জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৪ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৪
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

বিহান রিখিয়াকে বাড়ি পৌছে দিয়ে ফ্লাটে এসে সবে ঘুমিয়েছিল। এমন সময় কলিং বেল বাজাল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম মাখা চোখে হেলতেদুলতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে, মুখমন্ডলে রাগ স্পষ্ট। বিহান চোখ পিটপিট করে ভ্রু কুচকে বলল,
” ব্রো, আমার ঘুমের সাথে তোর কীসের শত্রুটা বলবি? তোর কাছে তো ডুপ্লিকেট চাবি আছেই, ঢুকে যেতি।”
সৌহার্দ্য মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,

” আপনাকে তো বিশ্বাস নেই। ভেতরে আপনার সাথে আপনার গার্লফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ আছে কি-না কীকরে জানবো? আপনার রঙলীলা সাক্ষাৎ দর্শন করার শখ নেই আমার।”
বিহান ঘুম চোখেই হেসে সরে দাঁড়াল। সৌহার্দ্য ভেতরে ঢুকে সোজা সোফায় গিয়ে বসল। সৌহার্দ্য কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে। বিহান বুঝতে পারল ঐ বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে, আর সেটা ওকে কেন্দ্র করেই হয়েছে। একটা জিনিস ও বুঝতে পারেনা। ও তো চলে এসছে। ওর ছায়ায় তো ওনাদের মারাতে হয়না। তবুও কেন করে এরকম করে ওনারা? শুধু সৌহার্দ্য এখানে আসে বলে? বিহান সৌহার্দ্যর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” ঐ বাড়িতে কিছু হয়েছে তাইনা? তুই কেন ওদের কথা কানে নিস বলবি? বলতে দে না ওরা যেটা বলে। যা ইচ্ছে হয় ভাবতে দে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সৌহার্দ্য ঝারি মেরে বলল,
” তাই বলে যা ইচ্ছা হবে তাই বলবে নাকি?”
” আরে কী হয়েছে কী তাতে? মরে গেছি আমি?”
” এমনি চুপ করবি? না-কি থাপ্পড় খেয়ে চুপ করবি?”
বিহান খানিক হাসল। এরপর পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলল,
” ওসব কথা বাদ দে। এবার বল কাজ হল? ঐ মেয়েটাকে যেকারণে কিডন্যাপ করেছিস সেটা হয়েছে?'”
সৌহার্দ্য একপলক বিহানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
” আমার কাজ হয়ে গেছে।”

” বাহ ব্রো! কী এম করলে যে একরাতেই সোজা হয়ে গেল?”
সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বিহানের দিকে তাকাতি বিহান চোখ মার। সৌহার্দ্য বলল,
” এই চুপ করতো তুই, সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বলবে।”
” ওকে, বলবি তো যে কী করেছিস?”
সৌহার্দ্য বিহানকে সারারাতে ঘটা কাহিনী খুলে বলল। বিহান সব শুনে একদফা মন খুলে হাসল। বিহানের হাসি দেখে সৌহার্দ্যও হাসল। বিহান হাসতে হাসতে বলল,
” সত্যিই ঐ মেয়ে একটা জিনিসই। মানতে হচ্ছে ভাই!”
সৌহার্দ্য এবারেও হাসল। বিহান কিছু একটা চিন্তা করে বলল,
” আমার মনে হয়না ঐ মেয়ের মাথা থেকে প্রেম করার ভুত আদোও নেমেছে।”
সৌহার্দ্য কপাল কুঁচকে বলল,

” বলছিস?”
” হুম বলছি তো।”
সৌহার্দ্যর হঠাৎ কিছু একটা মনে পরতেই ও বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুই বল তুই রিখিয়ার সাথে কী করেছিস? সেদিনের জন্যে মেয়েটার সাথে মিসবিহেভ করিস নি তো?”
বিহান হু কেয়ারস্ একটা ভাব নিয়ে বলল,
” আমার কী খেয়েদেয়ে কাজের অভাব পরে গেছে না কী?”
” তাহলে? সারারাত কী করলি?”
” কী আর করব? সারারাত নিয়ে নিয়ে ঘুরলাম। পাহারা দিলাম। রাতের ডিনার, সকালের ব্রেকফাস্ট দুটোই করালাম। বাড়ি পৌছেও দিলাম।”
সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” আমি তোকে ফোন করে বলতাম রিখিয়া কোথায় আছে দেখতে আর ওর খেয়াল রাখতে। কিন্তু তুই তার আগেই তুই ওর কাছে গিয়ে পৌছে গেলি কীকরে?”

