জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৬ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রাত বারোটা পনেরো বাজে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। সেই সন্ধ্যায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে এখনও থামার নামও নিচ্ছেনা। রিখিয়া রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। তুর্বী রুমে বসে ল্যাপটপে নেক্সট প্রজেক্টের কাজ করছে। রিখিয়া চুপচাপ বসে বসে ভাবছে বিহানের কথা। বিহানকে জড়িয়ে ধরা, ওর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্ত, সবটা। আচ্ছা বিহানের ‘ছেড়ে দেবো’ কথাটা শুনে এরকম অনুভূতি কেন হয়েছিল ওর? সত্যিই কী তাহলে প্রেম নামক অনুভূতি গ্রাস করে ফেলেছে ওকে? ভালোবেসে ফেলেছে ও বিহান নামক পুরুষটিকে?
অনেকটা সময় পরেও রিখিয়া যখন ভেতরে এলো না তখন তুর্বী ল্যাপটপটা বন্ধ করে কিচেনে গিয়ে কফি বানালো। দুটো মগে কফি ঢেলে নিয়ে চলে এলো ব্যালকনিতে। রিখিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ওর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,

” কী ভাবছিস?”
রিখিয়া কফির মগ হাতে নিয়ে না বোধক মাথা নাড়ল। তুর্বী মগে ফুঁ দিতে দিতে বলল,
” আজ ভিজে বাড়ি ফিরলি যে? কোথায় ছিলি?”
” বিহানের সাথে রেস্টুরেন্টে গেছিলাম।”
” আচ্ছা? আমি বলি এবার আর ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে না খেলে বিয়েটা করেই ফেলো।”
” থামতো। কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিস তুই। আর তাছাড়াও এখন আমি বিয়েটিয়ে করতে পারব না। আমার লাইফ এ সবকিছু এত নরমালি হবেনা। আমি বিয়ে করে নিলে আমার বাবা-মাকে দেখবে কে?”
তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
” কেন? তুই দেখবি। এখন যেভাবে দেখিস। বিয়ে করতে বলেছি, নিজেকে কারো কাছে বেঁচে দিতে বলিনি।”
রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” আচ্ছা ক-জন ছেলে বিয়ের পর তার বউকে চাকরি করতে দেয়? আর দিলেও সেই চাকরির টাকায় বাপের বাড়ির মানুষের দেখাশোনা করতে কজনকে দেয়?”
” আজব তো! তোর টাকা তুই কাকে দিবি সেটা ডিসাইড করে দেবে অন্যকেউ? তোর মনে হয়না এটা একটা জঘন্যতম রুলস?”
” মনে হওয়া দিয়ে কী কিছু হয়? সমাজ এটাই মানে।”
তুর্বী হালকা করে মুখটা বাঁকিয়ে বলল,
” গো টু হেল উইথ ইউর সমাজ।”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে হেসে বলল,
” তুমি সবসময় এতো চিল মুডে থাকো কীকরে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” কারণ আমি তোর মত ওসব মানুষের কথা ভেবে ভেবে দিন পার করিনা যাদের কাজই হচ্ছে নিজের ঘর চঙ্গে তুলে পরের ঘর নিয়ে তদারকি করা। কার মেয়ে ভেগে গেছে, কার ছেলেকে পুলিশে নিয়েছে, কার ডিবোর্স হয়েছে, কার বাচ্চা হয়না ইত্যাদি, বেসিক্যালি পরের বাড়িতে কী হচ্ছে তা নিয়ে যারা সারাদিন নিজেদেরর ঐ ইউসলেস লম্বা নাকটা গলাতে আসে তাদের কথা ভেবে আমি আমার নিজের খুশি, আনন্দ, কমফোর্ট জোন নষ্ট করিনা। আই থিংক কারোরই করা উচিৎ না।”
” সবাই তোমার মতো করে ভাবতে পারেনা। বেশিরভাগ মানুষই লোকের কথাকে ভয় পায়।”
” জানি।”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে লম্বা একটা শ্বাস ফেল
” তোমার কী খবর বলো? বসের সাথে প্রেম কেমন চলছে?”
তুর্বী একটু হেসে গা দুলিয়ে বলল,
” নট ব্যাড। ইউ নো ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আ’ম ইনজয়িং ইট।”
” তাই?”
তুর্বী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“লোকটা যখন হাতে হাত রাখে, হঠাৎ করেই কাছে টেনে নেয়, কপালের চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দেয়, একটু রোমান্টিক্যালি কথা বলে।অন্যরকম লাগে। সাচ আ গুড ফিলিং।”
রিখিয়া গালে হাত দিয়ে বলল,
” এতোই যখন গুড ফিলিং আসে তখন সিরিয়াস হয়ে যাও। খারাপ কী? সৌহার্দ্য ছেলেটা ভালো তো?”
” আরে দূর! আমার দ্বারা ওসব বিয়ে-টিয়ে হবেনা। এমনিই ভালো আছি।”
রিখিয়া একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে কফির মগে চুমুক দিয়ে বৃষ্টি দেখায় মনোযোগ দিল। তুর্বীও চুপ করে বসে আছে আর সৌহার্দ্যর কথাগুলো ভাবছে। ইদানিং ওর অজান্তেই সৌহার্দ্য নামটা জেকে বসে ওর মস্তিষ্কে।

