ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৩ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৩
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি দরজার ওপাশে ধূসর দাঁড়িয়ে আছে। নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি না তো ?
না স্বপ্ন দেখছি না কারণ চিমটি কাটার পর হাতে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছি। মিরপুর ১০শের এই ফ্ল্যাটে আমি আর আমার বান্ধবী রুবি থাকি ৩ মাস যাবৎ। ভার্সিটিতে এখান থেকে যাতায়াত করতে সুবিধা তাই।২ রুমের ফ্ল্যাট , বারান্দা ড্রইংরুম, কিচেন বেশ কমই ভাড়া ফ্ল্যাটের। রুবি বাসায় নেই সে গেছে টিউশনিতে বর্তমানে ফ্ল্যাটে আমি একাই আছি। এই মুহূর্তে কি দরজা খোলা ঠিক হবে?

কিন্তু বাইরে যে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার অপরিচিত কিন্তু অল্প পরিচিত। দরজা খোলা নিয়ে নিজের মনেই এক প্রকার দন্ড শুরু হয়ে গেলো৷ যখন আমি দরজা খোলা নিয়ে আকাশকুসুম ভাবছি ঠিক তখনই দ্বিতীয় বারের মতো কলিংবেল বেজে উঠলো । কি করবো ভেবে না পেয়ে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই দরজা খুললাম। ওনি আমায় দেখে ভূত দেখবার ন্যায় আবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। একটু পর তার দৃষ্টি ফ্লোরে নামিয়ে ফেলো। ওনাকে দেখার পর সর্বপ্রথম যে জিনিসটা আমার নজর কেরে নিলো, তাহলো তার সরু নাকের ডগায় কালো কুচকুচে তিলাটা। আচ্ছা এই ছেলেটার নাকে ডগায় এতো সুন্দর তিল কেন ?

মিরপুর ১০ এ আমার অতিঘনিষ্ঠ বন্ধু জুবায়ের থাকে একাই একটা ফ্ল্যাটে। আজকে থেকে ওর সাথে থাকবো বলে ঠিক করেছি। এতো বড় ফ্ল্যাটে একা থাকতে ভালো লাগে না জুবায়েরের, তাই ওর জোড়াজুড়িতে একপ্রকার বাধ্য হয়েই থাকতে হবে ওর সাথে।

বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসার পর আর বাড়িতে যাই নি কিন্তু প্রতিমাসে মা ঠিকই ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয় হাত খরচের জন্য। মায়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় কিন্তু বাবা সে তো আমাকে চিনেই না এমন তার হাবভাব। এই ভাবেই দুমাস কেটে গেলো। সকাল ঘুম থেকে উঠা ভার্সিটির ক্লাস, বিকেলে টিউশনি, রাতে ফ্ল্যাটে এসে পড়া, আবার ঘুমিয়ে পড়া। মাঝে মাঝে রাতে পড়তে পড়তে না খেয়ে ঘুমিয়ে পরি। এই ভাবেই চলছে জীবন। মাঝে মাঝে একা বসে চিন্তা করি, আজ থেকে ২ মাস আগে যদি আমার বিয়েটা হতো তাহলে আমার এখনকার জীবনধারা থাকতো সম্পূর্ণ ভিন্ন ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি এই নিয়ে আফসোস করি না কিন্তু বাবা মায়ের করা অবহেলাটা আমার এখন আর ভালো লাগছে না। আমি জানি, আমি যে ভুল করেছি তার ক্ষমা হয় না। আমার ভুলের শাস্তি সরূপ বাবা মায়ের করা অবহেলা নিতান্তই সমান্য।

আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি জুবায়েরের ফ্ল্যাটের ঠিক বাহিরে এই নিয়ে দুবার কলিংবেল বাজালাম তাও দরজা খুলছে না যার জন্য আমি অতিরিক্ত বিরক্ত। এর আগে কখনো আমি জুবায়েরের ফ্ল্যাটে আসি নি। আজ সকালে আমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস জুবায়ের নিয়ে এসেছে। পকেট থেকে ফোন বের করে জুবায়ের কে যখন কল করতে যাব ঠিক তখনই দরজা খুলে গেলো।

