জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৫ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৫
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

বিহান কিছুক্ষণ নুসরাতের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে গেমস খেলায় মনোযোগ দিল। নুসরাত বুঝল তার ভাইটার মনে এখনও অনেক অভিমান জমে আছে। নুসরাত গুটিগুটি পায়ে ধীরগতিতে বিহানের পাশে গিয়ে বসল। বিহান অনেক কষ্টে ফোনের দিকে নিজের দৃষ্টি আটকে রেখেছে। ভুল করেও তাকাচ্ছে না নুসরাতের দিকে। চোখ টলমল করে উঠছে, কিন্তু জোর করে সেই জল চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরতে দিচ্ছে না। সৌহার্দ্য এসে সিঙ্গেল সোফার হ্যান্ডেলের ওপর এসে বসল। নুসরাত সৌহার্দ্যর দিকে তাকাতেই সৌহার্দ্য কাঁধ ঝাকালো, অর্থাৎ ‘এবার তুমিই সামলাও’। নুসরাত বিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” পিচ্চু! কথা বলবি না?”

বিহান দাঁতে দাঁত চেপে ফোনের স্ক্রিন দেখছে। নুসরাত আস্তে করে বিহানের কাঁধে হাত রাখতেই বিহান হাত সরিয়ে দিল। নুসরাত ঘাড় বাঁকা করে বিহানের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” এখনও রেগে আছিস আমার ওপর?”
বিহান ফোনে স্ক্রিনে চোখজোড়া আবদ্ধ রেখেই বলল,
” রাগ কেন করতে যাব। যারতার ওপর রাগ করা যায়না?”
” আমি যে সে?”
” আমার কাছেতো তাই।”
নুসরাত এবার করুন স্বরে বলল,
” আচ্ছা সরি বলেছিতো কতবার। আমিতো কতবার বলেছি আমি ভুল করেছি। একবছর যাবত সরি বলছি। সেটা যথেষ্ট না?”
বিহান কঠোর স্বরে বলল,
” সরি বলার দরকার নেই আমি রেগে নেই।”
” তাহলে ঠিককরে কথা বল?”
বিহান কিছু বলল না। নুসরাত মুচকি হেসে বলল,
” একটা ভালো খবর দেওয়ার আছে তোকে।”
বিহান ভ্রু কুচকে তাকাল নুসরাতের দিকে। নুসরাত মুচকি হেসে বলল,
” তুই মামা হতে চলেছিস।”
বিহান অবাক চোখে তাকিয়ে রইল নুসরাতের দিকে। সৌহার্দ্যও অবাক হয়ে গেল। খুশি হয়ে প্রায় দৌড়ে এসে নুসরাতের পাশে বসে বলল,
” সিরিয়াসলি?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নুসরাত মাথা নাড়ল। বিহান এখনও অবাক দৃষ্টিতে দেখছে নুসরাতকে। আস্তে আস্তে ওর মুখেও হাসি ফুটে উঠল। ও খুশি হয়ে কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। নুসরাত বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” যেটা পারিস না সেটা করার চেষ্টা না করলে হয়না?”
বিহান এবার আস্তে আস্তে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে হুটি করেই জড়িয়ে ধরল নুসরাতকে। নুসরাতও মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরল ওকে। সৌহার্দ্য বুক থেকে পাথর নামল একপ্রকার। যাক দুজনের মান অভিমান ভাঙলো তাহলে। সৌহার্দ্য হাতভাজ করে দেখছে এদের। বিহান একদম বাচ্চাদের মত করে বলল,

” আমার আগে আর কাউকে জানাস নি তো?”
নুসরাত হেসে বলল
” উমহুম! শুধু তোর ভাইয়াকে বলেছি।”
” তাহলে ঠিকাছে।”
” এখনও আগের মতই হিংসুটে আছিস।”
বিহান নুসরাতকে আরেকটু ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
” আপুটা তো আমারই।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বলল,
” ও হ্যালো? এটা আমারও আপু।”
বিহান নুসরাতকে ছেড়ে একটু হিংসুটে স্টাইলে বলল,
” হ্যাঁ হ্যাঁ জানি সেটা এতবার বলার কী আছে?”
সৌহার্দ্য হাসল কিন্তু কিছু বলল না। বিহান নুসরাতের দিকে তাকিয়ে অবুঝদের মত বলল,
” আচ্ছা বেবিটা কবে আসবে?”
নুসরাত অবাক হয়ে বলল,
” তুই কী সত্যি বাচ্চা হয়ে গেছিস পিচ্চু!”
সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,
” ও আবার বড় ছিল কবে?”
বিহান বলল,

