জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৭ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৭
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

মাঠের পাশের পুকুরপারে সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে আছে সৌহার্দ্য আর তুর্বী। দুজনেই গভীর ভাবনায় মগ্ন। তুর্বী ভ্রু কুচকে রেখে ছোট ছোট চাকার টুকরো ছুড়ে মারছে পুকুরে আর একমনে ভেবে চলেছে। আর সৌহার্দ্য দুই হাত পেছনের দিকে রেখে পেছন দিকে হেলান দিয়ে সামনের সিঁড়ির দিকে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে। তুর্বী একটা লম্বা হাই তুলে বলল,
” কিছু ভেবে পেলে?”
সৌহার্দ্য হতাশ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
” উমহুম। কিছুই মাথায় আসছে না।”

তখনই পাশে রেখে দেওয়া সৌহার্দ্যর ফোন বেজে উঠল। তুর্বী তাকিয়ে স্ক্রিনে দোলা নামটা স্পষ্ট দেখতে পেল। ওর মেজাজ আবার বিগড়ে গেল। সারাদিনই কী সৌহার্দ্যর পেছনে লেগে থাকে না-কি? এখন কত ইম্পর্টেন্ট বিষয়ে ডিসকাস করছে ওরা, আর এই মেয়ে এখন প্রেমালাপ করতে ফোন করছে। সৌহার্দ্য ফোনটা রিসিভ করে বলল যে, পরে কথা বলবে। এরপর ফোন রাখতেই তুর্বী কটমট চোখে তাকিয়ে বলল,
” তা মাথায় আসবে কেন?এখনতো সারাদিন মাথায় হবু বউ এর চিন্তা ঘুরে বেড়ায় তাই না? অন্যদের নিয়ে ভাবার মত সময় আছে নাকি? আর তাছাড়াও তোমার মাথায় আবার কবে কোন প্লান এসছে? আগেও গাধা ছিলে এখনো গাধাই আছো। ”

সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে বলল,
” আমি গাধা?”
” হ্যাঁ গাধাই। বুদ্ধি থাকলে এতক্ষণে অন্তত একটা প্লান বলতে পারতে।”
” আহা! তোমার মাথাতো বুদ্ধিতে ভরপুর আছে তাইনা? তাহলে তুমিই বল কোন প্লান।”
তুর্বী এবার একটু হকচকিয়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে শুরু করল। সৌহার্দ্য হেসে দিয়ে বলল,
” কী মিস বুদ্ধিমতি? দেখাও তোমার বুদ্ধি।”
তুর্বী নিজের ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
” হ্যাঁ বলছিতো, এতো তাড়াহুড়োর কী আছে? বলছি, বলছি।”
সৌহার্দ্য এবার নিজেও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে। আপনি কী ভেবেছেন। মুখেই বড় বড় বুলি শুধু। কীকরে‍ যে এই মেয়ের প্রেমে পরলাম কে জানে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তুর্বী সৌহার্দ্য দিকে ঘুরে রাগী কন্ঠে বলল,
” হ্যাঁ এখনতো এসব মনে হবেই। ওমন সুন্দরী হবু বউ আছে। তার এতো গুন। ওসব দেখার পর এখনতো আমার সবকিছুই খারাপ লাগবে। নরমাল।”
সৌহার্দ্য ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে তুর্বীর দিকে। তুর্বীর কথায় আজ ও জেলাসির গন্ধ পাচ্ছে।তাহলে কী তুর্বী ওকে___ না, ও আগে থেকে আর কিচ্ছু ভাববে না এবার। যদি তুর্বীর মনে কিছু থেকে থাকে সেটা তুর্বীকেই বলতে হবে। তুর্বী নিজে থেকে বললেও সৌহার্দ্য কতটা ওকে আগের মত এক্সেপ্ট করতে পারবে সেটাও ভাবার বিষয়। সৌহার্দ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” তাতে তোমার কী সমস্যা? ইউ ডোন্ট কেয়ার রাইট?”
তুর্বী ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
” ইয়েস, আই ডোন্ট কেয়ার।”
” তাহলে এসব অবান্তর কথা বন্ধ করো।”
তখন তুর্বী কিছু একটা চিন্তা করে নরম গলায় বলল,
” আমরা নিজেদের মধ্যে অযথাই ঝগড়া কেন করছি? আমরা বিহান আর রিখুর প্যাচ আপ করার প্লান করতে এসে নিজেরাই ঝগড়া করছি।”
সৌহার্দ্যর এবার ঠান্ডা হল। তারপর বলল,
” এভাবে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা।”
তুর্বী মন খারাপ করে বলল,
” আর মাত্র দশদিন বাকি আছে বিয়ের। অামাদের এরমধ্যেই কিছু করতে হবে। আচ্ছা শাফিনের সাথে কথা বললে কেমন হয়।”

