জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৩ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৩
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

তুর্বীকে ছেড়ে দিয়ে সৌহার্দ্য সোজা নিজের বাড়িতে গেল। শফিক রায়হান বসে ল্যাপটপে নিজের কাজ করছিলেন। আমিনুর সাহেব ওনার পাশে বসে আছেন আর টিভি দেখছেন। মিসেস নাহার আর মিসেস আসমা কিচেনে রান্না করছেন। এরমধ্যেই সৌহার্দ্য এসে বাড়িতে ঢুকলো। ও কিছু না বলে ওপরে চলে যেতেই নিচ্ছিল। কিন্তু শফিক রায়হান থামিয়ে দিয়ে বললেন,

” কোথায় ছিলে কালকে?”
সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে গিয়ে সহজভাবে বলল,
” কিছু কাজ ছিল বাবা।”
শফিক রায়হান গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
” তা কাজটা কী ওই লোফারটার কাছে ছিল নাকি?”
সৌহার্দ্যর এমনিতেই মন ভাল নেই। বিহানকে এরকম কথা বলায় ওর আরও রাগ হল। ও শক্ত কন্ঠে বলল,
” দেখ বাবা। সবসময় সব কথায় ওকে টেনে আনা বন্ধ করো। যদি ওর সম্পর্কে ভালো কিছু বলতে না পারো তো খারাপ কিছু বলোনা।”
আমিনুর খান বললেন,

” বাবা তুমি খুব ভালো ছেলে। তোমার ভবিষ্যত অনেক উজ্জ্বল। কেন ঐ লাগামছাড়া একটা অসভ্য ছেলের সাথে থেকে নিজের মাথা খারাপ করছ? জাহান্নামে যাক ও। তাতে তোমার কী?”
সৌহার্দ্য তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,
” ফুপা, যাকে তুমি জাহান্নামে যেতে বলছ। সে তোমার নিজের ছেলে হয়। তোমার সন্তান।”
” ওরকম সন্তান না থাকাই ভালো।”
কথাটা বলতে বলতে রান্নাঘর থেকে মিসেস আসমা এগিয়ে এলেন। সৌহার্দ্য এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
” তোমরা কী চাও বলোতো? ও মরে যাক? তোমরা ওর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার পর একমাত্র আমিই ছিলাম ওর পাশে। যদি ঐ মুহূর্তে আমি ওর পাশে না থাকতাম, ও সুইসাইড করত। এতটাই ভেঙ্গে গেছিল ও। যদিও আজ আমি ওকে ছেড়ে গেলে ও সুইসাইড করবে না ঠিকই, কিন্তু জ্যান্ত লাশ হয়ে যাবে।”
মিসেস আসম বললেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার কী উপযুক্ত কারণ ছিলনা?”
সৌহার্দ্য কঠোর স্বরে বলল,
” তোমাদের মনে হয়না তোমরা একটা বাইরের মেয়েকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিয়ে ফেলেছিলে?”
আমিনুল খান বললেন,
” অন্যায় টা অন্যায়ই সৌহার্দ্য। সেটা ঘরের লোক হোক বা বাইরের। ও যে চরিত্রহীন। তার প্রমাণ তো ও এখন রোজ দিচ্ছে। ওকে জন্ম দিয়ে পাপ করে ফেলেছি।”
সৌহার্দ্য এবার কেন জানি ভীষণ রেগে গেল। রাগে চেঁচিয়ে বলল,
” ফুপা স্টপ অল দিস ননসেন্স।”

সবাই চমকে উঠল। সৌহার্দ্য নিজেও অবাক হল। ও কখনই বড় কারো সাথে এভাবে কথা বলেনা। অাজ অবধি বড়দের সাথে গলা উঠিয়ে কথা বলেনি ও। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে ফুপাকে ‘সরি’ বলতে নেবে তখনই সপাটে একটা চড় পরল সৌহার্দ্যর গালে। সৌহার্দ্য গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকাল নিজের বাবার দিকে। শফিক রায়হান রেগে বললেন,
” ওই ছেলের কাছ থেকে বেয়াদবিটাও শিখে ফেলেছ তাহলে? এবার বুঝেছ কেন বারণ করি ওর কাছে যেতে?”
সৌহার্দ্য মাথা নিচু করে শুনলো কথাগুলো এরপর কিছু না বলে বাড়ি থেকেই বেড়িয়ে গেল। মিসেস নাহার এবার রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এসে কান্নামাখা কন্ঠে বলল,

