জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪২ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রিখিয়াদের বাড়িতে আজ সবাই খুশি। বেশ খোশমেজাজে আছে সবাই। রিখিয়ার যে ভাই-ভাবি প্রায় বাড়িতে এসে এটা ওটা বলেছে, তাদের মুখ দিয়েও আজ মধু ঝড়ছে। রেজাউল ইসলাম, জাহানারাও আজ বেশ প্রসন্ন। মরার আগে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ করে যেতে পারবেন, এরচেয়ে খুশির আর কী হতে পারে? সব বাবা-মাই নিজের সন্তানের সুখ চান। উনারাও তার ব্যাতিক্রম নন। রিখিয়া তাকিয়ে দেখছে নিজের পরিবারের মানুষের খুশি। এদের খুশির জন্যেই তো ওর ওর জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে।

বিয়েটা আর কী জিনিস? এতদিন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিলেও সেদিন যখন ওর ভাইয়া-ভাবি ওর বাবা-মাকে এসবের জন্যে দোষারোপ করা শুরু করল। তখন ও বেশ কষ্ট পেয়েছিল। ওর বাবার আহত দৃষ্টি ওর নজর এড়ায় নি। ওর জন্যে এখন ওর বাবা-মা কষ্ট পাচ্ছে সেটা মানতে পারেনি। শুধু ভাবছিল কী করবে। ঠিক সেই মুহূর্তেই শাফিন ওকে ঐসব কথা বল। শাফিনের চিন্তাধারা ওকে অবাক করেছিল। যদিও শাফিন মানুষ হিসেবে খারাপ নয় সেটা ও আগেও জানতো। সারারাত ভেবেছিল ও এই বিষয়ে। যে কারণে বিয়েতে ও রাজি ছিলোনা সেই সমস্যা তো শাফিন দূর করেই দিয়েছে। তাহলে বাবা-মাকে কষ্টে রেখে কী লাভ? হয়তো শাফিনকে ভালোবাসতে পারবেনা কিন্তু ভালো স্ত্রী হয়ে থাকতে অবশ্যই পারবে। এসব ভাবতে ভাবতেই কেউ ‘রিখু’ বলে ডেকে উঠল। রিখিয়া তাকিয়ে দেখে শাফিন দাঁড়িয়ে আছে। শাফিন মুচকি হেসে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” থ্যাংকস।”
রিখিয়া শাফিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
” কেন?”
” বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্যে।”
রিখিয়া মলিন এক হাসি দিল। ও কেন রাজি হয়েছে শুধু ও-ই জানে। কিছু করার নেই এখন ওর আর। এখন শুধু মনপ্রাণ দিয়ে যতটা সম্ভব বিহানকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
শাফিনরা আর রিখিয়া ভাই-ভাবি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা হল খানিকটা। বিকেল হয়ে গেছে। রিখিয়া এমনিতে বেশ ক্লান্ত লাগছে। ভাবল এখন যখন কাজ নেই তখন বিছানায় একটু গা এলিয়ে দেবে। তাই উঠোন থেকে ঘরে যেতে নিলেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল,
” রিখু!”
রিখিয়া থমকে গেল। কারণ কন্ঠটা ওর খুব কাছের কারো। পেছনে ঘুরে তাকাতে ভয় করছে। যদি এটা ওর ভ্রম হয়? যদি মিথ্যা হয়। তাহলে আবার মন খারাপ হয়ে যাবে ওর। এসব ভাবতে ভাবতে সে আবারও ডেকে উঠল,
” রিখু।”