দরজা খোলার পর ওপাশের যে ব্যক্তিটি দৃশমান হলে সে আমার জন্য একদমই অপ্রত্যাশিত ছিলো। কারণ দরজার ওপাশে যে ছিলো আমার ভুল না হলে, সে আর কেউ না ট্রেনের সেই অপরিচিত কিন্তু অল্প পরিচিত নারীটি মানে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে আমি আবাক নয়নে তাকিয়ে আছি, কারণ সেদিনের পর তার সাথে যে আমার আবার দেখা হবে সেই আশা আমি কখনোই করি নি। সন্ধ্যাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ও আমার মুখমন্ডলের কোন একটা অংশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমি আমার দৃষ্টি ফ্লোরে নামিয়ে ফেলাম।
তারপর বললাম,
– আসসালামু আলাইকুম , জুবায়ের বাসায় আছে? বলতে দেরী জুবায়েরের কল আসতে দেরী হয় নি।

ফোনটা হাতে থাকায় স্কিনে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম জুবায়েরই কল দিয়েছে।
কল টা রিসিভ করলাম। সন্ধ্যার সামনেই বললাম,
-হ্যালো, কই তুই?
ওপাশ থেকে জুবায়ের বললো,
– কেন বাসায়, কিন্তু তুই কই?
– আমি তোর ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি এতো বার,,,,,,,,। সম্পূর্ণ কথা শেষ করবার পূর্বে জুবায়ের কল কেটে দিলো । আমি এখন যে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তার বিপরীত ফ্ল্যাটের মেইন দরজা খুলে গেলো সেদিকে তাকিয়ে দেখি জুবায়ের দাঁত কেলিয়ে হাসছে। গিটারের ব্যাগ হাতে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে আর তাকালাম না। জুবায়েরের কাছে চলে গেলাম।
আমি সন্ধ্যার সামনে থেকে আসার আগেও আড়চোখে দেখেছি ও আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো। সালাম দিলাম সালামের উত্তর ও দিলো না। আজব মেয়ে তো।

ওনি আমায় একবার দেখে চোখ ফ্লোরে নামিয়ে ফেলো কেন?
এরপর আর ওনি মানে ধূসর আমার দিকে একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখে নি? কারণ কি?
ধূসরের নাকের তিলটা দেখতে আমি এতোই বিভোর ছিলাম যে তার সালামের উত্তর ও দিতে পারলাম না। কিন্তু মাথার থেকে একদমই একটা ব্যাপার কিছু তেই বের করতে পারলাম না তাহলো ওনি আমায় দেখে ওনার দৃষ্টি ফ্লোরে নামিয়ে ফেলো কেন?
এইসব ভাবতে ভাবতে আমি রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যা দেখলাম তাতে আমার দু চোখ বড় হয়ে গেলো।

এখন বুঝতে পারলাম কেন ওনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকায় নি। তার কারণ হলো আমি তখন ওড়না ছাড়াই ধূসরের সামনে চলে গিয়েছিলাম।
আল্লাহ এটা কি হলো? আমি এই লজ্জায় জীবনও ধূসরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো না।

আজকে বাড়ীওয়ালাদের বাসায় আমাদের দাওয়াত । বাড়ীওয়ালা একজন আর্মি অফিসার যার ফলে সে সবসময় বাসার বাইরেই থাকে। এখন বাসায় থাকে শুধু তার বউ এবং তার এক মাত্র কন্যা। মাঝে মাঝে বাড়িওয়ালার মা এসে থাকেন ওনাদের সঙ্গে । এছাড়া পাঁচ তলায় মা মেয়ে একাই থাকতো আমরা আর জুবায়েরের ভাইয়া আসার আগে। বাড়ীওয়ালার বউয়ের না তুফসা , ওনাকে আমরা আপুই বলে ডাকে।