” আচ্ছা শোন আপু আজ কিন্তু এখানেই থাকবি। আমি তিনজনের জন্যেই খাবার অর্ডার করছি।”
নুসরাত বলল,
” বসতো।অর্ডার করতে হবেনা। আজ আমি রান্না করছি।”
সৌহার্দ্য উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
” ওয়াও! মাংস ভুনা প্লিজ!”
বিহানও তাল মিলিয়ে বলল,
” হ্যাঁ মাংস ভুনা।”
নুসরাত বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
” আচ্ছা ঠিকাছে কানের মাথা খাস না তো।”
তিনজনই এই ব্যাপারে একদফা মন খুলে হেসে নিল। এরপর শুরু করল তাদের খুনশুটিময় আড্ডা।

তুর্বী বিরক্তি নিয়ে হাত ভাজ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ বসের সাথে কথা বলেছিল ওকে ভালো কোন নতুন প্রজেক্টে কাজ করতে দেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু ওর বস সেই কমন কিছু ডায়লগ দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিখিয়ার জন্যে ওয়েট করছে। রিখিয়া বলেছে সিএনজি নিয়ে এই রোড দিয়েই আসবে। এসব ভাবতে ভাবতেই একটা সিএনজি ওর সামনে এসে থামল। ভেতরে থেকে রিখিয়া বলে উঠল,
” উঠে এসো?”
তুর্বী মুখ ফুলিয়ে উঠে বসল। সিএনজি আবার চলতে শুরু করল। তুর্বীকে এমন বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিখিয়া বলল,
” কী ব্যপার? মেজাজ এত খারাপ হয়ে আছে কেন?”
তুর্বী বিরক্তি ঝেড়ে বলল,
” আর বলিস না ইয়ার। বসকে বললাম সবটা। কিন্তু সে কী বলল জানিস?”
” কী বলল?”

” তুমি এখনও নতুন। এখনও বড় প্রজেক্টের জন্যে রেডি নও। আরেকটু একপিরিয়েন্স চাই। ব্লা ব্লা ব্লা।”
” হ্যাঁ তো কিছুদিন ওয়েট করো। ঠিক দেবে।”
” আরে তুই বুঝতে পারছিস না আমি বুড়ো হয়ে যাবো সিনিয়র আর্কিটেক্ট হতে হতে।”
রিখিয়া হাসল। মেয়েটা এত ছটফটে কেন? তুর্বী অাবার বলল,
” তারওপর বস আবার ব্যাংকক যাবে কয়েক মাসের জন্যে।”
রিখিয়া অবাক হয়ে বলল,
” তাহলে ওপার জায়গায় কে বসবেন?”
” কী জানি? হয়ত ওনার ছেলে।”
” তাহলেতো ভালোই! ওনার ছেলেকেই বলবে। ইয়াং তো। হয়ত তোমার প্রবলেম টা বুঝবে।”
তুর্বী একটু হেলান দিয়ে বলল,
” আমার প্রবলেম আমি মরার আগে শেষ হবেনা।”
রিখিয়া কিছু বলবে তার আগেই তুর্বীর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ওর মা ফোন করেছে। তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,

” এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। এখন এই মহিলার ফ্যাচফ্যাচানি শুনতে হবে।”
তুর্বী ফোন রিসিভ করে বলল,
” হ্যাঁ বলো।”
ওপাশ থেকে ওর মা বলল,
” টাকা লাগবে। কালকে হাজার পারেন পাঁচ টাকা পাঠিয়ে দিস।”
তুর্বী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” হ্যাঁ সেই। আমি তো টাকার ফ্যাক্টরি।”
” ওই এসব ত্যাড়া কথা বলছিহ কেন? টাকা লাগবে তাইতো চাইছি।”
তুর্বী অধৈর্য হয়ে বলল,
” আচ্ছা এত টাকা দিয়ে কী কর বলোতো? মাত্র দুজন মানুষ তোমরা। ভাইয়ের পড়ার খরচ আর তোমাদের দুজনের খেতে এত টাকা লাগে?”
” এখন তুই কী আমার কাছে হিসেব চাইবি নাকি? কটা টাকা দিস বলে এখন খোটাও শুনতে হবে?”
তুর্বী চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
” খোটা কখন দিলাম আজব! আচ্ছা পাঁচ হাজার তো? পাঠিয়ে দেব শান্তি?”
” হ্যাঁ একটু তাড়াতাড়ি।”