” শাফিন কে গিয়ে কী বলব? আগে তো এই দুজনকে রাজি করাতে হবে না? এরাতো বেঁকে বসে আছে। এদের ঠিক না করতে পারলে কোনকিছু করেই লাভ নেই।”
” হুম, সেটাও ঠিক।”
সৌহার্দ্য একটু ভেবে বলল,
” আমার মনে হয় রিখিয়ার জানা উচিত যে বিহান ওর জন্যে কী ফিল করে। কিন্তু সেটা আমাদের মুখে নয় স্বয়ং বিহানের মুখে।”
তুর্বী আরও বেশি চিন্তিত হয়ে বলল,
” কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব? তোমার কথা শুনে যা বুঝেছি। রিখিয়ার বিয়ের কথা শোনার পর ও কখনই কিছু বলবে না নিজে থেকে রিখিয়াকে।”
সৌহার্দ্য কিছু না বলে ভাবতে শুরু করল। তুর্বীও আবার ভাবনায় মগ্ন হল। ভাবনার মাঝেই হুট করে তুর্বী বলে উঠল,
” আমার একটা প্লান আছে।”
সৌহার্দ্য সোজা হয়ে বসে বলল,
” কী প্লান?”
” আমি তোমাকে টেক্সট করে দেব কী করতে হবে। এখন আমাকে উঠতে হবে। অনেকটা পথ যেতে হবে আমায়।”
” আচ্ছা। চল আগে কিছু খেয়ে নেবে।”
তুর্বী কিছু বলার আগেই আবার সৌহার্দ্য ফোন বেজে উঠল। এবারেও দোলাই ফোন করেছে। তুর্বীর কেন জানি এবার রাগের চেয়েও বেশি খারাপ লাগল। ও অনেকটাই অভিমানী গলাতেই বলল,
” এখন আমার খিদে নেই, আর সময়ও নেই। আসছি।”
বলে সৌহার্দ্যকে কিছু বলতে না দিয়েই তুর্বী চলে গেল। কেন জানিনা হঠাৎই কান্না পেল ওর। কান্না আটকানোর জন্যেই এই দ্রুত প্রস্হান। সৌহার্দ্যর পাশে দোলা নামটাই এখন সহ্য হয়না তুর্বীর। এটাই কী তবে প্রেম? প্রেম নামক রোগ কী তবে তুর্বীকেও গ্রাস করল?

সৌহার্দ্য আর বিহান মিলে অনেকদিন পর আজ জমিয়ে রান্না করেছে। আজ প্রায় দুবছর পর দুই ভাই মিলে আবার রান্না করল। কিন্তু এখন আর আগের মত রান্নাঘর লন্ডভন্ড হয়না। ওরা এখন গুছিয়ে রান্না করতে শিখে গেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে আজ সৌহার্দ্য নিজেই বিহানকে বলল,
” ড্রিংক করবি না আজ?”
বিহান একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল,
” কী ব্যাপার বলতো? আজ তুই নিজে থেকে আমাকে ড্রিংক করতে বলছিস?
সৌহার্দ্য জানে একমাত্র ড্রিংক করলেই বিহান নিজের ভেতরকার সব কথা উগলে দেয়। না হলে ওর মুখ ফোটেনা সহজে। সৌহার্দ্য ব্যাপারটা সামলাতে বলল,
” আসলে, তুইতো আর আমার কথা শুনবিনা। তাই বললাম।”
বিহান ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

