জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৭ || রোমান্টিক ভালবাসার গল্প

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

তুর্বী আর রিখিয়া একটা রেস্টুরেন্টে চুপচাপ বসে আছে। তুর্বী তখন থেকে পা দুলিয়েই যাচ্ছে। রিখিয়া ওর পায়ে একটা পাড়া দিল। তুর্বী ‘আউচ’ শব্দ করে উঠল। বলল,
” এভাবে পা দোলাচ্ছো কেন? ভদ্র মেয়ের মত চুপচাপ বসা যায় না?”
তুর্বী মুখ একটু ফুলিয়ে বলল,
” তাই বলে এইভাবে পাড়া মারবি?”
” ওরা এখনও আসছেনা কেন?”
” দুই ভাই-ই লেট লতিফ।”

রিখিয়া কপাল কুচকে তাকাল তুর্বীর দিকে। আর তুর্বীতো নিজের ধ্যানে আছে। আসলে আজ ওদের চারজনেরই লাঞ্চ করার কথা একসাথে। ওরা এসে বসে থাকলেও সৌহার্দ্য আর বিহান কেউই আসেনি। এরমধ্যেই রিখিয়ার দেখল বিহান আর সৌহার্দ্য আসছে। রিখিয়া বলল,
” ঐতো এসে গেছে।”
তুর্বী মাথা তুলে তাকাল ওদের দিকে। সৌহার্দ্য আর বিহান এসে ওদের বিপরীতে বসল। তুর্বী বলল,
” এতো লেট করে আসে কেউ? কতক্ষণ যাবত বসে আছি ইয়ার।”
বিহান বলল,
” সরি মিস জ্যামে পরে গেছিলাম।”
সৌহার্দ্য বলল,
” অনেকক্ষণ ওয়েট করছ তাইনা?”
তুর্বী রাগী কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ অনেকক্ষণ?”
রিখিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল,
” মিথ্যে কেন বলছ তুর? খুব বেশিক্ষণ হয়নি আমরা এসছি।”

সৌহার্দ্য আর বিহান হেসে দিল ওদের কথায়। বিহানের তুর্বীর চঞ্চলতার কথা শুনতে ভালোই লাগে। এই নিয়ে দুবার দেখেও নিল। এরপর খাবার ওর্ডার করে ওরা একে ওপরের সাথে কুশল বিনিময় করতে লাগল। যেহেতু বিহান আর রিখিয়ার অনেক স্বভাব আচরণই একরকম। তাই ওদের মধ্যে ভাবটাও তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। ওরা নিজেদের মত কথা বলছে, হাসাহাসি করছে এদিকে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া বোকার মত ওদের তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বিহার আর তুর্বী তাকিয়ে দেখে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া চুপচাপ বসে আছে। তুর্বী বলল,
” কী হল? তোমরা চুপচাপ বসে আছো কেন?”
সৌহার্দ্য লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
” তোদের শেষ?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রিখিয়ার দৃষ্টিও এখন বোকা বোকা। তুর্বী আর বিহান একে ওপরের দিকে তাকিয়ে ফিক আওয়াজ করে হেসে দিল। সৌহার্দ্য আর রিখিয়াও হেসে দিল। তুর্বী বলল,
” সৌহার্দ্য, তোমার এই ভাই কিন্তু একদম সলিড। মানে এরসাথে আড্ডা দিয়ে মজা পাওয়া যায়। ওপরদিকে তুমি? এক নম্বরের একটা গোমড়া মুখো। শেখো নিজের ভাইয়ের থেকে কিছু।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বলল,
” এর থেকে?”
রিখিয়া চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” না ভাইয়া! আপনি যেমন আছেন একদম পার্ফেক্ট আছেন। এদের মত লেজ ছাড়া বাদর হওয়ার দরকার নেই।”
বিহান আর তুর্বী একসঙ্গে বলে উঠল,
” আমরা লেজ ছাড়া বাদর?”

