকাল এই আপদটার মুখ দেখতে হলো??

অপ্রিয় সেই প্রিয়জন পর্ব ১১