বলে ফোনটা রেখে দিল। তুর্বী বিরক্তি নিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে ওর। রিখিয়া বুঝতে পারছে যে তুর্বী কান্না আটকানোর চেষ্টায় আছে। রিখিয়া তুর্বীর কাঁধে হাত রেখে বলল,
” তুমি তো জানো উনি এমনই কষ্ট কেন পাচ্ছো?”
তুর্বী নাকটা একটু টেনে হেসে দিয়ে বলল,
” ছাড়তো! ওই মহিলার কথা কে শোনে।”
রিখিয়াও আর কিছু বলল না। দুজনেই চুপচাপ রইল। ফ্লাটে পৌছে তুর্বী আগে ওয়াসরুমে গেল। রিখিয়া দুজনের ব্যাগই গুছিয়ে রাখতে গিয়ে ওর ব্যাগের চেইন খোলা থাকায় কিছু জিনিস নিচে পরে গেল। রিখিয়া ওগুলো ওঠাতে গিয়ে বিহানের সেই কার্ডটা চোখে পরল। আর মনে পরল বিহানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। বিহানের বলা শেষ কথাটা। আচ্ছা লোকটা ওকে এত সাহায্য করল, তারওপর ওর জন্যে লোকটার অপমানও হয়েছে। তাই ও যদি বিহানের সাথে একটা দিন একটু কফি খেতে গেলে কী এমন হবে? শুধু যাবে, কফি খাবে, কিছক্ষণ থাকবে এরপর চলে আসবে। এটুকুই তো। এটুকুর জন্যে যাওয়াই যায়।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৪

বিহানের ফ্লাট থেকে ওর সাথে ব্রেকফাস্ট করে একবার‍েই নিজেদের বাড়িতে এল সৌহার্দ্য আর নুসরাত। ওদের দুজনকে একসঙ্গে বাড়িতে ঢুকতে দেখে মিসেস নাহার এগিয়ে এসে বললেন,
” কীরে নুসু? কাল বাড়িতে এসে একটু পরেই বেড়িয়ে গেলি? এমন করে কেউ? কত চিন্তা হচ্ছিল জানিস?”
নুসরাত হেসে বলল,
” ঠিক আছিতো মা। আর তোমার জামাইও চলে আসবে দুপুরে।”
সোফায় বসে থাকা শফিক রায়হান বললেন,
” কাল সারারাত বিহানের বাড়িতে ছিলে দুজন?”
নুসরাত কিছু বলার আগেই সৌহার্দ্য বলল,
” হ্যাঁ ছিলাম। ভাই হয় ও আমাদের। তাই একরাত ওর কাছে থেকে আসাটা অন্যায় নাকি?”
নুসরাত ওর বাবার পাশে বসে বলল,
” বাবা পিচ্চুটার কথা খুব ভালো মনে পরছিল। তাই ওর কাছে একটু থেকে এলাম।”
শফিক রায়হান কঠিন কন্ঠে বললেন,
” তোমরা কী বুঝতে পারছ না ওকে এভাবে সাপোর্ট করে, তোমরা ওকে আরও বিগড়ে দিচ্ছো? তোমাদের এসব আল্লাদে ও বুঝতেই পারেনা যে ও ভুল করছে।”
স‍ৌহার্দ্য বলল,

” এখন কী করছে জানিনা। কিন্তু আগে ও কোন ভুল করেনি।”
” আচ্ছা? এত নিশ্চিত কীকরে তুমি?”
” আমার নিজের ভাইয়ের ওপর বিশ্বাস ছিল। আর এখনও আছে। আর তাছাড়াও তোমরা কেউই নিজের চোখে দেখনি কিছু।”
শফিক রায়হান হাত ভাজ করে বলল,
” আচ্ছা? এত বড় বড় কথা বলছ? তাহলে সত্যি যদি কোনদিন তুমি নিজেই ওকে কোন অন্যায় করতে দেখ? যদি সত্যি ভবিষ্যতে যদি প্রমাণসহ ওর কোন অপরাধ তোমার চোখে পরে তাহলে?”
সৌহার্দ্য শক্ত কন্ঠে বলল,
” সেদিন আমি নিজে ওকে ত্যাগ করব।”

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৬