রিখিয়া আবারও নড়ে উঠল। একটা ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। তারপর আস্তে আস্তে পেছন ফিরে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। নিজের চোখকে বিশ্বাস সত্যিই ওর সামনে তুর্বী দাঁড়িয়ে আছে। রিখিয়া যেন জমে গেল। দু-বছর পর হঠাৎ এভাবে তুর্বীকে দেখতে পারবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। ও রোজ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত যাতে শুধুমাত্র একটাবার যাতে ওর তুরের দেখা পায়। আজ সত্যিই তুর্বী ওর সামনে আছে। অবাক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। গলা দিয়ে কোন আওয়াজই বেড় হচ্ছে না। চোখে পানি জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে। তুর্বীও স্হির চোখে দেখছে রিখিয়াকে। আজ কতদিন পর এই মুখটা দেখল। নিজের বোনের চেয়েও বেশি আপন এই মেয়েটার কাছ থেকে কীভাবে এতদিন নিজেকে দূরে রেখেছিল শুধু ওই জানে। বুকের মধ্যে করে উঠছে। ও আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বলল,
” কী? একেতো ওভাবে চলে এসছিলি। আজ আমি যখন নিজে থেকে এতো কষ্ট করে এতটা পথ পার করে এলাম। এতোদিন পর দেখা হল আর তুই কিছুই বলছিস না! আমি কী এতোটা খারাপ? চলে যাবো?”

কথাটা বলতে না বলতেই রিখিয়া অস্ফুট স্বরে একবার ‘তুর’ বলে জাপটে ধরল তুর্বীকে। এতক্ষণ চোখে জমে থাকা জলগুলো ছেড়ে দিল। তুর্বী এতক্ষণ ধরে অনেক কষ্টে নিজের আবেগ কে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল ঠিকই কিন্তু এখন ওরও কান্না পাচ্ছে। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকে, চোখের কোণে জমা জল মুছে রিখিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
” একদম ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদবি না। কী হয়েছে? এমনভাবে কাঁদছিস যেন মরে গেছি আমি।”
রিখিয়া তুর্বীকে ছেড়ে দিয়ে নাকে নাক টেনে বলল,
” থাপ্পড় খাবে কিন্তু। এতোদিন পর এসেও এসব কথা বলছো? কোথায় ছিলে তুমি? এভাবে হুট করে জব ছেড়ে চলে যায়? আমি চলে এসছিলাম তাও তো তুমি জানতে আমি কোথায়। কিন্তু তুমিতো কিচ্ছু না জানিয়ে ভ্যানিস হয়ে গেলে। ঢাকাও গিয়েছিলাম তোমাকে খুঁজতে। কিন্তু পাইনি। আর আজ তোমার মনে হল এসে আমার সাথে একবার দেখা করা উচিত? এরকম করে কেউ?”
তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বলল,

” তো কী করব? খুব তো একা ফেলে চলে এসছিলি অামাকে। আমার অভিমান হয়না না-কি?”
আবার দুজন দুজনকে আবারও জড়িয়ে ধরে হেসে ফেলল। একে ওপরের প্রাণ ওরা। টানা দুটো বছর আলাদা কীকরে থেকেছে শুধু ওরাই জানে। আজ এতোদিন পর নিজের প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেয়েছে এরচেয়ে বেশি খুশির কী হতে পারে।
রিখিয়ার বিছানায় পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসে আছে তুর্বী আর রিখিয়া। রিখিয়ার মনটা এখন অনেকটাই ফুরফুরে। এতোদিনের মন খারাপ কিছুটা হলেও কেটেছে। টুকিটাকি গল্প করছে দুজনে। এতোদিনের বিভিন্ন ঘটানা নিয়ে আলোচনা করছে। রিখিয়া বেশ অবাক হয়ে বলল,
” সৌহার্দ্যই তাহলে আরজে এস আর ছিলেন?”
তুর্বী হেসে দিয়ে বলল,
” ভাব! এতমাস একসাথে থেকেই টের পাইনি।”
” সেটাই! আমারও অদ্ভুত লাগছে। তুমি তাহলে এতোদিন সিলেট ছিলে?”
” হুম। তোর এখানকার জব কেমন চলছে?”
” ভালো।”