সৌহার্দ্য বড় সোফায় বিছানার মত করে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কাজ করছে, আর বিহান ফ্লোরে বসে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে। সৌহার্দ্য ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” সারাদিন এসব গেমস-টেমস না খেলে একটু কাজ করলেও তো হয় না কী?”
” দেখ ব্রো, আমি একা মানুষ। পেন্টিং করে যা পাই তাতে করে আমার আর আমার থাকা খাওয়া আর গার্লফ্রেন্ডদের টুকিটাকি খরচ চলে যায়।”
সৌহার্দ্য চোখ ছোট ছোট করে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এখনও গার্লফ্রেন্ডস্?”
বিহান হালকা হেসে বলল,
” আগের কথা বলছিলাম।”
” সেটা হলেই ভালো।”
বিহান গেমস খেলায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

” ইদানিং এখানেই বেশি থাকিস কেন বলতো? আগেতো এতো বেশি আসতি না?”
সৌহার্দ্যও ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল,
” দুটো কারণ আছে। প্রথম কারণ বাবা এখানে নেই তাই তোর কাছে এলে ঝামেলা করারও কেউ নেই, আর দ্বিতীয় কারণ এখন তো আর তোর সো কল্ড গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে বাড়িতে আসিস না তাই।”
বিহান হেসে দিয়ে বলল,
” আচ্ছা? তো বস তোমার সেই বিখ্যাত প্রেম কেমন চলছে?”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল,
” এটাকে প্রেম বলে?”
বিহান ভ্রু নাচিয়ে বলল,
” তো কী বলে?”
” ভালো প্রশ্ন। কী বলে এটাকে?”
বিহান এবার ফোনটা রেখে বলল,
” ভালোবাসিস তুর্বীকে?
সৌহার্দ্য ভাবুক হয়ে বলল,

” হয়তো। শুরু থেকেই ওর প্রতি একটু একটু করে দূর্বল হয়েতো পরছিলাম। এন্ড এই সো কলড রিলেশনে যাওয়ার পর ওর সাথে আরও বেশি সময় কাটানোর পর, ওর এতো কাছে থাকার পর বুঝতে পারছি যে আই লাভ হার। ভালোবাসি ওকে। এখন থেকে না। সেইদিন রাত থেকে যেদিন আমি S.R. হয়ে একরাত ওকে আমার কাছে আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু বুঝতে এতোটা সময় লেগে গেল এই আর কী।”
বিহান কিছু না বলে হাসল। সৌহার্দ্য গালে হাত রেখে বলল,
” রিখিয়ার সাথে তোয চক্করটা কী বলতো? তোকে দেখে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। ভালোবাসিস?”
বিহান একটু লাজুক টাইপ হাসি দিয়ে বলল,