সৌহার্দ্য ঠোঁট চেপে হাসলো। আর রিখিয়া একটু বিরক্তি নিয়েই তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। দুটো এতো চঞ্চল কেন? আবার এটা ভেবেও মনে মনে হাসল যে এইজন্যই তো দুজনই ওর এত প্রিয়।এভাবে কিছুক্ষণ খুনশুটির পর ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেড় হয়ে একটা পার্কে গেলো। ওখানে সৌহার্দ্য-তুর্বী, বিহান-রিখিয়া আলাদা আলাদা হয়ে হাটছে। সৌহার্দ্য আজ তুর্বীকেই দেখছে। একটা সাদা লং শার্ট আর কালো জিন্স, পিঠের মাঝামাঝি ছুই ছুই লেয়ার কাট দেওয়া খোলা চুল যা বাতাসে হালকা উড়ছে। মেয়েটার এটিটিউটের সাথে সাথে রূপেরও প্রেমে পরছে আস্তে আস্তে। এখন ও ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে যে তুর্বীকে ছাড়া ওর জীবন অসম্পূর্ণ। এই মেয়েকে ওর জীবনে প্রয়োজন। হঠাৎই হাত তুর্বীর হাত ধরে আটকে নিল সৌহার্দ্য। তুর্বী ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘কী?’। সৌহার্দ্য তুর্বীর একটু কাছে গিয়ে ওর কপালের চুল সরাতে সরাতে বলল,

” তোমাকে দেখতে দাও একটু।”
তুর্বী সৌহার্দ্যর চোখে চোখ রাখল। সৌহার্দ্যর দৃষ্টি গভীর। একটু বেশিই গভীর। তুর্বীরও একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সৌহার্দ্যর ওমন দৃষ্টি গ্রাস করতে চাইছে ওকে। কিন্তু ওর চঞ্চল মন সেই অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
” এভাবে দেখার কী আছে? আর দেখতে পাফেন না?”
ব্যাস সৌহার্দ্যর মুডের বারোটা বেজে গেল। ও তুর্বীর দিকে হতাশ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
” কিছুনা চলো।”
যাওয়ার সময় আইসক্রিম খাওয়ার কথা উঠতে বিহান বলল ও নিয়ে আসছে। তখন তুর্বীও যেতে চাইল ওর সাথে। তাই বিহান আর তুর্বী গেল আইসক্রিম আনতে। সৌহার্দ্য আর রিখিয়া বসল বেঞ্চে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে সৌহার্দ্য বলল,

” তুর্বীর সাথে তোমার ছোটবেলার আলাপ?”
রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,
” না তো। এই শহরে এসেই আলাপ হয়েছে দুজনের।”
আবারও কিছুক্ষণ চুপ রইল দুজনে। এরপর রিখিয় বলল,
” তুর্বী কিন্তু একটু বেশি চঞ্চল। ওকে জোর করে কিছু করানো যায় না। ও ওর ইচ্ছেতে চলে। তাই ওকে কিন্তু ওর মত করেই সামলাতে হবে। এমনও মুহূর্ত আসতে পারে যে আপনি অধৈর্য হয়ে উঠলেন। কিন্তু তখন রেগে গেলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে।”
” কথাটা মাথায় থাকবে।”

বলে মুচকি হাসল সৌহার্দ্য। এদিকে আইসক্রিম হাতে নিয়ে সাইড দিয়ে হাটতে হাটতে বিহান বলল,
” তোমাদের দুজনের বন্ধুত্ব আমায় অবাক করে জানো? ওমন শান্ত, স্হির একটা মেয়ের বান্ধবী এমন হয়?”
তুর্বী হেসে বলল,
” তোমার আর সৌহার্দ্যরও তো তাই।”
” তা ঠিক। কিন্তু আমরা ভাই। ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। কিন্তু তোমরা তো তা নও।”
তুর্বী একইভাবে হাসল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” রিখিয়াকে ভালোবাসো?”
কথাটা শুনে থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল বিহান। রিখায়াকে ভালোবাসার কথাতো ও স্বপ্নেও ভাবেনি। আর তুর্বীর দ্বারা এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক সেটাও জানে ও। কিন্তু ‘রিখিয়াকে ভালোবাসো?’ বাক্যটা সোজা ওর হৃদপিণ্ডে গিয়ে লাগল। এমন মনে হল যেন ওর হৃদয়, মনও ওকে একই প্রশ্ন করল একইসঙ্গে। কিন্তু তবুও ও নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তরে শুধু লাজুক টাইপ একটা হাসি দিল। যেটা দেখে তুর্বীও হেসে দিল।

দেখতে দেখতে বেশ অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এরমধ্যে রিখিয়া আর বিহানের মধ্যে বন্ডিংটা দৃঢ় হয়ে উঠছে আরও। ওপরদিকে সৌহার্দ্য তুর্বীর প্রতি দিন দিন চরমভাবে দুর্বল হয়ে পরছে। এমন মনে হয় যেন তুর্বীকে ছাড়া ও বাঁচবেই না। তুর্বী ছাড়া সবটাই ওর কাছে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে একটাই তুর্বীর কাছে এখনও এটা একটা এক্সপিরিমেন্টই। কিন্তু সৌহার্দ্য এখন তুর্বীকে চায়, ভালোবেসে চায়, লোক দেখানো এক্সপিরিমেন্টাল সম্পর্ক আর চাইছেনা ও। ও চায় অন্যরা যেভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসে সেভাবেই তুর্বীকে ভালোবাসতে।