” হুম, চল ছাদে চল।”
” না, আজ ছাদে না তোর পেন্টিং রুমে বস গল্প করব। তোর পেন্টিং এর এক্সপ্লেনেশনগুলো শুনবো।”
” ওকে ফাইন।”
পেন্টিং করার রুমটাতে গিয়ে দুজনেই ফ্লোরে হেলান দিয়ে বসল। সৌহার্দ্য আগেই সব পেন্টিং এর কাপড় সরিয়ে দিয়েছে। এরপর বিহান ড্রিংক করতে করতে বিহানকে একেকটা পেন্টিং এক্সপ্লেইন করছে। সৌহার্দ্য যখন দেখল বিহানের নেশা হয়ে গেছে ও বিহানের চোখের আড়ালেই তুর্বীকে ফোন করল। এরপর রিখিয়ার পেন্টিংটাকে উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,
” আর এটা?”
বিহান মাতাল দৃষ্টিতে তাকাল ছবিটার দিকে। তারপর একটু হাসল। যে হাসিতে ভালোবাসা, কষ্ট, নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য সব মিশে ছিল। তুর্বী এতক্ষণ সৌহার্দ্যর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। ও দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে কানে নিলো। তুর্বীর পাশেই রিখিয়া বসে নিজের অফিসের কিছু কাজ করছে। তুর্বী চুপচাপ বিহানের বলা কথাগুলো শুনছে। তুর্বীকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,

” কার ফোন যে এভাবে চুপ করে শুনছোই শুধু কিছু বলছোনা?”
তুর্বী উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” আর বলিস না। হোল্ডে থাকতে বলে কোথায় যেন গেছে। আমারও ওয়াসরুম যেতে হবে। এই শোননা তুই ফোনটা একটু কানে ধরে রাখ। লাইনে আসলে বলবি আমি ওয়াসরুম গেছি, ওয়েট করতে।”
বলে ফোনটা লাউডে দিয়ে তুর্বী বাইরে চলে গেল। রিখিয়া বলল,
” আরে কে আছে সেটাতো বলে যাও?”

কিন্তু তুর্বী আর দাঁড়ায় নি। রিখিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এরপর ফোনটা থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে ও কানে দিল ফোনটা, ভালোভাবে শোনার জন্যে। ওপাশ থেকে বিহানের গলা পেয়ে ও চমকে উঠল। বিহান বলছে,
” জানিস ব্রো। ওকে প্রথম একটা মলে দেখেছিলাম। লিফ্টের মধ্যে একটা মেয়ের সাথে ক্লোজ অবস্থাতেই আমাকে প্রথম দেখেছিল ও। লজ্জায় আর বিরক্তিবোধে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর এই ব্যাপারটাই ইন্টারেস্টিং লেগেছিল আমার।

লিফ্টের বাইরে যখন ওকে ডেকে নাম জিজ্ঞেস করলাম তখন ভয়ে ভয়ে সরলভাবে ওর সব বলে দেওয়া, ইনোসেন্স দেখে অবাক হয়েছিলাম। এরপর যখন টাকার জন্যে ঘড়ি কিনতে না পেরে গোমড়া মুখে ফিরে যাচ্ছিল, সেটা নিতে পারিনি আমি। তাইতো ওকে ঘড়িটা পাইয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এরপর বারবার দেখা হয়েছে ওর সাথে। আমিও নানাভাবে ওরসাথে মজা করতাম। কেন জানিনা ওকে জ্বালাতে আমার অদ্ভুতরকম ভালো লাগতো।

