ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ২ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ২
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

অপরিচিত নারীটি আমার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক একটু মুচকি হাসলো । এই হাসিতেই আমার সর্বনাশ হবে জানলে আমি কখনো মেয়েটার দিকে তাকাতাম না৷
মেয়েটির হাসির উত্তরে আমিও একটু মুচকি হাসি ফেরত দিলাম। এর পর আমি আমার দৃষ্টি তার থেকে সরিয়ে ফেলাম। জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলাম। এখন আষাঢ় মাসের আজ ৬ তারিখ চলছে। আবহাওয়াও চমৎকার । এ বেলা রোদ তো ও বেলা বৃষ্টি ।

এতোক্ষণ চারপাশে এক ধরনের ভ্যাবসা গরম ছিলো আর এখন বাহিরে শীতল হাওয়া বইছে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হবে ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা চারদিকে বিরাজ করছে। এই দৃশ্য যেকোনো বর্ষা প্রেমির জন্য অত্যন্ত আনন্দের। আমিও নিজের অজান্তে নিজেকে বর্ষা প্রেমি দাবি করি কিন্তু মুখে স্বীকার করি না। কিন্তু আমি এখন আর বাহিরের দৃশ্য উপভোগ করতে পারছি না। আমার অবাধ্য মন বার বার আমার বরাবর অবস্থানরত অপরিচিত নারীর দিকে চলে যাচ্ছে। আমি আমার মাঝে এই পরিবর্তন এখন দমই এখন আশা করি নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি ট্রেনে বসে আছি। আমার বরাবর সিটে একজন ছেলে বসে আছে। সে দেখতে অত্যান্ত সুন্দর । তার মুখমন্ডলের যে জিনিসটা তাকে নিয়ে ভাবতে আমাকে বাধ্য করছে, তা হলো তার সরু নাকের ডগায় তিল। আমি আমার ১৮ বছর জীবনে কখনো দেখি নি কোনো ছেলের নাকের ডগায় এমন তিল । একটু আগে তারা সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে। চোখে চোখ পরায় সৌজন্য বজায় রাখতে একটু মুচকি হেসে ছিলাম তার উত্তরে তিনিও আমায় এক টুকরো হাসি ফেরত দিয়েছিলো। ওনার পরনে শেরওয়ানি যা দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না কারণ আমার পরনের লেহেঙ্গার সাথে ওনার শেরওয়ানি অনেক মিল, যেমন- রং, ডিজাইন ।

বাইরে আকাশ একটু পর পর ধূসর হয়ে উঠছে মনে হচ্ছে ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটা লং কামিজ বের করে নিলাম। এই কামিজটা পার্লারে যাওয়ার সময় বাসা থেকে পরে বের হয়েছিলাম। এক এক করে গায়ের গয়না গুলো খুলে হ্যান্ড ব্যাগ রাখলাম এবার একটু শান্তি লাগছে মেকআপটাও যদি তুলতে পারতাম তাহলে আর বেশি ভালো লাগলো। আমার পাশের সিট গুলা তাকিয়ে দেখলাম যে যার মতো ব্যস্ত এখন এই গয়নার ব্যাগ নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়া একেবারেই সম্ভব না। আমার বরাবর অবস্থানরত ছেলেটার দিকে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম । সে মাথা নিচু করে বসে আছে।ওনাকে কেন জানি ভরসার যোগ্য মনে হলো। তাই ওনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য একটু শব্দ করে কাশলাম। ওনি কাশির শব্দে উপরে চোখ তুলেন।তখন আমি ওনাকে বললাম,

– আসসালামু আলাইকুম আমি সন্ধ্যা ।
ওনি বলেন,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , আমি ধূসর।
ওনার নাম শুনে আমিতো রীতিমত অবাক না হয়ে পারলাম না। কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
– আমার একটা সাহায্য করতে পারবেন? আসলে আমি একাই ট্রেনে। এর আগে কখনো আমি একা ট্রেনে করে কোথাও যাই নি।
– জ্বি বলুন। কি রকম সাহায্য করতে পারি আপনার?
– আসলে আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার। এই ব্যাগটা একটু আপনার কাছে রাখবেন?
– আচ্ছা সমস্যা নেই, দিন আমাকে।

ধূসরের কাছে ব্যাগটা রেখে চললাম ওয়াশরুমে পরনের কাপড় পাল্টাতে।
১০ মিনিট পর ফিরে এসে নিজে সিটে বসলাম । এখন অনেকটা ভালো লাগছে। ধূসরের কাছ থেকে হ্যান্ড ব্যাগটা নিলাম এবং তাকে ধন্যবাদও জানালাম। ইতি মধ্যে ধূসর নিজের শেরওয়ানি খুলে হাতে নিয়ে রেখেছে এখন তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জাম।
হ্যান্ড ব্যাগ থেকে কাপরের শপিং ব্যাগ বের করে তাতে সুন্দর করে ভাজ করে রেখে দিলাম লেহেঙ্গাটা । ওরনা দিয়ে সুন্দর করে মাথা ঢেকে নিলাম। এরপর জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। একসময় ক্লান্তিতে দুচোখের তারায় নিদ্রা নেমে এলো

