জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩২ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

 জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

মাঝখানে আরো একটা বিষাক্ত দিন কেটে গেল। সৌহার্দ্য বিহানের ওখান থেকে ফিরে নিজের রুমে ঢুকেছে কিন্তু আর বেড় হয়নি, দরজাও খোলেনি। সৌহার্দ্যর মত শান্ত ছেলেরও আজ সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করেছে। দিনের শেষে বিহান আর তুর্বীর সাথে একটু কথা বলার ইচ্ছেটুকু হয়েছিল ওর। কিন্তু কোথাও একটা আটকে গেছে। বিহানও গোটা দিনটা নিজের ফ্লাটে গুটিয়ে বসে ছিল। সৌহার্দ্যর শেষের কথাটার জন্যে ওর প্রতি বেশ অনেক্ষণ অভিমান ছিল ওর। কিন্তু পরে বুঝল যে ও যা করেছে তার জন্যে এটাই প্রাপ্য ছিল। সৌহার্দ্য নিজের জায়গায় ঠিক। পরে বিহান সৌহার্দ্যকে কয়েকবার ফোন করার পরেও সৌহার্দ্য ফোন ধরেনি। রিখিয়াকে ফোন করতে লজ্জা করছে ওর।

কোন মুখে কথা বলবে? কী বলবে? মেয়েটার সাথে এতোবড় অন্যায় করার পরেও কী কিছু বলা যায়? তবুও নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে রিখিয়াকে ফোন করেছিল কিন্তু রিখিয়া ধরেনি ফোন। বরং একপর্যায়ে সুইচড অফ করে দিয়েছে।অপরদিকে রিখিয়া সারাদিন তুর্বীর সাথে তেমন কোন কথা বলেনি। তুর্বীর ওপর অনেকটাই বিরক্ত ও। তুর্বীর দোষ আছে কী নেই সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু ওর ছেলেমানুষীর জন্যে একটা ছেলে যে প্রচন্ড কষ্ট পেয়েছে সেটা নিশ্চিত। ওর নিজেরও যে মন ভেঙেছে তাই সৌহার্দ্যর কষ্টটা খুব ভালোভাবে উপলব্দি করতে পারছে। আর তুর্বী প্রচন্ড মানসিক অশান্তিতে রয়েছে। না রিখিয়া ঠিকভাবে কথা বলছে আর না সৌহার্দ্য ফোন ধরছে। সৌহার্দ্যর সাথে একটু কথা বলা জরুরি ওর। কিন্তু ছেলেটা ফোনটাই ধরছেনা। এখন সত্যিই ওর কান্না পাচ্ছে।

ঐ পুরো দিনটা চারজনেরই প্রচন্ড অস্হিরতা, কান্না আর ছটফটানিতেই কেটেছে। পরবর্তী সকালটা একটু অন্যরকমই হল। সারাদিন ভেবে সৌহার্দ্য আর রিখিয়া দুজনেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যেটা হয়তো এবার চারটি জীবনের মোড় সত্যিই ঘুরিয়ে দেবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

সকালে আজ দ্রুতই রোদের আলো ছড়িয়ে পরেছে চারপাশে। সকাল সকাল রোদের উজ্জ্বল আলো চারপাশে ঝকঝক করছে। ভ্যাঁপসা গরম চারদিকে। একটু অস্বস্তিকর পরিবেশ আজ। শফিক রায়হান সোফায় বসে চা খাচ্ছেন। আজ অনেক ভোরেই দেশে ফিরে এসেছেন সে। সৌহার্দ্য সিঙ্গেল সোফায় ওনার মুখোমুখি বসে আছে। চায়ের কাপটা টি-টেবিলে রেখে শফিক রায়হান বললেন,
” তুমি সত্যিই ব্যাংকক যেতে চাইছ?”
” হ্যাঁ বাবা! এমনিতেই তোমার এখন বয়স হয়েছে। তারওপর এতো বারবার বিদেশ জার্নি ঠিক হবেনা তোমার জন্যে। আর ওখানকার অফিসটাও ওরা ঠিকভাবে সামলাতে পারছেনা। আমারতো এদিকে কোন কাজ নেই। তাই আমি ওখানে থাকলে সবদিক দিয়েই ভালো হবে।”

