বিষাক্ত অনুরাগ পর্ব ৫ || Asfiya Zannat Turfa

বিষাক্ত অনুরাগ পর্ব ৫
Asfiya Zannat Turfa

সন্দেহজনক রোদ্দুরের ব্যবহার অদ্ভুত লাগছে তুরের কাছে। এই লোকটা কখন কি করছে, না করছে তুর বুঝে উঠতেই পারছে না। এই নিয়ে হাতে কপালে চুঁমু দিয়ে একাকার করে ফেলেছে। বউ থাকতে অন্য মেয়ের মধ্যে কি পায় পুরুষ? সব পুরুষ অবশ্য এক নয়। তবে এই রোদ্দুর নামক পুরুষটি একেবারে অসহ্যকর। হয় এর মাথা খারাপ নাহলে এর চরিত্র খারাপ। শেষে কিনা একজন চরিত্রহীন ছেলেকে বিয়ে করতে হলো তুরের? এসব ভাবার মাঝেই রোদ্দুর খাবার নিয়ে হাজির। তুর চোখমুখ খিঁচে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আছে।

– ” আমি এখন খাবো না। খিদে নেই আমার। খাবার রেখে দেন টেবিলে,, খিদে পেলে খেয়ে নিবো। ”
রোদ্দুর রাগান্বিত চাহুনি নিক্ষেপ করলো তুরের দিকে। তুরের বুক হঠাৎ করেই কেঁপে উঠলো রোদ্দুরের চাহুনিতে। তুর কি ভয় পেলো? নিজে নিজে ভেবেই তুর আমতা আমতা করে বললো,
– ” দিন খাচ্ছি। ”
রোদ্দুর এসে তুরের পাশে বসে। তুর প্রথমেই বলে ‘ আমি সুপ খাবো না। ‘ রোদ্দুর আবারও নিজের সেই অদ্ভুত হাসিটা, হাসলো! তুর হা করে চেয়ে আছে রোদ্দুরের দিকে। কেন জানি না তুরের বিশ্বাস হচ্ছে না যে রোদ্দুর বিবাহিত। তুর আচমকা বলে উঠলো,
– ” আপনার বউ এর একটা ছবি দেখান তো। ”
রোদ্দুর তুরের মুখে ভাত দিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
– ” কোন বউ এর ছবি? ”

কথাটি তুরের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তুর ভীষম খেলো। মুখের ভাত বাইরে রোদ্দুরের গায়ে ছড়িয়ে পড়লো। তুর কেঁশে উঠতেই রোদ্দুর তুরের মুখের সামনে পানি ধরে। তুর পানি খাচ্ছে, কিন্তু কাঁশি থামছে না। রোদ্দুর ভাতের প্লেট রেখে তুরের মুখ উঁচু করে ধরে ওর পিঠে হাত বুলাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা হয় তুর। তবে নাকের ছিদ্রে ভাত উঠে গিয়েছে বলে নাকটা জ্বলছে অসম্ভব রকমের। তুর স্থির থাকে। রোদ্দুর গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– ” নাকে ভাত উঠে গিয়েছে। এক কাজ করুন দুটো হাঁচি দিন। দেখবেন ভাত বেড়িয়ে আসবে।”
তুর অসহায় চোখে রোদ্দুরের দিকে তাকালো। এমন পরিস্থিতিতে সে এই প্রথম পড়েছে। আগে কখনও নাকে ভাত উঠে যাওয়ার মতো সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটেনি। তাই এ বিষয়ে কিছুই জানে না সে। কিন্তু হাঁচি দিবে কিভাবে? নাক জ্বলছে, হাঁচি তো আসছে না। রোদ্দুর চারদিকে তাকিয়ে তেমন কিছু পেলো না। অবশেষে নিজের রুমাল বের করে সেটা পেঁচিয়ে তুরের হাতে দিলো।

