জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৬ || লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৬
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

রাতের অন্ধকার আকাশে ঘনকালো মেঘ যমে আকাশকে আরও অন্ধকার করে দিয়েছে। হালকা শো শো বাতাস বইছে। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে রাতে বৃষ্টি নামবে। জৈষ্ঠ্য মাসের তীব্র গরমে আজ সারাটাদিন পার হয়েছে। সকলের অবস্থাই আজ নাজেহাল। তাই বোধহয় প্রকৃতি একটু সদয় হয়ে বৃষ্টি ঝড়িয়ে সবাইকে সিগ্ধ শীতলতা দেবে। ছাদের এককোণে পা ঝুলিয়ে বসে আছে বিহান আর সৌহার্দ্য। দুজনেই চুপচাপ বসে আছে, দুজনের মনই খারাপ হয়ে আছে। গোমড়া মুখ করে বসে আছে দুজনেই। বিহান মদের বোতলে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে যাচ্ছে। সৌহার্দ্য এতক্ষণ বারণ করেনি ঠিকই। কিন্তু এখন বেশি হয়ে যাচ্ছে তাই হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” বিহান, এবার থাম। অনেক হয়েছে।”
বিহান ঠোঁট বাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসল। কিন্তু কিছুই না বলে আবারও বোতলে চুমুক দিতে গেলে সৌহার্দ্য হাত ধরে ফেলে বলল,
” বিহান প্লিজ। ইটস টু মাচ।”
বিহান বোতলট সাইডে রেখে দিয়ে মাতাল কন্ঠে বলল,
” আমি সত্যিই খুব খারাপ তাইনা ব্রো? তুই-ই দেখ আমার বাবা-মা আমার মুখও দেখতে চায়না। যেই মামু আমাকে বুকে জড়িয়ে বড় করেছে, মানুষ করেছে। সেই মামু আমাকে সহ্য করতেই পারেনা। জীবনে একটা মেয়ে এলো যে আমাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে। ইনফ্যাক্ট আমি ওকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার পরেও ও এখনো আমায় ভালোবাসে। ও মুখে না বললেও আমি বুঝি সেটা। আজ ওর চোখের ভাষা অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারি আমি। কিন্তু আমি আমার দোষে সেই ভালোবাসাটাও হারিয়ে ফেললাম। কদিন পর ও অন্যকারো হয়ে যাবে। আমার রিখিয়া অন্যকারো হয়ে যাবে। তুই-ই বল সবাই আমার থেকে দূরে কেন চলে যায়। সবাই ভূল আমি ঠিক এটাতো হতে পারেনা তাইনা? আমি মানুষটাই খারাপ। তাই আমার সাথে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব হয়না। জঘন্য মানুষ আমি।”
এরপর পিটপিটে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকাল। সৌহার্দ্য বিহানেল কাঁধে হাত রেখে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” তুই যখন নিখোঁজ হয়ে গেছিলি। তখন তোর মামু প্রায় আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করত তোর কোন খোঁজ পেয়েছি কি-না। ফুপা-ফুপির সাথে আমি কথা বলতাম না। কিন্তু ওনারাও তোর খোঁজ করতো। তোর প্রতি রাগ, অভিমানে তোকে দূরে সরিয়ে রাখলেও আজও তোকে ওনারা ততটাই ভালোবাসে।”
বিহান টলমলে চোখে সৌহার্দ্যর দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল,
” একটু বিশ্বাস করতে পারল না?”
বিহানের এমন অসহায় গলা সৌহার্দ্যকে আহত করল। বিহান ড্রাংক তাই এভাবে বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ও ওর পরিবারের প্রতি ক্ষোভ বা দুর্বলতা কোনটাই প্রকাশ করেনা বহুবছর যাবত। ও বিহানের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ওকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
” পরিস্থিতি একটা হলেও। তার প্রভাব সবার ওপর একরকম পরেনা। ওনাদের দিক দিয়ে ভাবলে এরকম করাটা খুব বেশি অস্বাভাবিক না। ব্যাপারটাই এভাবে সাজানো ছিল।”