সৌহার্দ্যর মা অবাক হয়ে শুনছেন। কী বলছে কী তার ছেলে? চলে যাবে এখান থেকে? শফিক রায়হান বললেন,
” তুমি তো দেশ ছেড়ে যেতে চাইতেনা। বিশেষ করে তোমার ঐ আদরের ভাইকে ছেড়ে। হঠাৎ কী হল?”
সৌহার্দ্য কিছু বলছেনা। শফিক রায়হান গম্ভীর মুখে বললেন,
” ওহ তাহলে আমার কথাই সত্যি হয়েছে। ভাইয়ের প্রতি অন্ধবিশ্বাস আর ভালোবাসার দাম দিয়ে দিয়েছে, তাইতো?”
সৌহার্দ্য বিরক্তি নিয়ে বলল,
” আচ্ছা বাবা তুমিতো চাও আমি বিজনেস দেখি। সেটাইতো করতে চাইছি। সমস্যা কোথায়?”
” ঐ ছেলের জন্যে আমাদের থেকে দূরে কেন যাচ্ছো।”

” বাবা আমি বাচ্চা নই। ওখানে একজন দরকার তাই যাচ্ছি। প্লিজ কথা বাড়িও না।”
” তো কবে যাচ্ছো?”
” টিকেট পেলেই চলে যাবো।”
সৌহার্দ্যকে ওর বাবা-মা দুজনেই অনেক বোঝালেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ও ওর সিদ্ধান্তে অটল। রেগে গিয়ে শফিক রায়হান বিহানের বাবা-মাকে কল করে সবটা জানালেন। ওনারাও সৌহার্দ্যকে ফোন করে আটকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। যার ফলে ওনারা বিহানের ওপর আরও ক্ষেপে বেশি গেলেন। ওনাদের মতে বিহানই সব নষ্টের মূল।

সৌহার্দ্য আজ একটু বেড়িয়েছে, কালকে ফ্লাইট তাই কেনাকাটা করবে আর অফিসেও একটু যেতে হবে তাই। তুর্বী এদিকে অপেক্ষা করছে কবে সৌহার্দ্য আসবে অফিসে আর ও কথা বলবে। ওর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সৌহার্দ্যকে অফিসে আসতে দেখে তুর্বী দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্য তুর্বীর দিকে একবারও না তাকিয়ে কেবিনে চলে গেল। তুর্বীও পেছন পেছন গেল। নক না করেই ভেতরে ঢুকে পরল ও। সেটা দেখেও সৌহার্দ্য কিছু বলল না। ও ফাইল দেখায় ব্যস্ত। তুর্বী সৌহার্দ্যর সামনে গিয়ে হাফানো কন্ঠে বলল,

” সৌহার্দ্য আমার কিছু বলার আছে তোমাকে।”
” কন্টিনিউ।”
” দেখ আমি জানি তুমি আমার জন্যে হার্ট হয়েছো। বাট ট্রাস্ট মি আমি এরকমটা চাইনি।”
সৌহার্দ্য ফাইল দেখতে দেখতেই বলল,
” চ্যাপ্টারটা অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গেছে। সো আমি এসব নিয়ে ভাবছি না। অন্যকিছু বলার থাকলে বল।”
তুর্বী অসহায় গলায় বলল,
” সৌহার্দ্য আ’ম সরি।”
” ডোন্ট বি। এতে তোমার কোন দোষ নেই। আর হ্যাঁ কাল থেকে আবার বাবা বসবেন অফিসে। সো ওনার সাথে নতুন প্রযেক্ট নিয়ে কথা বলে নিও।”
” মানে? আঙ্কেল, আই মিন স্যার ফিরে এসছেন?”

” ইয়া, এন্ড আমি ব্যাংকক চলে যাচ্ছি। ওখানকার অফিসটা আমিই দেখব।”
তুর্বী যেন আকাশ থেকে পরল। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” চলে যাচ্ছো মানে?”
সৌহার্দ্য কঠিন গলায় বলল,
” আমি বাংলাতে বলেছি। না বোঝার কিছু নেই। আর এতে তো তোমার কিছু যায় আসারও কথা না তাইনা? সো ইউ মে গো।”
তুর্বী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সৌহার্দ্য চলে যাবে? ও নিজেকে সামলে বলল,
” সৌহার্দ্য এভাবে তোমার ফ্যামিলি, বিহানকে ছেড়ে তুমি..”
” দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। ইউ ক্যান গো।”
” সৌহার্দ্য তুমি..”
” তুর্বী যাও। আমি চাইনা তোমার সাথে মিসবিহেভ করতে।”