” তোমরা কী শুরু করলে বলবে? এক ছেলেকে তো অনেক আগেই বাড়িছাড়া করেছ। এবার আমার এই ছেলেটাও চলে যাবে। তখন থেকো তোমরা সুখে।”
আমিনুল খান গম্ভীর স্বরে বলল,
” বিহান যা করেছিল তাতে কী বাড়ি থেকে বের করে ভুল করেছি আমরা ভাবি? আপনার মেয়ে, আমাদের নুসরাতের সাথে যদি কোন ছেলে একই কাজ করত? তুমি পারতে তাকে ক্ষমা করতে? ওই মেয়েটা আমাদের কেউ নয় বলে তার প্রতি অন্যায় আমরা সহ্য করব?”
মিসেস নাহার চুপ হয়ে গেলন। শফিক রায়হান বললেন,

” তবুও যদি দেখতাম শুধরে গেছে। নিজে গিয়ে ফিরিয়ে আনতাম ওকে। দুনিয়ার কোথায় জায়গা না হলেও আমার বুকে জায়গা হত ওর। কিন্তু শোধরালো তো নাই। আগে যা গোপনে করত, ঐ ঘটনার পর সেসব প্রকাশ্যে করা শুরু করেছে।”
এবার আর সত্যিই কিছুই বলার নেই। সবার মনে এক ই ধারণা। যদি বিহানটা শুধরে যেত। তাহলে হয়ত ওকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে হতো না। কিন্তু বিহান যেরকম ছেলে তৈরী হয়েছে, সৌহার্দ্যর মত ভালো ছেলের ওর সাথে থাকা উচিত না।

রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে, তুর্বীর সেদিকে খেয়াল নেই। ও আরামে মোবাইলে গেমস খেলে যাচ্ছে। রিখিয়া বোকার মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” তোমাকে S.R. কিডন্যাপ করেছিল?”
তুর্বী খুব মনোযোগ গেমস খেলতে খেলতেই বলল,
” এই নিয়ে পাঁচবার একই প্রশ্ন করলি। নেক্স কোয়েশচন কর।”
রিখিয়া চোখ সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ কিছু একটা ভাবল। তারপর আবার ঠিকভাবে তুর্বীর দিকে ঘুরে বসে বলল,
” তুমি শিওর উনিই তোমাকে কিডন্যাপ করেছে?”
” আরে হ্যাঁ রে বাবা।”

” তুর সবটা খুলে বলবে? আমার কেমন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।”
তুর্বী বুঝল সবটা না শুনে না এই মেয়ে নিজে শান্তি পাবে না ওকে শান্তি দেবে। তাই ফোনটা রাখল। তারপর রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সবটা বলল। সব শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। তারপর বলল,
” তুমি ওনার মুখ দেখেছ?”
তুর্বী আফসোসের স্বরে বলল,
” আরে না। দেখালোই না ব্যাটা কালা মাস্ক।”
” কালা মাস্ক?
তুর্বী ঠোঁট বাঁকিয়ে মুখটা ফুলিয়ে বলল,
” সারাক্ষণ কালো রঙের মাস্ক পরে ছিল মুখে। চেহারাটা দেখতে পাই নি। তাইতো কালা মাস্ক বলি।”
রিখিয়া হেসে দিল। হাসতে হাসতে বলল,
” পারোও তুমি। তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলে এতক্ষণে অসুস্থ হয়ে যেত ভয়ে।”
তুর্বী ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
” স্পেশিয়ালি তুই।”