আচ্ছা তোমরা কি নতুন বিয়ে করেছো?
এই কথা শুনে প্রশ্ন করার ব্যক্তির দিকে ফিরে তাকালাম।
কথাটা যে বলেছে সে আর কেউই না সম্ভবত সেই হিজড়া দলেরই কেউ একজন হবে।
কে প্রশ্ন করেছে তাকে দেখবার জন্য আমি বললাম,
– কিছু বললেন?
– হ্যাঁ আমি পারুল এই দলটার সরদার। আসলে আমি আমার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তোমরা কি নতুন বিয়ে করেছো কিনা?
– সমস্যা নেই। আমি ওনাকে চিনি না, বিয়ে তো দূরের কথা।

– তোমরা দুইজনই তো বিয়ে পোশাকে ছিলে তাই জিজ্ঞেস করলাম ভাই কিছু মনে করো না।
– আরে না আপু কিছু মনে করি নাই।
বলেই চুপ করেই রইলাম আমি। ওনি বললেন,
– ভাই কিছু মনে না করলে দুটো কথা বলি তোমার সঙ্গে?
– অবশ্যই আপু। আমারও সময় কেটে যাবে আপানর সঙ্গে কথা বলতে বলতে।
– তুমি এখানে মানে চট্টগ্রামেই থাকো নাকি ঢাকায়?
– চট্টগ্রাম আমার পৈতৃক নিবাস, ঢাকায় থেকে আপাতত পড়া লেখা করছি আপনি?
– আমি ঢাকায় বাড্ডায় থাকি। চট্টগ্রাম এসে ছিলাম আমার ছোটবেলার পুরনো বন্ধুকে শেষ দেখা দেখতে। আল্লাহ ইচ্ছায় আজকে ভোরে মরা গেছে ও।

– ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ ওনাকে জান্নাত বাসী করুক
-আমিন, তুমি জানো আমি কিন্তু জন্মগত ভাবে হিজড়া না। আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে হিজড়া বানানো হয়েছে।
– কি বলেন? আপনার পরিবারের কেউ প্রতিবাদ করে নি?
– না ভাই। এই পৃথিবীতে টাকা যার আছে তারই রাজত্ব। সেখানে আমার পরিবার ছিলো একদমই দারিদ্র। তারা প্রতিবাদ করতে চেয়েও করতে পারি নি।
-আমি জানি না কি বলে আপনাকে শান্তনা দিবো, শুধু এতোটুকুই বলবো। আল্লাহ উপর ভরসা রাখুন ওনি নিশ্চয়ই পাপীকে শাস্তি দিবে।
– কি আর বলবো ভাই, আমি আমার অক্ষমতায় এখন আর আফসোস করি না। ভ্যাগের বিধান আমি মেনে নিয়েছি।

– আপু কষ্ট পাবেন না আল্লাহ আপনার পরীক্ষা নিচ্ছে, ধৈর্য্য ধরুন।
– একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যাঁ বলুন।
– তুমি বিয়ের পোশাক পরে ছিলে কেন? আজকে কি তোমার বিয়ে ছিলো?
– যদি আমি না পালাতাম তাহলে আজকে আমার বিয়ে হতো এবং আমি এই সময় আমার বাসর ঘরে নতুন বউয়ের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। এখানে বসে আপনার সাথে গল্প করতে পারতাম না।
– তুমি বিয়ে না করে পালিয়ে এসেছো?
– হ্যাঁ।

– কাহিনী কি একটু আমাকে বলবা? যদি তোমার আপত্তি না থাকে।
সংক্ষিপ্ত ভাবে আমার বিয়ে না করার পিছনের কারণটা তাকে বললাম এবং পালিয়ে যাওয়ার ও।
এভাবেই সারারাত আমি ওনার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। কথার ফাঁকে সন্ধ্যা মানে আমার বরাবর অবস্থানরত অল্প পরিচিত নারীর ঘুমন্ত অবস্থায় কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। হয়তো আমাদের আর নাও দেখা হতে পারি তাই এ কাজ। সেদিন ট্রেন স্টেশন থেকে বাসায় আসার আগে পারুল আপুর সাথে নাম্বার আদানপ্রদান হয়েছিলো আমার। ওনি তৃতীয় লিঙ্গে ব্যক্তি হলেও তার ব্যবহার ছিলো অত্যন্ত চমৎকার ।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ১

ঐ ঘটনার পর আজ দুমাস হতে চললো বাড়ী থেকে আর কেউ তেমন একটা কথা বলে না। মাঝে মাঝে মা ফোন দিয়ে কান্না কাটি করে কিন্তু বাবার সাথে কথাই হয় না আমার। কল দিয়ে মা শুধু একটা কথাই বলে,
-“সন্ধ্যা তুই এই কাজটা কি করে করলি, তোর কি একবারও আমাদের মানসম্মানের কথা চিন্তা করার উচিৎ ছিলো না?”

কল করেই খালি একই কথা দূর এইসব আর ভালো লাগে না। প্রচন্ড গরম পরে আজকাল। গরমে দুপুর বেলা রাস্তায় বের হওয়া যা না ছাতা ছাড়া। দুপুরে খাবার খেয়ে একটু ভাতঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম এর মাঝে কলিং বেলা বেজে উঠল৷ ডোর-হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখি দরজার ওপাশে সেদিনের ট্রেনের সেই ছেলেটা মানে ধূসর দাড়িয়ে আছে।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৩