তুর্বী মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেল। কিন্তু সৌহার্দ্য চলে যাবে ব্যাপারটা মানতে পারছেনা। কিছুতেই না। সৌহার্দ্যও ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটাবার কী শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলা যেতোনা যে ‘সৌহার্দ্য যেওনা। আমি তোমাকেই ভালোবাসি, আর তোমার সাথেই থাকতে চাই?’ তাহলে হয়তো সবটা অন্যরকম হত।
বিহান রিখিয়ার অফিসের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রিখিয়ার সাথে কথা বলা দরকার। ওর অন্যায়ের জন্যে মেয়েটার কাছে আরেকবার ক্ষমা চাইতেই হবে। সৌহার্দ্যর যাওয়ার ব্যাপারটা জানে ও। বিহানের বাবা-মা ফোন করে বলেছে। সাথে বিহানকে নানারকম কথাও শুনিয়েছে। বিহানের মা তো বলেই ফেলেছে, ‘তোকে জন্ম দেওয়ার জন্যে আর মাসুল গুনতে হবে? আর কত ধ্বংস করবি তুই? মরে যেতে পারিস না?’ ফোনটা কেটে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল বিহান। এসবে এখন আর কষ্ট হয়না ওর। এরচেয়েও কঠিন কথা শুনেছে ও। তবে সৌহার্দ্যর চলে যাওয়ার কথা শুনে ও বিচলিত হয়ে যায়। সৌহার্দ্যর সাথে দেখা করে ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টাও করেছে বিহান কিন্তু লাভ হয়নি। সৌহার্দ্য ঠিককরে কথাই বলেনি।

রিখিয়া ওর অফিস থেকে বেড়িয়ে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে আছে গেইটের সামনে। রিখিয়া মনটা কেমন করে উঠল। এ কী হাল করেছে ছেলেটা নিজের? কী হয়েছে ওর? কিন্তু বিহানের দেওয়া আঘাতের কথা মনে পরলেই ও নিজেকে সামলে চলে যেতে নিল। কিন্তু বিহান পথ আটকে বলল,
” রিখিয়া আমার কথাটা শোন প্লিজ।”
” পথ ছাড়ুন।”
বিহান ওখানেই হাত জোড় করে বলল,
” রিখিয়া আমি যা করেছে রাগের মাথায় করে ফেলেছি। বিশ্বাস কর রাগটা কমতেই আমি আমার ভুল বুঝেছি কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। তুমি এতো তাড়াতাড়ি আমাকে ভালোবেসে ফেলবে বুঝিনি আমি। জানি অনেক কষ্ট দিয়েছি কিন্তু..”
রিখিয়া একটু হেসে বলল,

” ভুল মানুষকে ভালোবাসলে কষ্ট পেতেই হয়। তাই আমিও পাচ্ছি। এটা নতুন কিছু না। আর কিছু বলবেন?”
” প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে।”
এভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরেও ক্ষমা না করার মত কঠিন হৃদয় এখনও রিখিয়ার হয়নি। তাই রিখিয়া বলল,
” দিয়েছি। ক্ষমা করে দিয়েছি।”
বিহান করুণ কন্ঠে বলল,
” রিখিয়া বিশ্বাস কর, তোমার ভালোবাসার বদলে যদি আমি তোমাকে কিছু দিতে পারতাম আমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হতোনা। কিন্তু মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে দ্বিতীয়বার ঠকাতে পারবনা তোমাকে।”
রিখিয়া মুচকি হেসে বলল,

” কিছুই দিতে হবেনা। তাছাড়াও আমি কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”
বিহান অবাক হয়ে বলল,
” কী?”
” হুম চলে যাচ্ছি।”
” তোমার জব?”
” ছেড়ে দিয়েছি। ওখানে জব অফার আছে একটা, ভালোই। বাড়িতে বাবা মার কাছেও থাকা হবে আর চাকরিও করা হবে। যাই হোক আসছি। ভালো থাকবেন। আর হ্যাঁ, দয়া করে ভবিষ্যতে কোন মেয়ের মন নিয়ে এভাবে খেলবেন না। সবাই রিখিয়া হয়না।”

বিহানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রিখিয়া চলে গেল। বুক ফেটে কান্না আসছে ওর। ভালোই যখন বাসেনা তখন আবার ওর সামনে কেন এল? এক মুহূর্তের জন্যে ও ভেবেছিল বিহান ওকে ফেরাতে এসছে, ওকে বলত এসছে যে, ‘সরি মহারানি আমি তোমাকেই ভালোবাসি, শুধু প্রথমে বুঝতে পারিনি।’ কিন্তু বিহান এরকম কিছুই বলল না। বিহানের চোখ অকারণেই ছলছল করে উঠল। যদি পারত মেয়েটাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘ভালোবাসি’। তাহলে হয়ত মেয়েটার কষ্টটা কমত। কিন্তু মিথ্যে বলে আবার মেয়েটাকে ঠকাতে পারবেনা ও। মেয়েটা তাহলে আরও বেশি কষ্ট পাবে। কারণ ভবিষ্যতে যে ও রিখিয়াকে ভালোবাসতে পারবে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছেনা ও। তাই হতাশ হয়েই ফিরে গেল।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। চারপাশটা ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রিখিয়া। বাইরে দিয়ে নিজেকে মোটামুটি সামলে নিলেই মনের ক্ষতটা এখনও তাজা। এই ক্ষত এত দ্রুত ভালো হবার নয়। তুর্বী এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রেলিং এ হাত রেখে বলল,
” এখনও রেগে থাকবি আমার ওপর?”
” আমি তোমার ওপর রেগে নেই তুর্বী। শুধু একটু বিরক্ত। এরকমটা না করলেও পারতে।”
” ইয়ার প্লিজ তুর্বী তুর্বী করিসনা। হার্ট হই আমি। আর কী করতাম আমি? ভালো না বেসেও সংসার করতাম ওর সাথে? টিকতো সেই বিয়ে? পরে আরও বেশি কষ্ট পেতোনা?”
রিখিয়া কিছু বলল না। তুর্বী বলল,

” আচ্ছা ছাড়। ঐ বিহানের জন্যে নিজেকে কষ্ট দিস না প্লিজ।”
রিখিয়া শান্ত কন্ঠে বলল,
” আমি আমাদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।”
তুর্বী অবাক হয়ে বলল,
” মানে?”
” ওখানে একটা ভালো জবের অফার এসছে। যদিও এখানকার চেয়ে বেতন আট হাজার কম। তাতে কী? ফ্লাটের ভাড়াইতো আমার ভাগে দশ হাজার চলে আসে। ওখানে তো সেটা লাগবে না। এমনিতেও বাবা মা অসুস্থ। আমার এখন ওখানেই থাকা উচিত।”
” এক মিনিট! এক মিনিট! কী বলতে কী চাইছিস তুই? তুই চলে যাবি? ইউ মিন তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি?”
রিখিয়া মলিন হেসে বলল,

” একদিন তো যেতেই হতো তুর্বী। সময়টা হয়তো এখনই।”
তুর্বী চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল,
” দেখ আমি জানি তুই ডিপ্রেসড কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিস না প্লিজ। দেখ একটু..”
রিখিয়া তুর্বীর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল,
” আমায় যেতে হবে তুর্বী। বাবা-মার এখন আমাকে দরকার। কখন কী হয়ে যায় বলা যায়না। আমি যাচ্ছি, কিছু করার নেই।”
তুর্বী এবার কান্নামাখা গলায় বলল,
” তুই ছাড়া এখানে আমার কেউ নেই ইয়ার।”

এবার রিখিয়ারও গলা ধরে আসছে। তবুও নিজেকে শক্ত করে তুর্বীর কাধে হাত রেখে বলল,
” আমি আসার আগেও তো একাই ছিলে। আমাদের জীবনে এমন অনেক মানুষ হঠাৎ করেই আসে, খুব কাছের কেউ হয়ে ওঠে, আবার হঠাৎ করেই একদিন চলে যায়। অনেক দূরে। এটাই বাস্তবতা, আর তোমাকে সেটা মানতে হবে।”
কথাটা বলে রিখিয়া চলে গেল রুমে। আসলে এই জবটার কথা আরও আগেই বলেছিল ওর ওখানকার এক বান্ধবী। কিন্তু ও শুধু তুর্বীর কথা ভেবেই যায়নি। কিন্তু এখন আর এই শহরে থাকা সম্ভব না। শহরটা বড্ড বিষাক্ত লাগছে ওর কাছে। এখানে থাকলে ও বাঁচবেনা। মরে যাবে, নিশ্চিত মরে যাবে। ভাগ্যিস পোস্টটায় নতুন জয়েন করা লোকটাও কিছুদিন আগে জব ছেড়ে দিয়েছে। তুর্বী ভেতরে এসে দেখে রিখিয়া ব্যাগ গোছাচ্ছে। তুর্বী অস্হির হয়ে সব আবার এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

