অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৬

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৬
Mousumi Akter

লাল টকটকে বেনারসি, আর গা ভর্তি গহনা পরে কবুল বলার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে পুষ্প। জীবনের এতগুলো বসন্ত পার হয়ে গিয়েছে সে মন খুলে হাসেনি কখনো।এই প্রথমবার পুষ্প যেন মন খুলে হাসতে পারছে।তার হাসির একমাত্র কারণ রাজন।পুষ্পকে এত হাসি-খুশি দেখে পূজা জিজ্ঞেস করল,

‘ পুষ্প দি বিয়ের দিন মানুষ কাঁদে,তুমি হাসছো কেন?’
পুষ্প লাজুক স্বরে বলল, ‘ কখন হাসতে দেখলি আমাকে।’
‘এইযে তুমি মনে মনে হাসছো,সেকি আমি টের পাচ্ছি না।’
পুষ্প আবার লাজুক হাসল।পূর্ণতা বলল,
‘ বিয়ে তো সবার ভাগ্যতেই থাকে। কিন্তু নিজের পছন্দের মানুষ ভাগ্য থাকে তো সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতীদের।’
পূজা আবার ও খিলখিল করে হেসে জবাব দিল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ নিজেকে এইজন্য সবসময় সৌভাগ্যবতী লাগে আমার।আমিও তাকে পেয়েছি প্রায়।’
এমন সময়ে রাজন রা চলে এল।বিয়েতে ওয়াসেল চৌধুরী রাজি নয়,তাই মানুষ দাওয়াত দেওয়া হয়নি।তাই রাজন রা ও ৪-৫ জন মানুষ এসছে মাত্র।তবে প্রভাত মানুষ কম বলে আয়োজনের কোনো ত্রুটি রাখেনি।দ্রুতই রাজনদের খাওয়া -দাওয়া শেষ হল।প্রভাত আগেই কাজী বলে রেখেছিলো।বিয়েও দ্রুত পড়ানো হয়ে গেল।রাজনের কাছে সব কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।সত্যিই আজ থেকে তার পছন্দের মানুষ চিরদিনের জন্য তার হয়ে গিয়েছে। বিয়েতে কৃষ্ণ ও এসছে।কৃষ্ণ কালো মানুষ। তবুও পূজা ঘন ঘন বলছে,

‘আজ তোমাকে একটু বেশীই সুন্দর দেখাচ্ছে।’
কৃষ্ণ জানে তাকে অত সুন্দর দেখাচ্ছে না।কারণ সস কুচকুচে কালো দেখতে।কৃষ্ণের গায়ের রং অনেক কালো।সাদা পাঞ্জাবিতে গায়ের কালো রং টা যেন আরোও কালো লাগছে।কৃষ্ণ একটু খুশি হয়ে বলল,
‘সত্যি ভালো লাগছে?’
‘আরে একদম নায়ক লাগছে।সুপার হিরো তুমি।’

‘আমি জানি আমাকে খুশি করতেই এসব বলছো।আসলে কালো মানুষকে কোনো পোশাকেই ভালো দেখায় না।এইদিকে আমার ইচ্ছা করে আমাকে যেন তোমার চোখে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ লাগে।’ কৃষ্ণ একদম মন খারাপ করে কথাটা বলল।পূজা মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
‘ তাকাও আমার দিকে?’

কৃষ্ণ মলিন মুখে তাকাল পূজার দিক।পূজা অমায়িক এক হাসি দিয়ে বলল,
‘যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম কৃষ্ণ, আমার অনুভূতি কত গভীর তোমার জন্য তুমি বুঝতে।আমার চোখে যদি দেখতে পেতে তোমাকে তাহলে আর কোনদিন গায়ের রং নিয়ে আফসোস হতনা তোমার।আমার চোখে তুমিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। ‘

কৃষ্ণ আনন্দে আত্মহারা।পূজার মত এত সুন্দর মেয়েটা কোনদিন তাকে ভালবাসায় কার্পণ্যতা করেনি।কৃষ্ণ ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে বলল,
‘একটা স্বর্নের চেইন বানাতে দিয়েছি তোমার জন্য।দাদার বিয়েটা হলেই দাদার থেকে আর ৫০ হাজার টাকা ধার নিবো আমাদের বিয়েতে খরচের জন্য।’
‘স্বর্ণ বানাতে দিয়েছো? এত টাকা কোথায় পেলে তুমি।’
‘এক বছর আগে বানাতে দিয়েছি। প্রতি মাসে ৫ হাজার করে টাকা দিয়ে শোধ করেছি।এ মাসেই আনব।আর দাদার থেকে ধার নেওয়া টাকা কাজ করে করে শোধ করে দিবো।’