” জানিনা, কিন্তু সত্যি বলতে মেয়েটা ভালো। অন্য সবার মতো না।”
সৌহার্দ্য অনেকটা অবাক হয়ে বলল,
” এই প্রথম তোর মুখে কোন মেয়ের প্রশংসা শুনলাম। ইটস্ গ্রেট!”
বিহান আবারও হাসলো। সৌহার্দ্য মনের কোথাও একটা স্বস্তি পেলো। ওর মনে হচ্ছে একমাত্র রিখিয়াই পারবে বিহানকে বদলা, ওর ভূল ধারণাগুলো ভেঙ্গে দিতে, ওর মনের শূন্যস্হান পূরণ করতে। সৌহার্দ্য বলল,
” এক কাজ করি? ওদের দুজনকেই কাল লাঞ্চে ডেকে নেই। তোরও তুরের সাথে আলাপ হয়ে যাবে আর আমিও রিখিয়ার সাথে একটু ভালোভাবে আলাপ সেড়ে নেব।”
” এজ ইউর উইশ ব্রো।”

তুর্বী অফিসে এসে সৌহার্দ্যর কথামত সোজা ওর কেবিনে গিয়েই ঢুকলো। কেবিনে ঢুকে কাউকে দেখতে না পেয়ে তুর্বী ভ্রু কুচকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে হঠাৎ করেই ওর হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে এলো কেউ একজন। তুর্বী একটু হকচকিয়ে গিয়েছে তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। তুর্বী চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” এটা করে কী বিশেষ বিনোদন পাও বলবে?”
সৌহার্দ্য হেসে বলল,
” কিছুক্ষণের জন্যে হলেও তোমার ঐ হকচকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পাই। ইউ নো খুব দুর্লভ জিনিস এটা।”
” মজা নেওয়া শেষ? এবার ছাড়ো।”
” এমন উদ্ভট কেনো তুমি? গার্লফ্রেন্ডরা বয়ফ্রেন্ডদের কাছাকাছি থাকতে কত কী করে। আর তুমি পালাই পালাই কর কেন?”

” আমরা ওসব ন্যাকা টাইপ বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড নই। ইউ নো দ্যাট।”
” ইয়া বাট এক্সপিরিয়েন্স নিতে হলে। একটু আধটু প্রেম প্রেম ভাব মনে আনতে হয় না কী?”
তুর্বী এবার সৌহার্দ্যর দুই কাধে হাত রেখে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
” আচ্ছা? তাই? প্রেম প্রেম ভাবটা কীকরে আনে?”
সৌহার্দ্য নিজের মুখটা একটু এগিয়ে এনে বলল?
” শিখিয়ে দেব?”
তুর্বী সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
” কটা প্রেম করেছ এর আগে?”
সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,
” যদি বলি দশ বারোটা? তুমি কী জেলাস হবে?”
তুর্বী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,

” জেলাস হব কেন? আপনি একশটা প্রেম করুন আমার কী? আমার যেই এক্সপিরিয়েন্স চাই সেটা পেলেই হলো। বাকি সব জাহান্নামে যাক।”
সৌহার্দ্য কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে রইল তুর্বীর দিকে। মেয়ৃটাকে কীকরে বোঝাবে ওর অনুভূতিটা? যত দিন যাচ্ছে তুর্বীর এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা যে ওকে আরও কষ্ট দিচ্ছে। তুর্বী সৌহার্দ্যর নাকে আঙ্গুল দিয়ে হালকা একটা ঘষা দিয়ে বলল,
” অনেক হয়েছে। এটা কাজের জায়গা। কাজ করাই বেটার।”
” হুম।”
বলে সৌহার্দ্য চুপচাপ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। তুর্বীও বসে সৌহার্দ্যর সাথে ডিজাইন, প্লান সব নিয়ে ডিসকাস করে লাঞ্চ করে একবারই নিজের ডেস্কে এসে বসল। পাশের ডেস্কের একজন মেয়ে ওপর একটি মেয়েকে বলল,
” দেখ নতুন ইয়াং হ্যান্ডসাম বস আসার সাথে সাথেই কেমন হাতে করে নিয়েছে। এরা পারেও ছলেবলে ছেলেদের বস করে নিতে।”
ওপর মেয়েটা বলল,