রিখিয়ার সম্মতি জানিয়ে শব্দ করে হাসল। হাসি থামিয়ে তুর্বী বলল,
” এবার তোর কেসটা বল তো। সারারাত কোথায় ছিলি?”
রিখিয়ার হাসি থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ রইল। বিহানের কথা ও ভুলেই গেছিল। প্রথমদিন থেকে কত রুড বিহেভ করেছির ও বিহানের সাথে। পাবলিক প্লেসে মিডিয়ার সামনে থাপ্পড় মেরেছে, যা-তা বলে অপমান করেছে, এমনকি পুলিশে দিয়েছিল, ওর জন্যে কোন দোষ ছাড়াই বিহানকে লকাপে রাত কাটাতে হয়েছে। এতকিছুর পর অন্যকেউ হলে তো ওর মুখও দেখত না। অথচ ছেলেটা কাল ওকে এত বড় বিপদ থেকে বাঁচালো। তারপর সারারাত তুর্বীকে খুঁজতে সাহায্য করল। এমনকি সারারাত ওর কাছে থাকল যাতে ওর বিপদ না হয়। ছেলেটাকে বাইরে দিয়ে যেমনই মনে হোক। মনটা যে একদম খাঁটি সেটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই ওর। ও এসব ভাবতে ভাবতেই তুর্বী বলল,

” কীরে বল? কোথায় ছিলি?”
তুর্বীর কথায় রিখিয়ার ও হুস এল। ও নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় বলল,
” বিহানের কাছে।”
তুর্বী ‘ওহ’ বলে নিজের কাজে মনোযোগ দিচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই রিখিয়ার কথা মাথায় ঢুকতেই চোখ বড়বড় করে তাকাল রিখিয়ার দিকে। এরপর বলল,
” আমি যেটা শুনলাম। তুইও কী সেটাই বললি?”
রিখিয়া হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। তুর্বী ফোন রেখে রিখিয়ার দিকে ঘুরে বসে বলল,
” মানে কী? তুই তো ওই ছেলেকে সহ্য অবধি করতে পারিস না। তার কাছে গোটা একটা রাত থেকে এলি?”
রিখিয়া একটু ইতস্তত করে বলল,
” আসলে ছেলেটা ততোটাও খারাপ না যতটা ভাবতাম আরকি।”
তুর্বী অবাক হল। কিছুক্ষণ চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থেকে বলল,
” তোর ভালো লেগেছে? সত্যি বলছিস।”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১২

” আজব! আমি কখন বললাম ভালো লেগেছে। আমি জাস্ট বলেছি খারাপ না।”
” আরে এটাই তো ভালোলাগার প্রথম ধাপ।”
” এই থামোতো!”
” আচ্ছা থামলাম, এবার বল না কাল রাতে কী হয়েছিল।”
রিখিয়া তুর্বীকে ওই বখাটেদের ঝামেলা থেকে শুরু করে সকাল পর্যন্ত সব খুলে বলল। সবটা শুনে তুর্বী চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। সেদিনের ওরকম অপমানের পরেও ছেলেটা এতো স্বাভাবিক ব্যবহার করল? এটাকি স্বাভাবিক? পরে ভাবল যে একটু বেশিই ভাবছে ও। একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেকরকম। হয়ত বিহান ব্যপারটা তেমন মনে নেয়নি। রিখিয়া বলল,
” কীরে? চুপ হয়ে গেলি কেন?”
তুর্বী রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হেসে বলল,
” যাবি কফি খেতে?”
” ভেবে দেখছি।”
” আরে এত ভাবাভাবির কী হল? এভাবে বলল ছেলেটা।”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর রিখিয়া বলল,

” যাক, অন্তত তোমার মাথা থেকে এই রিলেশনশীপের এক্সপিরিয়েন্স নেওয়ার শখ তো মিটল।”
তুর্বী অবাক হয়ে বলল,
” কে বলল? প্রেম তো আমি একটা করবই। আমার এই ব্যাপারটার এক্সপিরিয়েন্স করতেই হবে। এট এনি কস্ট। মানে মাস্ট! মাস্ট! মাস্ট!”
রিখিয়া হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। SR কে বিরক্ত করার ভুত ওর মাথা থেকে তো SR নিজে নামিয়েছে। কিন্তু এই প্রেম নিয়ে এক্সপিরিমেন্টের ভুত ওর মাথা থেকে কে নামাবে?

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ১৪