কৃষ্ণ যে পূজার কথা ভেবে এতকিছু করেছে পূজার তা জানা ছিলোনা।পূজা জানে কৃষ্ণ তাকে ভালবাসে, তাই বলে এত গভীর ভাবে।ওদের মত হত দরিদ্রদের ফ্যামিলিতে স্বর্ণ একটা বিলাসিতা ছাড়া কিচ্ছু না।এক বেলা মাছ না ধরলে পেটে খাবার যায়না ওদের।ছেড়া জামা-কাপড় সেলাই,জোড়াতালি দিয়ে বছর কাটিয়ে দিতে হয়।এক বেলা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য অনেক সংগ্রাম করতে হয় ওদের।এত সবের ভীড়ে ওদের দু’জনের ভালবাসা নিঁখুত।ছোট বেলা থেকে এক পাড়াতে বেড়ে ওঠা।

দু’জন ই জানে তাদের জীবনে অনেক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে।পূজা জেনে বুঝেই কৃষ্ণ বর্ণের একজন হত দরিদ্রকে ভালবেসে পা-গ-ল পারা।ওদের ভালবাসায় নামি-দামি উপহার নেই।গাছের একটা জবা ফুল বিনিময়ের মাধ্যমেই ওদের ভালবাসা শুরু হয়।ওই একটা জবা -ই যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার।নিজেকে সব সময় পরিপাটি ভাবে উপস্থাপন করা লাগে না।

কৃষ্ণ পূজার ঝরঝরে সিল্কি চুলের প্রেমে পড়েনি।তেজে চিপচিপে, বেনি করা চুল দেখতে দেখতে বড় হয়েছে।ভারী মেকাপে সাজ-সজ্জা করা মুখ ও কখনো দেখেনি।ছোট বেলায় কয়লা দিয়ে দাঁত মাজত, কলে এসে মুখ ধুয়ে গিয়ে পড়ত বসত।কৃষ্ণ এসে কল চেপে দিত।আহা! কি সুন্দর, মিষ্টি মধুর তাদের পথচলা।মাঝে মাঝে কৃষ্ণকে দেখার জন্য চুলে বেনি করতে করতে,কখনো আবার চুলে চিরুনি করতে করতে বাড়ির সামনে এসেছে পূজা।এই নিঁখুত প্রেম-ভালবাসা কি কোনো শব্দে বর্ণনার মতো।
কৃষ্ণের কথার জবাবে পূজা বলল,

‘আমার একটা শখ,আমার সুখ, আমার গহনা সবটাই তুমি। শুধু তুমি আমার হয়ে থেকো কৃষ্ণ আমার কিচ্ছু লাগবে না।’
কৃষ্ণ’র ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি ছড়াছড়ি।ছোট্ট সাদা রঙের প্রাইভেট কারটি এগিয়ে এল।পুষ্পের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসছে।বিদায়ের সময়ে তার বাবা এগিয়ে আসেনি। ডাকাডাকি করেও তার বাবাকে আনা যায়নি।মেরি একাই তার মেয়েকে শেষ বিদায় জানাল।মেরির চোখে এক ফোঁটাও পানি নেই।সে হাসছে।কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে তার হাসি।মেরিই বোধহয় একমাত্র মা যে তার মেয়ের বিদায়ে হাসছে।পুষ্প মেরিকে জড়িয়ে ধরে রাখল কতক্ষণ।সে শব্দ করে কাঁদছে না। শুধু ফোঁপাচ্ছে।মেরি পুষ্পের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘তুমি সুখি হবে সোনা। এই অশান্তির নীড় থেকে মুক্তি পেলে তুমি।’
পুষ্প এবার কেঁদে উঠে বলল,
‘ আর কোনো সকালে তোমার মুখ দেখে ঘুম ভাঙবে না আম্মু। মেয়েদের জীবন এত কঠিন কেন আম্মু।’
‘যার মুখ দেখে এখন থেকে ঘুম ভাঙবে তুমি তার অর্ধাঙ্গিনি সোনা।জীবনে যা কিছু হয়ে যাক ,যত কষ্টই হোক স্বামীর হাত কখনো ছাড়বে না।স্বামী হল মেয়েদের একমাত্র আপণ ঠিকানা।জন্ম -জন্মান্তরের বাঁধন।’