আপু আমার থেকে হয়তো ১২/১৩ বছরের বড় কিন্তু তার ব্যবহার অত্যন্ত বন্ধুত্বপূণ। ওনি আমার আর রুবি সাথে খুব সহজেই মিশে গিয়েছে। মাঝে মাঝে তুফসা আপুর মেয়ে ঘুমিয়ে গেলে, বারান্দায় বসে আমরা গল্প করি অনেক রাত পর্যন্ত। আপু বাসায় ভালোমন্দ কিছু রান্না করলে আমাদের দিয়ে খায়, আমরাও রান্না করে আপুকে দেই। সম্পূর্ণ বাসায় আপুর থেকে ছোট আমরাই তাই আপু আমাদের সাথে মিশে। বাড়ীতে বাকি যে ভাড়াটিয়া আছে তাদের কেউর সাথে আপুকে বেশি মিশতে দেখা যায় না। আপু আমাকে রুবি কে, জুবায়ের ভাইয়াকে তুই করেই সম্মোধন করে। আপুর অনেক ইচ্ছে ছিলো আমাদের তার বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াবে। এই উপলক্ষে আজকে আপুর বাসায় দাওয়াত আমাদের আর জুবায়ের ভাইয়ারও।

সন্ধ্যা থেকেই আপুর ফ্ল্যাটে আপুর সাথে কাজে সাহায্য করছি আমি। রুবি এখনো বাসায় আসে নি, ও বাসায় আসবে ৮ টা বাজে টিউশনি থেকে। বজকে তুফসা আপু অনেক ধরনের আইটেম রান্না করেছে। পোলাও , সাদা ভাত, মুরগীর রোস্ট, গরুর কালা ভুনা, খাসির মাংস, শুটকি ভর্তা, বাদাম ভর্তা, চিংড়ি মাছ ভাজা, আমের ডাল, সালাদ, পায়েশ, এবং সব শেষে মালাই চা।
আস্তে আস্তে রাত ১১ বাজতে চললো কিন্তু জুবায়ের ভাইয়া এখনো আসে নি তাই । তুফসা আপু জুবায়ের ভাইয়াকে কল দিতে বললো আমাকে তার ফোন থেকে। আমি জুবায়ের ভাইয়াকে কল দিয়ে ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিলাম। একবার রিং হওয়ার পর জুবায়ের ভাইয়া কল রিসিভ করে বললেন,

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ২

– আসসালামু আলাইকুম আপু,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , কোথায় তুই? খেতে আসবি না? খাবার যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে জুবায়ের।
– আসলে আপু আমার তো প্রচুর ক্ষুদা লাগছে কিন্তু একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
– কি সমস্যা তোর কি পেট খারাপ হইছে?
আপুর কথা শুনে আমি আর রুবি শব্দ করে হেসে ফেললাম। এরপর জুবায়ের ভাইয়া বললেন,
– আরে না আপু তুমিও মজা নিতাছো?
– আচ্ছা আর মজা করবো না বল কি হইছে তোর?
– আসলে আপু আমার সাথে আজকে থেকে ফ্ল্যাটে আমার এক বন্ধুও থাকবে। ওকে তোমার বাসার দাওয়াতে যাওয়ার কথা বলাতে সে বলেছে সে যাবে না। এখন তুমিই বলো ওরে ছাড়া আমি কিভাবে তোমার বাসায় গিয়ে খাই?

– এটা কোনো সমস্যা হইলো? হ্যাঁ,আহাম্মক তোর বন্ধুরে ফোনটা দে।
– ওয়েট দিচ্ছি।
জুবায়ের ভাইয়া জোর করে তার বন্ধুর হাতে ফোন দিয়ে বললো তার একমাত্র হতভাগী বোন তার সাথে কথা বলতে চায়। যা এদিকে আমরা পুরোটাই শুনতে পারলাম ।
ওপাশ থেকে একটি অপরিচিত কিন্তু অল্প পরিচিত গলার কন্ঠ ভেসে আসলো যা আমার হৃদয়ে তোলপাড় শুরু করে দিলো।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৪