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর তুর্বী শীতল দৃষ্টিতে রিখিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বিহানকে মিস করিস?”
রিখিয়া হালকা কেঁপে উঠল। কিন্তু সাথেসাথেই নিজের চোখেমুখে ফুটে ওঠা বেদনাকে কাটিয়ে নিয়ে, নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করে বলল,
” ছাড়ো এসব কথা। অতীত নিয়ে ভাবতে চাইনা আমি।”
” কিন্তু…”
এরমধ্যেই জাহানারা ট্রে তে করে চা আর নুডুলস নিয়ে এলেন। ওনাকে দেখে ওরা দুজনে থেমে গেল। জাহানারা নুডুলসের বাটি ওদের হাতে দিতে দিতে বললেন,
” তোমার কথা রিখিয়া প্রায়ই বলে। মাঝখানে না-কি উধাও হয়ে গেছিলে। যাই হোক, এবার ভালো সময়ে এসব। শুভ কাজ শেষ হওয়ার আগে কিন্তু যাওয়া যাবেনা। বিয়ে পর্যন্ত থাকতে হবে।”
তুর্বী হাসি মুখে নুডলস নাড়তে নাড়তে বলল,

” কার বিয়ে? ”
জাহানারা অবাক হয়ে বল‍লেন,
” সে-কী? রিখিয়া তোমাকে বলেনি? রিখিয়ার তো বিয়ে ঠিক হয়েছে। পনেরো দিন পরেই বিয়ে। আমাদের এম.পি. সাহেবের ছেলে শাফিনের সাথে।”
তুর্বী বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে জাহানারার দিকে তাকাল। কী শুনছে এসব? বিখিয়া বিয়ে করছে? অবাক রিখিয়ার দিকে তাকাতেই রিখিয়া চোখ নামিয়ে নিল। এখনই বিয়েটা ঠিক হওয়ার ছিল? এখন তীরে এসে তরী ঢুববে না তো?
ড্রয়িংরুমের বড় সোফাটায় বিহান মাথা নিচু করে গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। তারপাশে সিঙ্গেল সোফাটায় বসে সৌহার্দ্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। এতক্ষণ ফরিদও ছিল ওখানে কিন্তু পরে চলে গেছে। এখন ফ্লাটে শুধু বিহান আর সৌহার্দ্যই আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছেনা।