রাজনের হাতে পুষ্পকে তুলে দিল মেরি আর প্রান্তিক।রাজনের হাতে পুষ্পকে তুলে দিয়ে বলল,
‘একজন মা অনেক নরম হয় রাজন।আমি জানি আমার মেয়েকে তুমি ভাল রাখবা।একজন মা তখন-ই ভয়ংকর হয়ে ওঠে যখন তার সন্তান খারাপ থাকে।আমার মেয়েকে সুখ দিও রাজন।’
রাজন মেরিকে সালাম করে বেরিয়ে পড়ল।
তখন সন্ধ্যা।মেরির মন খারাপ তবুও সে স্বাভাবিক আছে।মা হিসাবে অনেক ভেঙে পড়ার কথা ছিলো।কিন্তু ভেঙে পড়েনি।জাহান মেরির ঘরে মেরির পাশে বসে আছে।মেরিকে বুঝাচ্ছে।মেরি হেসে জবাব দিচ্ছে।এমন সময়ে জাহান বলল,

‘আপনি এত শান্ত কীভাবে আছেন আপা?একটুও কষ্ট হচ্ছেনা।’
মেরি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘কিছু মানুষ কষ্টকে সঙ্গী হিসাবে গ্রহন করেই নেয়।তা না পারলে বেঁচে থাকা সহজ হত না’রে।’
‘আপা এত কঠিন কথা বলেন, অনেক কিছুই বুঝিনা আমি।’
‘তুই অনেক সরল জাহান।তোর জন্য কষ্ট হয় আমার।একবার যদি তোর জীবনের গল্প মুছে নতুন করে লিখতে পারতাম তাহলে আমি আমার নয়,তোর জীবনের গল্পটাই লিখতাম।’

এসময়ে প্রভাত মেরির ঘরে প্রবেশ করে।প্রান্তিক কে দেখে মেরি বলে,
‘বাবা কখন বের হবা?’
‘এখন আম্মু, চাচী কি জানেন?’
জাহান বলল,
‘কোন বিষয়ে?’
প্রভাত বলল,

‘চাচী পূর্ণতাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যেতে চাচ্ছি।কিন্তু আপনার অসুস্থ শরীর রেখে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
জাহান হেসে বলল, ‘ কিচ্ছু হবেনা বাবা।যাও তোমরা ঘুরে এসো।’
এসময়ে পূর্ণতা প্রবেশ করল।জাহান কে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আম্মু আমি যেতে যাচ্ছি না।প্লিজ উনাকে বলে দাও, তোমাকে রেখে আমি যাবনা।’
‘আমিই বলছি যাও।যাও আমার কিছু হবেনা।’
‘আম্মু আমার মন সায় দিচ্ছেনা।’

‘কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে।ঘুরতে গেলে অনেক কিছুই ভাল হবে।’
‘আমার কেন মনে হচ্ছে, সব খারাপ হবে।’
‘কিচ্ছু খারাপ হবেনা।আমাদের দোয়া আছে না।’
সারাদিন পর ওয়াসেল বাড়ি ফিরেছে।ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।ওয়াসেলের সামনে দিয়ে পূর্ণতার হাত ধরে ব্যাগ গুছিয়ে বের হল।প্রভাত কে বের হতে দেখে ওয়াসেল বলল,

‘কোথায় যাচ্ছো? ‘
‘বউ নিয়ে হানিমুনে যাচ্ছি।’
ওয়াসেল জানত তার ছেলে এমন কোনো উত্তর ই দিবে।বিড়বিড় করে বলল,
‘নির্লজ্জ,বেহায়া।’
‘সত্য কথা বলেছি, এতে নির্লজ্জের কি আছে।’
যাচ্ছো টা কোথায়?আমার জীবনটা তছনছ করার জন্য তুমি একাই যথেষ্ট।হুট করে আমার মেয়েকে এক জেলের বাড়ি পাঠালে।’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৫

প্রান্তিক ড্যামকেয়ার ভাবে বলল,
‘হানিমুন পাচ্ছে প্রচুর।আপাতত হানিমুনের প্ল্যানে আছে।ফিরে এসে যেন সুখবর দিতে পারি।সেই দোয়া করো।ফিরে এসে বাকি কথা হবে।’

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব ৩৭