বিহান কিছুই বলল না। সৌহার্দ্য জানে ও পুরোপুরি ঠিক বলছে না। দোষ হোক বা ভুল বিহানের বাবা-মারও কম নেই। কিন্তু বিহানের সামনে এসব বললে ওর মনে পরিবারের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়বে। বিহান ভাঙা গলায় বলল,
” ব্রো, তুই জানতি তাইনা রিখিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?”
সৌহার্দ্য গম্বীর স্বরে বলল,
” হুম জানতাম।”
” তবুও কেন নিয়ে গেলি ওর কাছে? আমিতো নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম। মনকে বুঝিয়ে নিয়েছিলাম ও সুখে আছে, ভালো আছে। কিন্তু আজ রিখিয়াকে দেখে আমার সবটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ওর আমার প্রতি আজও এতোটা ভালোবাসা দেখে আমি অস্হির হয়ে উঠেছি। আমি এখন আর নিজেকে সামলাতে পারছিনা। আমার কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলল,
” ওকে বললি না কেন তোর ভালোবাসার কথা? হয়তো সব ঠিক হতোনা।”
বিহান চোখ বুজে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

” ঠিক হতোনা ব্রো। আমি চিনি ওকে। ওর কাছে থেকে যতটা না চিনেছি, ওর থেকে দূরে গিয়ে আর ভালোকরে চিনেছি। বিয়ের আর বারোদিন আছে। ও নিজের কথা কখন-ই ভাবেনা। ও ওর দুই পরিবারের সম্মানের জন্যে, ওর হবু বরের, তার পরিবারের সম্মানের জন্যে আর পেছন ঘুরে তাকাবেনা। কিছুতেই না। কিন্তু আমি যদি এখন ওকে গিয়ে বলি আমি ওকে ভালোবাসি। তাহলে ওর মনে সারাজীবন আক্ষেপ থেকে যাবে যে নিজের ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েও তাকে গ্রহন করতে পারেনি। গুমরে গুমরে মরবে ও। তারচেয়ে আমার ভালোবাসাটা ওর অজানাই থাক। আমি সারাজীবন আড়াল থেকেই ওকে ভালোবেসে যাব।”
সৌহার্দ্য গম্ভীর মুখে বসে রইল। বিহানের কথাগুলো যে খুব ভুল তা-না। সবটা ঠিক করার একটা সুযোগ এলো কিন্তু বড্ড দেরী করে। বিহান হেসে বলল,

” একটা সময় ছিল যখন ও আমায় নিজের ভালোবাসার কথা বলতে এসে ভাঙা মন নিয়ে ফিরে গেছিল। আর আজ আমি ওকে নিজের মনের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। একেই বলে রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার।”
সৌহার্দ্য রাগী গলায় বলল,
” ফালতু বকিসনা তো। কীসের রিভেঞ্জ? এই দু-বছরের যন্ত্রণা, কষ্ট, ছটফটানি কী কম ছিল? যে প্রকৃতিকে আরও রিভেঞ্জ নিতে হবে?”
বিহান কিছু না বলে সৌহার্দ্য কোলে শুয়ে পরল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। সৌহার্দ্য বিহানের মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে মনে মনে ভাবছে যে, কী করা যায়? কী করলে রিখিয়া-বিহান নিজের ভালোবাসাও ফিরে পাবে। আর দুই পরিবারের সম্মানও বাঁচবে। তুর্বীর সাথে আলোচনা করতে হবে এই বিষয়ে। বিহান বলল,

