ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

এই নিয়ে দুবার বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছি আমি। কিন্তু এইবার যার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা আসলে আমার যে হবু বর সেও নাকি বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে।
হাস্যকর না? আমার কাছে ব্যাপারটা দারুণ লেগেছে। যখন আমার ছোট খালামনি আমাকে কল দিয়ে বলো আমার হবু বর সাখাওয়াত কে নাকি খুঁজে পাওয়া যায় নি যখন কাজি বিয়ে পড়াতে এসেছিলো।

বর পালিয়েছে এই কথা জানাজানি হওয়ার পর পাত্রীর পালিয়ে যাওয়া কথাটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। আমি যে ২য় বার বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছি এই কথা মোট চারজন জানে আব্বু, আম্মু, , ছোটখালা আর মেজুমামা। বিয়ে বাড়ীর সকলে জানে আমি এখনো পার্লারেই আছি।
এতোটুকু কথা বলেই খালামনি ফোনটা কেটে দিলো বিস্তারিত আর কিছু জানা গেলো না কারণ ইতি মধ্যে আমার ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। চার্জ শেষ তার জন্য।

বিয়ে না করার পেছনে একটা মস্ত বড় কারণ আমি বের করিয়েছি তাহলো আমার ছোট খালামনি, তিনি অত্যন্ত সুন্দরি হওয়ার পরও তার স্বামী পরকীয়া লিপ্ত ছিলো তাওবা আমার প্রাইভেট টিচারের সাথে। আমার টিচারের কিন্তু যোগ্যতা , রূপ,গুন কোনো কিছু দিক থেকে আমার খালামনির সমতুল্য ছিলো না। তারপরও খালামনির সংসার টিকে নি। ৬ বছরের সংসার ভেঙ্গে গেয়েছিলো। তাদের ডিভোর্সের পর জানতে পারলাম আমার খালুর যার সাথে পরকীয়া লিপ্ত ছিলো , সে আর কেউ না আমার প্রাইভেট টিচার। আমার প্রাইভেট টিচার খালামনির ডিভোর্স এর পর থেকেই আমাকে আর পড়াই নি ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

একদিন ওনার বাসা হঠাৎ গিয়ে জানতে পারি তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে আমাকে পড়ানো বাদ দেওয়ার পর পর । এক কথায় দুইকথায় আম্মু জানতে পারে টিচারের বরের নাম সুমন। সুমন কিন্তু আমার খালুরও নাম ছিলো। সেখান থেকেই আম্মুর খটকা লাগে ব্যাপারটা। পরে খালামনি কে ওনার খটকা লাগার ব্যাপারটা জানান, খালামনি তার এক ননাসের ছেলে মধ্যে জানতে পারে খালু বিয়ে করেছে, তার বউয়ের নাম রুজিনা। কাকতালীয় ভাবে আমার টিচারের নামও রুজিনা ছিলো। এর পর কয়েক বছর কেটে গিয়ে ছিলো হঠাৎ একদিন খালামনি সায়দাবাদ যাচ্ছিলো তার এক বান্ধবীর বাসায়।

তখন রাস্তায় খালু আর আমার টিচারকে একসাথে একই রিকশায় দেখে ছিলো আমার টিচারের হাতে একটা ৬/৭ মাসের একটা বাচ্চা ছিলো। এই দৃশ্য দেখার পর খালা মনি কাছে ব্যাপারটা একদম পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো তার হলো খালু আমার প্রাইভেট টিচারের সাথেই পরকীয়া ছিলো ববং তারই সাথে পরর্বতীতে খালুর বিয়ে হয়।
আমার কেন জানি মনে হয় সব পুরুষেরাই খালুর মতো হয়। তাই আমি বিয়ে করতে চাই না। এই কথা আমি আমার পরিবারে কাউকে বুঝাতে পারি না এবং পারছিও না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছি।

এখন আমি রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে আছি আমি বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে। প্ল্যাটফর্মে অবস্থানরত যাত্রীরা আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি নওশিন আদিবা, ডাক নাম সন্ধ্যা। এই বছর অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। যে দিন বয়স আমার আঠারো হলো ঐদিন আমার বড় চাচা বাবাকে ডেকে নিয়ে বললেন,

-দেখ সেলিম তোর মেয়ের বয়স আজকে ১৮ হলো । এখন তোর মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। যত তারাতাড়ি পারিস মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দে।আজ কালের যুগ বেশি ভালো না। হরহামেশাই দেখা যায় ছেলে মেয়েরা প্রেম ভালোবাসা লিপ্ত হয়। পরে বাবা মার মুখে চুন কালি মেখে পালিয়ে যায়। তাই বলছি যত তারাতাড়ি পারিস কোনো অঘটন ঘটার আগে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দে।

এদিকে আমার বাবা বড় ভাই বলতে অন্ধ ভক্ত। যার ফলে আমার বড় চাচার কথা আমার বাবা মস্তিষ্কে জাদুর মতো প্রভাব ফেললো। এই ঘটনার পরের দিনই আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলো আমার দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে যাকে আমার কোনোকালেই ভালো লাগতো না। ওনি ছিলো আমার দুচোখের বিষ। আর তার সাথেই নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে এই কথা জানার পর আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়েছিলো ।