” রিখু প্লিজ যাসনা।”
রিখিয়া আবার সব গোছাতে গোছাতে বলল,
” ছেলেমানুষী করোনা তুর্বী। যেতে হবে।”
তুর্বী অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল রিখিয়ার দিকে। কিছু একটা ভেবে বলল,
” আমায় সকালে ঘুম থেকে কে তুলবে ? অফিসে লেট হয়ে যাবোতো। এলার্মে কাজ হয়না আমার তুই জানিস।”
” বেশ কয়েকটা এলার্ম দিয়ে রেখ। পরে আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে যাবে।”
” আমার কফি কে বানাবে। তুই জানিস আমার কফি জঘন্য হয়।”
” করতে করতেই ভালো হবে।”
” আর আমার..”
রিখিয়া এবার একটু রেগে বলল,
” বাচ্চা নও তুমি তুর্বী। আর এসব করে লাভ নেই আমাকে যেতে হবে।”

কথাটা বলে রিখিয়া ওয়াসরুমে চলে গেল। তুর্বী ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে প্রায় কেঁদেই দিল। এদিকে সৌহার্দ্য চলে যাচ্ছে কাল। আর রিখিয়াও। একা এই শহরে কীকরে থাকবে ও? ও তো দম আটকেই মরে যাবে একপ্রকার।
সকাল সকাল বাবা মার কাছে বিদায় নিয়ে সৌহার্দ্য এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছে। ওনারা চেয়েও আটকাতে পারেন নি। এয়ারপোর্টে নেমে দেখে বিহান দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে ওর একরাশ অসহায়ত্ব। সৌহার্দ্য কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে যাচ্ছে বিহানও সাথে যেতে যেতে বলল,
” ব্রো প্লিজ যাস না। তুই যা বলবি আমি করব কিন্তু প্লিজ ডোন্ট গো।”
সৌহার্দ্য একটা ঢোক গিয়ে বিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমায় যেতে হবে। ওখানকার অফিসে এঈজন থাকা জরুরি।”
” আরে এতোদিন চলেছে বাকিদিনও চলে যাবে। প্লিজ যাসনা।”

কিন্তু সৌহার্দ্য শুনছেনা। বিহানও এটা ওটা বলে ওকে আটকাতে চাইছে। বিহান আর সামনে যেতে পারবেনা। তাই সৌহার্দ্যর হাত ধরে আটকে বলল,
” প্লিজ।”
সৌহার্দ্য হাত ছাড়িয়ে বলল,
” ছেলেমানুষী ছেড়ে বাড়ি যা। যাওয়াটা কোনভাবেই ক্যান্সেল করা যাবেনা।”
বিহান এবার জেদ ধরে বলল,
” আমি ওতো কিছু জানিনা। তুই যাচ্ছিস না।”
বলে লাগেজটা নিতে গেলেই সৌহার্দ্য আটকে নিয়ে বলল,
” আমি বাবাকে কথা দিয়েছিলাম ভবিষ্যতে যদি তোর কোন অন্যায়ের প্রমাণ আমি পাই তাহলে আমি নিজে তোকে ত্যাগ করব। কাছে থাকতে সেটা সম্ভব নয়। আর আমি আমার দেওয়া কথার খেলাপ করিনা।

 জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩১

বিহান শুধু তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্যর দিকে। সৌহার্দ্য চলে গেলে বিহান শ্বাস নেবে কীকরে? কে আছে সৌহার্দ্য ছাড়া ওর? ওর একা জীবনে যেটুকু বেঁচে ছিল সবটাই তো সৌহার্দ্যর জন্যে ছিল। না হলে তো পাঁচ বছর আগেই মরে যেতো। সৌহার্দ্য না থাকলে ও মরে যাবে, একদম মরে যাবে। কিন্তু তবুও কিছু বলল না। সৌহার্দ্য চলে গেল ভেতরে। ওরও কষ্ট হচ্ছে। গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু পারছেনা। বিহান আর তুর্বীকে দেখতে পাবেনা ভাবলেই সব ফাঁকা লাগছে ওর। কিন্তু না চাইলেও অনেক কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়। কিছু করার থাকেনা। বিহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সৌহার্দ্যর যাওয়ার দিকে। চোখ দিয়ে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পরল।

এদিকে রিখিয়াকেও আটকাতে পারেনি তুর্বী, চলে গেছে ও। তুর্বী কোন চেষ্টাতেই কাজ হয়নি। ভাগ্য অনেক যত্ন করে এই চারজনকে এক সুতায় গেঁথেছিল। একটা টানে সেই সুতো ছিড়ে আজ চারজন চারদিকে ছড়িয়ে পরল। ভাগ্য কী আবার কোনদিন এক করবে ওদের? ওরা কী আদোও কোনদিন পাবে জলফড়িঙের খোঁজ?

 জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৩৩