” তুর্বীকে তো আজও ততোটাই ভালোবাসিস। তাহলে আবার একটা চেষ্টা কেন করছিস না?”
সৌহার্দ্য একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
“ওকে নিয়ে আমি আর কোন আশা বা স্বপ্ন সাজাবোনা। দ্বিতীয়বার একই ধাক্কা নিতে পারবনা আমি। যদি কিছু ঠিক করতেই হয় ওকে নিজে থেকে আসতে হবে আমার কাছে। ওকে নিজে থেকে বলতে ও কী চায়। এইবার আমি নিজে থেকে এক পাও এগোবো না।”
বিহান সৌহার্দ্যর কোল জড়িয়ে ধরল আর মনে মনে প্রার্থনা করল এবার যাতে তুর্বী নিজে থেকে এগোয়। ওর ভাইটা কোনদিন অন্যকাউকে মানতে পারবেনা সেটা ও বুঝে গেছে। এখন সবটাই তুর্বীর হাতে।

রিখিয়া বিছানা গোছাচ্ছে। আর তুর্বী মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আসার পর থেকেই রিখিয়া ওর সাথে একটাও কথা বলেনি। সৌহার্দ্য, দোলা আর তুর্বী, ওরা তিনজন রেস্টুরেন্টে থেকে বেড়িয়ে পার্কে এসে দেখে ওর পার্কের বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে যে কিছুই ঠিক হয়নি সেটা সৌহার্দ্য আর তুর্বী দুজনেই বুঝতে পেরেছিল। যদিও এটাই এক্সপেক্টেড। কারণ একদিনে সবটা ঠিক হওয়ার কথাও না। তারপর ওরা একসঙ্গে লাঞ্চ করে ফিরে এসছে। খুব বেশি কাজ না হলেও প্রথম স্টেপ কম্প্লিট হয়েছে ওদের। তুর্বী অসহায় কন্ঠে বলল,
” এমন করছিস কেন? তুই খুশি হোস নি ওদের সাথে দেখা হয়ে সবটা ঠিক হওয়াতে?”
রিখিয়া এবার বালিশ ছুড়ে রেখে বলল,
” হ্যাঁ হয়েছি। কিন্তু আমাকে একবার জানাবেনা তুমি?”
” সরি ইয়ার। আমি ভেবেছিলাম আগে থেকে বললে তুই যাবিনা।”
” ওও। তাই মিথ্যে বলে নিয়ে গেছে।

” সরি!”
নিচু কন্ঠে বলে মাথা নিচু করে ফেলল তুর্বী। রিখিয়া ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। রিখিয়া শুয়ে পরল। তারপর তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে না থেকে শুয়ে পরো।”
তুর্বীও রিখিয়ার পাশে শুয়ে পরল। পাশাপাশি টানটান হয়ে শুয়ে আছে দুজন। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ ছিল। এরপর তুর্বী ইতস্তত কন্ঠে বলল,
” বলছিলাম যে, বিহানের সাথে কথা বলে কী বুঝলি?”
রিখিয়া ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বুঝবো?”
তুর্বী একটু অবাক হয়ে বলল,
” এতক্ষণ কথা বলেও তোর কিছুই মনে হয়নি?”
রিখিয়া একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
” কী বলছ বলোতো?”
তুর্বী এবার আর কোনরকভ ভনিতা করতে না পেরে সরাসরিই বলল,
” মানে, ওর মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করিস নি তুই?”
রিখিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” হুম। অনেকটা বদলে গেছে। আগের মত নেই। বেশ শান্ত আর ভদ্র হয়ে গেছে।”
তুর্বী রিখিয়ার দিকে ঘুরে শুয়ে বলল,
” তুই জানিস ও এখন আর কোন মেয়ের সাথেও তেমন মেশেনা। আই মিন ওভাবে মেশেনা।”
রিখিয়া একটু অবাক হল। অবাক হয়েই তুর্বীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” তুমি কীকরে জানলে?”
” বান্দরবান গিয়ে যখন দেখেছিলাম তখন খোঁজ নিয়েছিলাম।”
রিখিয়া ছোট স্বরে বলল,
” ওহ।”
তুর্বী উৎসাহি কন্ঠে বলল,
” তোর কী মনে হয়? ওর এই বদলের কারণ কী? এতো বদলে গেল কেন?”
রিখিয়া নির্লিপ্তভাবে জবাব দিল,
” আমি কীকরে জানবো? তোমার সামনেই তো ছিল জিজ্ঞেস করে নিতে।”
” কিন্তু তবুও! তোর একটা আইডিয়া আছেনা?”