বাবাকে অনেক করে বুঝিয়েছিলাম আমার দাঁড়া এই বিয়ে সম্ভব না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ঠিক হলো ৮ দিন পর, সামনের শুক্রবার আমার বিয়ে ঐই চাচাতো ভাইয়ের সাথে৷ এই ৮ দিন আমি আমার বাবাকে তোতাপাখির মতো বুঝিয়েছি আমার সমস্যার কথা। কিন্তু বাবা আমার কথা শুনে নি। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমি হলুদের দিন রাতে বাসা থেকে পালিয়ে ছোট খালামনির ফ্ল্যাটে চলে আসি। খালামনি তখন আমাদের বাড়ী বিক্রমপুর ছিলো। এই পর আমাদের দাদার বাড়ীর সকলের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

এই ঘটনার ২ মাস পর আমার বাবা আমার বিয়ে ২য় বারের মতো আবার ঠিক করলো। তার বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথে। যা আমি বিয়ের আগের মানে কালকে জানতে পারি। বিয়ের জন্যই নাকি বাবা আমাদের সপরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে সিফট হয়ে ছিলো। ছোট খালা থেকে জানতে পেরেছি ছেলেও নাকি অত্যন্ত সুন্দর এবং খুবই ভদ্র । মেজুমামা অনেক বার বলেছিলো ছেলের ছবি দেখতে আমাকে। আমি দেখি নি ছেলের ছবি। শুধু এতো টুকু জানি ছেলের নাম সাখাওয়াত। এর বেশি আমি ছেলের সম্পর্কে কিছুই জানি না।

এই সব চিন্তা করতে করতে আমার কাঙ্ক্ষিত ট্রেন তৃণা এক্সপ্রেস এসে পড়েছে, আমার গন্তব্য চট্টগ্রাম টু ঢাকা। তৃণা এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম থেকে ছাড়ে রাত ১১টায় এবং ঢাকায় পৌঁছায় ভোর ৫ টা ১৫ মিনিটে।
পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে ছুটলাম ট্রেনের দিকে।

আজকে আমার জন্য একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলো। কিন্তু আমার তো করার কিছুই ছিলো না। বাবা কে অনেক করে বুঝানোর পরও সে তার সিধান্তে অটুট ছিলো। আমার ক্যারিয়ার এখনো ঠিক হয় নি। মাত্র মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। আর এখনই বিয়ের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত নই৷ যাকে চিনি না , যার সম্পর্কে জানি না, সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত ব্যক্তি তার সাথে নাকি আমার সারাটা জীবন থাকতে হবে। তাই আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছি। একদিন সময় হলে মেয়েটার কাছে মাফ চেয়ে নিবো। আমি জানি আমার এই অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই তবুও আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো।

ছোট বোন তুবা বলেছিলো মেয়েটা নাকি অত্যন্ত লক্ষী, এবং খুবই সুন্দর । ছবি দেখাতে চেয়ে ছিলো তুবা আমাকে, আমি দেখি নি। কারণ মা আমার কাছে নওশিন মানে আমার হবু বউয়ের রূপের অনেক প্রসংশা করছে। তাই আমি রিক্স নেই নি ছবি দেখার, যদি ছবি দেখে প্রেমে পড়ে যাই। সুন্দরের পূজারী তো সবাই। মেয়ে আমার পছন্দ হয়ে গেলে আমি যেকোনো মূল্যে তাকে বিয়ে করবো তাই আর রিক্স নেই নি। আমি সাখাওয়াত হোসেন ধূসর । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে পড়ছি। আজকে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাচ্ছি।

এখন আমার গন্তব্য ঢাকা। আমি প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি তৃণা এক্সপ্রেসের জন্য । ঢাকায় অপেক্ষা করছে আমার সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ যা আমার নিজের হাতেই আছে। যদি মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করি। আমার ভবিষ্যতে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। ঠিক রাত ১১ টা বাজে তৃণা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে এসে থামলো। আমি আমার জন্য বরাদ্দ করা সিটে গিয়ে বসলাম।

তার ২ মিনিট পর আমার বরাবর সিটে বধূ সাজে এক নারীর এসে বসলো। তাঁর নজর নিচের দিকে আসেপাশে কি চলছে তার দিকে তার বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই। সে যেনো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমাদের পাশের সিট গুলোয় একদল হিজড়া মানে তৃতীয় লিঙ্গে মানুষ বসেছে। আস্তে আস্তে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে এলো, ট্রেনও ছেড়ে দেওয়া হলো। ট্রেন ছাড়ার পরই আমার বরাবর বসা বধূ সাজের নারী চোখ তুলে উপরে তাকালো ঠিক আমার দিকে।
তার নজরে কিছু একটা ছিলো কয়েক মুহুর্তে জন্য আমি আমার নিজের মধ্যে ছিলাম না। একদম অনুভূতি শূন্য হয়ে গিয়েছিলাম।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ২