ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৪ || লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৪
লেখায়- মোসাঃফাতেমা আক্তার

-আসসালামু আলাইকুম আপু
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, তুমি আসতে চাইছো কেন খেতে?
– আপু আসলে,,
– শুনো তোমার কথা পরে শুনবো এখন জুবায়ের কে নিয়ে খেতে এসো। তোমার জন্য আমরাও অভুক্ত জানো?
– আপু আমি দুঃখিত।
– শুনো ভাই দুঃখ পরে পেলেও চলবে তুমি আসো আমি খাবার সার্ভ করছি। জলদি।

এই বলেই আপু আমাকে ইশারায় বললো কলটা কেটে দিতে।
আমি আপুর কথা মতো কলটা কেটে দিয়েছি।
ড্রইং রুমে এসি চলছে তাও আমি তরতর করে ঘামছি। এখন যদি ধূসর আসে, আমি তো লজ্জায় তার সামনেই যেতে পারবো না। হায় আল্লাহ কি মুসিবতে ফেললা আমাকে।
ধপ করে আমি ফ্লোরে বসে পরলাম। আমার অবস্থা এখন করুন।
তুফসা আপু আর রুবি আমার এমন কান্ড দেখে সরু চোখে তাকিয়ে আছে, যা আমাকে আরো বেশি নাজেহাল করে ফেললো।

কলিংবেল বাজার শব্দে আমি ছুটে রান্না ঘরে চলে আসলাম। রুবি গিয়েছে দরজা খুলতে। ড্রইং রুম থেকে জুবায়ের ভাইয়ার, আপুর, রুবির সাথে ধূসরে ও গলার কন্ঠ ভেসে আসছে। ধূসরের কন্ঠ স্বরে আমার মনের তোলাপাড় কয়েক গুন বাড়িয়ে দিলো, যা আমার নিজের অজান্তে। একটুপরই আমার ডাক পড়লো খাবার খাওয়ার জন্য কি করবো ভেবে না পেয়ে গায়ের ওরনা দিয়ে বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে নিলাম। আমি ডাইনিং টেবিলের সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম বসাই খেতে বসে পড়ছে। শুধু ধূসরের বরাবরের চেয়ারটা খালি। ইয়া আল্লাহ ওনার সামনে যেনো না পরতে হয়, তার জন্যই এতো বড় ঘোমটা দিলাম কিন্তু ঘোমটা দিয়ে লাভ কি হলো। এই চেয়ারে বসলে ওনি আমার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাবে। এরপর আপু ডাকে আমার ভাবনায় বাঁধা পড়লো। ওনি বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– কিরে কাহিনি কি? হ্যাঁ খাবি না? ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন এখানে এসে বস।
আপুর কথা শুনে সবাই আমার দিকে ফিরে তাকালো। তাদের চাহুনি এমন ছিলো মনে হয় আমি কোনো খুনের আসামি ।
ওনাদের এমন চাহুনি দেখে আমি বিড়বিড় করে বললাম,
ইয়া আল্লাহ মাটি দুই ভাগ করো আমি মাটির নিচে চলে যাই।
এরপর রুবি আমার অবস্থা দেখে কিছু বুঝতে পারলো কিনা জানি না কিন্তু সবার মনোযোগ আমার দিক থেকে ফেরানোর জন্য কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
-আপু অলি কই? ও খেয়েছে?

এই যাত্রায় মনে হলে আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম এখন যদি রুবি অলি মানে তুফসা আপুর মেয়ের কথা না তুলতো তাহলে আমাকে আর কিছু কথা শুনতে হতো।
একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে ধূসরের বরাবর চেয়ারটাতে বসতে হলো। ওনার মুখোমুখি বসার পরও ওনি আমার দিকে একবারের জন্যও তাকিয়ে দেখে নি।যা আমায় প্রচুর ভাবাচ্ছে। ওনি কি আমাকে দেখেও না দেখবার ভান করছে নাকি এর পেছনে দুপুরের মতো আবার কোনো কারণ নাই তো?

এখানে এসেও যে আমাকে সন্ধ্যার সাথে দেখা হবে তা আমি জানতাম না। জানলে আসতাম না কারণ আমি জানি ও দুপুরের ব্যাপারটায় প্রচুর লজ্জা পেয়েছে যা তার চোখে মুখে আমি স্পষ্ট দেখেছি একটু আগে। আমি আর ওকে লজ্জা দিতে চাই নি তাই ওর দিকে আর দৃষ্টি মেলে তাকায় নি। খাওয়ার পর্ব শুরু হয়ে গেলো। এতো আইটেম দেখে আমার চোখছানাবড়া৷ না চাইতেও আপুকে বলে ফেললাম,
-আপু এতোসব আইটেম কি আপনি নিজে রান্না করেছেন? গরুর কালা ভুনা খুবই সুস্বাদু হয়েছে ঠিক চিটাগাং এর মতো।
আপু বলেনে,

– না গো আমি একা রান্না করি নি, আমার হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে ছিলো সন্ধ্যা আজকে। ওই তো গরু মাংসাটা রান্না করেছে। ও নাকি এর আগে একবার রান্না করেছিলো।
– সন্ধ্যা কে আপু?
আমি ইচ্ছে করেই এমন প্রশ্ন করলাম যাতে সন্ধ্যা একটু নরমাল হতে পারে আমার সঙ্গে। তারপর আপু বলেন,
– ওহ!! তুমি তো এখনো ওদের সাথে পরিচিত হও নি না? আচ্ছা সমস্যা নাই আমিই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।ওহ হচ্ছে রুবি আর তোমার বরাবর যে জন বসে আছে সে হলো সন্ধ্যা ।
সৌজন্যের খাতিরে রুবি কে হ্যালো জানালাম এবং সন্ধ্যা কে ও। কিন্তু সন্ধ্যা মুখে ঠিকই আমাকে হাই বললো কিন্তু আমার দিকে তাকালো না। হয়তো এখনো ওর লজ্জা কমে নি। মেয়েটার কিছুই খাচ্ছে না, প্লেটে খাবার নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। আচ্ছা ও কি আমার জন্যই খেতে পারছে না?
খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর আমাদের সবাইকে আপু বারান্দায় গিয়ে বসতে বললেন।

জুবায়েরের সাথে আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম। ভাদ্র মাস হওয়ায় প্রচুর গরম পড়েছে আজকে। চারদিকে একফোঁটা বাতাস নেই। কিন্তু বারান্দায় এসে একদমই ভিন্নচিত্র দেখতে পেলাম। তাহলো আপুর বারান্দায় মোটামুটি ভালোই বাতাস। আপুর বারান্দায় কোনো গ্রিল নেই । এটাকে ঝুলবারান্দা বলে। আমাদের চট্রগ্রামের বাসায় আমার রুমের সাথে ঝুলবারান্দা আছে। আপুর বারান্দায় মোটামুটি সব ধরনের ফুল গাছ আছে। আপু বারান্দায় যে ফুলগাছটা আমার দৃষ্টি কেরে নিলো তাহলো সাদা কাঠগোলাপ গাছ। কি সুন্দর গাছটায় কাঠগোলাপ ফুটে রয়েছে। আজকে পূর্নিমা। চারোদিকে পূর্নিমার চাঁদের আলোয় আলোকিত।

এখন রাত ১২টার বেশি বাজতে চললো। বারান্দা দিয়ে ঢাকার শহরকে শেষ বারের মতো দেখছি। এরপর আর কখনো হয়তো আমি আর এই দৃশ্য নাও দেখতে পারি। ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরী আস্তে আস্তে নির্জীব হয়ে পরছে। হবেই বা না কেন? সারাদিন জীবিকার চাহিদায় ছোটাছুটি করার পর এই রাতেই বেলাই তো আপনজনের কাছে ছুটে চলে যাওয়া যায়। এই একটা বেলাই অনেকে পরিবারের সাথে বসে দুটো খাবার খায়।

এই রাতের বেলাতেই তো কত রকমের রহস্যমূকল ঘটনা ঘটে শহরের আনাচেকানাচে ।এই রাতের বেলায়ই মানুষ মন খুলে জীবনের আনন্দ, দুঃখ উপভোগ করে। এই রাতের বেলায় অনেকে জীবনের আবার নতুন করে সূচনা করে প্রিয়জনের সাথে। অনেক যুবকই দিনের বেলায় ভালো থাকার অভিনয় করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, ঠিক তারাই রাতের বেলাকে বেছে নেয় নিজের ক্লান্ত মনটা কে শান্ত করতে। সেই যুবকরা নিজের মনকে শান্ত করতে গিয়ে অসংখ্যা নিকোটিন পুরে ছারখার করে। কই কখনো কি শুনেছে সেই নিকোটিনে কারণে কেউ তার ক্লান্ত মনকে শান্ত করতে পেরেছে?

শুননি তাই না? আমি বলি কি শুনছেন, শুনছেন ওমুক নামের একযুবক অকালে মারা গিয়েছে ফুসফুসের ক্যান্সার। অনেকে আবার একটু বেশিই আপডেট কারণ তারা শুধু সিগারেট খেয়ে থেমে থাকে না। তারা প্রেয়সীকে হারানোর শোকে আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। এদের মাঝে কয়েকজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। কিন্তু তারা সারাটা জীবন জীবন্ত লাশ হয়ে কাটায়। তাদের মাঝে আমিও একজন একবার নয়, দুবার নয়, পাঁচ বার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলাম।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৩

কিন্তু আমি আমার প্রেমিকের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেই নি। আমার আত্নহত্যার পেছনে খুব বড়ো একটা ইতিহাস নেই তবে আছে কিছু কষ্টের স্মৃতি যা আমি কাউকে কখনো বলি নি। বলবো বা কিভাবে আমার কথা শুনবার জন্য কেউ নেই আমার পাশে। পড়ার টেবিলের উপর থেকে একটা খাতা আর কলম নিয়ে লেখা শুরু করলাম।

“আমার নামের আগে যে কালিমা লেগেছে বা আমার গায়ের যে কলঙ্ক লেগেছে তা তো আর সহানুভূতি দিয়ে আর দূর করা যায় না? তাই না। সমাজের চোখে আমি সবসময় একজন ধর্ষিতা হয়ে বাঁচতে হবে। তা আমি মানতে পারবো না । মাফ করে দিও তোমরা আমায়, আমি তোমাদের ভালো মেয়ে হতে পারলাম না।”
ইতি
কুহু

লিখে কাগজটা পড়ার টেবিলের উপর একটা বই দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে। বাসার মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে গেলাম আমার গন্তব্য কমলাপুর রেলস্টেশন। আমি নুসরাত জাহান কুহু। অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। এছাড়াও আমার একটা পরিচয় আছে তাহলো আমি ধর্ষিতা। আমি আমার মায়ের ভাষ্যমতে তার গর্ভের কলঙ্ক ।

ধূসর রঙ্গের সন্ধ্যা পর্ব ৫