আরও গল্প পরতে ভিজিট করুন

– ” এটা দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দেন। হাঁচি আসবে। ”
তুর রোদ্দুরের কথামত হাঁচি দিলো। ভাত বেড়িয়ে যেতেই নাক আরও বেশি করে জ্বলতে আরম্ভ করে।তুরের চোখ লাল হয়ে আসলো। পানি পড়ছে অনবরত।রোদ্দুর তুরকে পানি দিয়ে আহতকন্ঠে বললো,
– ” এখনও কষ্ট হচ্ছে? ”
তুর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উত্তর দেয়।
– ” নাহ। আমি আপনার প্রথম স্ত্রীর ছবি দেখতে চেয়েছি। আপনি ওভাবে কেন বললাম? মনে হলো ডজন ডজন বউ আছে ”
রোদ্দুর হেসে বলে,
– ” থাকতেও পারে। ”
তুর এবার মেকি হাসি দিয়ে বলে,
– ” বুঝেছি। তাহলে ডক্টর রোদ্দুর, আপনার বউদের কোনো সমস্যা নেই, সমস্যাটা আপনার। আপনার সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা আছে কিনা চেক করেছেন তো? যদি আপনার সমস্যা থাকে তাহলে ডজন কেন? শতসহস্র বউ আসলেও আপনার রক্ত তো পৃথিবিতে আসবে না। শুধু শুধু একের পর এক বিয়ে করে, বেচারা মেয়েগুলোর জীবন নষ্ট করছেন। ”
রোদ্দুরের মেজাজ বিগড়ে গেলো তুরের কথা শুনে। ভেতরে রাগ জমলেও সামনে, মুখে মধু মেখে বললো,

– ” না চেক করা হয়নি। এই শুভ কাজটা না হয় আপনিই করে দিন। রেডি হয়ে আসবো ? চেক করবেন এখন? নাকি একটু পর বাতি নেভানোর পর চেক করবেন? ”
– ” নাউযুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ। ”
তুর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো। লোকটা আসলেই বদ। তুর কিছু না বলে খেতে শুরু করে, রোদ্দুর চুপচাপ বসে আছে। তুর বুঝলো রোদ্দুরের মন খারাপ তাই ও ইঙ্গিত দিয়ে বললো,
– ” আমার ডান হাতে ব্যাথা সে হুশ দেখছি কারোর নেই। ব্যাথায় হাত নাড়াতে পারি না আর আমাকে চামচ দিয়ে গিয়েছে। আরে ভাই চামচ দিয়ে খাবো ঠিক আছে কিন্তু ভাত মেখে দিবে না? চারভাগের এক ভাগ মেখে দিয়ে গিয়েছে। ”

রোদ্দুর এসে তুরকে খাইয়ে দিতে লাগলো। তুর রোদ্দুরের ফোন নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। একটা মেয়ের তিন চারটা ছবি আছে। আর কোনো ছবি কিংবা ভিডিও নেই। সব এ্যাপস এবং ফাইল ঘাটলো তুর। কোথাও কিছু নেই। যে মেয়েটার ছবি আছে, সে বেশ রূপবতী! গায়ের রং, চুল, চেহারা মাশাআল্লাহ! তুর বুঝলো এটা রোদ্দুরের বউ। এতো সুন্দর বউকে একা রেখে এই লোক এখানে থাকে কি করে?
– ” আপনার বউ তো বেশ রূপবতী রোদ্দুর। ”
– ” হ্যাঁ! আমাদের গ্রামে সেরা রূপবতী বাঁছাই করা হলে সেই ট্রফি কিংবা এ্যাওয়ার্ড নিঃসন্দেহে রুহানি পেতো। ”