বিহান ফরিদের সিথে বসে ওদের পরবর্তী কোন ক্রেতা পেন্টিং নিতে আসবে সেটা নিয়ে আলোচনা করছিল। তখনই বেল বেজে ওঠে। এসময় কারো আসার কথা না তাই দুজনেই অবাক হল। ফরিদ রং ঢালছিল টিউবে তাই বিহানই উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে ও স্হির হয়ে গেল। ওর সামনে সেই মানুষটাই দাঁড়িয়ে আছে যাকে দেখার জন্যে দুই দুইটা বছর ধরে ও মনেমনে ছটফট করছে। ওর জীবনের বেঁচে থাকার একমাত্র ভিত্তি ছিল এই মানুষটা। হ্যাঁ সৌহার্দ্যই দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। এতগুলো দিন পর ওকে নিজের সামনে দেখে অনুভূতি শূণ্য হয়ে গেল ও। শুধু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৌহার্দ্যর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলে আছে কিন্তু চোখ ছলছল করছে। ওর আদরের ভাইটাকে এতোদিন পর নিজের কাছে পেয়ে ইচ্ছে করছে জাপটে ধরতে। কিন্তু কেন যেন পারছেনা। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। তবুও অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” ভেতরে আসতে দিবিনা?”
বিহানের চোখমুখ লালচে হয়ে গেছে। অনেকটা অনুভূতিহীন ভাবেই দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভেতরে গিয়ে সোফায় বসে পরল। সৌহার্দ্য আস্তে আস্তে গিয়ে সামনাসামনি সোফাটায় বসল। বিহান একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্যও কিছু না বলে বসে তাকিয়ে আছে বিহানের দিকে। ফরিদ অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল দুজনের দিকে। পরে বুঝতে পেরেছিল যে ওরা হয়ত কাছের কেউ। তাই এদের মধ্যে থাকাটা ঠিক হবেনা চিন্তা করে ফরিদ বেড়িয়ে গেছে।
বেশ অনেক্ষণ হলো দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। বিহানতো সৌহার্দ্যকে দেখেই খুশি হয়ে গেছিল। জড়িয়েও ধরত। কিন্তু হঠাৎ আগের কিছু কথা মনে পরাতে থেমে গেছিল। নিরবতা ভেঙে বিহান নিজেই ধীর গলায় বলল,
” আমার এড্রেস কোথায় পেলে?”
সৌহার্দ্য বিহানের মুখে ‘তুমি’ শুনেও রিঅ্যাক্ট করল না। স্বাভাবিকভাবে বলল,
” তুর্বী দিয়েছে।”
বিহান একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,
” তুর্বীর সাথে দেখা হয়েছে তোর?”
” হুম হয়েছে।”
বিহান আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” হঠাৎ আমার মত একটা রেপিস্টের সাথে দেখা করার ইচ্ছা হল যে?”
সৌহার্দ্য এতক্ষণ শান্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
” আরেকবার তোর মুখ দিয়ে এই শব্দটা বেড় হলে আই সোয়ার তুই আজ আবার আমার হাতে চড় খাবি কিন্তু।”
বিহান কিছু না বলে চোখ সরিয়ে নিল। সৌহার্দ্য উঠে গিয়ে বিহানের পাশে গিয়ে বসল। এরপর হাত ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” সমস্যা কী তোর? হ্যাঁ। মানছি সেদিন রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছি। তাই বল আজও সেসব কথা মনে রাখবি? শুধু আমার ঐ একদিনের বলা কথাগুলোই মনে রাখবি। আর আমার এতো বছরের দেওয়া ভালোবাসা? সেগুলো কিচ্ছু না?”
বিহানের গলা কাঁপছে, চোখ টলমল করছে এখন। ও আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪১

” হ্যাঁ খুব ভালোবাসা দেখিয়েছেন আপনি। তাইতো দুটো বছর বিদেশে কাটিয়ে দিয়ে এসছেন। এখানে যে বিহান নামে একটা ভাই আছে আপনার। সে বেঁচে আছে না-কি মরে গেছে সেটা জেনে আপনি কী করবেন?”
সৌহার্দ্য হালকা হেসে তাকাল বিহানের দিকে। তারপর বলল,
” সরি! সত্যিই ভুল হয়ে গেছে। দেশ ছেড়ে যাওয়াটা আমার ভুল হয়ে গেছে। আমিতো কতসময় তোর কত ভুল ক্ষমা করে দিয়েছি। কত দোষ ঢেকেছি। আমার একটা ভুল ক্ষমা করা যায় না?”
বিহান কোন রিঅ্যাক্ট না করে এখনো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌহার্দ্য বলল,
” তুই যখন চাসই না আমি এখানে থাকি তাহলে আর আমি কেন থাকব? চলে যাচ্ছি তাহলে।”
কথাটা বলে উঠতে নিলেই বিহান সৌহার্দ্যর হাত ধরে ফেলল। কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে জোরে জড়িয়ে ধরল সৌহার্দ্যকে। কান্নামাখা গলায় বলল,

” প্লিজ আমাকে ছেড়ে আর যাস না ব্রো। আমি আর নিতে পারব না। প্রচন্ড কষ্ট হয়। আমিও তো মানুষ বল। দরকারে রোজ মারিস আমাকে। আমি কিচ্ছু বলব না। তবুও আমাকে ছেড়ে আর যাসনা, প্লিজ।”
সৌহার্দ্য চোখে জল চলে এল। ও দুহাতে বিহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৩