বিহান কিছু বলল না শুধু হাসল। সৌহার্দ্য সন্দিহান চোখে বিহানের দিকে তাকিয়ে ভাবল,
সেদিনের ঘটনাটা বিহান এত সহজে ভুলে গেল? ঐ ঘটনাটা পরেও রিখিয়ার সাথে এত নরমাল হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হলেও তো বিহানের পক্ষে সম্ভব না। বরং অন্য স্বাভাবিক মানুষের চেয়েও বিহানের মনে এই ঘটনার খারাপ এফেক্ট বেশি পরার কথা। এসব ভাবতে ভাবতে সৌহার্দ্য বলল,
” দেখ মেয়েটার ওপর কোনভাবে রাগ করিস না। ওর কিন্তু কোন দোষ নেই।”
বিহান ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,
” হ্যাঁ। ঠিকই বলেছিস। ওর কোন দোষ নেই। দোষটা আমার ছিল। আমিই বোকার মত ওকে হেল্প করতে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে গেছিলাম যে ও সেই মেয়ে জাত।”

” কীহ?”
” নাহ। মানে একটা মেয়ের গায়ে হাত দেওয়া ঠিক হয়নি সেটাই বললাম।”
সৌহার্দ্য লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” দেখ বিহান। আমি আগেও তোকে অনেকবার বলেছি এখনও বলছি। একজনের জন্যে সবাইকে দোষী ভাবাটা উচিত নয়। জীবনকে দ্বিতীয় সুযোগ দিতে হয়।”
বিহান একই ভঙ্গিতে হেসে বলল,
” টক হওয়া তেঁতুলের বৈশিষ্ট্য। সেটা যেই জাতের তেঁতুলই হোক।”
সৌহার্দ্য এই কথার উত্তরে কিছু বলবে তার আগেই বিহান বলল,
” ঘুম পাচ্ছে, রাতে ঠিক করে ঘুম হয় নি। চল ঘুমাবো।”
বলে বিহান উঠে বেডরুমে চলে গেল। আর সৌহার্দ্যও ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বিহানের সাথে রুমে গেল। এরপর দুজনেই বেডের দুপাশে এলোমেলো হয়ে যে যেভাবে শান্তি পেল শুয়ে পরল। সবাই রাতে ঘুমায় কিন্তু দুই ভাই মিলে সকালবেলাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই তুর্বীর মেজাজটা খুব বেশি পরিমাণ খারাপ হয়ে আছে। কিছু খেয়ে মুখ ফুলিয়ে খাটে শুয়ে আছে সে। কিছুই ভালোলাগছে না। আর ভালো না লাগার মূল কারণ হল তার কাজ। তাকে যেই কাজ দেওয়া হয় সেটা নিয়ে ও মোটেও সন্তুষ্ট নয়। মানছে ও নতুন জয়েন করেছে, এখনও তেমন বিশেষ কোন এক্সপিরিয়েন্স নেই ওর। তাই বলে ওকে যদি নতুন বা ভালো মানের প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ না দেয় তাহলে ও কী করে নিজের এবিলিটি বুঝবে? এক্সপিরিয়েন্স কীকরে হবে? এরমধ্যেই রিখিয়া এসে ওর পাশে শুয়ে পরল। তুর্বীকে চুপ থাকতে দেখে রিখিয়া বলল,