– ” রুহানি! বেশ মিষ্টি নাম। কিন্তু বাচ্চা! যাই হোক আপনাদের বাচ্চা নিয়ে যতটুকু হেল্প করা সম্ভব করবো আমি। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে আমার আম্মুকে কিছু জানাবেন না আপনি। ”
– ” আপনি নিজের গর্ভে আমার সন্তানকে কেন বেড়ে উঠতে দিতে চান না তুর? আমরা তো বৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছি। আপনার ইচ্ছায় হয়েছে বিয়েটা। আমি কোনো অবৈধ সন্তান জন্ম দিতে চাইনা তুর।”
– ” আমার ইচ্ছা? আপনার জোর এবং আমার অসহায়ত্বের কারনে আমি বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছি রোদ্দুর। আমার কোনো ইচ্ছা নেই অন্যের সাজানো সংসার ভাঙার।”
– ” আপনি তো ভাঙছেন না। বরং গড়ে দিচ্ছেন। ”
– ” আপনার মনে হয়, আমি নিজের সন্তান আপনাদের দিবো? আপনি আমার থেকে দয়া করে দূরত্ব বজায় রেখে থাকুন এবং চলুন। নাহলে আমার বিষে আপনার প্রাণনাশ হতে পারে। ”
– ” মানে? ”
তুর সামান্য হেসে ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,

– ” আমার অনুরাগ সবার থেকে ভিন্ন ডক্টর রোদ্দুর। আমি নিজের ভালোবাসাকে ঠিক ততটা ভালোবাসি যতটা ভালোবাসলে তুর নামক মেয়েটির অস্তিত্ব তাহাতে বিলীন হয়। যতটা ভালোবাসলে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও উন্মাদ হয়ে যায়, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। প্রিয় মানুষটির পাশে অন্যকাউকে সহ্য করতে পারি না। মেনে নিতে পারিনা তার দেওয়া ধোকা কিংবা অবহেলা। হয়ে উঠি ক্ষিপ্ত। এই বিষাক্ত অনুরাগ শুধু ধ্বংস জানে, ভেঙে চুরমার করতে জানে, গড়তে জানে না। ”
রোদ্দুর তুরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে প্লেট গুছিয়ে পাশে রাখলো। লাইট অফ করে তুরের পাশে আসতেই তুর সগতোক্তিতে বলে উঠলো,
– ” অন্যঘরে ঘুমান! ”

– ” আপনার আম্মু সন্দেহ করবে। তাছাড়া আমার শরীরও ভালো নেই। ঘুমের প্রয়োজন আমার।”
তুর কিছুটা সড়ে যেতেই রোদ্দুর শুয়ে পড়ে। রোদ্দুরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তুর রোদ্দুরের দিকে ফিরে শোয়। রোদ্দুর মাথার নিচে একহাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। জানালার গ্রিল ভেদ করে চন্দ্রের শুভ্র কোমল রশ্মি এসে পড়ছে রোদ্দুরের চেহারায়। তুর অনুভব করছে, যে সে রোদ্দুরের প্রতি ক্রোমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে। তবে এই দূর্বলতা অনন্ত’র মতো নয়। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। অনন্তকে তুর ভালোবাসতো, যদি অনন্তের প্রতি তুরের সেই অনুভূতি ভালোবাসা হয় তাহলে এখন রোদ্দুরের প্রতি যা অনুভব করছে সেটা কি?
মধ্যরাতে ভুলবশতভাবে তুরের হাত রোদ্দুরের গায়ের ওপর পড়তেই তুর শিউরে উঠলো, প্রচন্ড গরম রোদ্দুরের শরীর। তুর টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে উঠে বসে। রোদ্দুর তখন ঘুমে বিভোর। তুর রোদ্দুরের কপালে হাত দিতেই বুঝলো রোদ্দুর শরীরে ভীষন জ্বর। তুর গিয়ে ওর আম্মুকে ডেকে আনে। তাহমিনা এসে রোদ্দুরকে দেখে বললেন,