কিন্তু সেরকম কোন মুহূর্ত এলেই তুর্বী এড়িয়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে বোঝা যায় যে এই সম্পর্কটা ওর কাছে কতটা অবহেলার। শুরুতে ধৈর্য্য ধরে সৌহার্দ্য ব্যাপারটা মানিয়ে নিচ্ছিল ঠিকই কিন্তু আর পারছেনা। ওর মনে হত একসময় না একসময় তুর্বী বুঝবে। তুর্বীও ভালোবাসবে ওকে। কিন্তু এতোগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরেও তুর্বীর মধ্যে বিন্দু পরিমাণ অনুভূতির ইঙ্গিতও পায়নি ও। যেটা এখন আর সৌহার্দ্যর সহ্য হচ্ছেনা। সমস্ত ধৈর্যের বাদ ভেঙ্গে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে ওর নিজেকে।

শুক্রবার তাই আজ ছুটির দিক। তুর্বী কানে হেডফোন গুজে একমনে S.R. এর ‘প্রভাতের আলো’ শো শুনছে। ইদানীং শুনতে ভালোই লাগে ওর। কিন্তু শুরু থেকে সৌহার্দ্যর সাথে S.R. এর কন্ঠের অনেকটা মিল পায় ও। হুবহু মিল পায়নি তাই কো-ইন্সিডেন্স ভেবে পাত্তা দেয় নি।
এদিকে রিখিয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল বাড়ি থেকে ফোন এসছে। এমন সময় হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে অবাক হল। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর মা কেঁদে দিয়ে বলল যে ওর বাবার শরীরটা ভালো নেই। ওকে যেতে বলছে। ওকে দেখতে চাইছে ওর বাবা। কথাটা শুনে রিখিয়া কী করবে বুঝতে পারছেনা। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ও আজকেই আসছে।

ফোন রেখে রুমে এসে কেঁদে দিল ও। ওর পৃথিবীতে বাবা মাই তো আছে। বাবার অসুস্থ আর ও এতো দূরে। রিখিয়ার কান্নার আওয়াজে তুর্বী দ্রুত বেডরুমে এল। এভাবে কাঁদতে দেখে বলল,
” কী হয়েছে রিখু! কাঁদছিস কেন?”
রিখিয়া তুর্বীকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কান্না করল। এরপর সবটাই খুলে বলল। সবটা শুনে তুর্বী বলল ওকে বিকেলের ট্রেনে তুলে দেবে। নিজেই সব প্যাকিং করে দিল। আর বারবার তুর্বীকে সান্ত্বনা দিতে লাগল।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৬

রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে বিহান, রিখিয়া, সৌহার্দ্য আর তুর্বী। রিখিয়াকে ট্রেনে তুলে দিতেই এসছে ওরা। রিখিয়ার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে এল। বিহান রিখিয়ার দুই কাঁধে হাত রেখে বলল,
” একদম চিন্তা করোনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। সাবধানে যাও। আর নিজের খেয়াল রেখো।”
রিখিয়া মাথা নাড়ল। তুর্বী এসে জড়িয়ে ধরল রিখিয়াকে। দুজনের চোখেই পানি চিকচিক করছে। রিখিয়াকে ট্রেনে তুলে দেওয়ার পর। রিখায়া বিহান আর তুর্বীর দিকে তাকাল। কয়েকটা দিন তুর্বীকে দেখতে পাবেনা ভাবলেই কষ্ট হয় ওর, বিহানের জন্যেও কী হচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। তুর্বী ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইল যাওয়ার দিকে। বিহান লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

” তোরা আয়। আমি গাড়িতেই আছি।”
বলে চলে গেল। সৌহার্দ্য তুর্বীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
” মন খারাপ করোনা, চলে আসবে ও তাড়াতাড়ি।”
তুর্বী এমনিতে মাথা নেড়ে নিজেকে সামলালেও মন ভালো নেই ওর। রিখিয়া যে ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। কয়েকটা দিন ওকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবলেই কান্না পাচ্ছে ওর। কিন্তু কিছু করার নেই না চাইতেও অনেক সময় আপনজনের থেকে দূরে থাকতে হয়।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ২৮