” হ্যাঁ সেটাই। স্যারের কেবিনে ঢুকলে তো বেড়ই হতে চায়না। তারপর মাঝেমাঝে এক গাড়িতে আসা যাওয়া করে। দেখিসনা আজকাল কী সুন্দর ভালো ভালো প্রজেক্টে কাজ পাচ্ছে। এমনি এমনি নাকি?”
” সবই বুঝি এসব হচ্ছে বসদের পটিয়ে প্রমোসনের ধান্দা।”
তুর্বী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। এগুলো নিয়ে অফিসে প্রায়ই কানাঘুষা হয়। তুর্বী শুনেও না শোনার ভান করে। যেহেতু ওকে সরাসরি এসে কিছু বলেনা তাই ও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনা। আর এসব কথা শুনলে ওর হাসি ছাড়া কিছুই আসেনা। তুর্বী উঠে গিয়ে জল খেয়ে আসার সময়ই ঐ মেয়েটা বলল,
” আজ এতো তাড়াতাড়ি স্যার ছেড়ে দিল?”
ওপরজন বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৫

” ভালোই তো বসকে পটিয়েছো। নেক্সট কোন প্রজেক্টটা হাতাচ্ছো শুনি?”
তুর্বী এবার ছোট্ট শ্বাস ফেলল। সরাসরি যখন ওকে বলে ফেলেছে। আরতো ও চুপ করে থাকবে না। তাই একটা চেয়ার টেনে আয়েশ করে বসল ওদের দুজনের সামনে। তুর্বীকে এভাবে বসতে দেখে দুজনেই একে ওপরের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। তুর্বী বলল,
” আচ্ছা? সৌহার্দ্য স্যারকে দেখেছ? কত হ্যান্ডসাম, টল, ড্যাসিং?”
মেয়েটি ভ্রু কুচকে বলল,
” হ্যাঁ তো?”
” এরকম একজনকে পটাতে গেলে যোগ্যতা লাগে। তোমাদের খুশির জন্যে মেনে নিলাম আমি সৌহার্দ্য স্যারকে পটিয়ে প্রজেক্ট নেই। কারণ আমার সেই যোগ্যতা আছে। তো বেসিক্যালি আমি আমার যোগ্যতা দিয়েই কাজটা করেছি। কিন্তু এখন যি তোমাদের খুব বেশি জ্বলে তো ট্রায় করে দেখতে পারো স্যারকে পটাতে পারো কি-না। যদিও মনে হয় না পটবে। আমি আছি তো।”

কথাটা বলে চোখ টিপ মারল তুর্বী। ওপর মেয়েটা তুতলিয়ে বলল,
” আমাদের দরকার নেই এসবের।”
তুর্বী হেসে বলল,
” গুড! তাহলে তো হয়েই গেল। তোমাদের তো তাহলে আমাকে নিয়ে প্রবলেম থাকারই কথা না। বাই দা ওয়ে। খেটে খেটে কাজ কর। দেখ প্রমশন পাও কি-না। আমার মত তো আর স্যারকে পটাতে পারবেনা। কাজই ভরসা।”
কথাটা বলে সুর দিয়ে ‘তুঝে মিরচি লাগি তো ম্যা কেয়া কারু’ লাইনটা গাইতে গাইতে নিজের ডেস্কে চলে গেল।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৭