” না নেই। এবার আমার কথা ছেড়ে নিজের কথা বল। বিয়ে কেন করছনা এখনও?”
বিয়ের কথা শুনে তুর্বী মুখটা মলিন করে ফেলল। তারপর বলল,
” আমার কথা বাদ দে তো। আমার ভাইটাকে এখন সেটেল করে দিতে পারলেই আমার শান্তি। মা মারা যাওয়ার পর ওর সব দায়িত্ব তো আমার কাধেই।”
রিখিয়া নরম কন্ঠে বলল,
” আন্টি কীভাবে মারা গেল?”
” ন্যাচরাল ডেথ। দেড় বছর আগেই মারা গেছেন। যেমনই হোক। সৎ মা হলেও মা বলেতো ডাকতাম।”
তুর্বীর কথা শুনে রিখিয়া একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তুর তুমি যদি এখনো ভেবে থাকো সৌহার্দ্য নিজে এসে আবার সব শুরু করতে চাইবে তো ভুলে যাও। দুই-বছর আগে যা হয়েছে তারপরেও এই আশা করোনা। তুমি যদি কিছু চাও তো এবার তোমাকে নিজে থেকেই এগোতে হবে।”
তুর্বী কয়েকসেকেন্ড নিরব রইল। সৌহার্দ্য আর দোলার একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো ভাবলে কষ্ট হয় ওর। এখনো হচ্ছে। ও দ্রুত নিজেকে সামলে বলল,

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৫

” আমি কিছু চাইনা। আর তাছাড়াও ওর বিয়ের কথা চলছে। দোলা মেয়েটা ভালোই। আমার চেয়ে বেটার অপশন।”
” হয়েছে! কথা না বলে চুপচাপ ঘুমাও এখন।”
তুর্বী রিখিয়ার ধমক খেয়ে চুপ হয়ে গেল। রিখিয়া আর কিছু বলল না ভাবনায় মত্ত হয়ে গেল। সত্যিই বিহানের এই বদলের কারণ কী? শুধুই কী সৌহার্দ্যর থেকে দূরে থাকা? লোকটা নিজেকে এতো বদলে ফেলল কেনো? রিখিয়াকে ভাবতে দেখে তুর্বী মনে মনে খুশি হল। ও তো এটাই চেয়েছিল। ও চেয়েছিল রিখিয়া এ বিষয়ে ভাবুক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই রিখিয়ার ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের রিংটনে। রিখিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল এটা শাফিনের ফোন। ও কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করল।

তুর্বী ভাবছে শাফিন ছেলেটা এতো ভালো না হলেও হত। খারাপ হলে এই বিয়েটা ভাঙতে ওর গিল্টি ফিল হতোনা। কিন্তু এখন তো হচ্ছে। তবে শাফিন যখন ফোন করল তখন রিখিয়ার চোখেমুখে তুর্বী সেই খুশিটা দেখেনি যে খুশিটা বিহান ফোন করলে থাকত। বরং দেখেই বোঝা যাচ্ছে রিখিয়া বাধ্য হয়ে ফোন ধরেছে। জোর করে কথা বলছে। এভাবে সংসার করবে কীকরে? যদি বিহান রিখিয়াকে ভালো না বাসতো তাহলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু যখন একে ওপরকে ভালোবাসে তখন এই বিচ্ছেদ ঠিক হবেনা। আর মনে একজনকে রেখে অন্যজনের সাথে সংসার করাটা খুব যন্ত্রণার। বিশেষ করে একটা মেয়ের জন্যে। রিখিয়াকে ও সেই যন্ত্রণা দিতে চায়না। মেয়েটা এমনিতেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে সবটা ঠিক করতেই হবে। যেভাবেই হোক।

জল ফড়িঙের খোঁজে পর্ব ৪৭