একটু একটু করে ওকে অন্যরকমভাবে আবিষ্কার করছিলাম। কিন্তু সেইদিন পার্টিতে ওর সম্মান বাঁচাতে গিয়ে যখন আমাকেই এরকম অসম্মানের শিকার হতে হয় শুধুমাত্র ওর একটু ভুল বোঝার কারণে। তখন আমার মাথায় শুধু মায়ার কথাই এসছিল। বারবার সেই দিনটা, সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভাসছিল। সেই অপমান, সেই তিরস্কার, সকলের সেই ঘৃণাভরা দৃষ্টি সবকিছুই মাথায় ঘুরছিল। মনে হচ্ছিল সেসব আবার ফিরে এসছে।

মায়ার জায়গায় রিখিয়াকে কল্পনা করছিলাম আমি। ঐ মুহূর্তে আমার মাথা বিগড়ে গেছিল। তখন মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছিল। প্রতিশোধ!”
রিখিয়ার চোখ ছলছল করছে বিহানের কথা শুনে। স‍ৌহার্দ্য আড়চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে যে রিখিয়া লাইনে আছে কি-না। রিখিয়া ভাবছে যে মায়া কে? কার জন্যে বিহানকে অপমানিত হতে হয়েছিল? সকলের ঘৃণার পাত্র হতে হয়েছিল? কী করেছিল মায়া? বিহান আবার বলতে শুরু করল,

” এরপর ওর সাথে মেলামেশা আর বন্ধুত্বের শুরুটা নাটক ছিল ঠিকই। কিন্তু প্রথমবার যখন গাড়িতে ওকে আমার বুকে নিয়েছিলাম মনে হয়েছিল আমার সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে গেছে। ওর সংস্পর্শে এসে আস্তে আস্তে আমার ভেতরকার শূণ্যতা দূর হয়ে গেছিল। শুরুটা অভিনয় দিয়ে হলেও একপর্যায়ে আমি ওকে সত্যিই নিজের বন্ধু ভাবতাম। আর সেই বৃষ্টির রাতে যখন ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৬

ওরকম অনুভূতি তার আগে আমার কক্ষণো হয়নি। ওকে যখন ঠিককরে চিনতে শুরু করলাম তখন বুঝেছি যে আমি কতবড় ভুল করছি। তাইতো আমি চেয়েছিলাম আমার উদ্দেশ্য পূরণ হওয়ার আগেই, ও আমাকে ভালোবাসার আগেই সব সত্যি বলে দিতে। কিন্তু দেরী হয়ে গেছিল। ততোদিনে ঐ বোকা মেয়েটা আমার মত একটা অযোগ্য, বাজে, ইউসলেস ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিল। হয়তো আমিও বেসেছিলাম কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি। তাইতো ও যাতে আর কষ্ট না পায় তাই সরে এসছিলাম।

কিন্তু সরে গিয়ে বুঝতে পেরেছি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। যত দিন যাচ্ছিল ওর স্মৃতি আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, আমার রাত জাগার কারণ হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও সরাতে পারিনি মন থেকে। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। আস্তে আস্তে সেই অনুভূতির নাম খুঁজে পেলাম। বুঝতে পারলাম যে ঐ বোকা মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু আজ এসব কথার কোন অর্থই নেই। আর দশদিন। এরপর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। কিন্তু ও যারই হোক। আই লাভ হার। আই লাভ অর আ লট। কিন্তু আফসোস হচ্ছে। যদি একটা বার বলতে পারতাম, তোমার ভালোবাসা ব্যর্থ হয়নি রিখিয়া। আমিও ভালোবাসি তোমাকে। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”

রিখিয়া চোখ বন্ধ করে কেঁদে দিল। ওর হাত থেকে ফোনটা পরে গেল। সমস্ত শরীর কাঁপছে ওর। কী বলল বিহান এটা? কেন বলল? এখনই কেন বলল? একসময় এই তিনটে শব্দ ওর সমস্ত সুখের চাবিকাঠি ছিল। কিন্তু আজ যে এই তিনটে শব্দই ওকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিল। নিয়ত এতো নিষ্ঠুর কেন?

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৮