” কী ব্যপার? আজ এত চুপ যে?”
তুর্বী কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল,
” আমার ভবিষ্যত অন্ধকার।”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে তুর্বীর দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল,
” কী বলছ? তোমার ভবিষ্যতে কেন অন্ধকার হতে যাবে?”
” হোয়াট এম আই ডুয়িং ইয়ার? আমার জব টা আমার কাছে জাস্ট ইরিটেটিং হয়ে যাচ্ছে। ভালো বা বড় কোন প্রজেক্টই দিচ্ছেনা।”
” আরে তুমিতো কয়েক মাস হল জয়েন করলে। অপেক্ষা কর আরও কিছুদিন?”
তুর্বী বিরক্ত হয়ে বলল,
” কয়েক মাস যাবত কাজ করছি মানছি। তাই বলে ভালো একটা প্রজেক্ট দেবেনা? আমি কিছু না করলে বুঝব কীকরে আমি কতটা যোগ্য?”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তোমার বসের সাথে কথা বলে দেখ এ ব্যপারে?”
তুর্বী উঠে আসাম করে বসে বলল,
” মানে এখন আমি কাজ ভিক্ষা চাইব?”
রিখিয়া উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে বলল,
” আরে কাজ ভিক্ষা কেন চাইতে যাবে? তুমি জাস্ট গিয়ে বলবে তোমাকে যাতে একটা ভালো প্রজেক্টে কাজের একটা অপুরচুনিটি দেয়, ব্যাস। আর কিছু না।”
তুর্বী ভ্রু উঁচু করে বলল,
” বস শুনবে?”

” আরে তুমি বলেতো দেখো একবার? কাজ হলেও তো হতে পারে।”
তুর্বী মাথা নাড়াতে নাড়াতে ভাবল যে রিখিয়া ঠিকই বলছে। একবার বসের সাথে কথা বলেই দেখা যাক। বিষয় বদলে তুর্বী রিখিয়াকে বলল,
” এবার তুই বল বিহানের সাথে কফি খেতে কবে যাচ্ছিস?”
রিখিয়া আঙ্গুলে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বলল,
” ভাবছি কী করা যায়।”
” আরে এত ভাবার কী আছে? কফিই তো খাবি নাকি।”
রিখিয়া কিছু না বলে শুয়ে পরল। তুর্বীও আর ঈথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরল ওর পাশে।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৩

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক্ষণ। বিহান মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। আর সৌহার্দ্য টিভির দেখছে। দেখছে বলতে শুধু চ্যানেল ঘোরাচ্ছে স্হির হয়ে বসে কিছু দেখছে না। সৌহার্দ্য চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বলল,
” রাতে কী খাওয়া যায় বল তো?”
বিহান গেম থেকে মনোযোগ না সরিয়ে বলল,
” আজ রান্নার মুড নেই। অর্ডার করাই ভালো।”
” এখন করব না পরে?”
” সবেতো সন্ধ্যা হল। রাত হতে দে আগে।”
” আচ্ছা।”
আবার যে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। ঘন্টাখানেক কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই কলিং বেল বেজে উঠল। বিহান বলল,
” ব্রো, তুই যা। ইন্টারেস্টিং লেবেলে আছি।”
সৌহার্দ্য ছোট চোখে বিহানের দিকে একপলক তাকিয়ে দরজা খুলতে চলে গেল। দরজা খুলে সৌহার্দ্য অবাক হয়ে গেল। অবাক চোখে তাকিয়ে থেকেই বলল,
” আপু?”

নুসরাত মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিল। সৌহার্দ্যও হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরল নিজের বড় বোনকে। সৌহার্দ্য বলল,
” কেমন আছো?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোর কী খবর?”
” এইতো। তুমি এখানে এলে যে হঠাৎ?”
” গেছিলাম ঐ বাড়িতে। তুই ওখানে নেই শুনে এখানে চলে এলাম। তা সে কোথায়?”
সৌহার্দ্য ইশারায় দেখাল ভেতরে আছে। নুসরাত মুচকি হেসে পা টিপে টিপে ভেতরে এসে দেখে বিহান মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। নুসরাতের বুক ভার হয়ে এল। কাঁপাকঁপা গলায় বলল,
” পিচ্চু?”
বিহান চমকে তাকাল। নুসরাতকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল বিহান। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে আদ্রতা এসে ভর করল। তারসাথে মনে এসে ভর করল একরাশ অভিমান।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৫