– ” মামনি তুই ওর কাছে থাক আমি ঘর থেকে ঔষধ আনছি। তোর ডক্টর কাকুকে তো এখন পাওয়া যাবে না, রোদ্দুরকেও এতো রাতে হসপিটালে নেওয়া যাবে না। ”
তাহমিনা দ্রুতবেগে চলে গেলেন। তুর গালে হাত দিয়ে রোদ্দুরের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। রোদ্দুরের রেশম-কোমল চুলগুলো বারবার হাওয়ায় উড়ে এসে ওর চোখের ওপর পড়ছে। তুর নিজের চুল থেকে গাডার খুলে রোদ্দুরের চুল মুঠো করে চেপে ধরলো,
– ” মেয়েদের মতো এতো লম্বা চুল! চুলটুল কাটে না নাকি? বাইদে বাইদে লাগে। ”
তুর রোদ্দুরের চুলে ঝুটি বেঁধে আবারও মনোযোগ দিয়ে ওকে দেখতে লাগলো। তাহমিনা এসে রোদ্দুরের মাথার ওপর দুটো ঝুটি দেখে কিঞ্চিত চমকে যায়। এটা যে তার মেয়ের কাজ সেটা বুঝতে পেরে শব্দ করে হাসলেন উনি। এরপর তুরের হাতে ঔষধ দিয়ে নরম গলায় বললেন,
– ” তুর ঔষধগুলো নে! ওকে কিছু খাওয়ায় এগুলো খাওয়াবি। আর ওর জামাকাপড় খুলে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দে। ”

বিষাক্ত অনুরাগ পর্ব ৪

কথাটি তুরের কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তুর লাফিয়ে ওঠে। উত্তেজিত হয়ে বলে,
– ” মানে? আমি কেন? আমি কেন মোছাবো। ”
তাহমিনা ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
– ” তো কে মোছাবে? তোর বর তুই ছাড়া ওর জামা কাপড় খুলে গা মুছিয়ে দেবে কে? যা বলছি তাই কর। ওর জ্বর কমে আসবে। আমি ঘরে যাচ্ছি কিছু লাগলে ডাক দিস। ”
তুর মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তাহমিনা হালকা হেসে তুরের মাথায় হাত বুলালেন। এরপর ‘পাগলি’ বলে চলে গেলেন। তুর দরজা লাগিয়ে রোদ্দুরের সামনে এসে দাড়ায়। রোদ্দুরকে দেখে ওরও ভীষণ হাসি পাচ্ছে। মাথার উপর শিং এর মতো দুটো ঝুটি, ফর্সা নাক লালচে হয়ে গিয়েছে, ঠোটদুটোও লিপস্টিক ছাড়াই লাল হয়ে আছে। তুর শব্দ করে হাসে। কিন্তু বিপদ তো এখনও কাটেনি, এবার রোদ্দুরের শরীর স্পঞ্জ করতে হবে। বিনা অনুমতিতে অন্যের জামাকাপড় খোলার মতো গর্হিত অপরাধ আর কিছু হতে পারে? কেউ না জানুক তুর তো জানে যে রোদ্দুর ওর কাছে এবং ও রোদ্দুরের কাছে শুধুই অপরিচিত ব্যক্তি। তাছাড়া রোদ্দুর বিবাহিত, এমন অবস্থায় ঠিক কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না তুর। তুর লাইটের সুইচে হাত দিয়ে মনে মনে বললো,

– ” ওহ হো জান, তুই কেন চাপ নিচ্ছিস? বর হয় তোর, শুধু জামাকাপড়ই তো খুলবি। কিছু তো আর করছিস না। তাহলে এতো জড়তা কেন? যা দ্রুত গিয়ে কাজটা সেড়ে ফেল, বেচারা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। ”
আরেকবার ভাবলো,
– ” না তুর, তুই এটা করতে পারিস না। ও বিবাহিত। তুই নিজের কাজে মন দে, ওকে তুলে নিজের কাজ নিজেকে করতে বল। ও তোর প্রিয়মানুষ কখনও হতে পারে। ”
কিছুক্ষণ পর আবার ভাবলো,
– ” তুরের কথা শুনবো নাকি জানের কথা? কে ঠিক বলছে। রোদ্দুর কে? ওর জন্য এতোকিছু করবো কেন আমি? কিন্তু, ইশ কত কষ্ট পাচ্ছে ও। থাকুক বউ, জ্বর এসেছে, জীবসেবা করলে আল্লাহ খুশি হন। আমি তো এটুকু করতেই পারি, তাইনা? হ্যাঁ!”

বিষাক্ত অনুরাগ পর্ব ৬